কমন সেন্স, দ্যা আনকমন

কমন সেন্স, দ্যা আনকমন

আনেক বছরের পুরোনো ঘটনা মনে হঠাত উঁকি দিলে কেমন লাগে? তাও যদি তা আবার হয়, কোন এক বিরক্তিকর মুহূর্তে! বহু বছর আগের কথা, প্রায় ১৫-১৬ বছর হবে হয়তোবা, ক্লাসে একদিন এক স্যার হাস্যরসের ছলেই বলেছিলেন, “কমন সেন্স ইজ একচুয়ালি আনকমন”। মজা পেয়েছিলাম কথাটাতে, কোন সন্দেহ নেই। তিনি হাসির ছলে আরো কিছু ‘তিতা কথা’ বেশ মধুর করে বলতেন, যেমন – “ইউ আর রেগুলারলি ইররেগুলার” কিংবা “ইউ আর টূ আরলি ফর দ্যা নেক্সট ক্লাস”। কথাগুলো মনে পড়লে বেশ মজা লাগে। ছাত্রজীবনে শিক্ষকের অনেক কথাই হজম করতে হয়। কিন্তু পরবর্তী জীবনে সেগুলো বেশ ভাবিয়ে তোলে; কখনো বা ঠোঁটের কোনে হালকা হাসির আভা এনে দেয়, আবার কখনো মনকে ভিষণ তিক্ততায় ঠেলে দেয়।

ঘটনা দুদিন আগের। রমজানের ২৮তম দিনে, অর্থাৎ এমাসের ১৬ তারিখে। মেয়ে তার দাদুর কাছে বায়না ধরেছে, “আমাকে একটা লাল গাইই (গাড়ি) এনে দাও”। মেয়েটা এখনো ‘র’ উচ্চারণ করতে পারে না। নিজের নাম বলে ‘আইইশা আইইবা’ (আরিশা আরিবা)। মেয়ের আবার একটা বাতিক আছে, যার কাছে কোন কিছু চাইবে, তাকেই দিতে হবে, অন্য কেউ এনে দিলে হবে না। এদিকে রোজার মাস। বিকেল হয়ে গেছে। বাবাকে বললাম, তাঁর যাবার দরকার নেই, আমিই যাই, আনার পরে দাদার হাতে নাত্নীকে দিলেই হলো। আরো কিছু কাজ ছিল, ভাবলাম একসাথে কাজগুলো সেরেই ফিরি। ইফতারের তখনো প্রায় ঘন্টাখানেক দেরি আছে।

মেয়েকে আমি খুব বেশি দামি খেলনা দেবার পক্ষে না। কখনোই দেব না, ব্যপারটা ঠিক এমন না। তবে এই তিন ছুই-ছুই বয়সে বাসায় খেলনা আসা, আর তার দুচারটা নাট-বল্টু, বা হাতা-পা, বা আগা-মাথা, কিংবা গাড়ির চাকা আলাদা হতে খুব বেশি দেরি হয় না। তাই অল্প দামের খেলনাই দেই। বাসার কাছে একটা দোকান আছে যেখানে ১০০ টাকার মধ্যেই সব জিনিসের দাম। অন্য শহরগুলোতে এই ব্যবস্থা আছে কিনা জানিনা, কিন্তু ঢাকাস্থ পাড়াত এই দোকানগুলোর দেখি বেশ রমরমা অবস্থা। ভীড় লেগেই থাকে।

যাহোক, বাসা থেকে বেরিয়েই প্রথমে গেলাম সেই ১০০ টাকার দোকানে, লাল গাইই-র (গাড়ির) খোঁজে। মাঝারি সাইজের একটা পছন্দও হলো। নেড়েচেড়ে মনে হলো বাসায় গিয়েই ভাঙ্গবে না, সপ্তাহটা অন্তত পার হবে। অনেকগুলো লাল-নীল-কমলা রঙের গাড়ি একটা শেলফে ডাম্প করে রাখা। লাল দেখে একটা হাতে নিয়ে সেলসম্যানকে বললাম, “প্যাকেটটা খুলে দেখেন তো চাকাগুলো ঠিক আছে কিনা”। আমি তাকে বললাম, “মাটিতে চালানোর দরকার নেই, শুধু খুলে দেখলেই হবে”। সেলসম্যান ইয়াং ছেলে, অতি উতসাহী। কাস্টমার চালাতে নিষেধ করলেই বা কি, সে গাড়ির ক্ষমতা এবং তার সেলসম্যানশীপ দেখানোর জন্য অতি উতসাহী হয়ে প্যাকেট খুলে মাটিতে ধুলা-বালি-ময়লা এবং এই বৃষ্টির দিনে কাস্টমারদের পায়ে-পায়ে বয়ে নিয়ে আসা হালকা কাদার উপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে গাড়ির ক্ষমতা আর বিক্রেতা হিসেবে তার দক্ষতা দেখালো। একে তো ইফতারের সময় হয়ে আসছে, সেই সাথে আরো দুয়েকটা কাজ সেরে বাসায় ফিরতে হবে, তার ওপরে বাচ্চার জন্য পছন্দ করা খেলনাটাকে ময়লার ওপর দিয়ে নির্মম নির্লজ্জতায় দাঁত বের করা হাসি দিয়ে চালিয়ে দিল। বেকুব হওয়া ছাড়া তো আমার আর কিছুই করার নেই। আমি শুধু তাকে বললাম, “বাচ্চার একটা খেলনায় ময়লা না লাগালেই কি হতো না?” সে কি বুঝল, কে জানে। ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে হাসি দিল। আমি কথা না বাড়িয়ে এবারে লাল রঙের আরেক পিস নিজের হাতে নিয়ে আগে পরখ করে নিলাম যে, সে অন্যগুলোতেও আগের থেকে সযত্নে ময়লা মাখিয়ে রেখেছে কিনা। তারপরে বিল-কাউন্টারে গিয়ে নিজেই খেলনাটা টেস্ট করে দেখলাম। কে এদের বুঝাবে যে, ছোট বাচ্চারা গাড়ির মত একটা খেলনা পেলে বিছানা, সোফা, কোলের উপর, রিডিং টেবিল, এমনকি ডাইনিং টেবিলেও চালানো শুরু করে। তার ওপরে আবার বাচ্চারা যে সবসময় হাত ধুয়েই মুখে পুরবে বা খাবারে হাত দেবে, এমনটাও তো না। যাকগে, সুখের বিষয় হলো এখন পর্যন্ত খেলনাটা বহাল তবিয়তে আছে। লাল রঙের প্রতি আমার মেয়ের আকর্ষণটা মনে হয় একটু বেশিই। আকর্ষণ না কেটে যাওয়া পর্যন্ত সে এই খেলনাটা ভাঙ্গবে বলে মনে হচ্ছে না।

বাবা সেদিন হালিম খেতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু বাসায় এই মুহূর্তে কোন হেল্পিং হ্যাণ্ডস না থাকার কারনে আম্মার উপর দিয়ে বেশ চাপ যাচ্ছে। এদিকে আমার বউয়ের প্রাণ ওষ্ঠাগত তার সাথে সুপার গ্লু-এর মত সার্বক্ষণিক লেগে থাকা আমাদের মেয়েকে সামলাতে। আর সদ্য একাদশে ভর্তী হওয়া আমার ছোট বোনটা চা বানানো, পানি সিদ্ধ করা এবং থালা-বাসন ধোয়ায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করলেও কিচেনের অন্য কোন কাজে বেশ রিলাক্ট্যান্ট। আর সেজন্যই আম্মা এত ব্যস্ততার মাঝে সেদিন আর হালিম বানাতে পারেন নি। কাজেই খেলনা হাতে গেলাম হালিমের দোকানে। দোকানদারকে বললাম কন্টেইনারটা একটু মুছে নিয়ে তারপরে হালিম ঢালতে। এ দেখি আরো স্মার্ট সেলসম্যান। একদিনে এত্তগুলা স্মার্ট সেলসম্যান দেখার সৌভাগ্য হলো আমার! সে এক মুহূর্ত দেরি না করে সেই মাটির কন্টেইনারে (শানকি বা হাড়ি) পানি ঢেলে দিল, পরিচ্ছন্নতার নমূনা দেখানোর জন্য। তারপরে সেই পানি লেগে থাকা মাটির কন্টেইনারে হালিম ঢালতে গেল। আমার মাথা অনেক কষ্ট করে ঠাণ্ডা রাখলাম। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, এই পানির মধ্যে হালিম ঢাললে সেটা আসলে খেতে কি রকমের হবে। তারপর তাকে বুঝিয়ে আরেকটা কন্টেইনার মুছে তাতে হালিম ঢালালাম। কিন্তু আমার জন্য আরো চমক বাকি ছিল। সে মোটামুটি সাইজের একটা হালিম-ভর্তী মাটির ভাণ্ড একটা অতি হালকা নেটের (জালির) ব্যাগে ভরিয়ে দিল, যেটা পাত্রের ওজনে ছিঁড়তে কয়েক মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা না। আমি তাকে বললাম দুটো ব্যাগ একসাথে দিতে যাতে ভারে না ছেঁড়ে। সে আমার উপরে সদয় হয়েই হোক, কিংবা তার অতিরিক্ত স্মার্টনেসের ঠ্যালাতেই হোক, আগের ব্যাগটা সহ একই রকমের হালকা কিন্তু আরো বড় সাইজের একটা ব্যাগে ভরিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। অর্থাৎ ব্যাপারটা যা দাঁড়ালো তা হলো, আগের ব্যাগটা ছিঁড়বে না, কিন্তু পরেরটা ছিঁড়বে, কারন পরেরটা সাইজে বড় হবার কারনে দুটো ব্যাগের হ্যাণ্ডেল একসাথে ধরা যাচ্ছে না। ‘যাহা লাউ, তাহাই কদু’। বিষয়টা তাকে বোঝালাম, কিন্তু আমার যুক্তি তার মনোপুত হলো না, যদিও বেশ বিরক্তির সাথে সে বড় ব্যাগটাকে খুলে আগের ব্যাগটার সাইজের আরেকটা ব্যাগে পুরে দিল। কিন্তু, আবারো তার স্মার্টনেস, আগের ব্যাগের হ্যাণ্ডেল দুটো সে গিট্টু দিয়ে পরের ব্যাগটায় ভরালো। আমার অবস্থা তখন, ‘টিনের চালে কাক, আমি তো অবাক’। আমি শুধু অবাক না, রীতিমত নির্বাক। চিৎকার করে যে কেঁদে ফেলিনি এত্তগুলো স্মার্ট মানুষের চিপায়, এই সেদিন অনেক ছিল। তারপরে সে তার আরেক তেলেসমাতি দেখালো, এবারে সে দ্বিতীয় ব্যাগটার হ্যাণ্ডেল দুটোও গিট্টু দিয়ে দিল। এখন আপনারা চিন্তা করেন, আমি ধরব কোথায় বা ক্যারি করব কিভাবে? দুটো ব্যাগেরই হ্যাণ্ডেল এমন করে গিট্টু দেয়া যে এরকমের একটা ওজনের পাত্র ক্যারি করা প্রায় অসম্ভব। তাও আবার একসাথে গিট্টু না, ভেতরেরটার গিট্টু আলাদা, বাইরেরটার গিট্টু আলাদা। তারপরে সেই প্রচণ্ড ভীড়ের রাস্তায় যেখানে মানুষের ঠেলেঠেলি অবস্থা, তার স্মার্ট প্রশ্ন, “স্যার কি গাড়ি নিয়ে আসছেন, নাকি রিকশায় যাবেন স্যার? আমি তুলে দেই?” আমার এই চল্লিশ বছরের জীবনে কয়বার আক্কেল গুড়ুম হয়েছে মনে নেই, তবে সেই মুহূর্তে যে হয়েছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। যাহোক, আর কথা বাড়ালাম না, তাহলে একটু পরে রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে এই হালিম দিয়েই আমাকে ইফতার সারতে হবে। তাড়াতাড়ি দাম দিয়ে আমি অতি ভয়ে-ভয়ে দুই ব্যাগের গিট্টুর চিপা দিয়ে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বাসার দিকে হাঁটা দিলাম।

ইফতারের পরে গেলাম বাসার কাছেই আগোরার একটা আউটলেটে। বেশ বড় আউটলেট, সম্ভবত ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় এটাই। যদিও আমার কেনাকাটা বেশি কিছু না, তবে সবগুলোই ছিল জরুরী। আগোরায় ঢুকে মাথা খারাপ হবার জোগাড়। আমার মত এত্তগুলো মানুষের সব জরুরী শপিং একই দিনে একই সময়ে! এত্তবড় একটা শপিং মলে মানুষের সাথে গায়ে গা লাগিয়ে শপিং করতে হচ্ছে। সবাই ভদ্দরলোক। অন্তত পোষাক পরিচ্ছদ তাই বলে। অন্যদের কেনাকাটার তুলনায় আমি সেখানে নিতান্তই একজন নাদান কাস্টমার। এত্ত ভিড়ের মধ্যেও কিছু কাস্টমারের ভাবলেশহীন মোবাইল ফেসবুকিং সমৃদ্ধ হাঁটাচলায় আমি টের পেলাম ‘আমি কত্তবড় খ্যাত’। আরো অবাক হলাম, এই সুবেশী নারী-পুরুষের অধিকাংশই একই দিনে একই সাথে তাদের কমনসেন্স ভীড়ে হারিয়ে যাবার ভয়ে বাসায় রেখে এসেছেন। কি সাংঘাতিক স্মার্ট সবাই। এখনো মনে হচ্ছে, ‘আমি কত্তবড় খ্যাত’; এই লেখাটা লিখছি আর ভাবছি, ‘আমি কত্তবড় খ্যাত’। মনে হচ্ছে চিৎকার করে সারা দূনিয়াকে জানান দেই, “দেখ শালা! আমি কত্তবড় খ্যাত”। বিল-কাউন্টারগুলোতে লম্বা কিউ। খুশি হলাম, যাক আমার মত অনেক ‘খ্যাত’ পাওয়া গেল, যারা লাইনে দাঁড়ায়। কিন্তু, ও-মাঃ একি! আমি যে আবারো ‘খ্যাত’। আমার চেয়ে কত্ত দামী পোষাকের শিক্ষিত জনগন কি সুন্দর তাদের ট্রলিগুলো নিয়ে চিপার ভিতর দিয়ে কিউ ডিঙানোর চেষ্টা করছে – তাদের কাতারে সুবেশী নারীও আছেন, ফটাফট ইংলিশ-স্টাইলিশ পুরুষও আছেন। ওই মুহূর্তে ভীষণ খারাপ লেগেছিল। আমার দেরি হয়ে যাবে, সেজন্য না, বরং ওই মানুষগুলোর কাণ্ড দেখে। তারা যা করছে, ইন্টেনশনাল। শিক্ষিত ইন্টেলেকচুয়াল ইন্টেনশনাল অপরাধী। দুয়েকজনকে বলতে বাধ্য হলাম, “আপনি ট্রলি নিয়ে মাঝের ফাকা জায়গাটা ব্লক করে ফেলছেন কেন? কিউ-এ আসেন, সবাই আরাম করে যাই।” সেই সুবেশীদের চোখে মুখে কোন লজ্জাও দেখলাম না। কিন্তু মনটা ভীষণ খারাপ হলো। খামাখাই শুধু বিকেলের সেই দুজন সেলসম্যানের উপরে বিরক্ত হয়েছিলাম। তারা তো এডুকেটেড ছিল না। তাদের সমস্যা ছিল সামাজিক নির্বুদ্ধিতা। কিন্তু ভদ্র সমাজে এ’তো দেখি রীতিমত সামাজিক দায়হীনতা।

মনের কষ্ট নিয়েই সেদিন বাসায় ফিরলাম। এরই মাঝে এই সুবেশী শিক্ষিতদের আরও কিছু স্মার্টনেস দেখলাম, যা আপনারাও প্রতিনিয়ত দেখেন। কিন্তু দেখেন, আমি কত্ত বড় খ্যাত; আমি কিনা এসব দেখে কষ্ট পাই!

শেষের কথাঃ যারা রোজা রেখেছেন কিংবা রাখতে পারেননি অথচ সংযমী জীবন যাপন করে চলেছেন, মন থেকে ভাল কাজ করে যাচ্ছেন, সকলের ভাল চাইছেন, মহান সৃষ্টকর্তা তাদের সবার সৎ ইচ্ছাগুলোকে মূল্যায়ন করুন! সবার জীবন আনন্দে ভরে উঠুক! ঈদ মোবারক!

৩,৩০০ বার দেখা হয়েছে

২৬ টি মন্তব্য : “কমন সেন্স, দ্যা আনকমন”

  1. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

    তবে কি 'দিশি-বিদিশি' লবণ ফ্যাক্টরিগুলো লবণে আয়োডিন দেয়া ছেড়ে দিল? নাকি বেশি মাত্রায় দিয়ে ফেলে এখন লোকসান গুনছে। তবে তো দেখছি তাদের ক্ষেত্রেও 'কমন সেন্স ইজ ভেরি আনকমন'।

    ঈদ মোবারক!


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
      • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

        হা হা হা, আহমদ, এই গানটির কথা যখন পাড়লেই তবে এই গানটির সাথে গেঁথে থাকা আমার একটি অম্ল-মধুর স্মৃতির কথা বলি। গানটি আসলে,

        অনেক কথা যাওগো বলি কোন কথা না শুনি
        তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি

        তিনি ছিলেন আমাদের গবেষণা পরিচালক, আমরা ছাপোষা মাষ্টার। কত অভিনব আইডিয়াই না তার মাথায় সারাক্ষণ লাটিমের মতো ঘুরপাক খেত। সেগুলোর বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ত আমাদের কাঁধে। মিটিংয়ের পর মিটিং। নির্দেশের পিঠে নির্দেশ। তবে সবই ধোঁয়াশা কিম্বা কুয়াশার মত অবোধ্য। মিটিংয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইংরেজি কপচিয়ে শুধু বলেই যেতেন, শুনতেন না কিছুই। কারণ তিনি যে ডাইরেক্টর, নির্দেশ দেয়াই তো তার কাজ। সমাধানের রাস্তা বাতলে দেবার নয়। যাহোক, নির্দেশের কশাঘাতে চিড়ে চিপ্টে হতে হতে আমরা যখন একেবারেই নাজেহাল হয়ে পড়েছি, এমনই একদিন আমাদের কণ্ঠে করুণ সান্ত্বনার সুরে বেজে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ,

        অনেক কথা যাওগো বলি কোন কথা না শুনি
        তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি

        হায়, আমাদের পরিচালক মহোদয় যদি তোমার এই লেখাটি পড়তেন! আর বুঝতেন, 'কমন সেন্স......' (সম্পাদিত)


        দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

        জবাব দিন
  2. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    তোমার লেখাটি পড়ে মধুর প্রতিশোধের একটি ঘটনার কথা মনে পড়লো, ভাইয়া!

    আমাদের এখানে গ্রোসারীতে বা শপিং মল গুলোতে টেন আইটেমস অর লেস নামের কয়েকটি রেজিস্টার থাকে যেখানে দশটি বা তার কম জিনিসের মূল্য দ্রুত পরিশোধ করতে পারে একজন ক্রেতা। একদিন আমার সামনে যে ভদ্রলোকটি ছিলেন তিনি অনেকগুলো গ্রোসারী নিয়ে ঐ টেন আইটেমস অর লেস আইলে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি তার পেছনে দাঁড়িয়ে করবার মত কোন কাজ না পেয়ে মনে মনে তার জিনিসপত্র গুনতে শুরু করলাম। কর গুনে দেখলাম একুশটি আইটেম তার কার্টে। আমার চোখে বিরক্তি থাকলেও ভব্যতা বোধের কারণে কিছু বলতে পারছিলাম না। ভদ্রলোকের দৃষ্টি সামনের দিকে তখন, আমি চুপচাপ দুইটি চুইং গাম, একটি চ্যাপস্টিক আর একটি ক্যান্ডির প্যাকেট তার কার্টে রেখে দিলাম। কেউ তো আর গ্রোসারীর দিকে তাকিয়ে থাকেন না; ভদ্রলোক চুয়িং গাম আর বাকী প্যাকেটগুলো নিজের মনে করে বাড়ির পথে পা বাড়ালেন 😛

    জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ভাই, আপনাকে ইগ্নোর করা শিখতে হবে।
    দুনিয়া তো বদলাবে না, আপনাকেই বদলাতে হবে!
    তা নাহলে আপনার নিজের মনেরই শান্তি নষ্ট হবে, কারও কিচ্ছু হবে না... 🙁


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  4. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    আহমদ ভাই,
    সারাজীবন নগরবাসী আর নাগরিক জীবনযাপণের মধ্যে থেকেও যদি এতোদিন লেগে যায় আপনার এই সত্যটা উপলব্ধি করতে, তাইলে ক্যামনে কি? 😉

    নূপুর ভাইয়ের পরামর্শমত 'ইন্সেন্সিটিভ হওয়া' বা জুনায়েদের মতো 'ইগ্নোর করার' সাথে একমত নই। কারণ, পানশালায় প্রবেশ করে সুরা+সাকী উপেক্ষা করা বা ভুলে থাকা যায় কি? তাইলে আপনার উলিখিত এসব 'সামাজিক নির্বুদ্ধিতার' মাঝে বসবাসই কি জীবনের অমোঘ পরিণতি?

    আরেকটা কথা। বলেছেন-

    মনের কষ্ট নিয়েই সেদিন বাসায় ফিরলাম। এরই মাঝে এই সুবেশী শিক্ষিতদের আরও কিছু স্মার্টনেস দেখলাম, যা আপনারাও প্রতিনিয়ত দেখেন। কিন্তু দেখেন, আমি কত্ত বড় খ্যাত; আমি কিনা এসব দেখে কষ্ট পাই!

    এখানে কর্তা হিসেবে আপনাকে স্পষ্টভাবেই দেখতে পাচ্ছি উল্লিখিত 'সামাজিক নির্বুদ্ধিতা'গুলো থেকে আলাদা। এর সবথেকে স্পষ্ট মানে হলো, আপনি এসব থেকে মুক্ত, অন্ততঃ আপাতত। কিন্তু সব সময়ই কি? আপনি বা আমি কি সব সময় এসব সামাজিক নির্বুদ্ধিতা থেকে মুক্ত থাকতে পারি? আর তা' চাইলেও কি পারা সম্ভব?

    প্রশ্নগুলো উত্থাপন করলাম শুধুই প্রশ্ন করার জন্য নয়। রাজন হত্যাকান্ড এবং এর বিরুদ্ধে গণ-প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে আমার চিন্তার চর্চা কয়েকদিন ধরেই জট পাকিয়ে গেছে। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা কি বোঝা উচিত, আর কিভাবেই বা তা' সম্ভব, ইত্যাদি।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
    • আহমদ (৮৮-৯৪)

      আমার বুঝতে পারা তোর একটা প্রশ্নের উত্তর হলোঃ না আমরা কেউই মহামানব নই, কাজেই কখনো না কখনো আমরা প্রায় কমবেশি সবাই ভুল করি। কিন্তু ঢালাওভাবে গণনির্বুদ্ধিতাকে কিন্তু আসলে আমরা সবসময় উপেক্ষা করতে পারি না। হয়ত আমার মধ্যে ইগনোর করতে পারার যোগ্যতা কম, আর সেকারনেই মনে হয় আমার প্রকাশ অন্যদের চেয়ে ভিন্ন বা বেশি।

      কিন্তু তোর মন্তব্য পড়ে মনে হলো অনেকগুলো জায়গায় বোধহয় তুই নিজেকেই প্রশ্ন করছিস। তার মানে, এধরণের বিষয় কিছুটা হলেও তোকেও ভাবাচ্ছে। আমার ধারণা ভুলও হতে পারে।

      আরেকটা কথা, 'গণনির্বুদ্ধিতা' কিংবা 'গণনির্লজ্জতা' যখন পয়ারিবারিক চর্চায় পরিনত হয়, তখন কিন্তু মনের রিএকশন আমাদের অনেকেরই চলে আসে। আমি শুধু এখানে এসে মাঝে মাঝে ভেন্টিলেট করি, এইই যা। কোন সমর্থনের আসায় করছি, তা কিন্তু নয়। জাস্ট একান্তই নিজের মনের প্রশান্তির জন্য, কিছুটা নিজস্ব ভাললাগার জন্য লিখে যাওয়া।

      কিন্তু, একটু ভেবে দেখ, কখনো যে তোর নিজেরও বিরক্ত লাগে না, তাও হয়ত না। নিশ্চয়ই তুইও মাঝে মাঝে এধণের বিষয় একই দিনে একটার পর একটা ঘটতে থাকলে তুইও বিরক্ত হবি।

      আমি তো বরং মনে করছি, নূপুরদা, জুনায়েদ এবং আংশিকভাবে তোর পরামর্শ অনুযায়ি আমারই আসলে আরেকটু এডাপ্টিবিলিটি বাড়ানো দরকার, যাতে করে আমি নিজেই ভাল থাকতে পারি।


      চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

      জবাব দিন
      • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
        কিন্তু তোর মন্তব্য পড়ে মনে হলো অনেকগুলো জায়গায় বোধহয় তুই নিজেকেই প্রশ্ন করছিস। তার মানে, এধরণের বিষয় কিছুটা হলেও তোকেও ভাবাচ্ছে। আমার ধারণা ভুলও হতে পারে।

        আহমদ ভাই,
        আপনি ঠিকই ধরেছেন যে, প্রশ্নগুলো আমি আসলে আপনার ব্লগের প্রেক্ষিতে নিজেকেই করেছি। আর এধরণের বিষয়গুলো ইদানিং আরো বেশি ভাবাচ্ছে। কারণ, আগের থেকে বেশি- ইনফ্যাক্ট প্রায় প্রতিদিন- বাংলাদেশী সংবাদপত্র পড়ছি। তাছাড়া ফেসবুকেও নিয়মিত যাতায়াত চলছে। এ'ই থেকে ভাবনাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আর বাঙালি চলে আসছে প্রচুর।

        আমি আপনাকে এডাপ্টিবিলিটি বাড়াতে বলিনি কিন্তু 😛 । আমি শুধু বলতে চেয়েছি যে, এইসব প্রশ্ন আদতে আমাদের অস্তিত্বকে বোঝার, সমাজকে বোঝার ক্ষেত্রে অনিবার্য প্রশ্ন। এগুলোর মিমাংসা না-করে সমাজকে বুঝতে যাওয়া অসম্ভব। আর তাই আমি নিজেই এগুলোর উত্তর খুঁজছি। এপথে কতদূর এগুলাম তা' মাঝে মধ্যে সিসিবি'র মাধ্যমে শেয়ার করবো।


        There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

        জবাব দিন
        • আহমদ (৮৮-৯৪)

          তুই সরাসরি এডাপ্টিবিলিট বাড়াতে বলিস নি ঠিকই। কিন্তু আসলেই মনে হচ্ছে এডাপ্টিবিলিটি বাড়াতে হবে। আর এটাও ঠিক যে সবসময় ইগনোর করাও কিন্তু যায় না। আমার কাছে সবচেয়ে ভয়ংকর মনে হয় যখন টের পাই যে এধনের বিষয়গুলো পরিবার থেকে শুরু হয়ে সামাজিক স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছে। ভুল আমাদের হতেই পারে, কিন্তু তা মজ্জাগত হবে কেন?


          চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

          জবাব দিন
          • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
            ভুল আমাদের হতেই পারে, কিন্তু তা মজ্জাগত হবে কেন?

            এইটা মজ্জাগত নয়, কারণ মানুষের স্বভাবই হলো ক্রমাগত উন্নতির (পারফেকশন) দিকে যাওয়া, তা' সে যে-ই হোক। তবে ভুলগুলো অনেক সময় আমরা ভুলই মনে করি না। এজন্যই ভুল করা'কে আমাদের কাছে 'মজ্জাগত' মনে হতে পারে।

            কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল, কোনটা অগ্রগতি আর কোনটা পশ্চাৎগামিতা তা' বোঝাবুঝির মধ্যে আমাদের ঝামেলা হচ্ছে নিশ্চয়। কিন্তু সেটা জানবার পথের শুরুটা যে কোথায়, সেই হদিশই ত' পাচ্ছিনা? O:-)


            There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

            জবাব দিন
            • আহমদ (৮৮-৯৪)

              ঝামেলা তো আছেই।

              এই যেমন, টেকনোলজি আমি ভীষনভাবে পছন্দ এবং সমর্থন করি। কিন্তু তাই বলে হেডফোন কানে দিয়ে বা ফেসবুকিং করতে করতে রাস্তায় হাটতে থাকা, এটা তো সমর্থন করা যায় না।

              আবার কেউ এসবের চর্চা চালাতে থাকলে আমরা তো আর থাপ্পড় দিয়ে তাকে ঠিক করতে পারি না।

              আমার মনে হয় আমদের টোটাল আপব্রিঙিং প্রসেসের মধ্যে কিছু ঘাপলা হয়ে যাচ্ছে। একটা শিশু, একান্তই তার জেনেটিক বৈশিষ্টগুলো ছাড়া বাকি অভ্যাস বা 'খাসিলত'গুলো ডেভলাপ করে পারিপার্শিকতা থেকে, যার শুরু পরিবার থেকে, যা কিনা এক পর্যায়ে স্বীকৃত হয়ে যায় একটা জনগোষ্ঠির সামাজিক চর্চার মধ্য দিয়ে।

              তবে যতই বিরক্ত হই না কেন, আমি কিন্তু আশাবাদী মানুষ। কোন না কোন একটা মেকানিজমে নিশ্চয়ই এগুলোকে শোধন করা যাবে। হয়ত তা সময়সাপেক্ষ, কিন্তু অসম্ভব নিশ্চয়ই নয়।


              চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

              জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।