পিতা-কন্যার হ্যাং আউট-১

অনেক সময়ই দেখা যায়, একটা বয়সে পৌছুলে পুত্ররা আর বাবা-মায়ের সাথে বেরুতে চায় না।
এটার একটা কারন হতে পারে এই যে, মামা’স বয় বা ড্যাডি’স বয় – এদুটো পরিচয়ের কোনোটাই তারা পেতে চায় না।
কন্যারা এই দিক দিয়ে সুবিধায় থাকে। মামা’স গার্ল হতে কিছু আপত্তি থাকলেও ড্যাডি’স গার্ল হতে তাদের কারোরই কোনো আপত্তি থাকে না।
বাবার সাথে তারা শুধু যে বেরোয়, তাই না, ব্যাপারটা বেশ এনজয়ও করে।
আমি এই ব্যাপারটা আগে খুব একটা লক্ষ করি নাই।
সম্প্রতি ফেসবুকে “হ্যাং আউট উইথ ড্যাড” বা কাছাকাছি শিরোনামে কিছু কিছু উচ্ছসিত ছবি সম্বলিত পোস্ট দেখে ভাবতে বসলাম, “তাই তো, আমার কন্যাদের জন্যেও কি এমনতরো কোনো উপলক্ষ হয়েছিল, যা নিয়ে এমন উচ্ছ্বাস জানানো যায়।


আমার বড় মেয়ে আনীলার সাথে এমন একটা হ্যাং আউটের সুযোগ প্রথম হয়েছিল বেশ অনেক বছর আগে। তখনও প্রি-স্কুলে পড়ে সে।
সেবার ঈদে আমার আব্বা-আম্মা গ্রামে যাচ্ছেন তাদের গাড়ি নিয়ে। অনেক খালি জায়গা থাকায় বললেন, যাবো কিনা?
আনীলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “যেতে চাও?” দেখলাম, বাবার সাথে গ্রামে যেতে এক কথায় রাজী হয়ে গেল।
পরদিন আমি আর আনীলা ওর দাদা-দাদীর সাথে গাড়িতে চেপে বসলাম নড়াইল জেলার অন্তর্গত লোহাগড়া উপজিলার ইতনা গ্রামের উদ্দেশ্যে।
বিকালের আগেই পৌছে গেলাম গ্রামে।
এরপর একখানা বাইসাইকেল যোগাড় করে তার রডে আনীলাকে বসিয়ে শুরু হলো আমার আর আনীলার গ্রাম-দর্শন তথা ঘুরাঘুরি।
ইতনা স্কুল, লাইব্রেবী, পুজা-মন্ডপ, বাজার, চাঁড়ালদীঘির বিল, নিহার রঞ্জন গুপ্তের পৈত্রিক ভিটা, বামুনবাবু বিদ্যাসাগরের দালানের অবশিষ্টাংশ – কত কত জায়গায়ই যে আমরা পিতা-পুত্রী বাইসাইকেলে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছি, সবটা মনেও নাই।
এত কিছুর মধ্যে আনীলা খুব মজা পেয়েছিল ১) শ্যালো মেশিন দিয়ে মাটির নীচ থেকে পানি উঠানো দেখে আর ঢেঁকিতে ধান ভানতে দেখে। ঐ ছোট্টো ভ্রমনেও আমরা গ্রামের একটা বিয়ের আসরে গিয়েছিলাম। রঙিন কাগজ কেটে বিয়েবাড়ি সাজানো আর কলাগাছ দিয়ে বিয়েবাড়ির গেইট বানানো দেখাটা ওর জন্য ছিল খুবই চমকৃতকর অভিজ্ঞতা।
কথা ছিল, রাতে দাদীর সাথে ঘুমাবে আনীলা। আর ফিরেও আসবে তাঁদের সাথে। আমার ছুটি শেষ হয়ে যাবে বলে আগে আগেই চলে যাবো আমি একা একাই।
দেখা গেল, দুটোর কোনটায়ই আর আনীলা রাজী না। রাতে আমার সাথেই ঘুমালো যে’কদিন ছিলাম। আর আমার আসার দিন গো ধরলো, আমার সাথে ফিরে যাবার জন্য। আমাকে ছেড়ে একা একা থেকে যেতে নাকি মন টানছে না ওর।
অথচ টিকেট তো করি নাই ওর জন্য? তাছাড়া ঈদের পরপরই বলে কথা। কোনো টিকেটও পাওয়া যাচ্ছে না।
গাড়ির লোকজন ভাল ছিল। বললো, “ছোট মানুষ কোলে নিয়ে নেন, আমাদের কোনো আপত্তি নাই।”
বাবার সাথে হ্যাং আউটে গিয়েছে তাই বাবার সাথেই ফিরবে আনীলা – এইজন্যই লক্ষিপাশা থেকে ঢাকা পর্যন্ত একসিটে আমরা দুই পিতা-পুত্রী ফিরলাম। একটু কষ্ট যে হয় নাই, তা না, কিন্তু ভালও লেগেছিলা ওর এই আমাকে ছাড়তে না চাওয়াটা।


এটা ২০০৪-এর ঘটনা। খালা-খালু যাচ্ছেন চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার। বললেন, “যেতে চাও?”
আনীলাকে বললাম, “যাবা?” আনীলা বললো, “খুব ভাল হয়। ট্রেনে ওঠাটা ভাল ভাবে হয়ে যাবে।” সে তখন কেবল টু শেষ করে থ্রীতে উঠছে।
চট্টগ্রামে একরাত থেকে পরদিন কক্সবাজারে যাবো। কথা ছিল, আনীলা রাতে ঘুমাবে আমার খালাতো বোন মৌ-এর সাথে। সারা রাস্তা এসব পরিকল্পনা করেই পৌছুলাম।
পৌছানোর পর কোথাকার পরিকল্পনা কোথায় চলে গেল।
ঘুমানোর সময় ঘনিয়ে এলেই দেখা গেল, গুটিসুটি হয়ে আমার কাছে এসে হাজির।
“বাবা, তোমার সাথে ঘুমাবো।”
“আচ্ছা মা, ঘুমাও।”
পরদিন কক্সবাজার পৌছুতে পৌছুতে বিকাল হয়ে গেল। বারো বছর পরে কক্সবাজার গেলাম। বেশ অপরিচিতই লাগছিল।
ঠিক হলো, পরদিন মহেশখালি যাবো।
ওখানে থাকতেই জানলাম, সাগরে অস্বাভাবিক ধরনের বড় বড় ঢেউ হচ্ছে। কোনো সিগনাল নাই, তাই ওরা কেউ বুঝতে পারছে না, ঘটনা কি।
যাহোক, তার মধ্যেই ফিরলাম বিকালে। ফিরেই সোজা বিচে।
বিচে পৌছুনোর পরে বীচ দেখে তো আমি অবাক। সাগর অনেক দূরে সরে গেছে। সবসময় পানির নীচে থাকে যে কালো বালু, তা বেরিয়ে এসেছে। তা দেখে লোকজন ছুটছে দেখার জন্য, “ঘটনা কী?”
আমার কাছে অস্বাভাবিক ঠেকলো ব্যাপারটা। সাগরের এত পানি, গেল কোথায়? সী-লেভেল তো দেখছি ফুট দুয়েক নেমে গেছে, ভাবছি, এটা কি ভাবে সম্ভব?
এদিকে অন্যদের ঐ কালো বালির দিকে ছুটতে দেখে, আনীলাও গো ধরলো ওটা দেখতে যাবার।
স্থানিয় এক ফেরিওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “সাগর এত দূরে ক্যানো?”
সে বললো, “জানি না স্যার। জীবনেও তো এমন দেখি নাই। কি জানি একটা হয়েছে। দেখেন না আমরা ওদিকে যাচ্ছি না।”
দেখলাম, তাই তো, যারা এগুচ্ছে, তারা অস্থানীয়। স্থানিয়রা সবাই নিরাপদ দূরত্ব বজিয়ে রাখছে।
আমি আনীলাকে যতই বুঝাতে চেষ্টা করলাম, কিছু একটা সমস্যা আছে, ওদিকে যাওয়া যাবে না, ও ততই বেশি জেদ করতে লাগলো ওদিকে যাবার জন্য। ওর যুক্তি পরিষ্কার, “ঐ দেখো না জোয়ারের ফ্ল্যাগ? তাঁর মানে সাগরে যাওয়া যাবে।” আমিও বুঝাতে গলদঘর্ম হচ্ছি যে জোয়ারে পানি এত দূরে থাকে না।
এর মধ্যে খালাদের দেখি ওদিকে একটু একটু এগুচ্ছেন। আমি আনীলাকে শক্ত করে ধরে তাঁদের ডেকে বলছি, “বেশিদূর যাবেন না, কি একটা ঝামেলা আছে আজ সাগরে……” – বলে শেষ করতে পারি নাই। হঠাৎ দেখলাম অনেক দূরে সরে যাওয়া সাগরের উপর দিয়ে একটু ফেনা ফেনা কি জানি দেখা যাচ্ছে। দেখছি আর ভাবছি, কি হতে পারে ওটা?
কিছু বোঝার আগেই দেখলাম কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামনে থাকা লোকগুলোকে ঢেউ এসে ধাক্কিয়ে কুলে নিয়ে এলো।
আমি যেখানটায় দাঁড়িয়ে, সেখানেও কোমর পানি এসে গেছে।
আনীলাকে দ্রুত কোলে তুলে নিলাম।
আশেপাশের লোকজন পানির ধাক্কায় মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। অনেকে বেকায়দায় পড়ে ইঞ্জিওর্ডও হয়েছেন।
পরে জানলাম ওটা ছিল সেই ভয়াবহ সুনামির বাংলাদেশ পর্ব।
মহিসোপানে আটকে এদেশে তার তীব্রতা না কমলে, ঐ দিনই হতে পারতো হ্যাং আউটে থাকা আমাদের দুই পিতা-পুত্রীর শেষ হ্যাং আউট…
(চলবে)

৪,৯৪৩ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “পিতা-কন্যার হ্যাং আউট-১”

  1. বাবার সাথে এই সব সময়ের যে কি মূল্য, তা আমরা মেয়েরাই জানি ভাইয়া। তাই মেয়েদের ঝুলিতে দিতে থাকুন এমন আরো আরো অনেক মুহূর্ত। কারণ এই গুলিই হবে তাদের কাছে অমূল্য এক খনি আজীবন এর জন্যে।জানেন তো, মেয়েরা কোনোদিন আসলে বড় হয়না।
    এই আমিই কয়দিন আগে আমার এই ৩৭বছর বয়সেও বাবা-মার কাছে যেই ছোট টি হয়ে গিয়েছিলাম আর হয়ে কি যে শান্তি পেয়েছিলাম, আমার ছবি পোস্ট গুলোতে তার খুব সামান্য প্রকাশিত হয়েছিল।
    ভাল লাগলো আপনাদের হ্যাং আউট।

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      খুব ভাল বলেছো ঝুমুর।
      আসলে কি জানো, আমার এই ব্লগটা লিখছি কিন্তু আসলে সে জন্যই।
      তুমি যেটা বলেছো, আমি যে তা বুঝতে পেরেছি আর আজকাল যে খুব কনশাসলি আমি কন্যাদের জন্য হ্যাং আউটের উপলক্ষ তৈরী করে যাচ্ছি (কখনো কখনো ওঁদের মায়ের সাথে যুদ্ধ করেও) সেটা পরবর্তি পর্বে দেয়ার ইচ্ছা রইলো।
      জানলাম, এই পর্বটা ভাল লেগেছে। আশাকরি সেগুলো দেখে আগামি পর্বটা আরও বেশি ভাল লাগবে.........


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
  2. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    বাবা আর মেয়ে - এক অনন্য বন্ধন।
    মেয়েটা আমার এখন আর কাছে নেই।
    তার সাথে কাটানো সময়ের স্মৃতিগুলো আমার যেনো এক অমূল্য সম্পদ। একা হলেই জাবির কাটি, কখনো কখনো এমন কি কাজের ব্যস্ততার মাঝেও চলে সেই সব স্মৃতির দাপাদাপি। সময় চিলে গেছে বলে এখন বুঝি, ওই ঝোলাটা আরও অনেক সমৃদ্ধ করা যেতো...
    অপার ধন্যবাদ বন্ধু তোমায় এমন একটা বিষয় নিয়ে লিখবার জন্য।

    জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    একে তো ছেলে, তার উপর বাবা হবার অনেক দেরি আছে- তাই হয়ত উপলব্ধি করতে পারব না। তবে, আপনার উচ্ছ্বাসটুকু কিছুটা হলেও যেন ছুঁয়ে গেল।
    পিতা-পুত্রীর আরও অনেক 'হ্যাং আউটের' গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম! 😀


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    চমৎকার লাগলো পিতা পুত্রীর এই মধুর হ্যাং আউটের কথাগুলো পড়ে। সহজেই মন ছুঁয়ে যায়। আর ভাল লাগল প্রথম মন্তব্যটাও, ফারহানা শারমীন ঝুমুর এর।
    একটু কষ্ট যে হয় নাই, তা না, কিন্তু ভালও লেগেছিলা ওর এই আমাকে ছাড়তে না চাওয়াটা -- এই কথাটাও ভাল লাগলো।
    আমার কন্যা নেই, তাই হয়তো পুরোপুরি বুঝতে পারবোনা এসব হ্যাং আউট কতটা মধুময়। তবে দেড় বছরের একটা নাতনি আছে। ইচ্ছে আছে আর কিছুদিন পর ওকে নিয়ে হ্যাং আউটে বেড়ানোর। এমনিতেই আমার বাড়ীতে এলে আমার বুকটাই হয়ে যায় ওর বিছানা।

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      খায়রুল ভাই, অনেক ধন্যবাদ এত আগ্রহ নিয়ে পড়ার ও এত যত্ন নিয়ে মন্তব্য করার জন্য।
      আপনার বই প্রকাশিত হবার খবর দেখেছি।
      এখনো কেনা হয় নাই, পড়া হয় নাই।
      তাই মন্তব্য করি নাই।
      তবে খুবই খুশি যে হয়েছি, সেটা নির্দিধার বলতে পারি।
      আর শুধু কি খুশি, আসলে অনেক অনুপ্রানিতও হয়েছি।
      পড়ে আরও জানাবো।
      আপাতত অভিনন্দন জানিয়েই শেষ করছি...।


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      স্মৃতির পাশাপাশি এগুলো লার্নিং-এরও অগাধ সুযোগ সৃষ্টি তৈরী করে দেয়।
      মা, নানা, মামাদের সাথে আনীলা অনেকবার বিদেশে গিয়ে লাভ যেটা হয়েছে তা হলো, আজকাল কোথায় গেলে ইমিগ্রেশনসহ যাবতিয় এয়ারপোর্ট চেক-ইন চেক-আউট ফর্মালিটিতে ও থাকে আমাদের নেতা।
      সবাইকে ঠিক ঠিক মত গাইড করে প্লেন পর্যন্ত পৌছানো বা প্লেন থেকে নেমে হোটেলে পৌছুনোতে ওর দক্ষতা প্রশংসনীয়।

      আমি খুব ছোট থাকতে খুলনায় যাই।
      তখন থেকেই দেখেছি ওখানে অন্যরা ভিন্ন ধর্মের মানুষদের সম্পর্কে কথা বলতে গেলে নানান কটুক্তি করে এবং অত্যন্ত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যভাব দেখায়। এরকমটা ঢাকার পরিবেশে খুব একটা পরিচিত ছিল না। আমার শিশু মনে তখন থেকেই ব্যাপারটায় এতটা ডিটেস্ট তৈরী করেছিল যে এখনো কাউকে ওরকম করতে দেখলে রাগে গা জ্বালা ধরে যায়।
      অপছন্দ করলেও আগে বলার কিছু পেতাম না। পরে সেটাও রপ্ত করে ফেলেছিলাম।

      ভাল বা খারাপ, সব অভিজ্ঞতা থেকেই শিশুদের শিক্ষা গ্রহনে এ জাতীয় ঘোরাঘুরি অতুলনিয়.........


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : পারভেজ (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।