বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন নিয়ে ভাবনা

এই লিখাটা ৬ মার্চ নতুনবার্তায় গিয়েছিল। এখানেও আর্কাইভ করছি।

দেশের একটি প্রধান পত্রিকায় প্রকাশিত আজকের (৫ মার্চ ২০১৪) এক সংবাদে বলা হয়েছে, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি প্রস্তাবটি গৃহিত হলে দরিদ্র গ্রাহকের মাসিক ব্যয় বাড়বে ১০০ টাকা আর ধনী গ্রাহকের ব্যয় বাড়বে মাত্র ১২ টাকা।

তবে যা বলা হয় নাই, তা হলো, ওই “ধনী” গ্রাহকদের বিল ইউনিট প্রতি আর ১৫ পয়সা করে বাড়ানো হলে তাদের মাসিক ব্যয় “দরিদ্র” গ্রাহকগণের সমান হয়ে যেতো। তারা যে ওই বৃদ্ধিতে অনিচ্ছুক এমনটাও কিন্তু না, কারণ এই বৃদ্ধি তাদের দেয়া বর্তমান বিলের দুই শতাংশেরও কম। অথচ পত্রিকাটি এমনভাবে সংবাদটি তুলে আনল, যা দেখে মনে হয় যে এই মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্য গরীর-শোষণ ও ধনী-তোষণ।
ধনী-দরিদ্রের খরচের এই সাম্যতা অর্জন করা গেলেই যে পত্রিকাটি খুশি হয়ে তা অনুমোদন করে দিত, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। শুরুতেই পত্রিকাটি মূল্য বৃদ্ধি প্রস্তাবে শতাংশের হিসাব দিয়ে সেটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তাদের সংজ্ঞানুযায়ী বর্ণিত ওই সব গরিব গ্রাহকের (৭৫ ইউনিটের কম ব্যবহারকারী) ইউনিট প্রতি মূল্যবৃদ্ধি ৪১ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ সাম্যতার জন্য তাদের যে আকাঙ্ক্ষা তা পুরণে যা করেনি, তা কি তাহলে ধনীদের বিল অন্তত ৪২ শতাংশ বাড়ানো? তা যদি হয়, তবে তা হবে ইউনিট প্রতি ১৩.৩২ পয়সা। এটা গড় উৎপাদন ব্যয়ের দ্বিগুণেরও বেশি।
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সাথে চাহিদা কমানোরও সম্ভবত একটা সম্পর্ক আছে। ন্যূনতম বা কম ইউনিট ব্যবহারকারিগণের চাহিদা কমে যদি কিছু বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয় তবে তা ভর্তুকি হ্রাসে যেভাবে ভূমিকা রাখবে বেশী ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে তা একই ভাবে ঘটবে না। ওই ব্যবহারকারীরা এখনই যেখানে গড় উৎপাদন মূল্যের দেড়গুণ বা তারও বেশি দিচ্ছেন সেখানে ন্যূনতম বিলদাতাগণের বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ইউনিট প্রতি তিন টাকা বা তারও বেশি ভর্তুকি সুবিধা পাচ্ছেন। তারা সংখ্যায় যেহেতু বিপুল, এই ভর্তুকির পরিমাণও বিপুল।
আমি বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির এই প্রচেষ্টাকে ভর্তুকি থেকে বের হয়ে আসার একটা প্রয়াস হিসেবে দেখতে চাচ্ছি। কিন্তু কেন এই প্রয়াশ? কারণ আগামি ১০-১৫ বছরে আমাদেরকে বিদ্যুতে স্বাবলম্বি হতে যে ১৫-২০ হাজার মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে, তার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের সামর্থ্য আমাদের নেই। এই কাজের জন্য অন্য কারো না কারো কাছ থেকে অর্থায়ন পেতেই হবে। সেখানে বড় সমস্যা হলো, ভর্তুকি নির্ভর খাতে লগ্নীকারী পাওয়াটা হবে দুঃসাধ্য।
আমি বেশি ব্যবহারকারীদের উচ্চহারে বিল প্রদানের এবং কম ব্যবহারকারী কমহারে বিল প্রদানের বিপক্ষে নই। তবে তা করতে গিয়ে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে। আমার মত হলো, স্ল্যাবের সংখ্যা নামানো হোক সর্বোচ্চ তিনটায়। উচ্চতর স্ল্যাবের ভোক্তাকে অধিক ব্যবহারের জন্য বাড়তি মূল্য চার্জ করা হোক। মধ্যবর্তী স্ল্যাবে উৎপাদন মূল্যে বিদ্যুৎ দেয়া হোক। নিম্নতম স্ল্যাবের ভোক্তাদেরকে কম ব্যবহারে উৎসাহিত করতে ভর্তুকি হিসেবে ক্যাশ ইনসেন্টিভ দেয়া হোক। এই ইন্সেন্টিভের টাকার যোগান দেয়া হোক উচ্চতর স্ল্যাবের ভোক্তাদের কাছ থেকে নেয়া বাড়তি টাকা থেকে।
এই কাজটা আরেকভাবেও করা যায়। ধরা যাক, উৎপাদন মূল্যে বিদ্যুতের প্রাপ্যতার জন্য একটা মাইল স্টোন নির্ধারণ করা হলো যা ৩০০ ইউনিট। অর্থ হলো, যারা ঠিক ৩০০ ইউনিট ব্যবহার করবেন, তারা গড় উৎপাদন মূল্যে বিদ্যুৎ পাবেন এরচেয়ে কম ব্যবহারকারী পাবেন ইনসেন্টিভ আর বেশি ব্যবহারকারীকে দিতে হবে ওই ইনসেন্টিভের কভারেজ ব্যয়। ধরা যাক, ৩০০ ইউনিটের পর প্রতি ১০০ ইউনিটের জন্য এই ইনসেন্টিভের কভারেজের হার উৎপাদন ব্যয়ের ১০%। তাহলে যা দাঁড়াচ্ছে তা হলো, ৩০০ ইউনিটের পরের প্রতি ইউনিটের জন্য একজন উচ্চ ব্যবহারকারী মোট ব্যবহৃত ইউনিটের ওপরে ০.১% ইনসেন্টিভ কভারেজ হিসাবে দেবেন। এইভাবে এদের কাছ থেকে নেয়া গড় উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে বাড়তি মোট যে অতিরিক্ত অর্থের সংস্থান হবে তা ৩০০ ইউনিটের কম ব্যবহারকারীদের মধ্যে এমনভাবে বণ্টন করা হবে, যেন একজন কম ব্যবহারকারী বেশি হারে ইনসেন্টিভ পান।
এইরকম একটা ব্যবস্থা চালু করা গেলে এক দিকে যেমন ভর্তুকি হ্রাস পেয়ে শূন্যের কোঠায় চলে আসবে, অন্যদিকে তেমনই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ব্যাপারে সকল পক্ষই যত্নবান হবেন। আর বিদ্যুৎ সাশ্রয় হলে অধিক মানুষ যে বিদ্যুতের কাভারেজে আসবেন এটা তো জানা কথাই। তাছাড়া ভর্তুকি থেকে বের হতে পারলে তা যে নতুন উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে অর্থায়ন পাওয়া সহজ করবে, সেকথা আগেই বলেছি। এই নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি যদি মেগা পাওয়ার প্ল্যান্ট হয় তবে সেসবে ইকনোমিজ অব স্কেলের কারণে গড় উৎপাদন ব্যয় আরো কমানো সম্ভব হবে। আর তার সুবিধা পাবেন সকল পক্ষই।
৬৬৫ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন নিয়ে ভাবনা”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    গতকাল ঘুমাইনি। তারউপর সংখ্যার হিসাব একটু কম বুঝি। লেখাটা সময় নিয়ে পড়তে হবে। আপাতত ইটা ফালানো মূলক কমেন্ট করে গেলাম। তবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে কিন্তু নিয়মিত পাবলিক হিয়ারিং হয় এবং সেখানে মারদাঙ্গা আইনী যুদ্ধ চলে। যতদূর জানি বিইআরসি এই ব্যাপারে বেশ স্বচ্ছ।


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভালো লেখা।
    আজই আপনাকে বলতে চাইছিলাম যে ফেবুর মাদকতা কমান। ব্লগ লিখুন বেশি করে।
    :clap: :clap: :clap:


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।