ভূমিকম্পঃ ভয় বনাম দায়িত্ব

ভূমিকম্পঃ ভয় বনাম দায়িত্ব

নেপালের জন্য বেশ খারাপ লাগছে। প্রায়ই বিধ্বস্ত স্তুপের ছবি দেখছি। গতকাল টিভিতে ভূমিকম্পের সময়ে ধারণকৃত নেপালের একটা ভিডিও ক্লিপ দেখলাম। মায়ের কোলে সন্তানের চিৎকার, কান্না, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার ছুটোছুটি। যথেষ্ট পরিমানে মন খারাপ করা দৃশ্য। ফেসবুকের কল্যানে আপডেটগুলো আরো মন খারাপ করে দিচ্ছে। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা ছাড়া আমার আর এই মুহূর্তে কিই বা করার আছে। পরশুদিনের পরে কাল আবার দুপুরের ভূমিকম্পের পর যখন বিকেলে বাসায় ফিরছিলাম, মহাখালি ফ্লাইওভারের ওপরে প্রায় আধা ঘন্টার স্থির ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে সিএনজিতে বসে বেশ ভয় লাগছিল। আবার আজ সন্ধ্যায় যখন বাসে করে ফিরছিলাম, বাসা থেকে বউয়ের ফোন, “ভূমিকম্প টের পেলে?” আমি ভয়ে-বিষ্ময়ে-নির্বাক; সবগুলো অনুভুতি নিয়ে একসাথে কি ভাবছিলাম এখন তা আর মনে করতে পারছি না।

এখানে নিচের বেশ কিছু লাইন প্রায় এভাবেই আমি এক বন্ধুর লেখার পিঠে মন্তব্যে লিখেছিলাম। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে বাসে বসে আমার টের না পাওয়া ভূমিকম্পের পরে বাসার ফিরে মনের ভাবটা আর প্রকাশ না করে থাকা গেল না; বিষয়টা আসলে প্রথম দিনের ভুমিকম্পের সময়ের আমার আনুভুতি নিয়েই।

আমি মোটামুটি নিরীহ প্রকৃতির একটা মানুষ। সাহস মনে হয় বেশ কম। বন্ধুরা সবাই একবাক্যে এটা নিয়ে তামাশা করার অধিকার রাখে। তবে আমার এবারের প্রথম দিনের মোটামুটি দীর্ঘ সময়ের ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতাটা কিছুটা অন্যরকম। ভয় পেয়েছি, সন্দেহ নেই। কিন্তু দায়িত্বের কাছে ভয় হার মেনেছে। আলহামদুলিল্লাহ, বিপদ হয়নি। আমি মনে হয় ইদানিং হঠাৎ করেই বেশি বয়স্ক হয়ে গেলাম। অনেক কিছুই স্রষ্টার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেই। যদিও টেনশন ঠিকই কাজ করে মনের গভীরে।

যাহোক, সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। আমি একটা রুমের দায়িত্বে। অর্ধেক ছাত্র-ছাত্রীর খাতা জমাও পড়েছে। আধা ঘন্টার মত বাকি আছে। চেয়ারে বসে আছি। হঠাৎ মনে হলো মাথা ঘুরছে। বোঝার চেষ্টা করছি কি হচ্ছে। দেখি ছাত্র-ছাত্রীদের বেশ কয়েকজন ফ্যাকাশে চেহারা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা যখন দেখছে যে আমিও ওদের দিকে তাকিয়ে, অনার্স ফাইনাল সেমিস্টারের এক মেয়ের চিৎকার, “স্যার ভূমিকম্প!” আমি নিজে ভয় পেলেও সাহস দেবার জন্য হাসিমুখে বললাম, “তাই তো মনে হচ্ছে”। এরই মধ্যে দুজন ছাত্র, একজন মোটামুটি স্বাস্থ্যবান, আরেকজন হালকা গড়নের, অনেকটা অনুমতি নেয়া-না-নেয়ার মধ্যেই রুমের বাইরে, তারপরে চারতলা থেকে নিচে ভো-দৌড়। অন্যদের ভয় থামানোর জন্য বললাম, “সবাই নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে যাও”। সবাই দাঁড়ালো। সুবিধা হলো, দাঁড়ালে বা হাটলে ভুমিকম্প বোঝা যায় কম, কাজেই পাবলিক প্যানিকও কম। দরজা খুলে দাঁড়ালাম। দেখি পিয়ন তালা খোলার পরে সেটা আবার দরজার হাতলে লক করে রেখেছে। বুঝলাম রুমেই থাকতে হবে। এসবের মধ্যে ভূমিকম্প থেমে গেল। দেখি বারান্দায় কিছু ছাত্র দৌড়াচ্ছে, ধমকে দিলাম ওদের যেন আর প্যানিক সৃষ্টি না করে।

কিন্তু রুমের ওই তালাটা যদি খোলা থাকত, তাহলে হয়তো আমিও সাবাইকে রুম থেকে বের করে দিয়ে তালা লাগিয়ে নিচে দৌড়াতাম। পরীক্ষার খাতাগুলোর সিকিউরিটির কথা মাথায় রেখে ভয় সংবরণ করতে হলো। আর এই শিক্ষকতার তাগিদে বা দায়িত্বের খাতিরে সাহসও দেখাতে হলো।

অবশ্য ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই মিলেও যদি আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করে রুম থেকে বেরিয়ে যেত, আমি কিছুই মনে করতাম না; কারন, উই হ্যাভ ডিফারেন্স ইন পজিশনস, সো অবভিয়াসলি আই হ্যাভ টু এক্সেপ্ট দ্যা ডিফারেন্স অফ পারসেপশনস এণ্ড পার্সপেক্টিভস।

ধাতস্থ হবার পর দেখি মিসড কল, বাবাকে কল ব্যাক করলাম, তার প্রথম কথা, “কি করছিলে?” সব শুনে তিনি শুধু এটুকু বললেন, “ইউ জাস্ট ডিড দ্যা রাইট থিং”। বাবাও সন্তানের প্রতি স্নেহের চেয়ে সন্তানের প্রফেশনালিজমকে গুরুত্ব দিলেন। বুকটা ভরে গেল সাপোর্টিভ এই পিতার আশির্বাদে।

সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পূর্ব মুহূর্তে মোবাইল ফোনে পত্রিকাগুলোতে আপডেট দেখছিলাম। মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। আমার মনে পড়ছে সেই মুহূর্তে নেপালে হতাহতের সংখ্যা ছিল ৮৬৭ বা এই রকমের যার মধ্যে সেই মুহূর্তের আপডেটে শুধুমাত্র কাঠমুণ্ডুতেই পাচ শতাধিক। আর এখনকার আপডেট তো সবারই জানা। মনের চাপ তখনো শরীরে প্রবেশ করেনি। বাসায় ফেরার সময় মেইন রোড থেকে কিছুটা হেঁটে বাসায় ফিরলাম। কি হলো জানিনা, মনে হলো শরীর অবস হয়ে আসছে। হাটার শক্তি পাচ্ছিলাম না। এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলছি না। রাত্রে খাবার টেবিলে বসে টের পেলাম খেতে পারছি না। একেতো রুচি নেই, তার ওপর আবার হাত কাঁপছে।

আর কিছুই লেখার নেই। কি লিখব?

—————————- আহমদ মাহবুব-উল-আলম [আহমদ, সিসিআর, ১৪ তম ইনটেক (১৯৮৮-৯৪)]

১,৫৪০ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “ভূমিকম্পঃ ভয় বনাম দায়িত্ব”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    কখনো কখনো মানুষ তার ক্ষমতা আর ভবিতব্যের দুর্দমনীয়তার কাছে নিতান্তই অসহায় ।
    অথচ এই আমরাই জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এমনটাই মনোভাবে বসবাস করি, যেখানে জীবন্মন্ত্র কেবলি বলছে যেনো ...
    "বিনা যুদ্ধে নাহি দেবো সূচাগ্র মেদিনী" ।

    জবাব দিন
  2. সাইদুল (৭৬-৮২)

    অবশ্য ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই মিলেও যদি আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করে রুম থেকে বেরিয়ে যেত, আমি কিছুই মনে করতাম না; কারন, উই হ্যাভ ডিফারেন্স ইন পজিশনস, সো অবভিয়াসলি আই হ্যাভ টু এক্সেপ্ট দ্যা ডিফারেন্স অফ পারসেপশনস এণ্ড পার্সপেক্টিভস।

    চমতকার


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  3. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    কি যে লিখবো বুঝে পাচ্ছি না। ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে মাকে নিয়ে তিনতলা থেকে রাস্তায় নেমে যাই। এরপরে যখন উৎপত্তিস্থল নেপালের কাঠমুন্ডু ও পোখারার মাঝামাঝি জানলাম তখন প্রথম মনে হয়েছে আমার মিশিগান টেকের বন্ধু আসমার কথা। ওর খুব শীঘ্রই দেশে যাবার কথা। অজানা ভয়ে আরেক বন্ধুর কাছে জিজ্ঞাসা করলাম আসমার কথা। সে জানালো আমেরিকাতেই নিরাপদে আছে আসমা। দেশে যাবার কথা আগামী মাসে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম যখন জানতে পারলাম ওর পরিবারও নিরাপদে আছে। কিন্তু দুইদিন বাদে আজ যখন মৃতের সংখ্যা ৪ হাজার ছাড়িয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ৪০% মানুষ, চোখে পানি এসে যাচ্ছে বারবার। একটা দেশ মাটির সাথে প্রায় মিশে গিয়েছে। এই দুর্দশা খবরে দেখে সহ্য করাই বড় কষ্টের। 🙁


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  4. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    আমার মেডিকেলের ব্যাচে তিনজন নেপালী ছিল। প্রথমেই খোঁজ নিয়ে জানলাম ভালো আছে ওরা -- পরে বেশ স্বার্থপরের মত লাগল নিজেকে। সাহস করে ভিডিও কিম্বা ছবিগুলো দেখতে পারছি না।
    তোমার অভিজ্ঞতা পড়ে বুঝতে পারছিলামনা আমি নিজে কিরকম আচরণ করতাম। এ মুহূর্তগুলোতে ঠিক-ভুল নির্ধারণ তো পরের ব্যাপার, তাৎক্ষণিকার ডাকে কে কি করবো নিজেরাও জানিনা।
    তবু তোমার সাহস দেখে বড় ভালো লাগল। আমার মনে হয়, এ জাতীয় পরিস্থিতির ড্রিল হওয়া দরকার - ছোট বেলা থেকে মনুষ্যসৃষ্ট অথবা পরিবেশগত বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুতির অংশ হিসেবে। এ দেশে বাচ্চাদের খুব ছোটবেলা থেকেই ফায়ারড্রিল করানো হয়।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।