ফাউ প্যাঁচাল ০৪-“কাই” বৃত্তান্ত

বহুদিন হইয়া যাইতেছে সিসিবিতে নতুন রম্য দিতেছিনা। যাহাই হউক সম্প্রতি আমার সকল গভীর প্যাঁচাইন্যা রচনাসমূহ(কাব্য ও ছোটগল্প) পড়িয়া যাহারা নাভিশ্বাস ফেলিতেছেন, তেনাদের জন্য সুসংবাদ……নির্মল বাতাসে মুক্তির শ্বাস নিন। তবে আজিকে রম্য লিখিব চলিত ভাষায়। তাহা হইলে শুরু করিয়া দেই……

আমার বন্ধু ‘কাই’; ক্লাস সেভেন থেকে ওরে আমরা আদর করে ‘কাউয়া’ও ডাকি। সে মোটেও কোনো সাধারণ পোলা না। সবাই যদি ডাইনে যায় তাইলে কেউ কেউ বাঁয়ে যাইতে পারে, কিন্তু কাই যাবে উল্টা দিকে। রিকশাওয়ালা ভাড়া ২ টাকা বেশি চাইলে অভিমান করে ৫ কিলোমিটার হেঁটে বাসায় ফিরে সে। আগে বাংলাদেশের আন্ডারগ্রাউন্ড মেটাল ব্যান্ডের গান তুমুল রকম শুনতো, এখন মিলার গান শুনলে নাকি ওর দিল-এ দোলা দেয়। ওর প্যান্টে অনেক পকেট, এবং খুবই বিচিত্র দেখতে(আমি একবার গুনছিলাম ১১ টা); কারণ বলতে বলে ভার্সিটির পোলাপাইনদের নাকি ‘ব্যাগ বহন করা অনুচিত’। তাছাড়াও বেশি পকেট থাকলে অনেক সুবিধা, বহুত কিছু নেওয়া যায়(ওর পকেটে আমি স্ক্রু ড্রাইভার, স্যান্ডো গেঞ্জী, বই, এমনকী একটা ২ লিটার সেভেন আপও দেখছি)।

কলেজ থেকে বের হয়ে সে এক বছর খালি ঘুরেফিরে বেড়ালো; সে নাকি লাইফ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতেছিলো। এইরকম একটা এক্সপেরিমেন্ট ছিলো তিনতলা থেকে একতলা একটা ছাদে লাফ দেওয়া, পদ্মা নদীর কসম, সে লাফ দিছিলো! তয় আল্লা মালুম, সে বহাল তবিয়তে সেই লম্ফ সারভাইভ করেছিল। ওই বাড়ির আন্টি নাকি বাড়ির তোশক-বালিশ-লেপ সব রোদে দিছিলেন, যেগুলো কাই-এর জন্য ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্মের কাজ করে দিয়েছিলো।

এরচেয়েও ডেঞ্জারাস কাহিনী পরেরটা…… একবার রাস্তায় এক ট্রাক দেখে পাগলের তাল উঠল হঠাৎ। সাইকেল নিয়ে একটা পরীক্ষামূলক ধাক্কা খাইতে গ্যালো সে। পরে তারে কারণ জিজ্ঞেস করলে সে কইছিলো “কোনটার ভরবেগ বেশি তা চেক করে দেখতেছিলাম”।

যাইহোক, কপালগুণে ট্রাকের স্পিড ছিল কম, সে “জাপানীজ কামিকাজি” ষ্টাইলে আত্মঘাতী হামলা চালাইতে গেলে ড্রাইভার আতঙ্কে ব্রেক করছিলো। তাই হাত পা ছিলে যাওয়া ছাড়া আর কিছু হয় নাই তার। শোনা যায় ট্রাকের ড্রাইভার আর হেল্পার মারাত্মক রকম আশ্চর্য হয়ে গেছিলো……তারা খুফই এক্সপেরিয়েন্সড লোক, এ পর্যন্ত অনেক যানবাহন রে ধাক্কা দিছে, বহু এক্সিডেন্ট দেখছে, কিন্তু সাইকেল নিয়ে কেউ তাদের কখনোও ধাক্কা মারার চেষ্টা করে নাই।

খানকয়েক ইনজুরি নিয়ে তারপর ‘কাই’ হসপিটালে পৌঁছাইলো, তাও সে অফ যায় না। বেডে শুয়ে নার্সরে গুঁতাইতেছে, “আমি সিগারেট খাইতে চাই।”
নার্সঃ “হসপিটালে তো সিগারেট নিষেধ। তাছাড়া আপনি বেশ অসুস্থ… ”
কাইঃ “না! আমি খাবই……কেনো খাবনা?……এইটা আমার বাকস্বাধীনতার অংশ……সংবিধানের চতুর্দশ পরিচ্ছেদের ষষ্ঠ ধারায় আছে………(ইত্যাদি, ইত্যাদি…)”
এইদেখে নার্স ডিউটিতে থাকা ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আসলো। ডাক্তার এসে সব শুনে মাথা নেড়ে……
ডাক্তারঃ ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমার কাছে সিগারেট আছে। একটা দিচ্ছি তোমাকে। কিন্তু একটার পর আর যন্ত্রণা দিবা না……নাও…’
কাইঃ “আমি বেনসন খাই না…গোল্ডলিফ খাবো।”
ডাক্তারঃ “এমনিতেই আমি বিপদে আছি। আপাতত খাও, পরে দেখা যাবে।”
কাইঃ “না! আমি কিন্তু পালাবো বলতেছি, আমার গোল্ডলিফ-ই চাই…আমি কিন্তু……”

সে দাবি করে যে ব্যস্ত ডাক্তার তারে সিগারেট কিনে এনে খাওয়াইছিলো কিন্তু আমার ধারণা ওরে হাত পা বেঁধে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো হইছিলো।

আবার সে মাঝেমধ্যে গভীর রাতে ঘোরাফিরা করত, এমনকী ওর এলাকায় পেট্রল দেওয়া র‌্যাবের সদস্যদের সাথে ওর খাতির হয়ে গেছিল এতবার দেখা হওয়ায়……ইদানীং সে দাবী করে যে তার বুদ্ধিতেই নাকি র‌্যাব ‘ক্রসফায়ার’-এর বদলে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ শুরু করেছিল।

কলেজে থাকতে সে ভালো গোলকীপার ছিলো। সেটা ছাড়ছে কারণ এ পর্যন্ত প্রায় ডজন দেড়েক চশমা ভাংগা হইছে তার। তাছাড়া চশমা না পরলে সে নাকি মাঠে “একাধিক” বল দেখতে পাইত! ক্রিকেটেও খুব ভালো……ভালো ফিল্ডিং দিতো, উড়ে উড়ে লাফ দিয়ে ক্যাচট্যাচ ধরত। গুজব শোনা যায়, তার খেলা দেখে “বৈকালী” ক্লাবের কোচ তারে রিক্রুট করতে চাইছিলেন। কিন্তু প্রস্তাব শুনে “কাই” ডাইরেক্ট না কয়ে দিল। তার বক্তব্য……

“অসংখ্য ধন্যবাদ……কিন্তু আমি মনে করি, আমি কাসিম হাউসের হয়েই খেলতে চাই।”

মাত্র কয়দিন আগে তার মনে হইছে যে সে কথাটা তখন হাউস ফিলিংস্‌ থেকে কয় নাই; সে অন্য কোনো স্পোর্টস নিয়ে তার ভবিষ্যত দেখতেছিল। কোনটা জানতে চাইলে সে কয় -হা-ডু-ডু……

যাই হোক তারে নিয়ে বছর দুয়েক আগের একটা গল্প দেই……

তখন রাজশাহী ভার্সিটির ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট –এর তারকা ছাত্র ‘কাই’। নিজ যোগ্যতায় ফার্স্ট ইয়ারেই এক IELTS কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেয়া শুরু করল। ১ম ক্লাসটা তারে নিতে দেয়া হল listening skill -এর উপর। স্টুডেন্ট তার সব সিনিয়র ভাই এবং আপু। গড়ে সবাই তার থেকে ৪/৫ বছরে সিনিয়র। তাই সে খুবই টেনশিত। আমি আবার সেখানে প্রায়ই যাই……সেন্টারের কম্পিউটার সেকশানে-এ কিছু কাজ করি। আমার বসার যে জায়গা সেটা ক্লাসরুমটা থেকে একটা কার্ডবোর্ডের দেয়াল দিয়ে আলাদা করা মাত্র।

কাই কিন্তু আমাকে বারবার বলে দিছে আমি যেনো উল্টাপাল্টা কোনোকিছু না করি। কিন্তু পাগলরে সাঁকো নাড়াইতে না করে লাভ আছে নাকি?! পাশের রুমে বসে আছি এবং আমি জানি কাই এইমূহুর্তে খুফ টেনশিত। এই সুযোগ কাজে না লাগাইলে আমার “এক্স-ক্যাডেট 😀 ” বিবেক কেমনে মানে কন!

ঠিক টাইমে ক্লাস শুরু হল। সে লেকচার দেয়া শুরু করল। আমি কান খাড়া করে আছি। নার্ভাস কাই-এর কথাগুলান এরকম……
“আঁ……listening এ-এ-এ-কই সাথে স-স-সহজ এবং ক-ক-কঠিন। আ-আ-আমরা চেষ্টা ক্ক-ক-করব………(এইরকম তোতলামি আরও দেড় মিনিট…) ।”
হঠাৎ এক সুন্দর গলার আওয়াজ…”আপনি কি সুস্থ বোধ করতেছেন?? নাহলে কিছুক্ষনের জন্য ব্রেক নিতে পারেন……আমরা কিছু মনে করব না।”
কাইঃ “জ্বী……ইয়ে মানে…আপনারা সবাই কতো সিনিয়র! একটু এম্ব্যারাসড ফিল করছি…… 😕 ”
সুন্দর গলার মালিকঃ “নাহ, কোন সমস্যাই নয়……I find it rather cute”
কাই থতমত খেয়ে গেলো মনে হয়। ভাঙ্গাচোরা গলায় আওয়াজ শুনলাম,”থ্যাঙ্কস আপু……… :shy: ”
দেয়াল এর ওপাশ থেকে আমার উল্লসিত চিৎকার, “ওরে-এ-এ-এ-এ-এ-এ-এ কাই…………হায়! হায়!! হায়!!!……”

এরপর পুরা কোচিং সেন্টার অফ, পিনপতন নীরবতা; পাঁচ মিনিট সব চুপ! হঠাৎ কোচিং সেন্টারের আইটি সেকশানের পরিচালক সবুজ ভাই এসে হাজির আমার সামনে;
“রিজওয়ান, তুমি আজকের মতো অনেক কাজ করে ফেলছ……এখন বাড়ি যাও।”
“কিন্তু সবুজ ভাই আমি মাত্র বিশ মিনিট আছি……!”
“তা ঠিক , কিন্তু LISTENING-এর ক্লাস তোমার কাজের থেকে বেশী জরুরী।”
“প্লিজ ভাই……সেইরকম মজা দেখতেছি তো।”
“যাবা না মাইর খাবা!……”

কি আর করব! কাই সেইরকম বাঁচা বেঁচে গেলো সেদিন। তবে তার দাবী সে নাকি কঠিন ক্লাস নিতেছিলো। আর আমার “আর্তনাদ” নাকি কেউ শোনে নাই। ওইটা আমার চাপা। আর সে নাকি পুরা ক্লাস একবারো তোতলায় নাই। যাহোক এরপর সে আরো ৪ মাস ক্লাস নিছিলো। আর সেই চিকন কন্ঠের বড় আপুর সাথে পরে তার বেশ খাতিরও হইছিলো। তাইলে আপনারাই বোঝেন! (চলবে……)

৪,৩৫৫ বার দেখা হয়েছে

৬৩ টি মন্তব্য : “ফাউ প্যাঁচাল ০৪-“কাই” বৃত্তান্ত”

  1. শিরীন (৯৬-০২)

    ময়মনসিংহে 'সদাচার' নীল হাউস ।
    কাই এর সাথে দেখা করতে মন চায় । আমার পায়ের উপর দিয়া গাড়ি গেসিল । গাড়ি পাস করার পর আমার প্রথম যে কথা মনে হইছিল তা হইল "প্রাইভেট কারের ওজন বেশি না" B-) এইসব বিচিত্র কথা ক্যাডেটদের মনে হওয়াই শোভা পায় =))

    জবাব দিন
  2. জানুয়ারি , ফেব্রুয়ারি,...... এপ্রিল ,...... জুন, জুলাই , আগস্ট = মার্চ ও মে অনুপস্থিত ...!!!
    যাঁহারা "ম " দিয়ে শুরু উহারা কেন বঞ্ছিত হইল ??? আর র র র র ... কাই ভাই কি শেষ পর্যন্ত মেয়েটাকে পাইয়াছে ???
    সবগুলো ঘটনাই :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।