না-গল্প তিন: তোড়ার জন্য

ইন্টার্নশিপ চলাকালেই পারিবারিক আয়োজনে বিয়েটা সেরে ফেলে ডাঃ হৃদয় ইসলাম। কনে টুম্পা তখন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়ছে। কথা হয়, এখনি আনা নেয়া হবে না। দুজনেই যেহেতু পড়াশুনায় ব্যাস্ত, আগে পড়াশুনার পাট তো চুকুক তারপরেই না হয় সুবিধা মত ঘটা করে ওসব করা যাবে খন।
এরেঞ্জমেন্টটা কনে পক্ষের জন্য খুব একটা সুবিধাজনক না হলেও প্রথম সারির সরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে সদ্য পাশ করা তুখোড় ছাত্র এবং হ্যান্ডসাম ও স্মার্ট এই পাত্রের কাছে কন্যাকে পাত্রস্থ করতে পারার সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি হলেন না কনেপক্ষ। শর্ত মেনে নিলেন তাঁরা।
কনেপক্ষের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে হৃদয় ওঁদের দিয়ে এটাও প্রমিজ করিয়ে নেয় যে আনুষ্ঠানিক আনা-নেয়ার আগ পর্যন্ত বিয়ের ব্যাপারটা জানাজানি করা যাবে না। অজুহাত হিসাবে তার অবিবাহিত অবস্থায় বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকুরিতে বা আইএসএসবি দিয়ে স্বসস্ত্র বাহিনীতে যোগদানের প্রেফারেন্স ব্যবহার করে সে।
কনেদের শ্যামলির বাসাতেই নববধুর সাথে দেখা সাক্ষাৎ রাত্রিযাপন যেমন চলতে থাকে পাশাপাশি ঐ সরকারি মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্নী-হোস্টেলে থেকে অবিবাহিত পরিচয়ে তার ইউজুয়াল উৎশৃংখল জীবন যাপনও চালিয়ে যেতে থাকে সে।
ডাক্তার হলেও হৃদয়ের উৎশৃংখল জীবন যাপনের কথা ঘনিষ্ট জনেরা সব সময়েই কম-বেশি জানতো। শোনা যায় ছাত্র থাকা কালেই নাকি এক সহপাঠিনির সাথেও “উল্টা-পাল্টা” করতে গিয়ে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল সে। তবে সেটা কনের নিরুৎসাহেই খুব বেশিদিন টেকে নাই তা। আর সেই মেয়েটির অনিচ্ছার প্রতি শ্রোদ্ধা দেখিয়েই বেশী কানে পৌছেওনি ঘটনাটা।
বিষয়টার উল্টো সুবিধা নেয় হৃদয়। সে বুঝে ফেলে, ঘটনা জানাজানিতে নারীদের নিরুৎসাহ তার এই উৎশৃংখল জীবন-যাপনের জন্য বেশ সহায়ক। যখন যতটা পেরেছে, সুযোগের সদ্ব্যবহারে সে আর কখনো কুন্ঠিত হয় নাই।
অবিবাহিত পরিচয় থাকার সুবিধা নিয়ে ঐ জীবনটা সে চালিয়ে যেতে থাকে বিয়ের পরেও।
টুম্পা ও তার পরিবার যে একদমই অন্ধকারে ছিল, তা না, তবে ঐসব সম্পর্কের বেশির ভাগই স্বল্প মেয়াদি থাকায় খুব নিরেট কোন তথ্যও তাঁদের কাছে আসছিল না।
এরই এক পর্যায়ে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে মেডিকাল পূর্ববর্তি কলেজ-জীবনের সহপাঠিনী তোড়ার সাথে। তোড়া তখন বাজে একটা বৈবাহিক অভিজ্ঞতা চুকিয়ে শিশু-কন্যা নিয়ে সদ্য সেপারেটেড টগবগে তরুনী। হৃদয়ের মত সুপুরুষ তরুনের সাথে তার ব্যাটে-বলে সংযোগ হতে খুব একটা সময় লাগে না। দ্রুতই দুজনের সম্পর্ক এতটাই গভীর ও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে হৃদয়ের পক্ষে স্ত্রী টুম্পাকে দেয়া আগের এটেনশনে গড়মিল হতে শুরু করে। তাছাড়া তোড়াতো আর হৃদয়ের বিবাহিত অবস্থার কথা জানতো না, শুধু এটুকুই জানতো যে হৃদয় বড় উড়ু উড়ু স্বভাবের। ডালে ডালে মধু খাওয়া তার স্বভাব। এই স্বভাব থেকে ওকে ফেরাতেই বরং যতটা পারতো ফোন করে বা সাথে থেকে তাঁকে নিজের প্রতি ব্যাস্ত রাখতে চাইতো সে।
তোড়ার সাথে এই অধিক বন্ধনই কাল হয়ে দাঁড়ায় হৃদয়ের জন্য। নিজের জন্য বরাদ্দ সময়ে টান পড়তে দেখে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তরুনী ভার্যা টুম্পা টের পাওয়া শুরু করে যে “দাল মে কুচ কালা হায়”।
অন্যান্য ঘনিষ্টজনদের সহায়তায় আরও কিছু প্রমান পেয়ে ব্যাপারটা সে তার পরিবার কে জানায়। পরিবারের সদস্যরা মেডিক্যাল প্রফেশনে পরিচিতদের মাধ্যমে হৃদয়ের এই এক্সট্রা-মেরিটাল এফেয়ারের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়।
এরপরে একসময় তাঁরা তাকে চার্জ করে তার আচরন সম্পর্কে। যাবতিয় সাক্ষ্য-প্রমান জানার ও বোঝার পর হৃদয় বুঝতে পারে যে তার পালানোর কোন উপায় নাই। তোড়া ও টুম্পার মধ্যে যে কোন একজনকেই বেছে নিতে হবে তাকে। ঝামেলা এড়াতে তাই টুম্পাকেই বেছে নেয় সে।
কোন সাতে-পাচে না থেকেও প্রায় অকারনেই অদ্ভুত কেমিস্ট্রির এই সম্পর্কটাতে হঠাত ছেদ পড়ে তোড়ার জন্য। তোড়া জানতেও পারে না, তাঁদের এই উত্তপ্ত সম্পর্কটা হঠাৎ কি কারনে ভেঙ্গে গেল? হৃদয় তাঁকে বলেওনি কিছু। সে শুধু ধরে নেয়, হয়তো উজ্জলতর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই অনিচ্ছা স্বত্বেও তাদের এই দুর্বার প্রেমে ইতি টানাটাকেই বেছে নিতে হয়েছে হৃদয়কে। অথচ সে জানতেও পারেনি যে ঘটনাটি মোটেও তা না। স্ত্রী ও শশুরবাড়ির পরিবারের কাছে বিবাহ-বহির্ভুত সম্পর্ক ফাঁস হওয়ায় বিয়ে টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা হিসাবে তাঁকে মানে তোড়াকে পত্রপাঠ বিদায় করেছে হৃদয়, কোন রকমের যুক্তিসঙ্গত অজুহাত ছাড়াই। বলা যায় কুরবানি-ই করেছে তাঁকে, নিজের বিয়ে বাঁচাতে।
কি হলো তারপরে? সেই টুম্পার সাথে হৃদয়ের বিয়েটা কি টিকে গিয়েছিল? সুখি হয়েছিল তাঁরা?
না যায় নি। একবার নিষিদ্ধ নরীমাংসের স্বাদ পেয়েছে যে তরুন সে কি আর এত সহজে নীড়ে ফেরে? হৃদয়ও ফেরেনি। টুম্পা ও তার পরিবারের কাছে চেনা হয়ে যাওয়ায় দৃশ্যপট থেকে বিদায় করা তোড়ার কাছে সে আর ফিরে যায় না ঠিকই তবে ততদিনে “অবিবাহিত সরকারি ডাক্তার” পরিচয় ব্যবহার করে অন্য নতুন নতুন সঙ্গি জুটিয়ে নিতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি তাঁকে। এরই ফলশ্রুতিতেই হোক, বা নিরপরাধ তোড়ার অভিশাপেই হোক, টুম্পার কাছে আবারো যথারীতি ব্যাপারগুলো ধরা পড়তে শুরু করে।
এইবার আর কোন সুযোগ দিতে রাজি হয় না টুম্পা ও তার পরিবার। বছরখানেক সেপারেটেড থাকার পর পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তারা।
কি হয় তোড়ার?
ভুল মানুষকে বিয়ে করে একবার স্বামী কর্তৃক শারীরিকভাবে নিগৃহিত হয়েছিল সে। সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসেও নিস্তার পায়নি সে। একিউট ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের পরিনতি তাঁকে মেনে নিতে হয়েছিল।
দুর্ভাগ্য তার পিছু ছাড়ে না। আবারো প্রেমিক হিসাবে ভুল মানুষকে বেছে নেয়ার খেশারত দিতে হয় তাকে। এবার তার কপালে জোটে পারসিস্টেন্ট ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার। সাথে বোনাস হিসাবে সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি বা আত্মহত্যা-প্রবনতা।
বারবার হোঁচট খাওয়া তোড়া কি আর পারবে না এ থেকে ঘুরে দাড়াতে?

আরও কিছু না-গল্প:

একটি না-গল্প: সার্ভিস চার্জ

আরেকটি না-গল্প: বেল্ট কাহিনী

না-গল্প চার : আড়াইখানা ব্রেক-আপ কাহিনী

না-গল্প পাঁচ – তোড়ার কথা

১,৭০৬ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “না-গল্প তিন: তোড়ার জন্য”

    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      আমিও ভাবিছি।
      সমস্যা হলো, এই ভাবনা চিন্তার এক দুর্বল ক্ষনে নতুন আরেক তোড়ার সন্ধান পেয়ে গেলাম।
      এখন ধন্দে পড়ে গেলাম, কোন গল্পটা আগে বলি, নতুন তোড়ার নাকি অরিজিনাল তোড়ার?
      বাই দ্যা ওয়ে, আরও যদি কেউ থাকেন নিজের গল্প শেয়ারে ইচ্ছুক, এই আই ডিতে জানান:
      pervez840@gmail.com


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
  1. পরপর চারটি নপ-গল্প পড়লাম।
    বিষয় বস্তু খুব সুনির্দিষ্ট। সম্পর্কের ভেঙ্গে যাওয়া।
    লেখনী চমৎকার। আরো চমৎকার হতে পারে যদি চরিত্রের মুখে সংলাপ বেশী থাকে, লেখকের বর্ণনার তুলনায়।
    যদি চারপাশের বর্ণনা পাওয়া যায়, ভিজুয়ালাইজ করতে সুবিধা হয়।

    পড়তে পড়তে এরকম মনে হতে থাকে,
    প্রেম ও ব্রেক-অাপ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি নিয়ে ক্যাম্পেইন এই লেখাগুলোর মূল কারণ।

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      প্রথমেই অসংখ্য ধন্যবাদ, গল্পগুলি পড়ার জন্য।
      এরপরে আবারো ধন্যবাদ, পড়ে কিছু লিখার জন্য।
      পাঠক নারায়ন। গল্প পড়ে পাঠক যা ভাববে, সেটাই ঠিক।
      তারপরেও এটুকু বলা অন্যয় হবে না যে কেবলই সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়াটাই এই গল্পগুলির একমাত্র পতিপাদ্য করার কোন ইচ্ছা ছিল না।
      বরং সম্পর্ক নিয়ে ইদানিং চলতে থাকা নানা জটিলতা তুলে ধরাই গল্পগুলির লিখার উদ্দেশ্য ছিল।
      "প্রেম ও ব্রেক-অাপ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি নিয়ে ক্যাম্পেইন" করার কোন ইচ্ছা ছিল না। সেটা এসে গেলে তো বিরাট সমস্যা। তবে সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা-প্রবাহ নিয়ে ইনফরমেশন শেয়ারিং-এর ইচ্ছা পূর্ন মাত্রায় ছিল, আছেও।
      এই ব্যাপারটা অবশ্যই একেক জন এক এক ভাবে ব্যাখ্যা করার স্বাধীনতা রাখে।

      বর্ননা কমিয়ে নাটকিয়তা ও ঘাত-প্রতিঘাত বাড়ানোর চেষ্টা ভবিষ্যতে করবো। উপদেশটা নোটেড...

      বাই দ্যা ওয়ে তুমি সিসিবিতে লিখা শুরু করো না কেন?
      আমরাও কিছু গল্প শুনি তোমার কাছ থেকেও। রেজিস্ট্রেশন করে ফেল দিকিনি......


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : পারভেজ (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।