নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ভাবনা-২

নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ভাবনা-১

খুব নগন্য সংখ্যক হলেও কাউকে কাউকে এই বিষয়টাতে আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখে ভোটিং সিস্টেম নিয়ে আরও কিছু লিখালিখির ইচ্ছা হলো।

আজকে সিম্পল প্লুরালিটির কিছু সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করছি।

এই পদ্ধতিটি যা আমাদের দেশসহ বৃটিশ ঘরাণার বেশিরভাগ দেশেই এখনো প্রচলিত আছে তার প্রধান দুর্বলতা হল, এটা বহুদলীয় গনতন্ত্রকে ক্রমে ক্রমে দ্বি-দলীয় গনতন্ত্রে পরিনত করে ফেলে।

এ বিষয়ে ফরাসি আইন ও সমাজবিজ্ঞানি মরিস ডুভারগার পঞ্চাশ-ষাট দশকসমুহে এই নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে দুটি তত্ব প্রস্তাব করেছিলেন।

তাঁর প্রথম তত্বে তিনি তথ্য প্রমান দিয়ে দেখিয়েছিলেন আমাদের মত আসনভিত্তিক নির্বাচন (যা উইনার টেকস অল বা ফার্স্ট-পাস্ট-দ্যা-পোল নামেও সুপরিচিত) যে সব দেশে হয় তা হতে থাকলে কিভাবে ক্রমান্ময়ে তা (গনতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাটি) তার বহুদলীয় চরিত্র হারিয়ে দ্বি-দলীয় গনতন্ত্রে পরিনত হয়।

তবে তিনি আশাবাদ ব্যাক্ত করেছিলেন যে এজন্য “পর্যাপ্ত” সময় অতিবাহিত হওয়া প্রয়োজন। আমার মনে হয় পর্যাপ্ত অর্থে তিনি বেশ বড় একটা সময় মিন করেছিলেন। এবং তিনি আশা করেননি যে তাঁর জীবিদ্দশায় তিনি এরকম ঘটা নিজ চোখে দেখে যেতে পারবেন। পরবর্তিতে গর্ডন তুলোক নামক তার এক সহকর্মি ডুভারগারকে বলেছিলেন, “তোমার মতবাদ ঠিকই আছে তবে তা ঘটতে কমপক্ষে ২০০ বছর লেগে যাবে।”  তাই যদি হয় তাহলেতো দেখা যাচ্ছে ডুভারগারের এই “পর্যাপ্ত” সময়টি নিয়ে তো তাহলে তেমন দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

কিন্তু ঘটনা তা নয়। গর্ডন সাহেব যে জ্ঞানভিত্তিক পশ্চিমা রাজনীতি চর্চ্চার প্রেক্ষাপটে ঐ আশাবাদ (২০০ বছরের) ব্যক্ত করে ছিলেন তা যেসব দেশে নাই, সেখানে কি হতে পারে সে ধারনা তার ছিল না। আমাদের দেশের উদাহরন দেখলেই তা বোঝা যাবে। ৯১-তে প্রধান দুদলের বাইরে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোট পড়েছিল। তারা আসন পেয়েছিলো ৬০ এর বেশী। প্রধান বিরোধী দল দুটোর বাইরে এগারোটা ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের দল সংসদে ছিল যারা ওয়াচ ডগের ভুমিকা পালন করতে পারত। করেও ছিলো। অথচ ২০০৮-এ এই দুই প্রধান দলের প্রভাবমুক্ত সাংসদের সংখ্যা নেমে এসেছে ১ জন-এ। ভোটের অংশ ৫% এরও কম। এর পরেও কি প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হবে, “দ্বি-দলীয় গনতন্ত্রের কত দেরী পাঞ্জেরী?”

দেখুন তো আমরা কতো ফাস্ট।  দুশো বছরে পশ্চিমারা যে পথ পাড়ি দেবার কথা ভাবছিলেন, আমরা তা কি চমৎকারভাবে মাত্র বিশ বছরে পাড়ি দিয়ে ফেললাম!! আমরা মাত্র কুড়ি বছরের বহুদলীয় গনতন্ত্র চর্চ্চায় যেভাবে ডুভারগারের তত্বের সত্যতা প্রমান করে ছাড়লাম তা তাঁর জীবদ্দশায় এক অনন্য অর্জন হয়ে থাকবে।

ডুভারগার-এর দ্বিতীয় তত্বটি ছিলো এথেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্পর্কিত। অর্থাৎ বহুদলীয় গনতন্ত্রকে দ্বিদলিয় গনতন্ত্রে পরিনত হওয়া থেকে রক্ষা করা সংক্রান্ত। এটা শুনেই বুঝা যাচ্ছে যে দ্বি-দলিয় গনতন্ত্র জিনিষটা নিশ্চই খুব সুখকর কোন পন্থা না। তা যদি হতোই, তবে তাথেকে উত্তরন বাধাগ্রস্থ করতে হবে কেন?

ডুভারগার-এর দ্বিতীয় তত্বে যে প্রস্তাবগুলি বা বিকল্পগুলি আছে তা দেখে যে জিনিষগুলি পরিষ্কার করে বুঝলাম তা হলো –
১) কেন গনতন্ত্রচর্চ্চাকারী রাস্ট্রসমুহ ক্রমান্ময়ে তাদের এইজ-ওলড “উইনার টেকস অল” সিস্টেম ত্যাগ করে ডুভারগার প্রস্তাবিত পদ্ধতিসমুহের কোন একটি বেছে নিচ্ছেন?
২) নতুন করে গনতন্ত্রের চর্চ্চা শুরু করা দেশগুলির কাছে উইনার টেকস অল সিস্টেমটি কেন এত অপছন্দনীয়?
৩) উইনার টেকস অল বা ফার্স্ট-পাস্ট-দ্যা-পোল সিস্টেমটি কেন বহুদলীয় গনতন্ত্র ধ্বংসকারী একটি পদ্ধতি বলেও অনেকে মনে করেন। যদিও এর বিপক্ষে ব্রিটিশ বা আমেরিকান উদাহরন দিয়ে দাবী করা হয় যে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের দায়িত্বশীল আচরন এই দ্বিদলীয় পদ্ধতিতে উত্তোরনের গতি এবং কুফল কমাতে সক্ষম। তবে একথাও অনস্বীকার্য যে সেরকম দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন রাজনীতির চর্চ্চা আমাদেরসহ অনেক দেশেই আশা করাটা ঘোর বোকামি।

প্রশ্ন হলো কি ছিল ডুভারগারের প্রস্তাবে?  ১) ফার্স্ট-পাস্ট-দ্যা-পোল সিস্টেম ছেড়ে কোন একটা প্রোপরশনাল রিপ্রেসেন্টেশন পদ্ধতি বেছে নেয়া। ২) একান্তই যদি সম্ভব না হয় তবে অন্ততঃ পক্ষে রান অফ বা দুই পর্বে নির্বাচন করা।

বৃটিশ ঘরানার অনেকেই কিন্তু ডুগারভারের তত্বের সারবেত্তা বুঝতে পেরে পি আর -এর কোন একটা পদ্ধতিতে চলে গিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। খোদ বৃটিশ আইলস-এ স্কটল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস ও লন্ডন-এ এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। কমন্স সভায়ও এটা ব্যবহারে চাপ আছে। অচীরেই তা হয়েও যাবে বলেই মনে হচ্ছে।

দায়িত্বপুর্ন আচরন করে দ্বি-দলীয় পদ্ধতিতে উত্তরন যতই পেছানো যাক না কেন, ফার্স্ট-পাস্ট-দ্যা-পোল সিস্টেমের ইনহেরেন্ট দুর্বলতা কিন্তু তাতে কমে না। আর তা হলো, এই পদ্ধতিতে কাস্টেড ভোটের একটা বিরাট অংশই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারনে কোন ভুমিকা না রাখতে পারা। সোজা ভাষায় যাকে “ওয়েস্টেড ভোট” বলা হয়। ২০০৫-এর কমন্স সভার নির্বাচনে এই ওয়েস্টেড ভোট-এর হার ছিল ৭০% এর চেয়েও বেশী। এই বিপুল সংখ্যক ভোটের ফলাফলে ভুমিকা না রাখাটা ভোটদাতা গনের জন্য ডিমরালাইজিং ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। কালক্রমে ভোটারগন ভোটদানে আরো বেশী বেশী নিরুৎসাহীত হয়ে পড়েন। এই পদ্ধতিটি তা থেকে উত্তরনে কোন ভুমিকা রাখতে পারে না।

এর বাইরে আরও যে সমস্যাগুলো পরিস্থিতি খারাপ করাতে ভুমিকা রাখে তা হল, ১) ভারসাম্যপূর্ন আসনে ক্ষুদ্র একটি ভোটার গোষ্ঠিকে প্রভাবিত করে ফলাফল পালটে ফেলা, ২) ব্যাক্তিকেন্দ্রিক প্রচারনা নির্ভরতার জন্য ব্যাক্তিপর্যায়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা এবং তা থেকে শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটা, ৩) এইসব প্রচারনার মধ্য দিয়ে অকারন ব্যয়বহুলতা, ইত্যাদি।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে এ পদ্ধতি যদি এতই খারাপ হবে তাহলে এটা এলোই বা কেন, আর টিকে আছেই বা কি করে?

টিকে থাকার কারনটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঐতিহ্যগত কারনে। যুক্তিগ্রাহ্য কারনে অনেকক্ষেত্রেই এটা আর এইজন্য টিকে থাকছে না।

আর আসার কারনটা তো খুব সিম্পল। যে সময়ে এটা এসেছিল, তখন ব্যাপকহারে পি আর ব্যবহারের মত প্রযুক্তিগত সামর্থ কারো ছিলো না। এখন সামর্থ অর্জন করার পরেও ফার্স্ট-পাস্ট-দ্যা-পোল সিস্টেম আকড়ে থাকাটা হবে ঐতিহ্যের কারনে ট্রেন-প্লেন বাদ দিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে ভ্রমন করার মতই হাস্যকর।

আর কতকাল আমাদের এই হাস্যকর অবস্থার মধ্য দিয়ে চলতে হবে কেউ তা জানে না…

নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ভাবনা-৩

১,৯৩৬ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ভাবনা-২”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    পারভেজ ভাই,
    পরবর্তী পোস্টে 'পি আর পদ্ধতি' এবং 'রান অফ বা দুই পর্বে নির্বাচন' নিয়ে বিশদ আলোচনার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি... :dreamy:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আরো কিছু উদাহরণ দিলে পাঠকদের বিষয়টা বুঝতে আরেকটু সুবিধা হতো।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    জুনায়েদ কবীর, মোকাব্বির এবং রাজীব
    এই সিম্পল প্লুরালিটির বিকল্প ভোটিং পদ্ধতি সম্পর্কে আদৌ কেউ কোন আগ্রহ রাখে কিনা, সে ব্যাপারে বেশ সন্দিহান ছিলাম। এইজন্য প্রথম প্রয়াশ হিসাবে এই লিখাটা যথা সম্ভব হালকা রাখার জন্য টেকনিক্যাল বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়েছিলাম।
    সবার আগ্রহ দেখে ভালো লাগলো। ইনস্পায়ারড বোধ করছি।
    পরবর্তীতে মূল ধারনাকে যথাসম্ভব ভারী না করে আরো বেশী তথ্য সন্নিবেশ করার ইচ্ছা রইল।
    আগ্রহ দেখানোর জন্য ধন্যবাদ।


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : পারভেজ (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।