ইডি মানে এক্সট্রা ড্রিল

ক্যাডেট কলেজে ক্লাস সেভেনে সাধারণত কেউ এক্সট্রা ড্রিল খায় না। তবুও আমাদের মঈনুল আর সাজেদ যখন এক্সকারশনে গিয়ে কোকের বোতল ঝাঁকিয়ে কোক ছিটানোর অপরাধে ক্লাস সেভেনেই ইডি’র স্বাদ গ্রহণ করল, আমাদের কেউ কেউ ওদের দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাঁকাত আর ভাবত আহারে, ছেলে দুইটার কত কষ্ট হল। কেউ কেউ ভাবত, ক্লাস সেভেনেই ইডি?!! এরা নষ্ট হয়ে গেছে। এরাই একসময় ব্যাচের মান সম্মান ডুবাবে। কলেজের ডিসিপ্লিন নষ্ট করবে। আর কেউ কেউ ভাবত, ভাই রে ভাই। এরা তো জিনিস। ক্লাস সেভেনেই ইডি খেয়েছে। শাবাস ম্যান। তোরাই বস।

আমি নিজে ক্লাস সেভেনে ইডি খেয়ে কোন অস্বাভাবিকতার জন্ম দেইনি। কিন্তু ক্লাস এইটে এক বছরে ১২ টা ইডি খাওয়ার পরে সিদ্ধান্ত নিলাম যে বাকি ক্যাডেট লাইফ ইডি খেয়ে লিজেন্ডারি পর্যায়ে যেতে হবে। ভাবলাম, ইডি যে খাব তার তো একটা স্পেশালিটি থাকা উচিত। ভাবলাম ইডির জন্য আলাদা খাকি বরাদ্দ রাখি। তাই ক্লাস এইটের পুরানো খাকি দিয়ে আমি ক্লাস নাইনও পার করলাম। ক্লাস নাইনে যেই দুই সেট খাকি দেয়া হয়েছিল ওগুলো আমি শুধু ইডি খাওয়ার জন্য ব্যবহার করতাম। গেমস টাইম ছাড়া ওই দুইটা খাকি কোনদিন আমি অন্য কোন সময়ে গায়ে দেইনি।

ক্লাস ইলেভেনে উঠার পর খাকি গুলা টাইট হয়ে গেলেও টুয়েলভের মাঝামাঝি পর্যন্ত ওই দুইটা খাকি দিয়েই ইডি খেয়েছি। টুয়েলভের শেষের দিকে আমাদের কলেজে ডাংরি নামক একটা ইডির ড্রেস দিল। প্যান্ট, শার্ট একসাথে। এয়ারফোর্স পাইলটদের কভারঅলের মত। ক্লাস ইলেভেনে থাকতে একবার আমাদের কলেজে এয়ার ফোর্স থেকে মোটিভেশন করার জন্য একটা টীম এসেছিল। ওইখানে পাইলটদের কভারঅল দেখে আমাদের মনে প্রশ্ন জেগেছিল যে তাদের টয়লেট করতে হলে কি উপরের অংশ পুরাটা খুলতে হয় নাকি? ডাংরি পরে ইডি খাওয়ার সুবাদে সেই প্রশ্নের উত্তর আমরা পেয়ে গিয়েছিলাম।

ইডি খেয়ে লিজেন্ডারি পর্যায়ে যাইতে চেয়েছিলাম। পারি নাই। যদিও আমি জেপিশীপ প্রিফেক্টশীপের কল্যাণে অনেক ইডিই ড্রেস রেস্ট্রিকশনের উপর দিয়ে পার করছি তবুও আমার ইডির সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। ৪৮ টা। আর আমাদের মোহাম্মদের ইডির সংখ্যা ৭৫ টা! পার্থক্য অনেক। তার কাছে আমি নিতান্তই শিশু। এককালে কামনা ছিল যে ব্যাচের হাইয়েস্ট ইডি খাব কিন্তু ইডির লিস্টে নাম আসলে মনটা খারাপ হয়ে যাইত যে আজকে গেমস করতে পারব না। সবাই গেমস করবে আর আমি মাঠের চারপাশে পিঠে ৬ টা ইট নিয়ে চক্কর দিব। সবাই পায়ে ফুটবল নিয়ে দৌড়াবে আর আমি কাঁধে একটা শেল নিয়ে মাঠের এইপাশ থেকে ওইপাশ দৌড়াব। কাদার ভেতর ফ্রন্টরোল, সাইডরোল দিয়ে ভূত হয়ে যাব। আর এডজুটেন্ট আসলে তো ওইদিন রোজ কেয়ামত।

একটা একটা ইডি খেতাম আর ভাবতাম, নাহ, আর না। এখন থেকে ভালো হয়ে যাব। আর কোথাও লেট করব না। জুতা, মেটাল সবসময় পালিশ করা থাকবে। ক্লাসে আর উলটাপালটা কিছু করা যাবেনা। এইসব ভাবতে ভাবতে আর ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে ক্যান্টিনে বসে কোক খেতে খেতে আবার আমরা মাগরিবের নামাজে লেট করতাম। আবার স্টাফরা আমাদের নাম নোট করত। আবার আমাদের নাম আসত ইডির লিস্টে। এইভাবেই কাটত আমাদের আবারও ফিরে চাওয়া সেই দিনগুলি।

লম্বা লেখা। পুরোটা পড়তে জীবনের মূল্যবান ২/৩ মিনিট সময় চলে গিয়েছে। আসুন আমরা জীবনের আরও একটি মূল্যবান সময় নষ্ট করি। এক মিনিট নীরবতা পালন করি সেইসব মহামানবদের উদ্দেশ্যে, যারা ৬ বছর ক্যাডেট লাইফ পার করেও একটা ইডি’র অভিজ্ঞতা অর্জন থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

২,৫৭০ বার দেখা হয়েছে

১৫ টি মন্তব্য : “ইডি মানে এক্সট্রা ড্রিল”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    দু'-পাঁচ দিনের জন্য এমন একটা ভাবনা আমার মাথায়ও এসেছিলো ।
    সেটা ক্লাস সেভেনে এক্সট্রা ড্রিল শব্দের সাথে পরিচয় ঘটবার আগেই ।
    তবে এর পর সেটা হারিয়ে গিয়েছিলো ...
    তোমার লেখা পড়ে আমার সেই স্মৃতি মনে পড়লো ।
    বিষয়টা একটা লেখায় এসেছে যা এই সিসিবিতে পোস্ট করা আছে ।
    লিংকটাও দিচ্ছি এখানে।
    //cadetcollegeblog.com/lutful/50959

    লিখে যাও । 🙂

    জবাব দিন
  2. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    তুমি যে ক্যাডেট কলেজের চিত্র দিলে সে ক্যাডেট কলেজে আমি টিকতে পারতাম না। আমার পুরনো বন্ধুরা এখনও আমার আনটাইডি ড্রেস-আপ নিয়ে হাসাহাসি করে এবং ফেসবুকে দেখা ফিটফাট পোশাকে এই আমিকে পুরনো শান্তার সাথে মেলাতে পারে না। যাই হোক লেখা ভালো ছিল।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  3. I broke the discipline many times...smoked in the college premises,got late in the PT even once after the counting.got down in the pond in restricted time,stole date juice,mangoes,guavas n other fruits...played dorm cricket,punished juniors,unobeyed the dress code,scolded staffs,teased teachers,changed exam script in the hall...stood for principal parade without button,sometimes without proper shoe polish...even walked over the shed after lights off to another house & so many things...brought many cig packs for the smoker groups from CMH,from picnic & many more things those can't remember right now...but never got an ED,only an extra prep(which I dodged too) & fine in my 6 years tenure in JCC

    জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    ক্লাস সেভেনেই এক্সকারশন?
    আমাদের সময়ে এমসিসিতে ইডি'র প্রয়োগটা এতটা মারাত্মক ছিলোনা। তবে কিছু কিছু ক্রনিক ডিফল্টাররা রেগুলার ইডি খেতো। তাদের মধ্যে ছিলো আমারই ব্যাচমেট ১৮৮, যে তার নিজের নামের চেয়ে ঐ ক্যাডেট নাম্বারটা দিয়েই বেশী পরিচিত ছিলো। সেটা শুধু এমসিসিতেই সীমাবদ্ধ ছিলোনা, আমাদের অন্যান্য সিসি'র বন্ধুদের সাথেও সে ঐ সংখ্যা দ্বারাই পরিচিত ছিলো। সংক্ষেপে অনেকে তাকে শুধু "টেইট" বলতো, ওয়ান এইটী এইট এর অপভ্রংশ হিসেবে। এমনকি শুনেছি সে বিদেশের যেখানে যেখানে ছিলো, সেখানকার ছোট বড় সিসি বন্ধুরাও তাকে ওভাবেই চিনতো। সে খুব চঞ্চল প্রকৃ্তির ও কঠোর যুক্তিবাদী ছিলো, তাই কথার একটু উনিশ বিশ হলেই ইডি খেতো। তখন ইডি পরিচালিত হতো এফ এইচ আর এস এইচ এর মাঝামাঝি রাস্তাটির উপর, যেখানে সাধারণতঃ স্টেজ করা হয়ে থাকে। লাঞ্চের পর কিন্তু গেমসের আগে গরম রাস্তার উপরে ক্রলিং, ফ্রন্ট রোল, সাইড রোল, ফ্রগ জাম্প ইত্যাদি করিয়ে ইডি শেষ করা হতো। তখনো ইডির সময় ইট কিংবা শেল প্রয়োগের প্রচলন শুরু হয় নাই।
    বিএমএ লাইফে আমার একটা ইডি'র কথা বলি। সাধারণতঃ যখন ইডি পেতাম, তা কী অপরাধে পেতাম তা আগে থেকেই জানতাম। একদিন হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই ইডি তালিকায় নিজের নাম দেখে বিস্মিত হ'লাম। যথারীতি প্রস্তুত হয়ে ইডিতে হাজির হয়ে দেখি, ইডি পরিচালনা করবেন ১ নং প্লাটুনের এনসিও প্রশিক্ষক হাবিলদার আলী আকবর খান, ই বেঙ্গল (বর্তমানে মরহুম, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে বেহেস্ত নসীব করুন!)। আমি ছিলাম ২ নং প্লাটুনের। বিএমএতে তখন একটা প্রতিযোগিতার মত শুরু হয়ে গিয়েছিল যে এক প্লাটুনের ওস্তাদরা সুযোগ পেলেই অন্য প্লাটুনের জিসিদের টোকাই করতেন। আমি তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কী অপরাধে ইডি দেওয়া হয়েছে? উনি পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবই বের করে আমাকে দেখালেন। দেখলাম, তাতে লেখা আছে- "GC 139-LOV"। আমি বুঝতে পারছিলাম না। LOV বলতে কি উনি লাভ টাভ জাতীয় কোন কিছু বুঝাচ্ছেন নাকি? তখন তো আমাদের ব্যক্তিগত চিঠিপত্রগুলো সেন্সর করা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা করলেও তো করবেন এ্যাডজুট্যান্ট স্যার, কোন এনসিও তো নয় নিশ্চয়। তাই তাঁকে আবার LOV এর অর্থ জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, "ভিহিকালে (Vehicle এ) উইঠ্যা এত হাসেন ক্যান?" ইডি পাইছেন "লাফিং অন ভিহিকাল" এর জন্য।
    বুঝলাম, "লাফিং অন ভিহিকাল" ই তাহলে LOV!
    মনে পড়লো, ফায়ারিং রেঞ্জ থেকে ফেরার সময় আমি বসেছিলাম একটা ৩ টন লরীর একেবারে শেষে, টেইল বোর্ড ঘেঁষে। আমাদের ট্রাকটার ঠিক পেছনেই আসছিলো ১ নং প্লাটুনের ট্রাক, যেটার ফ্রন্ট সীটে বসা ছিলেন ওস্তাদ (হাবিলদার) আলী আকবর খান। তাঁর সাথে আমার কয়েকবার চোখাচোখিও হয়েছিলো। ফেরার সময় সতীর্থ ফিরদাউস আহমেদ (আর্মি দলের এবং সম্ভবতঃ জাতীয় হকি দলেরও, নামকরা গোল কীপার ছিলো একসময়ে) আমার পাশে বসেই দারুণ একটা জোক বলেছিলো। আমি হাসিতে ফেটে পড়েছিলাম, আর ওস্তাদ আলী আকবর খান পেছনের ট্রাকের ফ্রন্ট সীটে বসে সেটাই লক্ষ্য করেছিলেন। আর যাই কোথা!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : লুৎফুল (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।