দোয়েল বৃত্তান্ত ও পাদুকাপুরাণ

তারিক হাউসের সম্মুখের বাগিচায় একাদশ শ্রেণীর ক্যাডেটেরা তাহাদের জুতা ও মোজা শুকাইতে দিত। এই ঐতিহ্য বহুদিনের পুরনো বটে, বিধায় বাগিচার প্রায় ২০ বর্গমিটার ক্ষেত্র ক্যাডেটদের জুতার সুবাসে নির্দয় মৃত্যুভূমিতে পরিণত হইয়াছিল। তাই অত্র এলাকায় বৃক্ষকুলের শ্যামলিমা অনুপস্থিত ছিলো, একটি মাত্র অর্ধমৃত পামট্রি ছাড়া; যে কিনা বিপুল বিক্রমে বাঁচিয়া রহিয়াছিল একাদশ শ্রেণীর ক্যাডেটদের পাদুকাসুবাস এবং ইত্যকার পারলৌকিক আহবান প্রত্যক্ষ করিয়াও। কিন্তু ২০০৫ সালে ৩৭তম ব্যাচ একাদশ শ্রেণীতে পদার্পণ করিলে বৃক্ষটি ইহলোক ত্যাগ করিয়া যায়; বাগিচার মৃত্যুভূমির ক্ষেত্রফলও বাড়িয়া দেড়গুণ হইয়া যায়। এও না বলিলেই নহে আমি ৩৭ তম ব্যাচের ক্যাডেট।

তবে নিজের পাদুকাসুবাস ও এলাকার বৃক্ষকুলের উপর তাহার প্রভাব কম্মিনকালেও আমারে বিচলিত করে নাই।

তবে একদিন এই অনিচ্ছুক বৃক্ষনিধণে ছেদ পড়িল আমার, ওই মধ্যাহ্নে আমি কিঞ্চিত দেরী করিয়াই পাদুকা শুকাইতে দিবার উদ্দেশ্যে বাগিচায় গিয়াছিলাম। জুতা লইয়া টানাহেঁচড়া করিতেছি, হঠাৎ ডাইনে তাকায়ে দেখি………… এক মৃত দোয়েল পাখি! এ কী!

যাহারা এখনও মৃত পাখি দ্যাখেন নাই তাহাদের উদ্দেশ্যে আমার কিছু কথা…… মৃত দোয়েল পাখি নিপাট ভদ্রতায় ঠ্যাং দু’খানা আকাশপানে তুলিয়া চঞ্চু বাম পাশে হেলাইয়া চিৎ হইয়া পড়িয়া থাকে। ইহা দেখিয়া যেকোন পাষাণও গভীর মর্মপীড়া অনুভব করিবে, সেই পীড়া গভীরতর হইবে যদি এই পাষবিক ঘটনায় উহার বা উহার পাদুকার ভূমিকার সম্ভাবনা থাকে। আমি পাষাণ নই এবং আমার পাদুকাদ্বয় ব্যাপক আকারে সুবাস ছড়াইতেছিলো।

এই দেখিয়া আমি গভীর বেদনা অনুভব করিলাম এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞাও করিলাম যে নিয়মিত মোজা ধৌত করিব এবং নিকটবর্তী এলাকার জীববৈচিত্র সংরক্ষণে ভূমিকা রাখিব। তখনই ৬ নং রুম থেকে উত্তেজিত কথোপকথনের আওয়াজ শুনিলাম……
“এইটা কুনো কথা সুফি!! তুই একটা পাখি মাইরা ফেললি?”
“আমি কি ইচ্ছা করে মারছি নাকি?”
“কইলেই হইল?”
“আরে………আমি কি জানতাম যে লেগে যাবে!”
“তাই বলে জাতীয় পাখি?……হায় হায়!!”
“আমি তো না দেখে মারছি রে বাপ।”

আমি দৌড়াইয়া গেলাম রুমে। গিয়াই চাপিয়া ধরিলাম সুফিরে, ব্যাটা কি করিয়াছিস বল? কাহিনী যা শুনিলাম তাহার মুখে তাহাতে আমার হৃদয় আরো ভাঙ্গিয়া গেল। বোকা পাখি দানাপানির লোভে ৬নং রুমে আসিয়া ঢুকিয়াছিল। ঢুকিতে পারিলেও বাহির হইবার উপায় সে পায় নাই। দিশা হারাইয়া বেশ কিছুক্ষণ সে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করিয়া এদিক ওদিক উড়িয়া বেড়ায়। রুমের পোলাপাইন এই কারণেই বৈদ্যুতিক পাখা বন্ধ রাখিয়া ঘুমাইতে যায়। তাহাতেও ঝামেলা মিটে নাই, কিছু পরে বখিল খেচর দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হইয়া কিচির মিচির লাগাইয়া দেয়। ইহাতে সকলেই ত্যক্ত হইয়া জাগিয়া উঠে; এই গরমে একে পাখা বন্ধ, তাহার উপর এই!! সুফির মাথা বরাবরই গরম; রাগিয়া মাগিয়া তাহার পিটি শ্যু ছুঁড়িয়া মারে। তাহার বক্তব্য অনুযায়ী সে চশমা ছাড়া ছিল, বিধায় কোথায় কি ছুঁড়িয়াছে তাহা সে জানে না। খেচরের দুর্ভাগ্য যে ভাগ্যের লীলায় তাহার মৃত্যুক্ষণ উপস্থহিত হইয়াছিল।………এই বলিয়া সে কিঞ্চিৎ অশ্রুপাতও করিল। বেগতিক দেখিয়া সকলে আগাইয়া আসিয়া তাহারে সান্ত্বনা দিলো। অতঃপর পোলাপাইন মিলিয়া পাখির মৃতদেহ সৎকারের পরিকল্পনা আঁটিতে লাগিল। আবার অত্যুৎসাহী একজন সমাধিতে এপিটাফও লাগাইবার প্রস্তাব দিয়া বসিল; কয়েকজন তাহাতে সায়ও দিলো।

এসব শুনিয়া আমি অবশ্য কিঞ্চিত স্বস্তিবোধ করিলাম। পাখিহত্যার দায় স্কন্ধে চাপে নাই, এইবার নিশ্চিন্তে ঘুমাইতে পারি। হঠাৎ কি মনে করিয়া ঘুরিয়া দাঁড়াইলাম।
“অই সুফি, তুই কি শিওর যে পিটি শ্যুর বাড়ি খাইছে পাখিটা?”
“আরে চশমা ছিলো নাকি যে বলব! আর বাড়ি না খাইলে ক্যাম্নে মরল? ”
“ইয়ে মানে……কিভাবে বলি…!……আর কোনভাবে মরতে পারে না?”
“আঁ……কি কস?”
“লাস্ট কবে পিটি শ্যু ধুইছিস? ”
“……”
“শ্যু পাখির গায়ে হয়ত লাগে নাই, পাশ দিয়েই গেছে……”
“তারপর?”
“বুঝিস নাই এখনও!?”
“????”

পোলাপাইন ততক্ষণে অট্টহাসি দিতেছে, সুফি কতক্ষণ ঘাড় কাত করিয়া কি জানি ভাবিল। তারপর ব্যাপার টের পাইয়া গেল। এবং ক্ষেপিয়া আমারে ধাওয়া শুরু করিলো। মৃত পাখির শোক আমারে ক্লান্ত করিয়া দিয়াছিলো, তাই দৌড়াইয়া বিশেষ সুবিধে করিতে পারিলাম না; ধরা খাইলাম।

মিনিট পাঁচেক পরে আমি গোটা পাঁচেক ঘুষিঁর ব্যাথা লইয়া পোলাপাইনের সহিত আলোচনায় বসিলাম। কিন্তু সবাই আমার এই থিওরী এক ফুৎকারে উড়ায়ে দিল। বৈজ্ঞানিক উপায়ে ইহা নাকী সম্ভব নহে। এসব শুনিয়া তখনকার মতন হাল ছাড়িয়া দিলেও ঘন্টাখানেক পরে ঠিকই পাখির মৃতদেহ পরীক্ষা করিতে গেলাম। খানিক নাড়াচাড়া করিয়া কোন আঘাতের চিহ্ন পাইলাম না। উপলব্ধি আসিল যে বেচারা জুতার আঘাতে সম্ভবত মরে নাই, পাশ দিয়া যাওয়া জুতার গন্ধেই মরিয়া গিয়াছে। এখনও আমার ব্যাচমেটেরা এই ঘটনা স্মৃতিতে রাখিয়াছে “জুতার আঘাতে(!) মৃত দোয়েল পাখি” হিসেবে। কেবল আমিই সত্য ঘটনা জানি, সেই কারণেই এই ঘটনা আপনাদের কাছে বর্ণনা করিলাম।

সেই প্রস্তাবিত এপিটাফের ছবি…
21

৭,৯৭৫ বার দেখা হয়েছে

৭৪ টি মন্তব্য : “দোয়েল বৃত্তান্ত ও পাদুকাপুরাণ”

  1. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    হা হা হা
    দারুণ মজা পাইছি।
    এফিটাফটা জটিল হইছে।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  2. আন্দালিব (৯৬-০২)

    হা হা গ দি প গে (হাসতে হাসতে গড়ান দিয়া পইড়া গেলাম!)

    লেখার শুরুতে একটু খটোমটো লাগতেছিলো, কিন্তু দোয়েল পাখি আসার পর থেকে এমন তীক্ষ্ণ লেখা! সিম্প্লি-সুপার্ব! :clap:

    এপিটাফের ছবিটা খুব সুন্দর হয়েছে রেজওয়ান। দোয়েল পাখিটা আসলেই দেখতে বড় মোলায়েম। আদর করতে ইচ্ছা করতেছে।

    জবাব দিন
  3. তাইফুর (৯২-৯৮)

    বাছা,
    এখন হইতে সিসিবিতে লগইন করিবার পূর্বে পদযুগল অতি যতনে সুগন্ধি সাবানে ধৌত করিয়া লইবা ... উপরন্তু পদযুগলে জুতা ও মোজা'র ব্যবহার সীমিত করিলে জুতামোজাও বাচিবে, সিসিবিও বাচিবে।
    (মারাত্মক মজা পাইছি। ৫ তারা ... ফাটাফাটি)


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  4. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    তুমি তো দোয়েল পক্ষীর উপাখ্যান কহিয়া সিসিবিভূমি প্রকম্পিত করে দিলে হে...আমি আমার বোতাম-বাহক সমতলখানার নানা মোতাম টিপিয়াও পাইতেছিনা ইহাকে কি বিশেষণে ভূষিত করিব-অট্টহাসিতে ফাটিয়া পড়িয়াছে ভ্রাতঃ =)) =))

    জবাব দিন
  5. নাহ, ইদানিং এত জোস জোস লেখা আসতেছে, ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগতেছি।

    মোজা আর পিটি শু নিয়া আমার একখান কাহিনী ছিল, সময় কইরা দিমু।
    হাসতে হাসতে মিরা গেলাম রে বাপ :khekz: :khekz: :khekz:

    জবাব দিন
  6. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)
    “অই সুফি, তুই কি শিওর যে পিটি শ্যুর বাড়ি খাইছে পাখিটা?”
    “আরে চশমা ছিলো নাকি যে বলব! আর বাড়ি না খাইলে ক্যাম্নে মরল? ”
    “ইয়ে মানে……কিভাবে বলি…!……আর কোনভাবে মরতে পারে না?”
    “আঁ……কি কস?”
    “লাস্ট কবে পিটি শ্যু ধুইছিস? ”
    “……”

    এই লাইনগুলা পড়ার সময় দুর্ভাগ্যক্রমে পানি মুখে ছিলো। তোমার জন্যে আমার ল্যাপটপটার মনে হয় বারোটা বাইজাই গেলো। (ভাবানুবাদ - এই রকম আরোও লেখা চাই)।

    জবাব দিন
  7. রিজু, পাম ট্রি টার কথা মনে করায়া দিলি...

    লেখাটা দারুণ হইসে! আর ৩৭ এর ৬-৭ রুমের সামনের সু-এর স্তূপের পাশ দিয়ে প্রতিবেলায় হেঁটে যেতে হত আমাকে। সুতরাং, ঘটনা খুব ভালোভাবেই অনুভব করতে পেরেছি। খিকয

    আসলেই সুন্দর লেখা! 🙂

    জবাব দিন
  8. আছিব (২০০০-২০০৬)

    ওরে,মারমুখী রিজওয়ান, কেদারায় পশ্চাদদেশ স্থাপিত ছিল না ভাগ্যিস,নইলে পায়া ভাঙ্গিয়া গড়ান দিয়া পড়িতাম হাসিতে হাসিতে। :goragori: ফাইভ স্টার প্লাস :hug:
    দক্ষিণা বাতাসে তগো হাউসের পাদুকাসমূহের ভয়ংকর বদ খুশবু আমাগো কমন রুমে আইসা লাগত।সে যে কি পারফিউম রে ভাই :khekz: :khekz:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তানভীর (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।