গুজব রটনা সম্পর্কিত সচেতনতামূলক একটি ব্লগ

অনলাইন বা অফলাইনে ছেড়ে দেয়া ও ছড়ানো রিউমার-গুজব-হোএক্স নিয়ে কিছু একটা লিখার ইচ্ছা অনেকদিনের।
লিখি লিখি করেও লিখা হয়ে উঠছিল না, নানা কারনে।
এবার লিখাটা একরকমের জরুরীই হয়ে উঠলো হঠাৎ করেই।
কেন? সে কথায় পরে আসছি। তার আগে বলে নেই, আমার প্রথম অনলাইন হোএক্সের শিকার হবার গল্পটা।
গত দশকের গোড়ার কথা। তখনও ফেবু যুগ শুরু হয় নাই।
আমাদের সোশাল মিডিয়া ছিল গ্রুপ মেইল নির্ভর।
কোনো এক গ্রুপ মেইলে একবার ভাইরাস এলার্ট পেলাম কি একখানা ফাইল মুছে দেবার জন্য। কাকড়া দর্শন আইকনটা নাকি ভয়াবহ এক ভাইরাস। ওটা ডিলিট না করলে সবকিছু নাকি শেষ হয়ে যাবে অচিরেই।
কথাটা শোনার সাথে সাথে বন্ধুদের সেটা তো জানালামই, কিন্তু তার আগে সেই ফাইলটা মুছে ফেললাম।
কিছুক্ষনের মধ্যেই এক বিশাল মাল্টি ন্যাশেনালে কর্মরত হেড অব আইটি মাইক্রোসফটে যোগাযোগ করে জানালো, ওটা ছিল হোএক্স।
সেই যে বছর পনেরো আগে একবার টাক খেয়ে শিক্ষা নিয়েছিলাম, আর কখনো সে ভুল করি নাই।
বরং একাধিক বার অন্যদের হোএক্স ছড়াতে দেখে তা করতে নিষেধ করার কারনে চক্ষুশুল হয়েছি অনেকের।

দুটো ঘটনা না বললেই নয়।
আমার খুব প্রিয় এক অপিনিয়ন লিডার টাইপের স্টুডেন্টকে একবার দেখলাম ফেসবুকে এজাতিয় একখানা সস্তা হোএক্স ফেরি করতে।
তাকে যখন হোএক্সের প্রমানসহ তা করতে নিষেধ করলাম, উত্তরে ইনবক্সে সে যা বলেছিল তা হলো এই:

The1stOneBetter

বিস্তারিত ময়না তদন্তে আর নামলাম না।
বুঝতেই পারছেন, তার আর মনেহয় কোনো দরকার নাই।
কী বলেন?

সম্প্রতি আরেকখানা একই ধরনের ফলস এলার্ম সার্কুলেটেড হতে দেখলাম পরিচিত জনদের মাঝে।
যিনি তা করছেন, তাকে সেটার যুক্তির অসারতা জানিয়ে প্রশ্ন করার পর তিনি এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন যে সোজাসুজি জানিয়ে দিলেন, আমি তাঁর এসব “গুরুত্বপুর্ন জনকল্যানমূলক” প্রচেষ্টা পছন্দ না করলে তাকে যেন সোজাসুজি ব্লক করে দেই।
তিন যা করছেন, করেই যাবেন। তাতে গুজব রটানো হোক বা না হোক, তাঁর কিছু এসে যায় না।

সেই তথাকথিত জনসচেতনামূলক স্ট্যাটাস

সেই তথাকথিত জনসচেতনামূলক স্ট্যাটাস

হোএক্স স্লেয়ার নামের এক সাইটের সাহায্য নিয়ে এসব গুজব বিরোধী প্রচেষ্টা যে সব সময় একই রকমের বাঁধা বা দুর্ব্যবহারের মুখে পড়েছে, তা নয়।
অনেকক্ষেত্রেই পাঠকগন বা সেটা বিস্তারকারিও সেগুলার অসারতা মেনে নিয়েছেন।
সরিয়ে নিয়েছেন নিজ টাইমলাইন থেকে।
ভিটামিন এ ক্যাপসুল খেয়ে শিশুদের অসুস্থ হয়ে পড়া থেকে প্রানহানী ঘটার মতো হোএক্সগুলো ব্লাস্টিং-এর সময় সেরকমের বেশ কিছু সুখকর অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল।

এবার আসি আজকের এই লিখালিখির প্রেক্ষাপট নিয়ে।
বেশ কিছুদিন ধরেই লক্ষ করছি, সিলেক্টেড কিছু কিছু পরিচিত জন ও ফেবু বন্ধুদের সম্পর্কে নানান গুজব রটাচ্ছে কেউ কেউ।
আজ একজনকে তা নিয়ে বিতশ্রোদ্ধ হয়ে কৌতুক করতেও দেখলাম।
ব্যাপারটা ভাবালো।
ভাবালো দুটি কারনে:
১) যেকোনো রিউমারের বিস্তার ঘটে এক্সপনেনশিয়ালি। এর অর্থ হলো, একজন শ্রবনকারী যদি কোন ভাবে একাধিক ব্যক্তির কাছে শোনা কথাটা বলেন, তাহলে ১০ থেকে ১২টা সাইকেল পড়েই সেটা লক্ষ লক্ষ মানুষের কানে পৌছে যায়। সমস্যা হলো, এত মানুষ যখন একটা ভুল জানে,সেটা মিথ্যা হলেও একধরনের গ্রহনযোগ্যতা অর্জন করে ফেলে।

২) যার বিরুদ্ধে গুজবটা রটে, এটা তাকে এক ধরনের বুলির সম্মুখিন করে ফেলে। কোনো অন্যয় না করেও বারংবার নানা জনকে উত্তর দিতে দিতে অচিরেই তাঁর নাভিশ্বাস উঠে যায়। আর মানসম্মানের কি ক্ষতিটা যে হয়, সে আর নাই বা বললাম…

এবার তাই গুজব রটনার মনস্তত্ব নিয়ে কিছু কথা বলি।
প্রথমেই বলে রাখি, গুজব কারা রটায়?
গবেষনায় প্রমানিত হয়েছে, তাঁরাই গুজব বেশি রটিয়ে থাকে, যারা নানাবিধ এংজাইটিতে ভোগে আর একারনে যাঁদের আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি থাকে।
অনেকক্ষেত্রেই দেখা গেছে এই সব গুজব রটনাকারী শোনা কথাটাতে মনের মাধুরি মিশিয়ে পরিবেশন করে কারন এর মাধ্যমে তারা নিজেদের একটা বিশ্বাসযোগ্য ভাবমুর্তি গড়ে তোলার ও সমাজ সচেতন প্রমানের প্রয়াস পায়।

দেখা যাচ্ছে উদ্দেশ্য আসলে কারো উপকার করা নয়, বরং নিজের স্বার্থসিদ্ধী। আর তা অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে।
এ তো গেল গুজব রটনার মনস্তত্ব। এবার দেখি গুজব যারা তৈরী করে, কিসের ভিত্তিতে তা করে তারা?
এখানেই প্রথমেই যেটা কাজ করে তা হলো অনিশ্চয়তা।
একটা কিছু ঘটেছে বা চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে অথচ দর্শক যখন তার কার্যকারন জানছেন না, অনেক সময় দেখা যায় গল্পচ্ছলে তা থেকে গুজবের সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে।
একটা উদাহরন দেই।
ধরা যাক ক, খ ও গ তিনজনই কোনো না কোনো ধরনের একাকি জীবন যাপন করছেন। ক তাঁর একাকিত্ব নিয়ে বীতশ্রোদ্ধ। নানান জটিলতার মুখোমুখি। অথচ খ কে তিনি দেখছেন হাসিখুসি উচ্ছল। হতে পারে খ তাঁর একাকিত্বের সাথে খাপ খাওয়ানোর অন্য কোনো উপায় বাতলে নিয়েছে।
কিন্তু ক ভাবলো, খ নিশ্চয়ই অনৈতিক কোনো এক পন্থায় সেটা করছে। ক কিছুটা লক্ষ করে এক সময় হয়ত খ-এর কোন এক ঘনিষ্ট জনকে তাঁর সন্দিহান মনের লক্ষ বানালো।
এরপর একসময় খুব যুক্তিগ্রাহ্যভাবে তা গ-কে জানালো।
গ যদি ক-এর মতই হয়, তাহলে এক পর্যায়ে দেখা যাবে তারা দুজনে মিলে খ-এর নামে তার কোন এক ঘনিষ্টজনকে ঘিরে এমন এক গল্প ফেদে দেবে যা শুনে অন্যরা ফেলতে পারবে না।
ব্যাস হয়ে গেল রিউমার উৎপাদন।
এবার তা রটানোর জন্য চাই কিছু দুর্বল চিত্ত মানুষ যাদের পক্ষে শোনা গল্পটার সত্যতা যাচাই দুরুহ।
বরং খ-এর কাছের মানুষ ক ও গ-এর কাছ থেকে জেনেছে বলে খুব সহজেই সেটাকে “বিশ্বস্তসুত্রে প্রাপ্ত” সত্যঘটনা জ্ঞান করে জনে জনে বলে বেড়ানো শুরু করে দেবে তা।
একবার ভাববেও না যে, এর মধ্য দিয়ে নিজের ইমেজ লিফটিং করতে গিয়ে একজন নিরপরাধ ব্যক্তির কি ভিষন একটা ক্ষতি তারা করে যাচ্ছে।

যেকোন গুজব শোনা মাত্রই তাই যেটা করনিয়, তা হলো,
১) এর সোর্স খুজে বের করা অর্থাৎ জানতে চাওয়া “কোথা থেকে শুনেছেন?”
২) তথ্যের ইনকন্সিস্ট্যান্সিগুলো লক্ষ করা ও সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন করে বিস্তারকারীকে সংশয়বিদ্ধ করা যেন সে আর তা স্প্রেড না করে।
৩) যার সম্পর্কে রিউমার রটানো হচ্ছে, তাঁর বা তাঁর ঘনিষ্টজনদের দিয়ে তথ্যের সত্যতা যাচাই করে যত দ্রুত সম্ভব, সঠিক তথ্য প্রকাশ করা। সেটা করা একান্তই যদি সম্ভব না হয়, অন্ততপক্ষে চলমান মিথ্যাটাকে মিথ্যা বলে চিহ্নিত করে একটা বিবৃতি দেয়া।

এসব না করে চুপচাপ বসে থাকলে মিথ্যাটাই একসময়ে ফুলে ফেপে এমন আকার নেবে যা ভিক্টিমের জীবন দুর্বিসহ করে দেবে।
মনে রাখতে হবে, যে কোনো রিউমার ফাইট ব্যাক না করার অর্থ ঐ রিউমার বিস্তারকারীকে উৎসাহ দেবার সমতুল্য।
সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে দেখা যাবে, ঐসব ব্যক্তিবর্গ আরও বড় বড় ও জটিলতরো রিউমার তৈরী ও তা ছড়ানোতে পটু হয়ে উঠবে।
আমি আপনি কেউই আর তা থেকে নিস্তার পাবো না।

হাত পা গুটিয়ে বসে না থেকে, চলুন, শোনামাত্রই যে কোনো ধরনের রিউমার, গুজব, হোএক্স, গসিপ-এর টুটি টিপে ধরি তা আমাকে এফেক্ট করুক বা না করুক………

৪,২৮৯ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “গুজব রটনা সম্পর্কিত সচেতনতামূলক একটি ব্লগ”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    একবার এক বন্ধু কে বললাম, তুই দেখি অমুক পেইক লাইক দিছিস। ঐটা জামাতি জিনিস।
    বন্ধু কইলো, তাতে কি হইছে!
    আমি কইলাম, কিছুই না।

    এরপর আর কাউরে কিছু বলি না।
    বেশি বিরক্ত হইলে যারা ফালতু জামাতি জিনিস লাইক করে তাদের স্ক্রিন শট ফেবুতে দিয়া দেই। (সম্পাদিত)


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      "তাদের স্ক্রিন শট ফেবুতে দিয়া দেই" - ভাল বুদ্ধি।
      তবে এখানে যেটার নাম পরিচয় দিলাম, তারে আমি চিনি না। সে আমার ফেবু ফ্রেন্ডও না।
      কিন্তু পাবলিক পোস্ট এমন ঘোষণা দিয়ে অন্যরে দিয়ে শেয়ার করাচ্ছে দেখে নাম পরিচয় গোপন করলাম না।

      অন্যটি ছিল ইনবক্স কথোপকথন। ঐটার গোপনিয়তা তো রাখতেই হয়, তাই না?
      তাই রাখলামও - নাম পরিচয় ঢেকে দিয়ে.........


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
      • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

        আপনি ঠিকই করেছেন।
        আমার মনে আছে আমিও ঐ পোষ্ট টি দেখেছিলাম।
        তবে এটা ঠিক বাচ্চাকাচ্চাদের ছবি পাবলিকলি দেয়াটা কিছুটা হলেও বিপদজনক।


        এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

        জবাব দিন
        • পারভেজ (৭৮-৮৪)

          "তবে এটা ঠিক বাচ্চাকাচ্চাদের ছবি পাবলিকলি দেয়াটা কিছুটা হলেও বিপদজনক।"
          শুধু বাচ্চাদের ছবিই না, আইডেন্টিটি বের করা যায়, এমন অনেক কিছুই পাবলিকলি দেয়া বিপদজনক।
          কাউকে কাউকে দেখি, বাসার একটা নাম দিয়ে ফেসবুককে তা চিনিয়ে রাখে।
          আর চেক ইন দেয়, "হ্যাভিং ফ্যামিলি টাইম এট 'অমুকস প্লেস বা হাউজ বা ইত্যাদি"
          ঐ চেক ইন প্লেসে ক্লিক করলে, স্ট্রিট ম্যাপ চলে আসে।
          তো কথা হলো, এসব সিকিউরিটি ইস্যুতে সচেতনতা বাড়াতে চেষ্টা করাটা দোষের কিছু না।
          কিন্তু সে জন্য এরকম একটা সেনসেটাইজিং গল্প ফাঁদা, সেটা ভাইরাল করা, এবং তাঁর মাধ্যমে প্যানিক তৈরী করা - এগুলোর কোনটাই আবার ঠিক না।
          এতে সমস্যা হলো, এই অত্যুৎসাহের কারনে মূল বার্তা থেকে মনযোগ অন্যত্র স্থানান্তর হয়ে যায়.........


          Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

          জবাব দিন
  2. তানভীর (২০০১-২০০৭)

    :thumbup:
    পারভেজ ভাই, এমন ব্যাপারগুলো সামনে ঘটে গেলেও কখনো ভেবে দেখি নাই.....
    "হাত পা গুটিয়ে বসে না থেকে, চলুন, শোনামাত্রই যে কোনো ধরনের রিউমার, গুজব, হোএক্স, গসিপ-এর টুটি টিপে ধরি তা আমাকে এফেক্ট করুক বা না করুক………"
    আপনার মতকরে চিন্তা ও করি নাই।
    উপদেশ মেনে নিলাম 🙂


    তানভীর আহমেদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : অরূপ (৮১-৮৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।