স্মৃতির নিনাদ

936050_522078711257382_2371342545513905714_n

ডর্ম ১০ এর ফোর্থ প্লেস।  তখনকার সময়ের পুরো আপস্টোর  এর সবচেয়ে ভীতিকর প্লেস। প্রতি আফটার লাঞ্চ প্রায় একঘণ্টা ধরে “লুক দেয়ার সাইড” হয়ে থাকা, আর তারপর মাথা ঘোরাবার সুযোগ পেলেই দেখি সামনে যমদূতের মত দাঁড়িয়ে থাকা সিনিয়রদের রক্তবর্ণ চোখের রক্তহিম করা চাহনি। বুঝতে বাকি থাকেনা পরের পর্বটুকু।

তবে আর যাই হোক ঘড়ির কাঁটাটা ৩টা ১৫ এর ঘর স্পর্শ করতেই মুক্তি মিলতো। তারপর ড্রেস চেঞ্জ হতে না হতেই ডিউটি ক্যাডেট এর বেল। শরীর টাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে আবারো ছুটে চলা। পেছন ফিরে দেখতাম টানটান করে পাতা বেড কাভারটা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। যাহোক সবকিছু উপেক্ষা করেই এসে দাঁড়াতাম আফটারনুন প্রেপ স্কোয়াডে। কখনও বা গনগনে সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেহের সর্বশেষ ঘর্মবিন্দুটি পর্যন্ত নিঃসরণ, কখনও বা নাকে গরম পিচের পোড়া গন্ধ……………………………………       কনুইএর নিচে অল্প একটু জ্বালা………………………………

তারপর কোনওরকমে প্রেপে এসেই সমস্ত গা এলিয়ে যখন রাজ্যের ঘুম ভর করত, আর ICCLMM প্র্যাকটিস এর সুবাদে আদিব ভাই এর গলায় ‘অর্থহীন’ এর সেই গান গুলো যখন অবুঝ এই মনটাকে নিয়ে হারিয়ে যেত কোন এক স্বপ্নের রাজ্যে তখনই পেছন থেকে প্রেপ গার্ড এর নীরস কণ্ঠস্বর – “Everyone Get up…………………..”  কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে……………………… কানে বাজছে আদিব ভাই এর গলা –

“জোছনা অজানা পথে চলা, যেখানে আছে যে মোর ভালোবাসা……………………………………”

এতো আনন্দের মাঝে গাছ টাকে দেখা হয়নি কখনও। হয়তো দেখেছি, কিন্তু তখন শরতের নীল আকাশ কেও কষ্টের নীল চাদরে মোড়া মনে হত, ঈশান কোণে জমে থাকা শ্রাবণের কালো মেঘ নতুন কোন ছন্দের দ্যোতনা তৈরি করত না। বয়ে আনত নতুন কোন অশনি সঙ্কেত। দখিনা বাতাস আমাদের দেহের ঘর্মবিন্দু গুলো কে শুকিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালাত মাত্র, জাগাত না কোন রোমান্টিক উস্কানি। হয়তোবা তাই সেই গাছের কোন এক শুকনো ডালে যখন ছোট্ট একটি ফুল উত্তরের বাতাসে দেহ মেলে নেচে চলত তখন তার গোলাপি পাপড়ী আর তার উপর মিহি বেগুনি রঙের প্রলেপ মনের ভেতর তৈরি করতো অন্য কোন ব্যাঞ্জনা……………

“আমার মনের গোটা ক্যানভাস টা গোলাপি রঙের আভায় পূর্ণ, মাঝে মাঝে কোথাও বেদনামাখা বেগুনি আভা।”

তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে। ব্লকের এপাশটা প্রায় ছাড়ব ছাড়ব ভাব। হঠাৎ একদিন ডেস্কের প্রায় কোণার দিক থেকে টেনে বের করলাম ‘অভিযাত্রিক’ টা। একটা গল্প চোখে পড়ল। ‘গোলাপি ফুলকে ভেবে’ – আজাদ ভাইএর লেখা । ততদিনে বসন্তের বাতাসও ফুরিয়ে গেছে, নস্টালজিয়ার মৃদু সমীরণের কোন বালাইও ঘেঁষতে পারেনি আমার এই ক্ষুদ্র মনটার আশেপাশে। তবুও সেদিন গল্পটা পড়ার পর ভেতরের অশ্রুকণাকে সামাল দিতে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছিল চোখের পাতাদুটোকে। শুধুমাত্র নিয়ম রক্ষার খাতিরে বাঁ পকেট এ রাখা রুমাল টাতে সেদিন হাত পড়েছিল বহুদিন পর।

তারপর আর এপাশটায় আসা হয়নি অনেকদিন। কেটেগেছে চার-চারটা বসন্ত। কোথায় যেন শুনেছিলাম এটা নাকি প্রকৃতির নিয়ম। যেখান থেকে শুরু, সেখানে এসেই আবার সব কিছু শেষ হয়। তাই হয়তো একদিন প্রকৃতির এই অদ্ভুত নিয়মটা পূরণ করতেই আবার ফিরে আসলাম। সেই একই দিকে, ব্লকের এপাশটায়। ততদিনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ক্লাস সেভেন এর কচি কচি কাঁধ দুটোর উপর সিনিয়রদের চাপিয়ে দেওয়া নিয়মের বোঝাগুলো নেমে গেছে অনেক আগেই। অনুভূতির কৈশিকতাগুলো প্রশ্রয়ের অভাবে আর বেড়ে উঠতে পারেনি কখনও। তবুও কোন এক জোছনাহত রাতে ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাওয়ার সুবাদে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। কোত্থেকে যেন একদমকা উড়নচণ্ডী বাতাস আমার সব স্মৃতি গুলোকে পিঠে চাপিয়ে উড়িয়ে নিয়ে এল আমার কাছে। হঠাৎ চোখ পড়ল গাছটার দিকে। একসময় আমার কিশোর মনের ক্যানভাসটা ভরে উঠত যার গোলাপি রঙের আভায় আজ সেই কাঞ্চন গাছের প্রতিটি শুকনো পাতা আমার ক্যাডেট জীবনের এক একটি স্মৃতি নিয়ে ঝরে পড়ছে প্রতিনিয়ত। শুধু দাঁড়িয়ে থাকছি আমি আর আমার গোলাপি ফুলের গাছটা, কলেজ জীবনের শেষ বসন্তের অপেক্ষায়।

সব প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে একদিন দেখি গাছটার এক ডালে ছোট্ট একটা ফুল। সেই আগের মত। উত্তরের বাতাস, গোলাপি পাপড়ি, মাঝে বেগুনি রঙের প্রলেপ। আবার আমার ক্যানভাসটা ভরে উঠল গোলাপি রঙের আভায়, মাঝে মাঝে কোথাও বেদনা মাখা বেগুনি রঙের ছটা।

আজ কলেজ জীবনের ছয় বছর শেষে যখন সবাই কলেজের খেরোখাতা থেকে নিজ নিজ হিসেব চুকিয়ে নিতেই ব্যস্ত, তখন মনে হয় ভাল হত যদি এসব কিছু ভুলে যেতে পারতাম। যদি আশিক ভাই এর মত গাইতে পারতাম –

“তবু তোমার শত বেদনার রঙ আমার ছায়ামুক্ত, আমি ভুলে গেছি তোমায়, তুমি মিশে গেছ আমার, স্মৃতির সাত রঙে……………………”

তবু পারিনি। কারণ এখনও যখন ৩ঃ২০ এ আফটারনুন প্রেপের বেল পড়ে, সব অলসতা ভেঙ্গে চিরচেনা সেই রাস্তা দিয়ে যখন কলার উচিয়ে ব্লকে যাই, তখনও নাকে এসে লাগে গরম পিচের পোড়া গন্ধ। প্রেপ এ বসে যখন এক একটা আস্ত নিউটন, ডালটন আর আইনস্টাইনের সাথে শুধুই মিছে সখ্যতা গড়ার ছলনাময় খেলা খেলি নিচতলা থেকে ভেসে আসে অন্য কোন প্রেপ গার্ড এর গলা “Class 7 everyone get up………………..কানে বাজে আদিব ভাই এর সেই চিরচেনা কণ্ঠস্বর……………………………

“জোছনা অজানা পথে চলা, যেখানে আছে যে মোর ভালোবাসা……………………………………”

 

(আজাদ ভাই এর গোলাপি ফুলকে ভেবে থেকে অনুপ্রানিত)

 

 

পুনশ্চঃ  গল্পটা লিখেছিলাম এইচএসসি পরিক্ষার কয়েকদিন আগের কোন এক প্রেপ এ বসে। কলেজ থেকে বেরিয়ে আসার কয়েকদিন বাকি তখন। সিসিবি তে এটি আমার প্রথম লেখা। খুব একটা যে লেখালেখির অভ্যাস আছে তাও নয়। এতো গুণী মানুষের ভিড়ে আমার মত কারো লেখা দুঃসাহসিকতা বই কিছু নয়। তবুও সাহস করে লিখলাম। ভুল ত্রুটি মার্জনীয়…………।।

 

 

১,৬২০ বার দেখা হয়েছে

১৫ টি মন্তব্য : “স্মৃতির নিনাদ”

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।