পচিশে মার্চের টুকরো স্মৃতি

একাত্তর সালের ২৫শে মার্চ রাতে ডিনার করে অন্য আর দশটা দিনের মতোই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ কি একটা হৈ চৈ-এ জেগে উঠি। দেখলাম সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে। আমরা তখন আগামসিহ লেনে থাকি। আমাদের বাসার সব বাতি নিভিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ি। উত্তর দিক, যে দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সেদিক থেকে ঘন ঘন গোলাগুলির শব্দ আসছিল। ঐ অবস্থায় কতক্ষন ছিলাম মনে নেই। হঠাৎ শুনলাম আগুন আগুন। দক্ষিন দিক, যেদিকে নয়াবাজার অবস্থিত, ঐ দিকের আকাশ লাল হয়ে আছে। আমরা প্রচন্ড আতংকে প্রতিটি মুহুর্ত পার করতে লাগলাম। একদিকে আগুন যা বেড়েই চলেছে, অন্যদিকে গোলাগুলির শব্দ যা এগিয়ে আসছে।

একটা সময় দেখলাম আগুন সব পুড়িয়ে ঝিমিয়া আসছে। গোলাগুলির শব্দও কমে আসছে। সকাল ও হয়ে আসছে। কিন্তু সব থেমে আসতে থাকলেও অনস্বীকার্য বাস্তবতাঃ ক্ষুধা, ঐটা তো থেমে আসে না বরং বাড়ে। বেড়েই চলে।
শিশু হওয়া একটা বিরাট সুবিধা হল, ঘটনার আকস্মিকতায় ভয় পেলেও আতংক গ্রাস করে না। সকাল হলেও আতংকের কারনে বড়দের মধ্যে ব্রেকফাস্ট বিষয়ক কোন তাড়া দেখলাম না। নাস্তা তৈরীর তেমন তোড়জোর দেখলাম না। সবাইকে বরং রেডিওর উপর হামলে পড়তে দেখলাম কি অবস্থা জানার চেষ্টায়। আর আমাদের, মানে ছোটদের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, কি নাস্তা হবে কখন হবে সেইটা।
তখনতো আর ফ্রীজের দিন না। সকালে দোকান থেকে ডিম এনে তা ভেজে খাওয়াটাই ছিল রীতি। আব্বার মহুরী ছিলেন মুনীর মামা। উনি বেরুলেন, এবং খবর নিয়ে এলেন কোথাও কিছু পাওয়া যাচ্ছেনা। শহরের অবস্থা খুব খারাপ। শীঘ্রই পাওয়া যাবেও না। এই সময়ে আমার মা তার যাদুর বাক্স খুললেন।

আমার মা তখনকার মহিলাদের মধ্যে জনপ্রিয়, “বেগম” পত্রিকার একনিষ্ঠ পাঠিকা ছিলেন। বেগম-এর এমব্রয়ডবী কাপড়ে তুলে আমাদের হাতে জামা বানিয়ে দিতেন। মার্চের প্রথম দিককার বেগমে পাঠিকাদের জন্য সামনে কঠিন সময়ের পূর্বাভাস ছিল। উপদেশ ছিল, ঘরে সংরক্ষনযোগ্য খাদ্যসামগ্রীর ব্যবস্থা রাখার। বেগমের একনিষ্ঠ পাঠিকা মা, ছোটভাই-এর খালি ডানোর কৌটা ঝালাই করিয়ে ঢাকনা লাগিয়ে সংরক্ষন পাত্র বানালেন। নিউমার্কেটের অলিম্পিয়া থেকে আধমনের মত টোস্ট বিস্কিট কিনে ঐগুলায় ভরে রাখলেন। বেগমের উপদেশ অনুযায়ী পর্যাপ্ত চিনি, গুড়, গুড়াদুধ, আরো কি কি যেন স্টক করলেন, মা কে জিজ্ঞাসা করতে হবে।

২৬শে মার্চ থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটা দিন ধরে আমাদের প্রধান খাদ্য হয়ে উঠলঃ
“মিষ্টি দুধে ভেজানো টোস্ট বিস্কিট”।

২,০৯১ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “পচিশে মার্চের টুকরো স্মৃতি”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "এই সময়ে আমার মা তার যাদুর বাক্স খুললেন।" - তখনকার দিনের ঐ মহাবিপদ কালে মায়েদের যাদুর বাক্স যে বাবাদেরকে কতটা রেহাই দিয়েছিলো, সেরকম অনেক ইতিহাস আমারও জানা আছে। সে সম্পর্কে লেখারও ইচ্ছে আছে।

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      কি যে লিখি, ভাবছি!!! 😕 😕 😕
      তুমি পড়েছো, পড়ে কিছু একটা বলেছো - এতেই বর্তে গেলাম।
      ধন্যবাদ-টাদ দিয়ে তো পরিবেশটা এক্কেবারে ফরমাল করে ফেললে গো
      এখন তো আমার আবার উত্তরে বলতে হবে "ইউ আর ওয়েলকাম" বা "ডোন্ট মেনশন ইট" অথবা "নো প্রবলেম" ইত্যাদি... ইত্যাদি...
      কোনটা যে বলি, চিন্তায় পড়ে গেলাম!!! 😉 😉 😉


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
  2. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    আমার এইসব আম্রিকান এটিকেট নিয়ে তুমি ভেবো না মোটেই। সারাদিন তো এই থ্যাংক ইউ এর ওপরেই থাকি বলতে গেলে! তাই মুখ ফস্কে বেরিয়ে যায় হামেশাই! আমার কন্যা তো খাবার টেবিল থেকে খেয়ে ওপরে যাবার আগে থ্যাংক ইউ মা বলে যাবে, এমনই মাথা নষ্ট! 😛 😛

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আপনাদের মত সিনিয়রদের সহাচার্যে থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এই রকম ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা জানতে পারা 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  4. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ৫ বছর বয়সের পারভেজ ভাই কে ধন্যবাদ।

    কোন কারণ ছাড়াই চোখে পানি আসলো।

    আমার হতভাগা বাঙলাদেশ।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      আমি পাঁচ না, ছয় বছরের ছিলাম।
      আমার সাড়ে পাচের ছোট্টো কন্যাটিকে দেখে মনেহয়, ছয় খুব একটা বড় বয়স না।
      অন্ততঃপক্ষে গোলাগুলি মধ্যে থাকা আর সকাল বিকাল চলতে ফিরতে লাশের দেখা পাওয়ার জন্য......

      কিন্তু যখন হামলার খবরে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটতাম মাইলের পর মাইল, চাষ করা বা লাঙ্গল দেয়া জমির আইল ভেঙ্গে, কোল পেতাম না কোন। আমার চেয়ে ছোটরা তা পেতো। আমাকে ছুটতে হতো নিজের পা ভরসা করেই।
      তখন কিন্তু মনে হতো, ছ'বছর অনেক বড় একটা বয়স!!

      এখন মাঝে মাঝে ভাবি, কি হতে পারতো ঐসব ছুটাছুটির সময় যদি কখনো দল ছুট হয়ে পড়তাম?
      আমাকে খুজে পেত তো আবার? নাকি পরিবারের একটি হারিয়ে যাওয়া শিশুর ছবি হয়ে রয়ে যেতাম ফ্যামিলি এলবামে।
      বাপ্পা মজুমদারের বোনের মত.........


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
  5. সামিউল(২০০৪-১০)

    অনেক ভাল লাগলো পারভেজ ভাই। :clap:
    এরকম আর ঘটনা শোনান আমাদের। নিজ চোখে দেখি নাই যুদ্ধ। আপনি বললে তাও অনেক কিছু জানা যাবে। 🙂


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      আমি ও আমাদের বন্ধুরা হলো একাত্তরের ইয়াংগেস্ট জেনারেশন, যাঁদের স্মৃতিতে একাত্তর আছে।
      আমাদের সামান্য ছোটরাও দেখেছি তেমন কিছুই মনে করতে পারে না। সেই তুলনায় আমার স্মৃতি অনেক সমৃদ্ধ।

      আগ্রহ দেখানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ।
      হ্যাঁ, শোনাবো সেই সময়কার কিছু কিছু গল্প। একটু অরগানাইজ তো করি আগে......


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
  6. গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

    একাত্তরের এক এক জন ব্যক্তির গল্প শুনতে আমার অনেক ভাল লাগে। এই টুকরো ছবি/গল্পগুলোতে আমার ইতিহাসের চেয়েও বেশি আগ্রহ। পরের ঘটনাগুলো যতটুকু মনে পড়ে, কিংবা যতটুকু অন্যদের কাছ থেকে সরাসরি শুনেছেন, সেগুলো জানার আগ্রহ থাকল। আপনারা কি ঢাকাতেই ছিলেন? নাকি গ্রামের দিকে চলে গিয়েছিলেন? কোন সময়? এই লেখাটার কথা আর কিছু নাই বললাম। সবাই তো বলছে।

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      আমারও মনেহয় এইসব টুকরো স্মৃতি সংগ্রহ করাটা একটা দারুন ব্যাপার হতে পারে।
      আমারগুলা আমি বলা শুরু করলাম।
      দেখি আর কে কে কি কি টুকরো স্মৃতির ঝাঁপি নিয়ে এগিয়ে আসে।

      সত্যিই দারুন হয় এই গল্পগুলি শুনতে পেলে।

      কিন্তু জানো, এতটা কাল কেউ না, আমার এইসব গল্প শুনতে চায়নি। সবাই ভেবেছে, "ছোট্ট মানুষ ও আবার কি জানে"। আমিও কি এক অভিমানে কাউকে বলতাম না আমার ঐসব স্মৃতিকথা।
      তবে আজকাল খুব বলতে ইচ্ছা হয়। মনেহয়: আমারও জানানো উচিৎ - যতটা জানি, যতটা দেখেছি। এগুলোরও মূল্য আছে।
      উৎসাহ দেওয়ার জন্য তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ...


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : পারভেজ (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।