সুইসাইড প্রিভেনশন নিয়ে ভাবনা

এক
প্রায়ই দেখি কোনো সেনসেশনাল বা ওয়েল সার্কুলেটেড সুইসাইড কেইস পেলেই এক দঙ্গল মানুষ বিশ্লেষণ করতে বসে যান – কি ছিল সেই আত্মহত্যার কারন।
এজ ইফ, ঐ ঘটনাটা না ঘটেলে যেন এই আত্মহত্যাটি আর ঘটতো না।
এই প্রচেষ্টার মধ্যে মারাত্বক কিছু ভুল আছে।
প্রথমেই জানা দরকার, মানুষ আত্মহত্যা কেন করে?
আমেরিকায় পরিচালিত স্টাডি বলছে ৯০%-এর চেয়েও বেশি আত্মহত্যাকারীর কোনো না কোনো ডায়াগনাইজড বা আনডায়াগনাইজড এমন মানসিক রোগ থাকে, যেগুলার একটি সিম্পটম হলো “আত্মহত্যা প্রবনতা”।
মনে রাখা দরকার, আত্মহত্যা প্রবনতা নিজে কোনো রোগ নয়, কিন্তু এটা – বাইপোলার ডিজ-অর্ডার, স্কিজোফ্রেনিয়া, ডিপ্রেসিভ ডিজ-অর্ডার, এংজাইটি ডিজ-অর্ডার ইত্যাদি মানসিক রোগাক্রান্তদের অসুস্থ্যতাকালিন একটি লক্ষন।
এই মানসিক রোগাক্রান্তগন আত্মহত্যা প্রবন অবস্থায় যখন এমন কিছু দ্বারা ট্রিগার্ড হন যা তাঁর কাছে ঐ ট্রিগার্ড পরিস্থিতি উত্তরনের উপায় বলে মনেহয় – তাঁরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
মোট আত্মহত্যাকারীদের ৯০% আত্মহত্যার ভিক্টিমদের ক্ষেত্রেই যে কারনটিকে আমরা “আত্মহত্যার কারন” হিসাবে ভাবছি, সেটা আসলে আত্মহত্যার ট্রিগার, কারন নয়। আত্মহত্যার আসল কারন হলো তাদের আত্মহত্যা প্রবনতা যা তাদের মানসিক অসুস্থতার অনেক লক্ষনের একটি।
তাই এই ৯০%-এর আত্মহত্যার ঝুঁকি কমাতে ‘কারন মনে করা’ ঐ ট্রিগার দূর করা বা করতে চেষ্টা করা কোনো সমাধান না। কারন একজন আত্মহত্যা-প্রবন কিসে ট্রিগার্ড হবেন, তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না। এই কারনে, সম্ভাব্য সকল ট্রিগার খুজে বের করে তা থেকে তাঁকে নিবৃত্ত করাও সম্ভব না।
যেটা সম্ভব, তা হলো:
১) কারো এমন কোনো মানসিক সমস্যা আছে কিনা যা তাঁকে আত্মহত্যা-প্রবন করতে পারে – সকল স্টিগমার উর্ধে উঠে আগে সেটা নির্ধারন করা।
২) এটা নির্ধারিত হলে তাঁকে নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়ে যেতে উৎসাহ ও সহায়তা প্রদান করা।
৩) চিকিৎসারত অবস্থায় বা চিকিৎসার বিরতিকালিন অবস্থায় তাঁর মধ্যে নতুন করে কোনো আত্মহত্যা-প্রবনতা দেখা দিচ্ছে কিনা, সেদিকে লক্ষ রাখা।
৪) যখনই কোনো কার্যকলাপে তাঁকে আত্মহত্যা-প্রবন বলে মনে হবে, তাৎক্ষনিক ভাবে তাঁকে চিকিৎসকের সরনাপন্ন করা অথবা সরনাপন্ন হতে উৎসাহ দেয়া।

এইভাবে আত্মহত্যা-প্রবনদের অর্থাৎ মোট আত্মহত্যার ৯০% প্রিভেন্ট করা গেলেও বাকি সেই ১০% আত্মহত্যা এইভাবে প্রিভেন্ট করা যাবে না (কারন তা করতে আত্মহত্যা-প্রবন হওয়ার দরকার পড়ে না), নীচে তা নিয়ে আলোকপাত করছি।

দুই
৯০% সফল সুইসাইড আত্মহত্যা-প্রবনরা করে বলে বাকি ১০% কে ইগনর করতে বলি নাই।
যেটা বলতে চেয়েছি, তা হলো, আত্মহত্যার কারন হিসাবে দৃশ্যমান ঘটনাটিকে নয়, বরং ভিক্টিমের মানসিক অবস্থাকে বেশি গুরুত্ব দিতে বলেছি।
আরো কিছু তথ্য দেই, যা দেখলে এই যুক্তিটিকে যেন আরও বেশি গ্রহনযোগ্য মনেহয়।
আমেরিকায় গড়ে বছর ৪০ হাজারের মত সফল সুইসাইডের ঘটনা ঘটলেও এটেম্পটের ঘটনা ঘটে ১০ লাখের মত।
যে ৩৬ হাজার আত্মহত্যা-প্রবন এসব এটেম্পটে সফল হন, তাদের বড় একটা অংশই তা হন সেকেন্ড বা থার্ড এটেম্পটে।
সেই অর্থে আত্মহত্যা-প্রবনদের এটেম্পট করার হার সাকসেসের দুই থেকে আড়াই গুনের মধ্যেই হবে। তার বেশি নয়।
অর্থাৎ আশি হাজার থেকে ১ লাখ সুইসাইডাল মানুষ এটেম্পটে করে সেখান থেকে ৩৬ হাজার সফল হন।
এর কারন হলো এই যে, মানসিক সমস্যায় ভোগাদের প্রিপারেশন ভাল থাকে এবং তাঁরা সেটা করেন সাফল্যের জন্যই।
তারমানে দাড়াচ্ছে, আত্মহত্যা-প্রবন না হয়েও, যে চার হাজার সফল হন, তাদের মধ্যে এটেম্পট করার হার আসলে অনেক অনেক বেশি।
নয় লাখ বা তারও বেশি ঐরকম নন-সুইসাইডালের মধ্যে মাত্র ৪ হাজার সফল – ব্যাপারটাকে তাই “খুব সিরিয়াস মৃত্যু-প্রচেষ্টা না বলে বরং একসিডেন্টাল ডেথ হিসাবেও গন্য করার সুযোগ থেকে যায়।
আসুন এটার আরেকটু ব্যাখ্যা করি।
দেখা গেছে নন-সুইসাইডালরা যে সব কারনে এটেম্পট করেন, তাঁর একটি হলো, অতি যন্ত্রনা দায়ক কোনো রোগ আর সহ্য করতে না পেরে যন্ত্রণা অবসানে।
এদের এটেম্পট টু সাকসেস রেইট অতি উচ্চ হবার কথা।
ঐ চার হাজারে এরা যদি ১ হাজার হন, তাহলে এটেম্পটের সংখ্যা দু’চার হাজারের বেশি হবার কথা না।
কারন এরা কাজটা করছেন খুব পারপাজফুলি এবং একটা মটিভেশন নিয়ে যন্ত্রনা মুক্তির জন্য।
বাকি যারা আছেন, তাঁরা মানে প্রায় নয় লাখ মানুষ এটেম্পট করেন দুই কারনে:
১) মানসিক সমস্যা ছাড়াই কোনো এক্সটারনাল কারনে সাডেন লো হবার জন্য যেমন: ড্রাগ বা সাবস্ট্যান্স এবিউজের কারনে অথবা অতি ঘনিষ্ট কারো মৃত্যু বা বিচ্ছেদজনিত কারনে বিহ্ববল হয়ে।
২) কোনো একটি সমস্যা কমুনিকেশনের আর কোনো উপায় যখন দেখে না, তখন সুইসাডাল এটেম্পটকে একটি দৃষ্টি আকর্ষনি ইনুস্ট্রুমেন্ট হিসাবে ব্যবহারে প্রবৃত্ত হয়ে।

একটু ভাবলেই বোঝা যাবে, এরা যে পদ্ধতিগুলা ব্যবহার করে, সেগুলা আসলে খুব ভেবে চিন্তে বেছে নেয় না। আর মরাটা এই দুই দলের জন্য প্রায়োরিটিও না।
প্রথম দল চেষ্টাটা করে তাৎক্ষনিক আবেগে পড়ে আর দ্বিতীয় দলের মূললক্ষ্য থাকে মরা না, বরং কমুনিকেট করা।
এই দুই কারনই খুব মৃত্যুবান্ধব নয়। তাই এদের এটেম্পট সাকসেস রেশিও এত খারাপ।
বরং বলা যায়, এর মধ্যে যে সাকসেসগুলা ঘটে, হয়তো সেগুলা মোর অব একসিডেণ্ট!!!

তিন
প্রথমে এদেশিয় কিছু তথ্য
১) এদেশে নারীদের মধ্যে বিষন্নতায় আক্রান্ত হবার হার পুরুষদের চেয়ে দ্বিগুনেরও বেশি।
২) আত্মহত্যার হার প্রায় চারগুন।
৩) সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পদ্ধতি স্ট্যাঙ্গুলেশন ও বিষপান। এর মধ্যে স্ট্যাঙ্গুলেশন হলো সবচেয়ে কম খরচে ও হাতের কাছে পাওয়া উপকরন দিয়ে কার্যকর করা যায়।
৪) বছরে আত্মহত্যার ঘটনা রিপোর্টেড হয় ২০ হাজারের মত। এক্সিডেন্টাল মৃত্যুর কারন হিসাবে এটা টপটেনের একটি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, আত্মহত্যা প্রিভেনশনের জন্য আগের বলা বিষয়গুলির বাইরেও এদেশে যে বিষয়গুলি মাথায় রাখতে হবে তা হলো:
– নারীরা অনেক বেশি ঝুকির মধ্যে থাকে,
– সেই নারী যখন বিষন্নতায় ভোগেন, ঝুঁকি আরও বাড়ে।
– উপকরনের উপর নিয়ন্ত্রন আনা ঝুঁকি কমায় না।
বরং যা করা যায়, তা হলো, স্ট্রেসের সোর্সগুলি চিহ্নিত করে সেগুলা শিথিল করা যেন কোনো বিষন্নতা তাদের গ্রাস না করে।
কিছু ব্যাপার অনেককেই ধরে নিতে দেখি, যেগুলা ভুল:
ক) “আত্মহত্যা করা খুব সাহসের ব্যাপার”। ব্যাপারটা মোটেও তা না। যারা এটা করেন, তাঁরা নিরুপায় হয়েই এটা করেন। নিরুপায় হয়ে করা একটি কাজে সাহসিকতার কিছু নাই। যা আছে তা হলো অসহায়ত্ব। একজন নিরুপায় মানুষের অসহায়ত্বের দিকে নজর দিন। “ওর কি আর এত সাহস হবে” – ভেবে নিশ্চিন্ত থাকবেন না।
খ) “আত্মহত্যাকারী হলো স্বার্থপর”। না, বেশরভাগ ক্ষেত্রেই ওরা বরং খুবই সহানুভুতিশীল। আর এই সহানুভুতিটা থাকে বলেই নিজের সমস্যা ম্যানেজ করার ঝামেলা থেকে ঘনিষ্টজনদের মুক্তি দিতে নিজের প্রানের বিনিময়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে বেশিরভাগ সময়।
তাই, যে “অন্যকে ফুলের টোকা”-ও দেয় না, অথবা যার “সবার জন্য কত মায়া” তাঁকে নিয়ে “সে কি আর সুইসাইড করবে?” ভেবে নিশ্চিন্ত হবেন না।
তাঁর সমস্যা চিহ্নিত করুন, সমাধান করুন।
নইলে দুর্ঘটনা একবার ঘটে গেলে সারাজীবন কিন্তু বুক চাপড়াতে হবে…

পুনশ্চ:
কখনো আত্মহত্যা-প্রচেষ্টা করেছেন, এমন কেউ যদি আত্মহত্যার হুমকি দেয় – ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেবেন না।
সিরিয়াসলি নেবেন।
তাঁর কাছ থেকে যে কোনো বিষয়েই সতর্ক থাকবেন।
সম্ভব হলে ১০০ হাত দুরত্ব বজায় রাখবেন তাঁর ও আপনার নিরাপত্তার স্বার্থেই।
সে যেন কোনো কারনে আপনার কোনো কাজে জীবনেও আর উত্যক্ত বোধ না করে, সে বিষয়ে যত্নবান হোন।

৫,৬১৯ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “সুইসাইড প্রিভেনশন নিয়ে ভাবনা”

  1. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    জরুরী পোস্ট।

    আমাদের দেশে শারিরীক স্বাস্থ্য নিয়ে লোকজন যতোটা চিন্তিত তার সিকিভাগ সচেতনতাও যদি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে থাকতো! এদেশের সিংহভাগ মানুষের ভাবনা এখনো ভাত কাপড়েই কেন্দ্রীভূত। মনের যে অসুখ হয় এবং মনেরও যে চিকিৎসা দরকার সেটির গুরত্ব অনেকেই অনুধাবন করেন না।

    তোমাকে অনেক ধন্যবাদ জরুরী বিষয়ে আলোচনা করার জন্য, ভাইয়া।

    :clap: :clap: :clap: :clap: :clap: :clap:

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      পড়ার ও মন্তব্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, সাবিনা...
      ভাল আছো তো?
      অনেকদিন হলো কিছু লিখছো না।
      তাড়াতাড়ি কিছু লিখে পাঠাও।
      তোমার কোনো একটা লিখা নিয়ে আবারও আমরা এখানে কিছু আড্ডাবাজি করি...
      😀 😀 😀 😀 😀


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
  2. উনার একাকিত্ব ছিলো। মরে পচে গেলেও দেখার কেউ নেই।তাই এ কাজ করেছে।
    তিনি বিয়ে করলে একাকিত্ব avoid করতে পারতেন। আর মরার চিন্তাও আসতো না। সুরা নিসায় এটাই সমাধান আছে। ধন্যবাদ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহমদ (৮৮-৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।