কাহলিল জিবরান পড়তে বসে মনে উঁকি দেয়া কিছু টুকরো ভাবনা


“Your children are not your children.
They are the sons and daughters of Life’s longing for itself.
They come through you but not from you,
And though they are with you yet they belong not to you.”
Kahlil Gibran

১৯৯২-এ যখন আমাদের বিয়ে হয়, আমি তখন সদ্য সাতাশে। উনি তখনো একুশ পেরোননি।
বিয়ের ষষ্ঠ দিনে আমরা সংসার করতে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেই মহানগরের চেয়ার কোচে।
এরেঞ্জড ম্যারেজ বলে তখনো খুব একটা পরিচিত নই আমরা। একই রুমে একখাটে ঘুমাই ঠিকই কিন্তু তাঁর পোশাক বদলের সময় আমার বাইরে বেরিয়ে গিয়ে অপেক্ষা করা লাগে।
এরকম একজন অর্ধ পরিচিতের সাথে কি সাহসের সাথেই না সেই তরুণ বয়সে তিনি তাঁর যাত্রা শুরু করেছিলেন!
২-৪ দিন হালিশহরের অফিসার্স মেসে কাটানোর পর বাসা পেলাম।
৪ বেডের বিশশাল বাড়িতে সংসার শুরু করার পর জানতে চাইলাম, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ওনার পরিকল্পনা কি?
যেহেতু পড়াশুনা করছেন, কাঙ্খিত উত্তর ছিল, “অনার্সের পর” বা এজাতীয় কিছু একটা।
কিন্তু আমাকে অবাক করে উনি ভিন্ন এক উত্তর দিলেন।
“তোমাকে তো এখনো ভাল মত চিনিই না। আগে ভাল করে চেনা-পরিচয় হোক। একটা সন্তান যার সাথে শেয়ার করবো, সে কেমন মানুষ, ভাল করে জানতে-বুঝতে হবে না?”
“বুঝলাম, কিন্তু, এই অর্ধ-পরিচিতের সাথে যে একা একা এতটা দূরে চলে এলে, তখন সংশয় হয় নাই কোনো?”
“হ্যাঁ হয়েছে। কিন্তু সে রিস্ক তো নিজের উপর। নিজের জীবনের ওপর রিস্ক নেয়া আর এখনো পৃথিবীতে আসে নাই, এমন এক শিশুর সারাটা জীবনের ওপর রিস্ক নেয়া কি এক হলো?”
সেই থেকে উনি আমাকে চিনে যেতেই লাগলেন। আর আমাদের ভাবী সন্তানের পৃথিবীতে আগমন পেছাতেই থাকলো।
এরপর একসময় উনি আত্মীয় স্বজনদের প্রশ্নের মুখে পড়ে যখন আর উত্তর করতে পারছেন না, আমাকে জানালেন, এখন সময় হয়েছে চেষ্টা করার।
আমরা চেষ্টা করলাম, চেষ্টায় কাজও হলো।

গল্পটা বললাম এজন্য যে একটি সন্তানের পৃথিবীতে আসা না আসায় বাবা-মা, তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা – এগুলো সবই উপলক্ষ, কারন না।
এ নিয়ে তাই গর্বেরও কিছু নাই, মন খারাপ করারও কিছু নাই।
এটা কোনো সাফল্যও না ব্যার্থতাও না। এটা শুধুই প্রকৃতি থেকে পাওয়া দায় নির্বাপন।
অথচ কত কত মানুষই না এই ব্যাপারগুলো নিয়ে অকারণ গর্বে মেতে উঠে সরল সহজ জীবনটা কী ভীষণ কঠিন করে ফেলি?
নিজের তো বটেই, সন্তানেরও।
কেন এত সব অকারণ দক্ষযজ্ঞ???


You may give them your love but not your thoughts,
For they have their own thoughts.
You may house their bodies but not their souls,
For their souls dwell in the house of tomorrow,
which you cannot visit, not even in your dreams.”
Kahlil Gibran

এ’স শেষ করে, এ-টু শুরুর আগে আনীলা বললো, “বাবা, আমাকে কি বিদেশে পড়তে পাঠাবা? তাহলে কিন্তু এখন থেকেই প্রিপারেশন শুরু করা লাগবে। আমার বন্ধুদের প্যারেন্টসরা শুরু করেছে”।
বললাম, “তোমাকে পাঠাবো, এটাও ঠিকা না। আবার পাঠাবো না, এটাও ঠিক না”।
অন্যরা যাচ্ছে, সেটা দেখে না, বরং তোমার নিজেকে দেখে, নিজের এবিলিটি ও রেজাল্ট দেখে বুঝতে হবে, তুমি কোন লেভেলে বিলং করো। তোমার বিদেশে যাওয়াটা উচিৎ নাকি অনুচিত”।

ঐ যে দেখো, বাসার সামনে রাস্তায় যারা ক্রিকেট খেলে, ওরা হলো পাড়ার লেভেলের খেলোয়ার।
তোমার কোচিং-এর পাশে, ধানমন্ডি মাঠে যাদের খেলতে দেখো, তাঁরা লীগ পর্যায়ের। স্টেডিয়ামে যারা খেলে তাঁরা জাতিয় পর্যায়ের। আর শাকিব-তামিমরা হলো বিশ্বমানের।
এই পাড়ার ছেলেদের মধ্য যদি শাকিব-তামিমদের মত কেউ থাকে, তাঁর জন্য ধানমন্ডি মাঠে পৌছুনো, সেখান থেকে স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়া আজকাল আর অসম্ভব কিছু না।
কিন্তু যে আসলেই পাড়ার মানের, তাঁকে যদি জোর করে ৪ নাম্বার রোডের ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করি, কিছু উন্নিতি হবে কিন্তু সে লিগপর্যায়ে পৌছানোর উপযুক্ত হবে না। মাঝখানে খালি খালি সে কষ্ট পাবে।
বেশ কিছু পাবলিক পরীক্ষাতো দিলা। দেড়-দু’শ সহপাঠির সাথে তো পড়ছো, নিজের লেভেলটা বুঝতে চেষ্টা করো। তোমার যদি মনে হয়, তুমি বিশ্বমানের, তাহলে যাও বিদেশে। আর তা মনে না হলে, দেখো, কোথায় তুমি ফিট হও।
কারন হলো, শাকিব-তামিমদের ঘরে বসিয়ে রাখা বা জোর করে পাড়ার ক্রিকেট খেলানোটা যে পর্যায়ের অন্যয়, পাড়ার লেভেলের ক্রিকেটারদেরকে ঠেলে বিশ্বপর্যায়ে পাঠানোটা তারচেয়েও বড় অপরাধ।

আমি এসবই তাঁকে বলেছিলাম, তাঁর প্রতি থাকা ভালবাসা থেকে। সে সেটা বুঝেছিল বলেই এরপর ক্যারিয়ার সিলেকশন, চয়েস অব সাবজেক্ট – এসব নিয়ে আমার আর কিছু তাঁকে বলা লাগে নাই। সে যা বেছে নিয়েছে, নিজের যোগ্যতায় ও নিজের আগ্রহেই। আমি তাঁর ও তাঁর সিদ্ধান্তের উপর আস্থা রাখছি এবং সেজন্য তাঁকে আমার সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছি।

আগে শুনতাম, মেডিক্যালে পড়া নাকি বেশ কঠিন। সপ্তাহের ছয়দিন, দিনে ৬-৭ ঘন্টা করে ক্লাস রুটিন দেখে ভাবলাম, “বাব্বা, এত পড়া পড়ে ক্যামনে” (বিজনেসের ক্লাস বেশিরভাগই সপ্তাহে চারদিন, দিনে ৩ ঘন্টা করে)?
আনীলা এবার ফোর্থ ইয়ারে উঠবে। ওকে দেখে আমার মনেই হয় না, তেমন কঠিন বা ইনটেন্স কোনো লেখাপড়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
নিজে আগ্রহ নিয়ে, নিজের এবিলিটি বুঝে নিজে থেকে ক্যারিয়ার বেছে নিতে পারলে হয়তো এমনটা সম্ভব।


You may strive to be like them,
but seek not to make them like you.
For life goes not backward nor tarries with yesterday.

আমার শিক্ষকদের আমি সবসময় প্রেজেন্ট টেন্সে পরিচয় দিলেও স্টুডেন্টদেরকে পাস্ট টেন্সে বর্ননা করি।
আমি দেখেছি, আমার অনেক স্টুডেন্টের কাছ থেকেই এখন আমার শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছুই আছে। তাই তাঁদের ছাত্রত্ব এখন পাস্ট টেন্সের ব্যাপার।
একসময় যাদের পড়িয়েছি, এখন তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা পেতে কিন্তু দারুন লাগে।
না, সবসময়ই এই শিক্ষাগুলি একাডেমিক শিক্ষা না।
অনেক সময়ই এগুলোর মধ্যে নিজেকে উন্নততর করার, নিজেকে চেনার, একজন আরও ভাল মানুষ হবার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত।
এই যেমন, একদিন, এক পুরনো স্টুডেন্টের সাথে আলাপ করতে গিয়ে জানলাম, তাঁদেরকে যখন বিজনেস স্ট্যাটিসটিকস বা অপারেশনস ম্যানেজিমেন্ট পড়িয়েছি, এগুলো কেন তাঁরা পড়ছে, সেই ব্যাপারগুলো শুরুতেই খুব একটা না বোঝায় তাঁর শেখার মটিভেশন ক্ষুন্ন হয়েছিল। শেখার আগ্রহের অভাব বোধ করেছে সে।
যতদিনে সে ব্যাপারটা জেনেছে, বুঝেছে, মটিভেটেড হয়েছে – অনেক দেরী হয়ে গেছে। কোর্সে তাঁর আর সেরকম ভাল করা হয়ে ওঠে নাই।
আমি এই ফিডব্যাকটা খুব গুরুত্বের সাথে নিলাম। বিইউপিতে গত সেমিস্টারে নেয়া কোর্সে এটা নিয়ে কাজ করলাম। সেমিস্টার শেষে আমার মনে হলো, স্টুডেন্টরা অনেক বেশী আগ্রহ ও উৎসাহ নিয়ে কোর্সটা করেছে।
ভাল গ্রেডের পাশাপাশি ভাল শিখেছেও।

এতো গেল প্রোফেশলান অর্জনের কথা।
ব্যক্তি আমিও আমার এসব প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে আরও কত কত বিষয়ে যে প্রতিনিয়ত শিখছি এবং শিখে শিখে লাভবান হচ্ছি, তার ইয়ত্তা নাই।
নারীবাদ সম্পর্কে জানা, হোমোফোবিয়া থেকে বেরিয়ে আসা, নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে ধারনা পাওয়া – এজাতীয় আরও অনেক অনেক বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানের লীড আমি পেয়েছি কোনো না কোনো স্টুডেন্টের সাথে সংশ্রাব থাকার কারনেই।

আগামী দিনটাকে যারা সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাবে, তাঁদের উপরে আস্থা রাখতে যারা না পারে, তাঁদের দীনতাকে করুনা করা যায় কিন্তু এজন্য তারুন্যকে দোষারোপ করা যায় না। তারুন্যের উপরে আমাদের আস্থা রাখতেই হবে, তাঁদের এগিয়ে যাবার পথ করে দিতেই হবে। এটা করতে না পারলে সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি – কোনো কিছুই এগুবে না…

৫,৫৭৯ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “কাহলিল জিবরান পড়তে বসে মনে উঁকি দেয়া কিছু টুকরো ভাবনা”

মওন্তব্য করুন : পারভেজ (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।