১লা মে ২০১৫ – দিবসে দিবসের ব্যবচ্ছেদ

১লা মে ২০১৫ – দিবসে দিবসের ব্যবচ্ছেদ

১। মে দিবসের কথা আসলেই ফকির আলমগীরের কিছু গান আমার মনে পড়ে যায়। মেহনতি জনতার জন্য দরাজ গলায় গাওয়া গান। যদিও এই শিল্পীর গাওয়া আমার প্রিয় গান অন্য আরেকটা, “মায়ের এক ধার দুধের দাম, কাটিয়া গায়ের চাম, পাপোষ বানাইলেও ঋণের শোধ হবে না … এমন দরদী ভবে কেউ হবে না, আমার মা গো …”। ছোটবেলায় কেন যেন এই গানটাতে বেশ মোহাবিষ্ট হতাম। এখন অবশ্য ঠিক সেরকম হয় না; বুকের ভেতরটাতে কেমন যেন চিনচিনে একটা অনুভুতি কাজ করে। যাহোক, এই শিল্পী বা তার গান, কোনটাই আমার এখনকার বিষয় নয়। মে মাসের শুরুর দিনটাতে ফেসবুকে এক জুনিওর ক্যাডেটের স্ট্যাটাসে একটা অনুরোধ দেখেছিলাম, অনেকটা এরকমঃ “এই দিনটিতে যেন কেউ অন্তত রিকশাচালকের সাথে দরদাম না করি; তাদের চাওয়া ভাড়াটাই যেন আমরা দিয়ে দেই”। আমার মাথায় কথাগুলো বেশ পেঁচিয়ে গেছে। আমি নিতান্তই শান্তিপ্রিয় মানুষ। হয়তো মাঝে-মাঝে টেম্পার লুজ করি; তা তো অনেকেই করেন। কিন্তু আমি খেয়াল করেছি আমার মত এত বেশি সদয়ভাবে আপোষে আসতে যেন আমার চারপাশের মানুষগুলোর বেশ অনীহা। কাউকে আঘাত দেয়ার তাগিদে, কিংবা কোন কিছুর উদ্দেশ্যে এটা বলা নয়; নিতান্তই কিছু উপলব্ধি মাত্র। … … … বুঝতে পারছি আমার কথাগুলো তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। আসলে পরিকল্পনাবিহীনভাবে লিখতে বসা। তবে হ্যাঁ সকাল থেকে কোন এক প্রাচীন দার্শনিকের একটা কথা বারবার মনে পড়ছিল, গৃহকর্মীদের ব্যাপারে, অনেকটা এভাবে, “এদের ছাড়া চলাও মুশকিল, আবার এদের সামলানোও বেশ কষ্টকর কাজ”।

২। … … … ১লা মে’তেই আমাদের বাসার কাজের মেয়েটির প্রস্থান হলো। বলা চলে তাকে বিদায় দিতে হলো। মেয়েটা ঠিক সাড়ে ছয় মাস ছিল আমাদের বাসায়। এই ক’মাসে তার একবিন্দু পরিমান ত্রুটি আমরা পাইনি, বাসার মুরুব্বীরা সবাই তাকে সন্তানের মতন আদর যত্ন করেছেন, আমার বোন বা স্ত্রী বাসায় যে সম্মান পায়, তার চেয়ে এই মেয়েটিকে কোন অংশে কম সম্মান করা হতো বলে আমার মনে হয় না (আবশ্যই কিছু সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই)। কোন আবদারও অপূর্ণ রাখা হতো না, অবশ্য তার আবদারও ছিল নিতান্তই সামান্য – সুগন্ধি সাবান, রঙ্গীন চুড়ি, সামান্য কানের দুল, কিংবা মুখে মাখার জন্য ফেয়ার এন্ড লাভলী ক্রীম – এসব আর এমন কি। আমার পরিবারের সদস্যরা তার এসমস্ত আবদারের ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন। আমার মেয়েটাকেও সে বেশ আদর করত। আজ বিদায় হবার পূর্ব মুহূর্তেও সে আমার আড়াই বছরের মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়েছে। আমার মেয়েটাও দেখি খুব সহজেই এই গৃহকর্মীদের সাথে মিশে যায়; আমরা বাধা দেই না; খালি একটু সতর্ক নজর রাখি; তা তো যে কোন মা-বাবা-ই রাখবেন; এটা মোটেও দোষের কিছু না বলেই আমার ধারনা। আর হ্যাঁ আরেকটা বিষয়ে সচেতন থাকতে হয়, তা হলো আমাদের বাচ্চাটা যেন স্বাভাবিকভাবে আঞ্চলিক উচ্চারণে অভ্যস্ত হয়ে না পড়ে – এটাও মনে হয় মা-বাবা হিসেবে আমরা চাইতেই পারি। সন্তানকে নিজের মতন করে গড়ে নিতে, বড় করতে, ত্রুটিমুক্ত রাখতে, কে না চায়? কাজেই এটাও মনে হয় আমাদের মতন মধ্যবিত্ত পরিবারের মা-বাবা-দের একটা কমন আচরণ। তাহলে তো এটাতেও দোষের কিছু নেই।

আমাদের বাসায় সাড়ে ছ’মাস থাকা এই মেয়েটা বেশ মায়া তৈরি করে ফেলেছিল আমাদের সবার মধ্যে। কোন কাজে না নেই; রাত-বিরাতে চা বানানোর অনুরোধে বাসার একজন পরিবার সদস্যের মতই একটু বিরক্ত প্রকাশ করে সে ঠিকই চা বানিয়ে নিয়ে আসত, আবার জিজ্ঞেস করত, “চা বানানো ঠিক হয়েছে কিনা?” তারপরেও মেয়েটাকে এই শ্রমিক দিবসেই বিদায় দিতে হলো। সিদ্ধান্তটা ছিল প্রাথমিকভাবে আমার। আমি আমার মা-বাবাকে আমার যুক্তি বোঝালাম। এবং তাকে সাময়িক ছুটির পরিবর্তে আপাতত পূর্ণকালীণ ছুটিতে পাঠানো হলো। বিকাল থেকে দেখি মা-বাবা সহ বাসার সবার মন খারাপ। সত্যি কথা বলতে আমার মন সবচেয়ে বেশি খারাপ হলেও কাউকে বুঝতে দিলাম না। আমার অনেক কষ্ট লেগেছে কাজটা করতে। কিন্তু যদি কখনো মনে সন্দেহ হয় যে, কাউকে দয়া করলে, নিজের বা পরিবারের ক্ষতি হতে পারে, তখন কি করা উচিৎ? বাবা দেখি বিকালে টিভির দিকে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু তিনি নিশ্চুপ; আমি বাবা-কে বললাম, “মন খারাপ করো না, মেয়েটা কাজে-কর্মে পটু, এর আগেও ঢাকায় বেশ কয়েক জায়গায় কাজ করেছে, সে নিশ্চয়ই অন্য কোথাও একমাসের মধ্যেই কাজ জুটিয়ে নেবে; আর আমাদের বাসা থেকে জমানো বেতন আর বখসিস সহ যা পেয়েছে, তা দিয়ে তার পরিবারের কয়েকমাস চলে যাবার কথা।”

— — একটু পেছনে যাই … … … আমার মায়ের মোবাইলে এই মেয়েটার মা ছাড়াও আরো অনেকের ফোন আসা শুরু করে; বলা বাহুল্য সবাই টিন-এজার এই মেয়েটার গ্রাম সম্পর্কিত পূর্ব পরিচিত, এবং সবই আমাদের অচেনা পুরুষ মানুষের ফোন। মেয়েটাকে বলা হলো যে তার মা ছাড়া (যেহেতু মেয়েটার বাবা বেঁচে নেই) আর অন্য কারো সাথে তার ফোনালাপ করতে দেয়া সামাজিকভাবে সম্ভব না; বিষয়টা মেয়েটার মাকেও জানানো হলো। কিন্তু গত মাস খানেক ধরে আমার মায়ের প্রিপেইড মোবাইলের ভূতুড়ে রকমের ব্যালান্স কমা শুরু করে; গত মাসের পনেরো দিনের মধ্যেই আম্মার মোবাইলের প্রায় হাজার খানেক টাকার ব্যালান্স কেমন করে যেন শেষ হয়ে গেল। আম্মার অভ্যাস হলো ড্রইং রুম, ডাইনিং টেবিল, রান্না ঘরের শেলফ, এধরনের জায়গায় মোবাইল ফোনটাকে রাখা। প্রথম দিকে তেমন পাত্তা দেইনি, কিন্তু গত দু-তিন-দিন থেকে এই কাজের মেয়েটার অস্বাভাবিকভাবে বাড়ি যাওয়ার বায়না শুরু হলো। তাকে কিছুদিন পরের কথা বলা হলো, কিন্তু সে বেশ এডামেন্ট, এমনকি তার কথা বার্তায় আম্মাও বেশ ঘাবড়ে গেলেন, হঠাত করেই যেন মেয়েটা পালটে গেল, সুইসাইড করা বা পালিয়ে যাবার মতো কথাবার্তা নাকি সে আম্মাকে বলেছে। আমি কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছিলাম না। এই মেয়ের সাথে এই আচরণ বেমানান। তার কথা, “আমি আবার আসব, আমাকে এখন যেতে দেন”। বেশ রহস্যজনক। তাকে সকাল বেলা আমিও একবার খুব আদর এবং আদবের সাথে বোঝালাম; আমার অফিস থেকে বিভিন্ন সময়ে ছুটি চেয়েও না পাওয়ার কথা বলা হলো; আমার স্ত্রীও তাকে বোঝালো যে কিভাবে বিয়ের মাত্র আট দিন সময় থেকে পড়াশোনার চাপে এবং নববিবাহিত জীবনে আটকা পড়ে আমার স্ত্রী (এবং আমিও) প্রায় একবছর পরে আমাদের বাবা-মা-কে দেখতে দিনাজপুর-পঞ্চগড়ে গিয়েছিলাম (তখন আমাদের মা-বাবা-রা ঢাকায় ছিলেন না, দিনাজপুরে এবং পঞ্চগড়ে তাঁদের কর্মক্ষেত্র এবং অবসরকালীন কিছুদিন তারা কাটিয়েছেন)। কিন্তু এই মেয়েটা কিছুতেই কিছু মানছে না, শেষে মনে হলো প্রায় বিদ্রোহ করার মতন অবস্থা; সে আজই বাড়ি যাবে, যেভাবেই হোক। আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল; কি এমন হলো যে হঠাৎ এখনই তাকে বাড়ি যেতে হবে। তার মায়ের সাথে তার প্রতিনিয়ত (প্রায় প্রতিদিনই) কথা হয়। এব্যাপারে আমার মা-বাবা সহ আমাদের বাসার সবাই সবসময়ই বেশ উদার। দুপুরে আমি দোদুল্যমান সিদ্ধান্তহীনতায় বেশ মানষিক চাপের মধ্যে থাকলাম। এদিকে মেয়েটা কেমন করে যেন জেনেছে যে গ্রাম থেকে তাকে যে বয়স্ক লোকটা ঢাকায় নিয়ে এসেছে (একজন লোকাল হাউজ-মেইড সাপ্লায়ার), যিনি কিনা প্রতিবার ঢাকায় এলে প্রতিটা বাসায় গিয়ে তার সন্তানতূল্য এই মেয়েগুলোর সাথে নিজে দেখা করে তারপরে গ্রামে ফিরে যান (কারন তার নিজের মেয়েও এরকম ভাবে ঢাকায় একজনের বাসায় কাজ করে)। যাহোক এবারে সেই বয়স্ক লোক তার নিজের মেয়েকে এক বাসায় রাখার জন্য ঢাকায় এসেছেন। উপায়ন্ত না দেখে তাকে সংবাদ দেয়া হলো, তিনি যেন আমাদের বাসা না হয়ে গ্রামে ফিরে না যান। তিনিও আমাদের বাসায় এসে মেয়েটার হঠাৎ এমন এডামেন্ট অবস্থা দেখে বেশ অবাক হলেন। এবং তিনিও বেশ কিছুক্ষন মেয়েটাকে বোঝানোর চেষ্টা চালালেন। শেষে এতটা অস্বাভাবিকতা আমার কাছে বেশ ধোঁয়াটে মনে হলো। আমি আম্মাকে আড়ালে ডেকে বললাম, “কি করা যায়”? আম্মার সহজ-সরল চিন্তা, “যেতে চায় তো যাক; কি আর করা যায়; কদিন পরে তো আসবেই বলছে।” আমি বুঝলাম, আম্মা স্নেহান্ধ হয়েছে; এই মেয়ে আবার ফিরে আসলে যে আগের সেই মেয়েটা আর ফিরে আসবে না, সেটা আম্মা এখনো ধরতে পারছে না। আমি আম্মাকে আমার সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দিলাম। আমার বাবা বেশ প্র্যাক্টিক্যাল মানুষ তাকে কনভিন্স করা কঠিন হলো না; বরং আমি আমার কথাটা বলার সাথে সাথেই বাবা বুঝে গেলেন। যাহোক মেয়েটাকে জানানো হলো তার আর আসার দরকার নেই। তার পাওনা বেতন কড়ি সব বুঝিয়ে দেয়া হলো। শেষে আরও অতিরিক্ত একটা পাঁচশ টাকার নোট মেয়েটার হাতে দিলাম। খুব খারাপ লাগছিল। মেয়েটার চোখে পানি ছিল। আমার ছোট বোনটার চেয়েও বয়সে ছোট। আমাদের মতন কোন পরিবারে জন্মালে তাকে তো আর এভাবে বাড়ি-বাড়ি আশ্রয় নিয়ে খেটে খেতে হতো না। আমার বারবার মনে পড়ছিল মাত্র কিছুক্ষন আগে এই মেয়েটা আমার বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়েছে। ঘুম থেকে জেগেই আমার আদরের কন্যা তাকে খুঁজবে। আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখে-মুখেও কষ্টের ছাপ। কিন্তু আমি কি করতে পারতাম? আমার মায়ের মোবাইলে আসা সেই ফোনকলগুলো, যেগুলো মেয়েটাকে না দেবার জন্য কখনো কখনো আমাদের সেই মানুষগুলোর কাছে বেশ কটু কথা শুনতে হতো; আবার ইদানিংকালের আম্মার মোবাইলের অস্বাভাবিক ব্যালান্স হারানো; মেয়েটার হঠাত অস্বাভাবিকভাবে বাড়ি যাবার হুমকি মূলক আচরণ। সবকিছু মিলে আমি অসহায় হয়ে গেলাম। নিজের পরিবারের সিকিউরিটির কথা আমার কাছে সবচেয়ে বড় হয়ে গেল। আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম, এই মেয়েটা পরের বার ফিরে এলে অনেক সমস্যা হতে পারে। তার গ্রামের সেই ছেলেগুলোকে সে আমাদের বাসার ঠিকানা দিয়ে আসতে পারে। সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া গৃহকর্মীদের দ্বারা কিশোর অপরাধের ঘটনা যে কখনো কোথাও ঘটেনি, তা তো না। তারপরেও আসলেই অনেক খারাপ লাগছে। আজ রাতে যখন আমার স্ত্রী আমাদের মেয়েটাকে কোলে করে পুরো বাসা হেটে হেটে ঘুম পাড়াচ্ছিল, বারবার আমাদের ওই কাজের মেয়েটার কথা মনে পড়ছিল। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, শ্রমিক দিবসেই এটা আমাকে কেন করতে হলো? কিন্তু, একজন বাবা, একজন সন্তান, একজন স্বামী, একজন বোনের বড় ভাই, সর্বোপরি পুরো পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে থাকা একজন মানুষ হিসেবে এটাই আমার জন্য ছিল একমাত্র সময়োপযোগী প্রাগমাটিক সিদ্ধান্ত। আমার হাতের আঙ্গুলটা আমার যতই প্রিয় হোক, গ্যাংরিন হলে তার মায়া আমাকে ত্যাগ করতেই হবে। কিন্তু তাই বলে এই শ্রমিক দিবসেই কেন? জীবন আসলেই বড় রহস্যময়।

৩। আমার মতন যারা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরী করেন, তাদের মনে যে কখনো বেকার হয়ে যাবার আশঙ্কা আসেনি তা মনে হয় কেউই বলতে পারবেন না। যারা দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারী চাকুরীতে আছেন, যাদের পরিবার পরিজন নিয়ে চলতে হয়, তারা এই চিন্তা প্রতি বছরে দু-চার-বার হলেও নিশ্চিতভাবে করেছেন। আমাদের এর আগের কাজের মেয়েটির সাথেও আমার কন্যার মিষ্টি মধুর সম্পর্ক ছিল। মেয়েটা কাজে কর্মেও ভাল ছিল। কিন্তু সেই মেয়েটার কিছু আজব বৈশিষ্ট ছিল। তাকে বেশি করে খেতে দিলে সে নিতে চাইত না, কিন্তু প্রায়ই চুরি করে খেতে গিয়ে ধরা পড়ত। খাবার জিনিস খেয়েছে, এটাতে সমস্যা নেই, কিন্তু পরিবারের সকলের হাইজিনের কথা চিন্তা করলে বিষয়টা আসলেই গুরুতর। সবচেয়ে বড় সমস্যা সে যেটা করত, তা ছিল সামাজিক সমস্যা। তাকে কিছুতেই ছয়তলার জানালা বা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কোন কিছু নিচে ফেলা থেকে বিরত করা যেত না। হয়তো ময়লার ঝুড়ি হাতের কাছেই আছে, কিন্তু সে লুকিয়ে-লুকিয়ে জানালা দিয়েই নিচে ফেলবে। তার প্লেটের খাবার সে রান্না ঘরের জানালা দিয়ে পাশের বাসায় ফেলবে, অথচ অন্য সময় চুরি করে খাবে। পেটের দায়ে কাজ করছে। এদের প্রতি আমার যে কি পরিমান মায়া জন্মে যায়, আমি বোঝাতে পারব না। কিন্তু এরকমের সামাজিক যন্ত্রনাদানকারীকে আর কতদিন ধরে শুধরানো যায়? তার বিদায়ের দিনটাতেও বেশ খারাপ লেগেছিল। ওই মেয়েটা সম্ভবত আমাদের বাসায় প্রায় টানা দু’বছর ছিল। মাঝে ছুটিতে বাড়ি গিয়েও সে আমাদের ফোন করেছিল। আমার বাবা-মা-স্ত্রী সবার সাথে সে ছুটিতে গিয়েও গ্রাম থেকে পয়সা খরচ করে ফোনে কথা বলত। আমার মেয়েটা বা ছোট বোনটা কি করছে খোঁজ নিত। সেই মেয়েটাও আমার ছোট বোনের চেয়েও বয়সে ছোট ছিল। এ বড় আজব মায়া। রক্তের সম্পর্ক নেই, অথচ মায়া পড়ে যায়। কিন্তু মায়া পড়ে যাওয়া এই শ্রমজীবি মানুষদের সাথে একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে গিয়ে বেশ নির্মম ভাবে মায়া ত্যাগ করতে হয়। একবার আমার চাচার বাসার ছোট থেকে (প্রায় শিশু থকে) বড় হওয়া একটা টিন এজার ছেলের বিষয়েও আমাকে এমন সিদ্ধান্ত দিতে হয়েছিল। ছেলেটা সম্পর্কে আমাদের দূঃসম্পর্কের গরীব আত্মীয়। আমার চাচার বাসায় ছোট থেকে বড় হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ একদিন সে বাসা থেকে পালিয়ে যায়; একদিন পরে বাসায় ফেরে। চাচা আমাকে বাসায় ডেকে নিয়ে যান, কারন ছেলেটি আমার ভীষণ ভক্ত ছিল। আমি ছেলেটার সাথে কথা কথা বলে কোন আগা-মাথা বের করতে পারিনি। খুব খারাপ লাগলেও আমি চাচাকে বলেছিলাম তাকে যেন দ্রুত গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কারন একবার পালিয়েছে, রাস্তায় রাত থেকেছে, কে জানে সে অন্য কোন জীবনের আকর্ষনে আছে কিনা, আর যাই হোক রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না। সেই ছেলেটা এখন আমাদের গ্রামের বাড়িতে আছে। আমি গ্রামে গেলে এখনো সে আমার আসেপাশে ঘুর-ঘুর করে। আমিও প্রশ্রয় দেই। কিসের যেন মায়া পড়ে গেছে। সে নিজে খেটে খায়। ছোট ভাইটাকে পড়াশুনা করায়। আমার কাছে মাঝে মাঝে ফরম ফিলাপ বা প্রাইভেটের টিউশনের টাকা চেয়ে ফোন করে। আমি পুরো টাকাটা দিয়ে দেই। আর বলি, আর কারো কাছে যেন হাত না পাতে। একবার আমার আব্বা-আম্মা গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। ছেলেটার জন্য আমি আম্মার হাতে কিছু টাকা পাঠিয়েছিলাম। সে যে আমাকে কতবার ফোনে বলেছে যে টাকাটা সেই মুহূর্তে তার কতটা কাজে লেগেছে ভাইয়ের পড়াশুনার জন্য। চোখে প্রায় পানি চলে আসে। আমাদের মতন ঘরে জন্মালে তো তাকে আর হাত পাততে হতো না। আমার কথা বাদই দিলাম, আমার ছোট বোন বা আমার নিজের সন্তানকে এই বাচ্চাগুলোর সাথে তুলনা করে ভাবতে গেলেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এই ছেলেটার কাছে আমার অনেক ঋণ আছে। একবার আমি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের বিয়ের অনেক আগের কথা। আমি তখন চাচার বাসায় থাকি। তখনকার সেই বাচ্চা ছেলেটা যে আমার কি পরিমান সেবা যত্ন করেছে, আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমার কোথায় কোন ড্রয়ারে টাকা থাকত, কোথায় খুচরা পয়সা থাকত, সেই শুধু একমাত্র জানত। কখনো আমার একটা টাকাও এদিক-ওদিক হয়নি। অনেক সময় আমার অনুমতি নিয়ে আমার মানিব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে বাজার করে এনে বাকি টাকা আমাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিত। কিন্তু তার পরেও, একবার তার টিন এইজে সে যখন পালিয়েছিল তাকে আর চাচার বাসায় রাখার পরামর্শ আমি দিতে পারিনি। এই ছেলেটির জন্য ভবিষ্যতে কিছু একটা করে দেবার ইচ্ছা আমার আছে।

৪। শিক্ষকতা আমার প্রথম পেশা নয়। আমি কর্পোরেট জবে ছিলাম। আমার প্রথম চাকরীর অভিজ্ঞতা তুলনামূলকভাবে বেশ নিম্নমানের ছিল। বেতনকড়ির দিক থেকে নয়, সম্মানের দিক থেকে। কাজের কোন আগামাথা ছিল না। কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ হওয়া সত্বেও আমার দায়িত্ব ছিল জগাখিচুরী টাইপের, যেটা ক্রমশ উন্মোচিত হয়, এবং আমার স্বপ্নভংগ হতে থাকে। ছাত্রজীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের একাডেমিক বিভিন্ন বিষয়ে এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করা এই আমিই আমার প্রথম কর্মজীবনে যে কত আজব অসহায় অপমানের মধ্যে কাজ করেছি তা কেবল আমিই জানি। মাত্র দেড় মাসের মধ্যে ঠিক দুমাসের মাথায় যেদিন আমি চাকরী ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, বাসায় বেশ অগ্রহনযোগ্য প্রাণীতে পরিগনিত হলাম। আত্মীয় মহলে সবার ধারণা হয়ে গেল, আমি অলস, ফাঁকিবাজ, কাজে অনীহা আছে আমার, আমি পরিশ্রম ভয় পাই, ইত্যাদি ইত্যাদি; কিন্তু তাদের কাউকেই আমি আমার স্বপ্ন ভংগের কথা বোঝাতে পারছিলাম না। সেই দিনগুলোর কথা আমার আজো মনে পড়ে। তবে হ্যাঁ নিঃসন্দেহে সেই চাকরীটা আমার জীবনে মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় ছিল, যা আমি এতদিন পরে উপলব্ধি করি, বেশ ভালভাবেই করি। তা হলো মানুষকে পেটের দায়ে কিনা করতে হয়। মনের মাঝে অপমান-যন্ত্রণা সব চেপে রেখে মুখে হাসি মেখে কাজ করে যেতে হয়। এখন শিক্ষকতায় আছি। কোন কাজই এখন আর ছোট মনে হয় না। পিওন না থাকলে নিজের হাতেই ন্যাকড়া নিয়ে চেয়ার টেবিল মুছে ফেলি, কিংবা বোতল হাতে করে পানি ভরিয়ে নিয়ে আসি। মাঝে মাঝে ছেলে-মেয়েরা দৌড়ে আসে, কারন তারা মনে হয় এমনটা দেখে অভ্যস্ত নয়, “স্যার আমাকে দেন, আমি করে দেই।” আমি কখনোই দেই না। এটা আমারই কাজ। আমাকেই করতে হবে। এতে ছোট হবার কিছুই নেই। বরং আমাকে দেখে আমার ছাত্ররা কিছুটা হলেও শিখুক; বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে যাবার পরে যেন সো-কলড এমএ পাশের ভূত তাদের মাথায় চেপে না থাকে। নিজের কাজ নিজে করার মধ্য দিয়ে যেন সো-কলড ইজ্জত হারানোর ভয় তাদের না থাকে। নিতান্তই দুইহাত উপচে পড়া জিনিস বা বই-খাতা-পত্র না থকলে আমি কখনোই আমার কোন ছাত্র-ছাত্রীর সাহায্য নেই না। তারা যেন দেখে হলেও কিছুটা শেখে। এটা নিজের কাজ। লজ্জার কাজ না। কাজ করার নাম লজ্জা নয়। মাথা বিকিয়ে দেবার নাম লজ্জা।

৫। কিছুদিন আগে একজন থার্ড-পার্টি কনসালট্যান্ট হেসেবে আইএলও-র কিছু ট্রান্সলেশনের কাজ করলাম। লেবার ইন্সপেক্টরদের প্রায় ১৬টা ট্রেইনিং মডিউলের মধ্যে ২টা সামলেছি। কাজ শিখলাম অনেক। ভুল করেছি ইনিশিয়ালি অনেক। কিন্তু ধাপে ধাপে সামলেও নিয়েছি। অনেক বড় মাপের কাজ ছিল। অন্তত আমার মত অতি তুচ্ছ-ক্ষুদ্র মানুষের কাছে তো বটেই। শ্রম আইন, এর বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন দেশে এর প্রয়োগ, এসব নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক কিছু জানা হলো। জানার কোন শেষ নেই। কাজ করে যাই, শিখতে থাকি। কোন কাজই ছোট নয়। আমার বাসার সেই গৃহকর্মীদের কাজই হোক, কিংবা ক্লাসে ছাত্রদের পড়ানোই হোক; কাজ কাজই। এই লেখাটা মে-দিবসেই দেবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সময়াভাবে হয়ে ওঠেনি। সারাদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সামাল দিয়ে মনটাকে শান্ত করে তারপরে লিখতে বসেছিলাম। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলাম প্রথম দিকে। আমি নিশ্চিত ছিলাম না, লেখাটা আদৌ শেষ করতে পারব কি না! এখনো বেশ কনফিউজড, আসলে এতক্ষন কি লিখলাম! ইদানিং আমি মনে হয় বেশ স্বার্থপর হয়ে গেছি। আমি বুঝতে পারছি, পাব্লিক ডিমান্ড, অর্থাৎ পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখাটা তৈরি হয়নি, বরং অতি স্বার্থপরতার ভেন্টিলেশন থেকে লেখাটা জন্ম নিল।

————————————— আহমদ মাহবুব-উল-আলম [আহমদ, সিসিআর, ১৪তম ইনটেক (৮৮-৯৪)]

২,১৯৪ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “১লা মে ২০১৫ – দিবসে দিবসের ব্যবচ্ছেদ”

    • আহমদ (৮৮-৯৪)

      ধন্যবাদ রকিব! অনেকদিন মনের শান্তিতে চা খাওয়া হয় না। মনে হয়, অন্যরাও খেতে পারছে না। কদিন আগে দুজনকে আমি বলছিলাম, সিসিবির কি দারুন একটা স্বর্ণযুগ গেছে একসময়। তারাও একবাক্যে সহমত পোষণ করেছে।


      চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

      জবাব দিন
    • আহমদ (৮৮-৯৪)

      নূপুরদা, আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম। ভাবছিলাম দেখি আপনি কি বলেন। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে আপনি আমাকে ইমোশনাল ফূল ভাবা শুরু করে দিয়েছেন।

      অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার মতন এই অতি ক্ষুদ্র কারো লেখা পড়ে কিছু মন্তব্য করার জন্য।

      তবে যাই বলেন, আমি অন্তত ইমোশন চেপে না রেখে ভেন্টিলেট করার একটা জায়গা পেয়ে গেছি। এটাই বা আমার জন্য কম কিসে? (সম্পাদিত) (সম্পাদিত)


      চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

      জবাব দিন
      • নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

        হা হা। 'ইমোশনাল' শব্দের পর আমি আর 'ফুল' জুড়িনা। 😀
        আসলে ইমোশনাল মানুষকে আমার কখনোই বোকা বা বাস্তবতাবর্জিত মনে হয়নি। ইমোশনাল না হলে বাঁচা কি করে যায় সেটাই আমি ভেবে পাই না।
        মনে আছে, বেশ কয়েকবছর আগে তোমারি একটা লেখায় বলেছিলাম তোমার ক্লাসে একদিন গিয়ে ছাত্র হতে চাই? এখন ইচ্ছেটা আরো জোরালো হয়েছে; কবে যে দেশে যেতে পারবো সেটাই প্রশ্ন। সিসিবিতে কয়েকজনকে দেখছি যাঁরা শিক্ষকতাকে ঈর্ষণীয়ভাবে উপভোগ করছেন; তাঁদের মধ্যে তুমি, মাহমুদ (৯০-৯৬) আর পারভেজ ভাই অন্যতম। আন্দালিব যখন পড়াত তখন সেও ভীষণ মগ্ন ছিল এ ব্যাপারে। আমার খুব ভালো লাগে -- সমীহ করি তোমাদের।

        জবাব দিন
  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    মে দিবসের ব্যবচ্ছেদ পড়ে ভালো লাগলো।
    "এখনো বেশ কনফিউজড, আসলে এতক্ষন কি লিখলাম!" - যাই লিখেছো, সুখপাঠ্য হয়েছে। তবে এটাও বলতে দ্বিধা নেই, লেখাটা পড়া শেষে আমিও কিছুটা কনফিউজড বোধ করছি, লেখাটার আকর্ষণে এক নিঃশ্বাসে পড়া শেষ করেছি, তবুও।

    জবাব দিন
    • আহমদ (৮৮-৯৪)

      ভাইয়া অনেক ধন্যবাদ লেখাটা পড়ার জন্য।
      আপনাদের তুলনায় বয়সে যোগ্যতায় সব দিক থেকেই আমি অতি তুচ্ছ একজন মানুষ।
      আমি নিজেও ভালই জানি যে আমার লেখালেখি মোটেও ভাল না।
      হাতের লেখার অবস্থা আরো খারাপ (হা হা হা...)
      এখানে ঢু মারি কিছুক্ষণ বগর-বগর করে নিজেকে কুছুটা হালকা করার জন্য।


      চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

      জবাব দিন
  2. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    মাঝে মাঝেই মনে হয় এই যে এক একটা দিবস । আমরা মনে হয় এগুলোকে এই এক একটা দিনের আবর্তে আঁটকে রাখারই একটা ফ্রেম তৈরী করেছি এর মধ্য দিয়ে ।
    তোমার এ লেখাটা সেই আবর্তের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে ।
    ভালো লাগলো ।

    জবাব দিন
    • আহমদ (৮৮-৯৪)

      আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণভাবে সহমত পোষন করি ভাইয়া। বিশেষ দিবসেই আমরা কোন একটি জাত-শ্রেণী-পেশা-সম্পর্ক-কে সম্মান দেখাব, আর অন্য দিনগুলোতে পুরোপুরি ইগনোর করে যাব, এটা আমার কাছে অনুভুতিবিহীন সেলিব্রেশনের মত মনে হয়।

      আপনাদের মত সিনিয়রেরা আমার মত নগন্য একজনের লেখায় এমনভাবে মন্তব্য কছেন; আমি সত্যিই আবেগাপ্লুত।


      চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোস্তাফিজ (১৯৮৩-১৯৮৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।