গৌস্টিং: নতুন অনলাইন উৎপাত-৩

প্রথম পর্ব: গৌস্টিং: নতুন অনলাইন উৎপাত-১
দ্বিতীয় পর্ব: গৌস্টিং: নতুন অনলাইন উৎপাত-২
ছয়: গৌস্টি-র মনঃস্তত্ব
এই পুরো সিরিজের এই অংশটাই সবচেয়ে জটিল।
এই অংশে তাত্বিক আলাপের পাশাপাশি অন্ততঃ একজন রিয়েল লাইফ গৌস্টির সাথে আলাপ করে তাত্বিক জ্ঞানের সাথে তাঁর অভিজ্ঞতা মিলিয়ে নিয়ে লিখছি।

প্রথমে তাত্বিক আলাপ করি:
গৌস্টেড হবার পর একজন গৌস্টির উপর সেটার প্রভাব পড়ে ধাপে ধাপে:
প্রথম ধাপ: অস্বীকার করা
গৌস্টির পয়েন্ট অব ভিউ থেকে তখনও সম্পর্কটা উত্তপ্ত অবস্থায় আছে। তাই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার বিষয়টা তাঁর কাছে ঠেকে একটা দুর্ঘটনার মত। সে ভাবে, “সে হয়তো ব্যাস্ত, তাই হয়তো উত্তর দিতে দেরী হচ্ছে অন্য কোথাও ট্রাই করি…” অন্য কোথাও ট্রাই করে যখন নিজেকে ব্লক পায়, তখনো ডিনায়েলটা চলতে থাকে এভাবে, “ওহ হো, ভুল করে বোধ হয় আমাকে ব্লক করে ফেলেছে, যাই বলি গিয়ে সেটা ঠিক করে দিতে…”
এভাবেই একে একে সব মাধ্যমে চলে যোগাযোগহীনতা আবিষ্কারের প্রক্রিয়া আর সেই সাথে চলে নানাবিধ ডিনায়েলের প্রচেষ্টা…
দ্বিতীয় ধাপ: আত্ম অনুসন্ধান
এক্সিডেন্টাল না, স্বেচ্ছায় সর্বপ্রকারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারটি বুঝতে পারার পর গৌস্টির যে প্রতিক্রিয়া হয়, তা হলো: “আমি কি গত কয়েকদিনের মধ্যে নিজের অজান্তে এমন কিছু করে ফেলেছিলাম যা সে নিতে পারে নাই? সেজন্য কি সে একটা ব্রেক নিয়ে আমাকে শাস্তি দিতে চাচ্ছে?
এরপর একটা বড় সময় কাটতে থাকে পুরানা কনভার্সেশন হাতড়ে পাতড়ে খোজাখুজি করে কি কি অন্যয় সে করেছে। কিছু খুজে না পেলে শুরু হয় আরেক হতাশাজনক অধ্যায়…
তৃতীয় ধাপ: আত্ম দোষারোপ
এই ধাপটা শুরু হয় এটা বুঝবার পর যে গৌস্টির নিজের কোনো দোষে সে গৌস্টেড হয় নাই, বরং পুরো ব্যাপারটা হয়েছে গৌস্টারের হটকারিতায়। কিন্তু একই সাথে মন সায় দেয় না এই সেদিনের প্রিয় মানুষটাকে এজন্য দোষারোপ করতে। তাই কোনো একভাবে পুরো ব্যাপারটার দায় নিজের ঘাড়েই নিয়ে নেয় গৌস্টি…
চতুর্থ ধাপ: মনঃদৈহিক প্রতিক্রিয়া ও সেলফ এস্টিম ভেঙ্গে যাওয়া
সেলফ ব্লেমিং অতিক্রমনের প্রচেষ্টা থেকে একইসাথে শুরু হয় মানসিক ও শারীরিক প্রতিক্রিয়া। এই পর্যায়ে সেলফ ব্লেমিং উত্তরনে চলে যোগাযোগের প্রচেষ্টাও। যতই তা করা বিলম্বিত হয়, সেটা উৎকণ্ঠা ও বিষন্নতার জন্ম দিতে থাকে গৌস্টির মধ্যে। এর পাশাপাশি তিনি রক্তচাপে তারতম্য, প্যালপিটিশন, পেশির ব্যাথ্যা, ক্ষুধামন্দা, নিদ্রাহীনতা, লুজমোশন/কন্সটিপেশন, ইত্যাদিতেও আক্রান্ত হতে থাকেন একে একে। গৌস্টির সেলফ এস্টিমও এসময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই সব অবস্থা কারো কারো জন্য অনির্দিষ্ট কালের জন্যেও ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় চলতে পারে। অবশ্য এরমধ্যে কেউ কেউ আবার নিজে থেকেই নিজেকে পরিস্থিতির শিকার বুঝতে পারে এবং রিকভার করা শুরু করে। তবে তা না হলে চিকিৎসক বা কাউন্সেলরের সহায়তা নেয়া জরুরী হয়ে উঠতে পারে।

আজ একটা আর্টিক্যালে পড়লাম, লিখেছে, গৌস্টি নয়, আসলে গৌস্টারই হলো মানসিক চিকিৎসা পাবার উপযুক্ত মূল ব্যাক্তি। কোনো পরিনতি না ভেবে খামখেয়ালি করে যারা এভাবে অন্যকে অসুস্থ্যতার দিকে ঠেলে দেয়, তাঁদের মানসিক সুস্থ্যতার ব্যাপারটা গভীর নিরীক্ষার আওতায় আসা প্রয়োজন……

কারো কারো মনে হতেই পারে, “গৌস্টিং আর এমন কি? এক ধরনের রিজেকশনই তো। এটা আসলে ঐ লোকগুলারই সমস্যা। রিজেকশন সহ্য করতে পারে না। এখন খালি খালি গোস্টারকে দুষতেছে…”।
ঘটনাটা কি তাই?
আসুন বিশ্লেষণ করি।
আমাদের মগজে “সোশাল মনিটারিং সিস্টেম (SMS)” নামক যে জটিল ব্যবস্থা আছে, তা সারাক্ষণ পারিপার্শ্ব থেকে তথ্য নিয়ে আমাদেরকে প্রস্তুত করে, কোন পরিস্থিতিতে কখন কি আচরন করতে হবে সেই ব্যাপারে। বেশীরভাগ পরিস্থিতিতেই আমরা যে র‍্যাশানাল আচরন করি, তা এজন্য যে SMS প্রাপ্ত তথ্যের সঠিক বিশ্লেষন করে তা দিয়ে আমাদের সঠিক আচরন করায়।
গৌস্টিং-এ যা ঘটে, তা হলো, তথ্যহীনতার কারনে SMS আমদের কোনোই আউটপুট দিতে পারে না। তাছাড়া সম্ভব্য ঘটনার অনুমান এতটাই ভিন্ন থাকে যে সেজন্য কি করা উচিৎ, তা নিয়েও কোনো প্রস্তুতির সুযোগ হয় না।
এর ফলাফলে তৈরী হয় বিরাট একটা আবেগগত বিশৃংখলার।
আর সেই বিশৃংখলা থেকে একজন গৌস্টি আরও বেশী অবিবেচকের মত কিছু করে ফেলতে পারেন তখন। করেনও।

এতো গেল গৌস্টেড হওয়াটা পুরোপুরি জানার আগের প্রতিক্রিয়ার কারন।
এবার জেনে নেই, পুরোপুরি জানার পর মানে গোস্টেড হবার ব্যাপারে কনভিন্সড হবার পর, কি কি ঘটে?
প্রথমেই যেটা ঘটে, তা হলো গৌস্টারকে একদম ভুলে এগিয়ে যাবার একটা ইচ্ছা। কিন্তু আগের ঐসব কনফিউশনের ইফেক্টে সেটা সাধারনতঃ পুরোপুরি সফল হয় না। তাছাড়া কাউকে ভুলে যাওয়াটা একটা ধীর প্রক্রিয়া। এই তাৎক্ষণিক ভুলে যাওয়ার প্রচেষ্টা সেখানে বরং আরও বেশী বেশী মনে করিয়ে দেয় অতীতকে এবং গৌস্টার-কে।
এর প্রতিক্রিয়ায় তাঁদের মধ্যে বরং নতুন ধরনের অবসেশন এমন কি স্টকিং বিহেভিয়ারের জন্মও নিতে দেখা যায়।
“দেখি তো, কতটা সুখে আছো, এরকম ভাবে ছেড়ে গিয়ে?” – এ জাতীয় একটা প্রশ্ন তখন বারবার ঘুরে ফিরে আসে। আর সেটার উত্তর খুজতেই কারনে অকারনে গৌস্টারকে সোশাল মিডিয়ায়, রিয়েল লাইফে খুজে ফেরে গৌস্টি।

গৌস্টির এই খুজে ফেরাটা গৌস্টারের অগোচর থাকে না। তাই, আসলে যেমনই থাকুক, সেও সচেষ্ট হয় নিজেকে গৌস্টির চোখে অনেক সুখি, অনেক স্ট্রং দেখাতে যার অনেক কিছুই হয়তো সত্যি না। তাছাড়া অনেক সময় বিবেকের দংশনেও আক্রান্ত হয় কোনো কোনো গৌস্টার, এই ভেবে যে, “আসলেই কি কাজটা ঠিক করেছিলাম একজনকে এভাবে গৌস্টিং করে?”
এটা আরও বেশী হয়, যখন সে পরবর্তিতে এমন কারো সাথে মেশে, যে গৌস্টেড ব্যক্তিটির চেয়ে কম কেয়ারিং বা তাঁর কাছ থেকে অন্য কোনোভাবে এবিউসিড হয়ে।
দেখা যায়, গৌস্টিং পরবর্তি এই ক্ষত গৌস্টার ও গৌস্টি – উভয়কেই দীর্ঘ্যদিন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়……

সাত: কেন এই লেখালেখি
বন্ধু বললো, “কি হবে গৌস্টিং নিয়ে লিখে, গৌস্টিং কি এতে বন্ধ হবে?”
বললাম, “না বন্ধ হবে না। যতদিন স্বার্থপর, এমপ্যাথিশূন্য, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ গুলো থাকবে – গৌস্টিং চলতেই থাকবে। তবে সচেতন হলে গৌস্টিং-এ আক্রান্তগন দ্রুতই সেটা বুঝতে পারবেন। আর এতে করে আক্রান্ত পরবর্তি প্রথম তিনটা ধাপ দ্রুত অতিক্রম করতে পারবেন। তারপরেও যদি তাঁরা সাফার করতে থাকেন, বুঝবেন, তাঁদের প্রোফেশনাল হেলপ দরকার।”
“আবার গৌস্টাররা যদি বোঝেন, এভাবে গৌস্টিং করে শর্টরানে তাঁরা সফল হতে পারলেও রেপুটেশন খুইয়ে লংরানে তাঁরা ভালনারেবল হয়ে যাচ্ছেন, অন্যরা সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁদের আর আস্থায় নিতে পারছে না, তাঁদের কেউ কেউ নিরুতসাহিত হবেন। লাভের মধ্যে এটুকুই…”
প্রযুক্তি নিজে থেকে কোনো সমাধান দেয় না। কিন্তু তার অপব্যবহার মানুষ চিনতে সাহায্য করে।
একটা গল্প শুনাই।
হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম, আমার এক ফেবু বন্ধুর আত্মীয়া আমাকে ব্লক করেছে। তাঁর সাথে আমার কোনো পরিচয়, দেখা সাক্ষাৎ কিছুই নাই।
অবাক হলাম, “কেন তাহলে এই ব্লক?”
ভেবে দেখলাম তাঁর কোনো কোনো পোস্টে আমার ঐ ফেবু বন্ধু ট্যাগ থাকতেন।
বন্ধু আছে দেখে আমি সেগুলো লাইক দিতাম।
আর উনি ভাবলেন, আমি ওনার পোস্ট লাইক দিচ্ছি, আমার নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে।
পরে জানলাম। একবার নাকি উনি কি একটা ধরা খেয়েছিলেন সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে। তারপর থেকে উনি “ঘর পোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয়ে তড়পান!!!”
উনিও এই ব্লকের অপব্যবহার করে ওনার এই অতি সন্দেহ প্রবণতা জানান দিয়ে গেলেন…
হ্যাবিচুয়াল গৌস্টাররাও এরকম নির্বিচার গৌস্টিং করে যাবেন আর তাঁদের রেপুটেশন হারিয়ে মাটিতে নামবেন।

কিছু কিছু স্ট্যাডি বলছে, একবার গৌস্টেড হওয়া মানুষেরা আজকাল সঙ্গি নির্বাচনে আগের থেকে সতর্ক। এটা ভাল। গৌস্টিং যখন এসেই গেছে, যেকোনো সম্পর্কের শুরুতেই তাই খোলাসা করে নেয়ার সুযোগ কিন্তু তৈরী হয়েছে এটা বলে নেয়ার যে “সম্পর্কটাকে গৌস্টিং মুক্ত” রাখার।
এতে করে যদি গৌস্টিং নামক ব্যাপারটার লাগাম একটু টেনে ধরা যায়…

(পুনশ্চ: এক গৌস্টির অভিজ্ঞতা লিখতে চাচ্ছিলাম। ভাবছি সেটা নিয়ে আলাদা করে পরে সিরিজ লিখবো কারন এটা বেশী বড় হয়ে যাচ্ছে…)

৪,৯৭০ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “গৌস্টিং: নতুন অনলাইন উৎপাত-৩”

  1. রেজা

    পারভেজ ভাই, আপনার তিনটি লেখাই পড়লাম। অনেক কিছু জানতে পারলাম।


    বিবেক হলো অ্যানালগ ঘড়ি, খালি টিক টিক করে। জীবন হলো পেন্ডুলাম, খালি দুলতেই থাকে, সময় হলে থেমে যায়।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : পারভেজ (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।