একজন মিজানের গল্প

001

002

একটা প্রশ্ন দিয়েই শুরু করি আজ। আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি যে, ক্যাডেট কলেজে সবসময় শুধুমাত্র সফল প্রাক্তন ক্যাডেটদেরই আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়? যারা তাদের ক্যারিয়ার ও জীবনে উজ্জ্বল-তাঁরাই আমাদের রোল মডেল হয়ে থাকেন। হ্যাঁ, স্বাভাবিক; তাঁদের সাফল্য আমরা অনুপ্রাণিত হবো অবশ্যই। কিন্তু এটা কি আমাদের কখনো মনে হয়েছে যে, এমনও ক্যাডেট থাকতে পারে যারা ঠিক ততটা সফল নয়? তারা কোথায় কেমন আছে সেই খোঁজে আমরা খুব একটা আগ্রহীও হই না। তারাও তাদের যাবতীয় অক্ষমতা, ব্যর্থতা আর না- পারার গ্লানিটুকু নিয়ে অন্তরালেই থেকে যায়। ব্যাপারটা যেন এমন দাঁড়িয়ে গেছে যে ক্যাডেট মানেই সফল। আর যারা তা নয়, হতে পারেনি-সেটা যেকোনো কারণেই হোক-তাদের এই পরিচয়টা, কখনো তাদের অস্তিত্বটুকু পর্যন্ত আমরা বিস্মৃাত হই। কেন? আমরা কি তাদের সাথে নিজেদের ্পরিচয় শেয়ার করতে লজ্জা পাই?
আমরা সব কলেজই একটা কাজ কমবেশি করে থাকি। সেটা হলো, ক্যাডেটদের সামনে উজ্জল, সফল একজন প্রাক্তন ক্যাডেটকে তুলে ধরা। উদ্দেশ্য-মেধায়, মননে, যোগ্যতায় নবীন যেন প্রবীণের মত হয়ে উঠতে পারে; অথবা ছাড়িয়েও যেতে পারে। তাঁর সাফল্যের মূলমন্ত্রে যেন এরা উজ্জীবিত হতে পারে। কিন্তু, ভাবনাটা একটু বিপরীতমুখীও হলেও তো ক্ষতি কিছু নেই। এমন কোন প্রাক্তন ক্যাডেট যদি ওদের সামনে দাঁড়ায়, যার ওদের সাথে শেয়ার করার মত কোন সাফল্যের গল্প নেই-তাহলে ওরা কি কিছুই শিখবে না?
আজ আমি মিজানকে ( সে একজন প্রাক্তন ক্যাডেট, আমার সহপাঠী এবং সে একজন মানুষকি রোগী ) দাঁড় করিয়ে ছিলাম তার জুনিয়র কলেজ মেটদের সামনে। কিছুই না, শুধু নিজের পরিচয়টুকু দিয়েছে। এরপর আমি ওদের বলেছি মিজানের আদ্যোপান্ত। বলেছি, যেন ওরা দুর্বলকে উপহাস করতে না শেখে। কখনো কখনো মানিয়ে নিতে না পারার ফল কী ভয়ংকর হতে পারে তা এইটুকু বয়স আর অভিজ্ঞতায় ওদের বোঝার কথা নয়। যেমন বুঝিনি আমরাও। সেই সময়, সবসময় চুপচাপ, নিজের ভিতর গুটিয়ে থাকা মিজানের বন্ধু আমরা কেউই হয়ে উঠতে পারিনি। চাইওনি। আমরা সাফল্য দেখেছি, সাফল্যের পথে হেঁটেছি। ব্যর্থ, অপাংক্তেয় মিজানকে আমরা মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি। অথচ ও তো আমাদেরই একজন ছিলো। আজ ভেবে অনুতাপ হয়, কেন তখন আরেকটু অন্যরকম ভাবলাম না? আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধ আর ক্যাডেট স্পিরিট যেন ব্যর্থদের, পিছিয়ে থাকাদের জন্য ঠিক ততটা কার্যকর ছিল না। হয়ত আজও থাকে না।
ঠিক এই জিনিসটাই যেন আজকের ক্যাডেটদের মধ্যে কাজ না করে সেজন্য আজ মিজানকে ওদের সামনে দাঁড় করালাম। ওকে দেখে, আমার মুখে ওর কথা শুনে এইটুকু অন্ততঃ বলতে পারি যে আজ ক্যাডেটরা নতুন একটা ব্যাপার ভাবতে শিখল। প্রদীপের আলোর নিচের অন্ধকারটুকু এড়িয়ে না গিয়ে যেন ভালো করে দেখতে শেখে আজকের ক্যাডেটরা এবং ওদের দেখে আমি নিশ্চিত যে, মিজান ওদের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। আমি এটুকুই চেয়েছিলাম।
সাফল্যের মোহ আর চাকচিক্যে ওরা যেন হৃদয়হীন না হয়ে যায়। নিজের দুর্বল ক্যাডেট বন্ধুটিকে উপহাসে জর্জরিত না করে তার পাশে দাঁড়ানোর মত মনের জোর যেন ওদের সব সময় থাকে।
সবাই ভালো থাকবেন।

২,৮২৯ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “একজন মিজানের গল্প”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    মোবাশ্শির ভাই আপনাকে হৃদয়ের গভীর থেকে শ্রদ্ধা ও স্যালুট। ক্যাডেট কলেজ সিস্টেমে প্রত্যেকটা মানুষ তাদের সামর্থ ও এক্তিয়ারের মাঝে অনেক কিছু করার সুযোগ রাখেন। বেশীরভাগ সময় করেও থাকেন। কিন্তু এ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে আপনি সেটা এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছেন। খুব ভাল লাগছে ব্যাপারটা দেখে।


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  2. সামিউল(২০০৪-১০)

    ভাই, যা বলতে চাচ্ছিলাম মোকাব্বির ভাই বলে দিয়েছেন। আপনার প্রতি সহস্র ::salute:: ::salute:: ::salute:: ::salute:: ::salute::
    আল্লাহ্‌ আপনার এবং মিজান ভাইয়ের মঙ্গল করুন।


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  3. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    ছবিদুটো দেখে আর লেখা পড়ে চোখে পানি চলে এলো।
    এর বেশী কি-ই বা বলার আছে।
    মিলনায়তনে দর্শক-শ্রোতার সারিতে যে ক্যাডেটরা বসে ছিলো, তাদের সৌভাগ্যরে কথা ভেবে আপ্লুত হয়ে আছি।

    জবাব দিন
  4. সাবিহা জিতু (১৯৯৩-১৯৯৯)

    তোমার মতন করে ভাবতে পারলে আমাদের সমাজ থেকে আল্গা মুখোশধারীদের সংখ্যা বিলীন হয়ে যেত, অভী। তোমাকে ছোটবেলা থেকে চিনি, কিন্তু কখনো তোমার এই রূপ দেখা হয়নি। খুবই গর্ববোধ হচ্ছে। তোমাকে যারা ক্লাশমেট এবং এখন যারা এ্যাডজুটেন্ট হিসেবে পাচ্ছে নিশন্দেহে তারা ভাগ্যবান এবং এই বর্তমান ক্যাডেটগুলোর তোমার থেকে পাওয়ার এবং নেওয়ার অনেক কিছু আছে।
    আমি ব্যাক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের শিশুদের সমাজের ভালো-খারাপ, ন্যায়-অন্যায়, সফলতা-ব্যার্থতা সবকিছুর সাথে পরিচয় করানোর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এতে করে ছেলেবেলা থেকেই ওদের মানসিক ধারনক্ষমতা এবং চিন্তাপ্রসারতা বৃদ্ধি পায়। এই কারণেই আমার সাত বছরের মেয়ে এবং তিন থেকে চার বছরের প্রি-স্কুলের ছিছুদেরকে আমি ইতিবাচক ব্যাখ্যা দিয়ে ওদের মত করে আমাদের চারপাশের অনেককিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আর এটা করতে গিয়ে আমাকে আমার পরিবার, গার্জিয়ানদের থেকে বেশ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল শুরুর দিকে। পরে আমি গার্জিয়ানদের সাথে নিয়ে একটা ছোটমতন ওয়ার্কশপের আয়োজন করি, যেখানে তাদের বোঝাতে সক্ষম হই যে সচেতনতা তৈরীর ক্ষেত্রে এবং পজিটিভ দৃষ্টিভঙী তঈরীর ক্ষেত্রে শিশুকাল থেকেই একটা গ্রাউন্ড তৈরী করা দরকার। হয়তো হ্যা, এতো ছোট বয়সেই ভালো-মন্দ বা ন্যায়-অন্যায়েত বিচারের ভার ওদের দেয়া যাবে না, কিন্তু ওদের সাথে গল্পের ছলে বা কিছু দৃষ্টান্তমূলক উদাহরন উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আমরা ছোটখাট অনেক বিষয় সম্পর্কে ধারনা দিতে পারি। তোমার এই ঘটনা আমাকে নতুন করে ভাবাতে শিখালো, অভী। life is not a bed of roses and those who can keep going managing the odds, are the fittest. সাফল্যকে যেমন আলিঙন করতে জানতে হবে, অসফলতাকে বা ব্যার্থতাকে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের আশপাশের ছোট-বড়, ধনী-গরীব, সফল-ব্যার্থ সবাইকে সম্মান করতে হবে, মানুষের যোগ্য সম্মান দিতে হবে। আর এই দৃষ্টিভঙীর পরিবর্তনটা ওভারনাইট পরিবর্তন আশা করাটা বোকামী। তাই আমার মনে হয় আমরা যারা পরবর্তী প্রজন্মকে গড়ার দায়িত্বে আছে, আমাদের মত অভিভাবক, শিক্ষকদের এই ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সেই নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে।
    আজ মিনা ফুপ্পীর প্রতি আরো একবার শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসছে। সন্তান হিসেবে তোমাদের প্রশংসা শুনে এসেছি সবসময়, কিন্তু এরকম একজন মানুষ তৈরী করে গেছেন যে মা, সে নিসন্দেহে মহিয়সী।


    You cannot hangout with negative people and expect a positive life.

    জবাব দিন
  5. সব ক্যাডেট কলেজে সব ব্যাচেই কম বেশি দুই একজন থাকে - যারা ক্যাডেট জীবন পূর্ণ ভাবে শেষ করার পরে ও বাইরে এসে প্রচলিত সমাজের সঙ্গে তাল মিলাতে পারে না অথবা সমাজের পংকিল পথে পা বাড়ায় -- হয় সমাজের পিছনে পড়ে থাকে নয় তো হারিয়ে যায়।
    আমার দুই বন্ধু, খুবই মেধাবী চিরতরে হারিয়ে গেল এভাবে ---
    একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষে - নিজ পরিবারের দানকৃত জমিতে প্রতিষ্টিত স্কুলে একযুগের বেশী শিক্ষকতা করেও চাকুরী স্থায়ীকরণ তো দুরের কথা - বেতন পায়নি এক টাকাও। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে চলে গেল ওপারে ---
    আরেকজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রিতে চান্স পেয়েও কিভাবে যেন চলে গেল অন্ধকার জগতে - অতঃপর না ফেরার দেশে।।

    আরেকজন - এখনও আছে বেঁচে -- ডাক্তার হয়েছে জীবনের মূল্যবান এক যুগের বেশী সময় ব্যয় করে -- ঔষধ, সর্বনাশা ঔষধ , ততঃপর আরো কিছু -- কখনো ডাক্তার, কখনো রোগী

    আমার সবসময় মনে হয়েছে -- আমরা বন্ধুরা ওদের পর্যাপ্ত সময় দেইনি, যখন দরকার ছিল। অথচ কি আবেগময় সময় কাটিয়েছি ওদের সঙ্গে --
    মিছে আত্মশান্তনা দেই --আমরা ব্যস্ত ছিলাম নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে, কত টুকু সময়ই বা দিতে পারতাম তাদের ঐ সময়?
    তবুও মন কাঁদে --তোদের জন্য --

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাবিহা জিতু (১৯৯৩-১৯৯৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।