এক টুকরো আনন্দ

২০১৮ সালে ঘোষিত “বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭”-প্রাপ্ত এক্স-ক্যাডেট আর্কিটেক্ট শাকুর মজিদ ভাইয়ার নাম যদি কোন এক রিসার্চ আর্টিকেলে রেফারেন্স হিসেব থাকে, এবং সেই একই আর্টিকেলে এলফাবেটিক অর্ডারে ঠিক আগে-পরের একটা রেফার্ড আর্টিকেলের লেখক হিসেবে যদি আমি নিজের নামটাকে খুঁজে পাই, তাহলে সেই মুহূর্তে এর চেয়ে বড় আনন্দ আমার মত এক ক্ষুদ্র শিক্ষক-রিসার্চারের আর কি হতে পারে? আমি নিতান্তই সামান্য এক মানুষ; আর শাকুর মজিদ ভাইয়ার মতন এত বড় একজন লেখক-নাট্যকার-ফটোগ্রাফারকে অভিনন্দন জানানোর জন্য যে মাপের প্রফেশনাল রিসার্চার বা আর্টিকেল-অথর হওয়া প্রয়োজন, তার ধারে কাছেও আমি নই। শাকুর ভাইয়া সিলেটের মানুষ; স্বাভাবিক ভাবেই তিনি বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য অনেক কাজ করেছেন। তাঁর একটা ডকুমেন্টারি মুভি এই গবেষণাটাতে (যেটা নিয়ে কথা বলছি) রেফার্ড হয়েছে।

আমার রেফার্ড আর্টিকেলের দুজন কো-অথর, আমারই ছাত্র, আসাদ এবং তারিক-কে তো আমি অভিনন্দন জানাতেই পারি; ছাত্র আমার চেয়ে যত বড় অবস্থানেই পৌঁছাক না কেন, হাজার হোক তারা তো আমার ছাত্রই। আসাদ বর্তমানে আমারই ডিপার্ট্মেন্টাল কলিগ; ক্লাসে পড়িয়েছি এমন ছাত্রদের মধ্যে সে-ই আমার প্রথম সহকর্মী। কো-অথর এই দুজন ছাত্র আমার তত্ববধানেই তাদের মাস্টার্সের থিসিস করেছিল। তবে, এই রেফার্ড আর্টিকেলের কাজটার শুরুর চিন্তা বা প্রচেষ্টা ছিল অনেক আগের থেকেই। সমাজ-বিজ্ঞানের-অধ্যাপক, আমার বাবার আগ্রহের কারনেই মূলতঃ খুব ছোটবেলা থেকেই আমি লোক-সঙ্গীতের ভক্ত হয়ে পড়ি; আর সেকারনে ক্যাডেট কলেজ জীবনে বন্ধুদের অনেক টীজ সহ্য করতে হয়েছে; যদিও, এখন সেই রেগুলার টীজগুলো অনেক বেশি মিস করি।

ক্লাসে পড়ানোর ফাঁকে, লোক-সাহিত্য বা লোক-সঙ্গীতের যে সামান্য জ্ঞান আমার আছে, তা আমার ছাত্রদের সাথে শেয়ার করি। বাউলদের গানের দেহতত্ব এবং আধ্যাতিক চিন্তার প্রতিফলন নিয়েও বিভিন্ন সময়ে ছাত্রদের সাথে অনেক কিছুই শেয়ার করেছি। ছাত্রদের সাথে শেয়ার করা বিষয়গুলো থেকে ছাত্ররা অনেক সময় তাদের মাস্টার্স কোর্স-ওয়ার্ক পরবর্তী থিসিসের প্লান করে। আর খুব স্বাভাবিকভাবেই, যে শিক্ষকের কাছে তারা তাদের পছন্দের টপিকের অনুপ্রেরণা পায়, তাঁর সাথেই তারা তাদের সেই টপিক শেয়ার করে কাজ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। কোন এক সময় মিস্টিসিজম নিয়ে আলোচনা চলাকালে আমি বাউলদের এবং চারণ-কবিদের কথা এবং তাদের বিভিন্ন লিরিক নিয়ে ক্লাসে আলোচনা করেছিলাম। তাতে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা কেমন আগ্রহ বা মজা পেয়েছিল জানি না, কিন্তু তার বেশ কিছুদিন পরে আমার ছাত্র, তারিক, আমার কাছে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের মিস্টিসিজম এবং স্পিরিচুয়ালিটি নিয়ে কাজ করার জন্য তার আগ্রহ দেখায়। কাজটা সুপারভাইজ করার জন্য আমার আগ্রহ এবং আনন্দ কোনটারই কমতি ছিল না। সেই সাথে আসাদ আড়াল থেকে আন-অফিশিয়ালি এই কাজে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময় আসাদও আমার ক্লাসেরই একজন ছাত্র। অবশ্য কাজটা করার মুহূর্তগুলো যে খুব বাধাবিহীন ছিল, সেটা শতভাগ দাবি করতে পারছি না। তবে, সময়মত কাজটা বেশ ভালভাবেই শেষ হয়।

এরপর থেকে আসাদ আমাকে নিয়ে লেগে ছিল এই কাজটাকে একটা পাব্লিশেবল রিসার্চ আর্টিকেল হিসেবে শেইপ দেবার জন্য। ততদিনে আসদেরও আমার তত্বাবধানের পড়াশোনা শেষ। সে তখন অন্যত্র চাকুরীরত, এবং রিসার্চ অঙ্গনে বেশ কিছু কন্ট্রিবিউশনও করে ফেলেছে; রিসার্চ এবং পাব্লিকেশনের কাজ বেশ ভালভাবেই বুঝে গেছে।

কাজটাকে কোন রিসার্চ জার্নালে পাব্লিশ করার জন্য দাঁড় করানো হলো। কিন্তু দেশের ভেতরেই কোন গবেষণা জার্নালে জমা দেব, নাকি কোন ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে দেব, সেটা নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা চলছিল। একটা রেফারেন্স/লিঙ্ক ধরে মোটামুটি মানের একটা ইন্টারন্যাশনাল আইএসএসএন-জার্নালে পরীক্ষামূলক ভাবে কাজটা ছাপানোর জন্য পাঠানো হলো। বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি আমাদের; অল্পকিছুদিনেই ইমেইলে আর্টিকেলের এক্সেপ্টেন্স এপ্রুভাল চলে আসে। মাইনর কারেকশন্স-এডিটিং সহ অন্যান্য ফর্মালিটিজ সারা হলো। তার দুয়েকমাসের মধ্যেই আর্টিকেল পাব্লিশ হবার ইমেইল চলে এলো। আনন্দ হলো অনেক।

কথায় আছে, দুঃখ বাটলে কমে, আর আনন্দ বাটলে নাকি বেড়ে যায়। আমাদের সেই পাব্লিশড আর্টিকেলটা এর আগেও অন্য রিসার্চারদের গবেষণাতে রেফার্ড হয়েছে। কিন্তু এবারের আনন্দটা সম্পূর্ণ অন্যরকমের। পরিচিত মহলের উঁচু মাপের কারো নামের পাশে নিজের নামটা দেখার সৌভাগ্য এই প্রথম হলো।

৪,৯০১ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “এক টুকরো আনন্দ”

মওন্তব্য করুন : আহমদ (৮৮-৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।