না-গল্প চার : আড়াইখানা ব্রেক-আপ কাহিনী

গল্প নাম্বার – এক
একটি আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নবম শ্রেনীতে অধ্যায়নরত থাকাকালে সহপাঠি রুমমেট রুমার কাছ থেকে রাজুর ঠিকানা পেয়েছিল মিতু। রুমা তখন চুটিয়ে প্রেমালাপ চালাচ্ছে রনির সাথে আর মিতুর সাথে এমন একটা ভাব করছে যে, “এত সুন্দরি, সুকন্ঠি হয়ে কি লাভটা হলো রে তোর, যদি একটা বয়ফ্রেন্ডই না থাকলো জীবনে?”
প্রথম প্রথম ভালই যুক্তি দিয়ে নিজের অবস্থানকে শ্রেয়তর প্রমান করে ছাড়তো মিতু। বলতো, – “কি ক্ষতি হয় রে বয়ফ্রেন্ড না থাকলে? আর কি এমন লাভই বা হবে, বল দেখি? থাকবে তো দূর কোন দ্বীপে, কোন লাভ আছে? তারচেয়ে এই তো ভাল, নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত আছি”।
কিন্তু যতই দিন যেতে থাকে, বুঝতে পারে রুমা-রনির সম্পর্কটাকে সে ঈর্ষা করা শুরু করেছে। দিনের শেষে ও যখন বিছানা গা এলিয়ে কড়িকাঠ গোনে, রুমা তখন আধ শোয়া হয়ে হাসি হাসি উজ্জ্বল মুখে রনির সাথে গল্প করে চলে। কিছু বলতে গেলে বিরক্ত হয়।
মিতু বোঝে, রুমা চায় ও বসে বসে ওদের গল্প শুনুক, আরো জ্বলুক, আরো পুড়ুক। মিতু সেই সুযোগ দেয় না চেয়ার নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। বসে বসে আকাশের তারা গোনে।
মিতু একটা জিনিষ পরিষ্কার বোঝে যে রুমার এই সম্পর্কটা যতই এগুচ্ছে, সে তত বেশি করেই একা হয়ে পড়ছে। অন্তত রুমে থাকা সময়টাতে।
প্রেমে পড়া কিশোরি রুমার উচ্ছল জীবন দেখে আজকাল মিতুর পুরনো যুক্তিগুলো নিজের কাছেই খোড়া বলে মনে হয়। নিজ থেকে তর্কযুদ্ধে নামে না আর। রুমার উপস্থিতিতেও নিজেকে বড় একা একা লাগে ওর।
মিতুর সেই দুর্বল এক সময়ে একদিন রাজুর ঠিকানা দিয়েছিল রুমা। বলেছিল, “চমৎকার হ্যান্ডসাম ছেলে। পারিবারিকভাবে খেলাধুলার সাথে জড়িত। তুখোর প্লেয়ার। প্রায় সব খেলায়ই কলেজ টিমের ছেলেদের সাথে টক্কর দেয়। রনি না থাকলে কবেই আমি ওর প্রেমে পড়ে যেতাম?”
আরও বললো, “মিতুনি, জানটুস, এই সুযোগ হারাস না। রনির খুব কাছের বন্ধু। রনির কাছে থেকে তোর কথা শুনে আগ্রহ দেখিয়েছে। ওর জন্য কত মেয়ে পাগল?” ইত্যাদি ইত্যাদি…
সেই থেকে রাজুর সাথে শুরু। প্রথম প্রথম চিঠি লিখালিখি, ফোনালাপ। ছুটিতে এসে পুর্ব-পরিকল্পনানুযায়ি একই কোচিং-এ ভর্তি হওয়া। দেখাশোনা। রাত জেগে আরো ফোনালাপ। আর এসব দিয়েই আরো ঘনিষ্টতা। তবে তখনো তা গাঢ় বন্ধুতেই আটকে আছে। এরচেয়ে বেশি কিছু না।
এসএসসি পরীক্ষার পর লম্বা ছুটিতে এসে নানা অজুহাতে দেখা সাক্ষাতের শুরু। এক পর্যায়ে প্রেমে পড়াটাও হয়ে যায় মিতু আর রাজুর।
প্রেমে পড়ার পর থেকে মিতু বুঝতে পারে সে রাজুর বাড়তি কিছু এটেনশনও যেমন পাচ্ছে, বাড়তি কিছু খবরদারিরও মুখোমুখি হচ্ছে। মাঝে মাঝে ঐ খবরদারিগুলোকে ওর অপছন্দ হলেও আবার ঐগুলোকে ও নিজের প্রতি রাজুর বাড়তি মনোযোগ বলে মনে মনে বিশ্বাস করতে চাইতো।
দুবছর চুটিয়ে প্রেম করার পর এল জীবনের মহা সন্দিক্ষন। ক্যারিয়ারে মোড় ঘোরানো এইচএসসি পাশোত্তর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া।
ছাত্রী হিসাবে মিতু খুব একটা খারাপ না হলেও, কোচিং-এর অজুহাতে বের হওয়ার সময়টা প্রেম করার কাজে ব্যবহার করায়, ভর্তি পরীক্ষাগুলো আশানুরুপ হলো না একটাও।
মিতু ভাল কোন প্রতিষ্ঠানেই সুযোগ পেল না। শেষমেশ তাকে জাতিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনস্ত একটি কলেজে ঢুকতে হলো।
ওদিকে মিতুর কোচিং টাইমটায় সমানে প্রেম করেও, রাজুর প্রস্তুতিতে কোন সমস্যা হলো না। নিজের কোচিং এর জন্য এমন সব স্লট সে বেছে নিয়েছিল যে তার একটা নিরেট প্রিপারেশনে যেন কোনই বাধা না হয়। ভর্তি পরীক্ষার পর দেখা গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাল একটা ডিপার্টমেন্টে মেধা তালিকায় ভাল অবস্থানের কারনে সুযোগ পেয়ে গেছে রাজু।
এরপর থেকে দুজনের যোগাযোগ কমা শুরু করে।
নতুন পরিবেশ নতুন সহপাঠিদের সাথে থেকে রাজু বুঝতে পারে, “ধানাই-পানাই “অমুক” কলেজের ছাত্রী আমার গার্লফ্রেন্ড” – এটা বললে ওর মান থাকে না। নিজের “সিংগেল” পরিচয়টা বরং “ওটা” থেকে ভাল। মিতু ফোন করলে আলাপ ছোট করে আনা শুরু হয়। নিজে থেকে যোগাযোগ করে না। “বোঝায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না? পড়াশুনার বিরাট চাপ।” তোমাদের “অমুক” কলেজ তো আর না। বোঝো না কেন?” আবার পাশাপাশি সখ্যতা গড়ে ওঠা শুরু হয় অন্য কোন সহপাঠিনির সাথে।
ছোট্ট গন্ডির কলেজে মিতুর জগত আরো ছোট হয়ে আসে। মিতু বুঝতে পারে, রাজু তাকে এভয়েড করছে।
মিতুর আর কিছু করার থাকে না। নিজেকে গুটিয়ে নেয়। মেনে নেয় রাজুর সাথে চার বছরের ঘনিষ্টতার বিচ্ছেদ যার দুটো বছর কি যে প্রেমময় ছিল?
শুধু মাঝে মাঝে মনেহয়, কি এমন ক্ষতি হতো কোচিং এর সময় গুলো ঐভাবে ডেটিং করে নষ্ট না করে ভাল কোথাও চান্স পেয়ে গেলে? আজ রাজু তো তাহলে তাকে এইভাবে ডাম্প করতে পারতো না, তাই না?
=====================================

গল্প নাম্বার – দুই
কাছাকাছি একটা প্রক্রিয়ায় ছেলেদের এক আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়া সজিবের সাথে সখ্য গড়ে উঠেছিল মেয়েদের আরেক আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া কবিতার। কবিতা সব সময়েই বলে এসেছে, “দেখ, তুই কিন্তু আমার লাভার টাভার কিছু না। হ্যাঁ তবে তুই-ই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু যার সাথে যাবতিয় সুখ দুঃখের কথা ভাগ করি। করে শান্তিও পাই। কিন্তু খবরদার, আমাকে কখনো গার্লফ্রেন্ড-ট্রেন্ড বলবি না। এইরকম কোন পরিচয়ও দিবি না”।
কবিতার সামনে সজিব স্বীকার করেও তা কিন্তু তবুও সজিবের বন্ধুমহলে চাউর হয়ে যায়, “সজিব ইজ ইন লাভ উইথ কবিতা”। নিজের বন্ধুদের মাধ্যমে এইচএসসির আগেই ব্যাপারটা জানতে পারে কবিতা। চিঠি লিখে চার্জ করে সজিবকে। সজিব বুঝায়, যে বন্ধুদেরকে ও কিছু বলে নাই। এই চিঠি চালাচালি দেখে টেখে বা ফোনে কথা বার্তা শুনে-টুনে বন্ধুরা নিজে থাকেই এটা ধরে নিয়েছে হয়তো। তাছাড়া ভুল কি আর এমন? তুই যখন গার্ল এবং ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড তো বলতেই পারে ওরা, তাই না?
খুবই বিরক্ত হয় কবিতা। ও খুব ভাল করেই জানে গার্ল এবং ফ্রেন্ড এর সাথে গার্লফ্রেন্ডের পার্থক্য আকাশ-পাতাল।
ভর্তি কোচিং গুলো এগিয়ে চলে হুড়মুড় করে। এইচএসসির রেজাল্ট বের হয়। দেখা যায় সজিব অনেক জায়গায় পরীক্ষাই দিতে পারবে না। রিলাক্সড মুডে থাকা সজিব নানা অজুহাতে কবিতাকে খোচায় এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানোর জন্য। কবিতা সময় বের করতে পারে না। বন্ধু মহলে চাউর হয়, তবে কি রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় কবিতা এড়িয়ে চলছে সজিবকে? আবার বিরক্ত হয় কবিতা। এবং খানিকটা বোঝেও যে এই রটনার পিছনে হয়তো সজিবের ইন্ধন আছে। কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে বিরক্তি বোধ করে সে।
একসময় শুরু হয়ে যায় ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়া। দেখা গেল মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং আইবিএ সহ ভাল ভাল সব প্রতিষ্ঠানেই চান্স পেয়ে কবিতা বড়ই কনফিউশনে আছে, কোথায় পড়বে আর কোনটা ছাড়বে সেট ভেবে ভেবে? আর ওদিকে কোথাও সুযোগ না পেয়ে সজিব বড়ই নিশ্চিন্ত কারন সে ঠিক করে ফেলেছে বাসার কাছে কোন একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার জন্য।
ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হবার পরপরই বন্ধু পরম্পরায় কবিতার কানে আসা শুরু করে, “ডিএমসির স্টুডেন্ট কবিতা অমুক “সাধারন” প্রাইভেট ইউনিভার্সটির সজীব কে ডাম্প করলো বলে। এইবার আর রাখ ঢাক না করে এসব বলে বেড়াচ্ছে সজিব নিজেই।
কবিতা প্রথম প্রথম অবজ্ঞা করে এসব। যখন দেখে শুধু বন্ধুরাই নয়, সিনিয়ার জুনিয়াররাও পর্যন্ত ক্রমাগত কানের কাছে এই একই গান গেয়ে যাচ্ছে, সজিব কে জিজ্ঞাসা করে কবিতা। “এগুলো কিসব রটাচ্ছিস? কেন রটাচ্ছিস?” সজিব উত্তর দেয়, “ভুল কি বলেছি? তুই তো ব্রেক আপ করেই ফেলেছিস প্রায়। সবাই জানে আমাদের এফেয়ারের কথা অথচ তোর কি আচরন, বল? কোন গ্যাদারিং-এ আসিস না। আমার তাই বাধ্য হয়ে গা বাঁচাতে বলতেই হয়েছে ঐ কথা”।
– “একদম বাজে কথা বলবি না, সজিব। আমি বহুবার বলেছি, আমরা বন্ধু ব্যাস। এখানে গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড এফেয়ার এইগুলা আসে কি করে? তোর বন্ধুরা যদি তা ভাবেও, সেটা তোর সমস্য যে তুই ওদের ভুল বোঝাটা দূর করতে পারিস নাই। এখন এটা তোরই দায়িত্ব সবাই কে ক্লিয়ার করা যে আমরা ফ্রেন্ড আছি ছিলামও। তবে সেটা ঐসব প্রচলিত গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড বা এফেয়ার জাতীয় কিছু না। আর এর সাথে ডিএমসিতে চান্স পাওয়া না পাওয়ার কোন সম্পর্ক নাই। তবে হ্যাঁ, পড়াশুনা শেষ হোক, বিয়ে করার কথা তো আসবেই একসময়ে। তখন আমি প্রথমেই তোকে ছাড়া আর কারো কথা ভাববো না। এটুকু বলতে পারি”।
কবিতা কি বলে, আর সজিব কি করে, বোঝে না কবিতা। এটুকু বোঝে হঠাৎ সজিবের দারা পরিবার এসে হাজির হয় কবিতার কাছে। এরকম সোনার টুকরো মেয়ে তাঁদের পুত্রবধু হবে শুনে তারা আপ্লুত। খেদমতে খেদমতে ভাসিয়ে নিতে চায় কবিতাকে। আবারো বিরক্ত হয়। খুবই বিরক্ত হয় কবিতা।
দুবছর চলছে এইসবের শুরু হবার পর থেকে। প্রতি মুহুর্তে বন্ধু-সিনিয়ার-জুনিয়ার শুধু না সজিবের আত্নীয়-পরিজনদের কাছ থেকে ক্রমাগত প্রত্যাশার চাপ আবার পাশাপাশি “কবে ব্রেক-আপ হচ্চে?” – এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতে এখন অনেকটাই অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে কবিতা। মুখে তেমন কিছু আর বলে না আজকাল। ব্যাখ্যা দিতে দিতেও ও এখন ক্লান্ত। কবিতা ভাবে, কি হতো যদি আরেকটু খারাপ রেজাল্ট করলে? কোথাও চান্স না পেলে? কোন কিছু (প্রেম-ট্রেম) না করেও এতগুলো মানুষের সামনে দিয়ে প্রতি নিয়ত কিসের এই পরীক্ষা দিয়ে বেড়াচ্ছে সে?
=====================================

গল্প নাম্বার – আড়াই
এটা মার্কিন মুলুকের বাঙ্গালী কমুনিটির গল্প। টুয়েলভ গ্রেডের ছেলেটির জন্ম ও বেড়ে ওঠা দুই-ই ঐদেশে। আর ইলেভেন গ্রেডার মেয়েটি কয়েক বছর হলো, পরিবারের সাথে ওখানে গিয়ে থিতু হয়েছে। দুজনের দেখা সাক্ষাৎ মূলত লাঞ্চের টেবিলে। একসময় ঘনিষ্টতাও হয়। নিজের প্রতি ছেলেটির কেয়ার সাপোর্ট দেখে মুগ্ধ হয় সে। তাছাড়া একই কমুনিটিরই যখন। কিন্তু যেদিন থেকে সে গার্লফ্রেন্ড হবার প্রস্তাবে সম্মত হয়, অবাক হয়ে লক্ষ করে কি ভীষণ পরিবর্তনই না ঘটে গেছে ছেলেটির আচরনে?
মন পেতে সারাক্ষন তাবেদারি করে বেড়ানো সেই একই ছেলে তাকে কি পোশাক পরতে হবে, কাদের সাথে এক টেবিলে বসা যাবে আর কাদের এভয়েড করতে হবে, এইসব “সবক” দেয়া শুরু করেছে। মার্কিন মুলুক তো আর বাংলাদেশ না যে একবার অমুকের গার্লফ্রেন্ড – এই ছাপ পড়ে গেলে জীবনই বিকল? সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ঐ জন্ম সুত্রে আমেরিকান কিন্তু চুড়ান্ত রকমের আধিপত্যবাদি বাঙ্গালী চরিত্রের তরুনকে জবাব দিয়ে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসে জন্মসুত্রে বাংলাদেশি ও সম্প্রতি আমেরিকান হয়ে ওঠা মেয়েটি।
=====================================

আরও কিছু না-গল্প:

একটি না-গল্প: সার্ভিস চার্জ

আরেকটি না-গল্প: বেল্ট কাহিনী

না-গল্প তিন: তোড়ার জন্য

না-গল্প পাঁচ – তোড়ার কথা

১,৫৬০ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “না-গল্প চার : আড়াইখানা ব্রেক-আপ কাহিনী”

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।