অরিগ্যামির নিয়ে একটি অন্যরকমের স্মৃতি

ক্লাস এইট বা নাইনে থাকতে অরিগ্যামির উপরে একটা বই পেলাম লাইব্রেবীতে। তবে বইটার নাম ছিল “পেপার ফোল্ডিং এন্ড মডেলিং”।
নির্দেশন পড়ে পড়ে আর ছবি দেখে দেখে কাগজ ভাঁজ করে বেশ কিছু মজার মজার  জিনিস বানানো শিখে ফেললাম।
যখন সেগুলো বানাতাম, অনেকেই খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতো, খুলতো কিন্তু আর আগের অবস্থায় নিতে পারতো না। ব্যাপারটা বেশ মজারই ছিল।

আমাদের একজন ডেমুনেস্ট্রেটর ছিলেন যিনি হঠাৎ অসুস্থ্ হয়ে পড়েন। দীর্ঘ্যদিন সিএমএইচে থেকে যখন ফিরলেন, দেখলাম ওজন হারিয়ে কি দুর্বলই না হয়ে গেছেন তিনি। আমরা ভেবে ছিলাম উনি সুস্থ্য হয়ে ফিরে এসেছেন। কিন্তু না। উনি জানালেন আবারও লম্বা চিকিৎসার জন্য তাঁকে যেতে হবে।

ক্লাস নাইন বা টেনে থাকতে ল্যাব ক্লাসে এক্সপেরিমেন্ট শেষ করে বসে বসে অরিগ্যামি করছি। এরই মধ্যে দেখি হঠাৎ স্যার পিছন থেকে এসে জানতে চাইলেন, কি কর?
একটু ভয়ে ভয়েই বললাম, স্যার এক্সপেরিমেন্ট শেষ তাই একটু রিক্রিয়েশন আরকি।

উনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো কাজটা দেখলেন। আমাকে ওনার অফিসে নিয়ে গেলেন। দু-একটা ছোট ছোট ট্রিক দেখে নিলেন। মনে হলো খুব মজা পাচ্ছেন।

ফের চিকিৎসার জন্য যাবার আগে প্রতিদিন একটু একটু করে আমার জানা প্রায় সবগুলি মডেল বানান শিখে নিলেন।

দেখলাম, আমার মতই ওনারও সবচেয়ে পছন্দের মডেল হলো পেপার ক্রেইন আমরা যাকে পাখী, সারস, রাজহাস ইত্যাদি নামে বানাই এবং ব্যাঙ। ব্যাঙ বানানোটা খুবই আগ্রহের সাথে শিখলেন। এই শেখায় কেন যে তাঁর এত আগ্রহ ছিল, বুঝেই পেলাম না।

দ্বিতীয়বারের মত উনি দীর্ঘ চিকিৎসার জন্য চলে গেলেন।

ওনার কি আসুখ হয়েছে, আমাদের জানা ছিল না। বেশ কয়েকমাস পর এবার যখন ফিরলেন, দেখলাম রক্তাল্পতায় তিনি ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন। শুখিয়ে অর্ধেক। এর মধ্যেও ল্যাবে আসতেন। ধীরে ধীরে চলা ফেরা করতেন, কথা বলতেন। অনেক কিছুই মনে করতে পারতেন না। একসময়ে আমরা জেনে গেলাম উনি ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন এবং চিকিতসার বাইরে চলে গিয়েছেন।

একদিন আমাকে ডেকে নিয়ে অফিসে বসালেন। বললেন, হাসপাতালে থাকার দিনগুলোতে ওনার একটা প্রধান বিনোদনই ছিল, এই অরিগ্যামি। আর উনি যখন কাগজ ভাঁজ করে করে আস্তো একটা ব্যাঙ বানিয়ে ফেলতেন, ওনাকে দেখতে আসা মানুষদের চোখে মুখে যে  বিস্ময় উনি দেখতেন তা তাঁকে মুদ্ধ করতো। বারবার বললেন, এই অরিগ্যামি শেখাটা তাঁর একটা স্মরনীয় অভিজ্ঞতা।

এর কিছুদিন পর উনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন। ওনার সাথে আমার এই অরিগ্যামিজনিত সম্পর্কের কথাটা কারো সাথে সেইভাবে আর শেয়ার করা হয় নাই। এখনো কাগজ নিয়ে বসলে ওনার মুখটা ভেসে ওঠে। অবাক হয়ে ভাবি, নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকা একটি মানুষ কিভাবে তুচ্ছ এক একটা বিষয়কে অবলম্বন করে আনন্দ পেতে পারেন। বিনোদন নিতে পারেন। মানুষ সত্যিই বিচিত্র জীব!

আজ এখানে পেপার ক্রেইন বানানো দেখাচ্ছি।

১) যেকোন একটা কাগজকে বর্গাকার করে নেয়াটাই হলো প্রথম কাজ।

01 02 03

এইভাবে বর্গাকার করে নিতে হবে

এইভাবে বর্গাকার করে নিতে হবে

২) বিপরিত দিকে দুটি কৌনিক এবং একই দিকে মাঝামাঝি দুটি ভাঁজ দিয়ে নিতে হবে।

একটি ভাঁজ ভিতরের দিকে অন্যটা বাইরের দিকে

একটি ভাঁজ ভিতরের দিকে অন্যটা বাইরের দিকে

মাঝামাঝি দেয়া দুটো ভাজই একই দিকে

মাঝামাঝি দেয়া দুটো ভাজই একই দিকে

৩) ভাঁজগুলো ব্যবহার করে এইরকম একটা শেইপ দেয়া লাগবে।

07 08 09

৪) প্রথমে ভাঁজগুলো দিতে হবে মাপ ঠিক রাখতে পরে দরকার মত তা ব্যবহার করতে হবে।

10 11 12 14 15 16

৫) দুইপাশেই একই কাজ করে ঘুরিয়ে নিতে হবে। পরের স্টেপ গুলো ঘোরানো অবস্থায় করতে হবে।

17 18 20 21

৬) মূল স্ট্রাকচার রেডি। এখন সামান্য উল্টে পাল্টে পাখী দাঁড়িয়ে যাবে…

22 23 24 25 26 27

 

দাঁড়িয়ে গেছে আপনাদের পেপার ক্রেইন। অভিনন্দন।

পুনশ্চ: স্যারের নামটা ইচ্ছা করেই উল্লেখ করলাম না। ওনার ছেলে আমাদের বছর দু-তিন পরেই কলেজে ভর্তি হয়। সম্ভবতঃ ডাক্তার। আমি চাচ্ছি না, এই গল্পটা কেউ আগ বাড়িয়ে ওর সাথে করুক।

আরেক দিন ব্যাঙ বানিয়ে দেখানোর ইচ্ছা রইল।

১,৭২৫ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “অরিগ্যামির নিয়ে একটি অন্যরকমের স্মৃতি”

  1. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    এত কিছু পারতাম না। নৌকা, শাপলা, প্যান্ট, ক্যামেরা আর কি কি যেন... ভুলে গেছি।

    স্যারের কথা শুনে খারাপ লেগেছে। এই সময়টা মানুষ কিভাবে পার করে তা বুঝার জন্য ছোট্ট একটা ঘটনা শেয়ার করি। আমার বাড়ির কাছে এক বিশাল বপুর মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছিল। ভার্সিটিতে পড়ার সময়। মুখ ভর্তি করে পান খেতেন। মুখ ভর্তি মানে বাস্তবিকই মুখ ভর্তি। ৮-১০ টা পান এক সাথে খেতেন। এই পান খাবার জন্যই সে সবার কাছে পরিচিত ছিল। আমার সাথেও পরিচয় একই কারনে। বেশ হাসিখুশি মানুষ।

    কিছুদিন পর বাড়িতে গিয়ে শুনি লোকটা আত্নহত্যা করেছে। পরে লোকমুখে শুনেছি, ক্যান্সারের কারনে ডাক্তার সময় দিয়েছিলেন ৬ মাস। ৩ মাস পার হবার আগেই উনি নিজ থেকেই না ফেরার দেশে চলে যান।


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    অরিগ্যামি করার জন্য যে ধৈর্যের প্রয়োজন সেটা আমার একেবারে নেই --- অসম্ভব সৃষ্টিশীল একটা ব্যাপার। কি জানি কোনদিন হয়তো কোন অবসরে শেখার জন্যে আকুল হবো!

    স্যারের শেষসময়ে একটা প্রেরণা হতে পেরেছিলেন এটা একটা বিরাট ব্যাপার।

    মৃত্যুভয় এখনো আসেনি, তবে চিন্তা আসছে ধীরে ধীরে।

    জবাব দিন
  3. টিটো মোস্তাফিজ

    ধন্যবাদ পারভেজ ভাই। বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানর জন্য অরিগ্যামী দারুণ কাজের। পেপার ক্রেনটা সবচাইতে বিখ্যাত। এক ক্যান্সার রোগী মনে করছিলো একহাজার ক্রেন তৈরী করতে পারলে সে সুস্থ্য হয়ে উঠবে। কিন্তু তার আগেই সে মারা যায়।সেই স্মৃতি রক্ষার্থে প্রতি বছর বিশেষ একটা দিনে অনেকে পেপার ক্রেন তৈরী করে। অরিগ্যামী ব্যাঙ দেখার অপেক্ষায় :dreamy:


    পুরাদস্তুর বাঙ্গাল

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      এই ঘটনাটা আমি প্রথম যখন শুনি, তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম। আমিও যে একজন ক্যান্সার আক্রান্তকে বিপুল উৎসাহে অরিগ্যামিতে ব্যাস্ত থাকার কথা জানতাম, সেটা ভেবে।
      কত বিচিত্র মিল ঘটে একদমই অজ্ঞাতে।
      স্যারের এটা জানার কোন সুযোগ ছিল না যে এমন ঘটনা জাপানে ঘটেছে।
      আবার ঐ জাপানিজও জানতো না যে কেউ একজন অসুস্থ্যতা জনিত বোরডম কাটাতে বাংলাদেশে একাজ করছে।
      আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম।


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
  4. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    ছবিগুলো আর বর্ণনাটুকু পড়েছি। শুরু থেকে পড়ে আসি নাই। কোন একটি কারণে ক্যান্সারে মৃত্যুর বিষয়টা এখনো সহজে নিতে পারি না।


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  5. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    চমৎকার একটি স্মৃতিকথা।
    ভালো লাগলো পড়ে।

    অরিগ্যামী দেখতে ভালো লাগে।
    শেখার আগ্রহ নাই আর।
    তবে ঐ নৌকা-প্লেন ব্যাস এই।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।