একজন পর্বতারোহী ও কিছু কথা ২য় পর্ব

I wished to acquire the simplicity, native feelings, and virtues of savage life; to divest myself of the factitious habits, prejudices and imperfections of civilization; … and to find, amidst the solitude and grandeur of the western wilds, more correct views of human nature and of the true interests of man. The season of snows was preferred, that I might experience the pleasure of suffering, and the novelty of danger.

ESTWICK EVANS, in his book A PEDESTRIOUS TOUR
The course 275 on the way to Bakkhim
ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা আমার motivation টা কোথায়। তবে কষ্টের সুখটা আমিও উপভোগ করে থাকি। আর পাহাড়ে একা চলার আইডিয়াটা যে আমিও রোমান্টাসাইজ করি তা তো বলেছিই। তার পরেও কথা থেকে যায়। ফ্যানটাসি আর রিয়েলিটি দুটো এক জিনিস নয়। পাহাড়ে চলার মতো boring কাজ দুনিয়াতে আর নেই। কোন কাজ নেই, শুধু চলছি আর চলছি। মনের আবেগ কেমন যেন শুন্যের মতো। সুন্দর একটা জায়গা পেয়ে যে ক্যামেরাটা বের করে একটা ছবি তুলবো তারও মানসিক শক্তি নেই। আপাতত চলাই যেন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। মনটা ব্যস্ত রাখতে হলে দরকার খুবই শক্ত একটা বিষয় । যেটা জীবনে সেরকম গুরুত্বপূর্ণ। তার কথা ভেবে যদি মনটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখা যায় আরকি। আসলে পর্বতারোহণটা জীবন থেকে আলাদা কিছু নয়। নিজেকে খোঁজার একটা তাগিদই সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। সামনে কি আছে অজানা থাকায় এই আপাত অর্থহীন চলাটাও অনেকের কাছে এক ধরণের অর্থ খুঁজে পায়।

২৬-১১-০৯
এত কষ্ট জীবনে আগে কবে করেছি মনে করতে পারছিনা। পুরো শরীর টা ব্যাথা। পর্বতাভিযানের ঠেলা বেশ টের পাচ্ছি। গতকাল সারাদিন বাস জার্নি করে আমরা ইয়োকসাম নামক জায়গাটায় আসি। তখনও বুঝে উঠতে পারিনি সামনে কি অপেক্ষা করছে। বাসে গান শুনতে শুনতে বাসার কথা খুব মনে পড়ছিল। ২৪ তারিখ আউটিং এ বাসায় ফোন করে কাউকে পাইনি। সামনের ২০ দিন যে আমি সব রকমের যোগাযোগ হতে বিচ্ছিন্ন থাকব সেটাও জানানো হলো না। ব্যপারটা ঠিক ভালো হলো না। এই মুহুর্তে আসলে ওটা নিয়ে ভাবারও অবকাশ নেই। ডাইরি লেখাটাও নিতান্তই দ্বায়িত্ববোধ হতে করছি। দার্জিলিং HMI হতে গ্যাংটক ও সিক্কিম হয়ে ওয়েস্ট সিক্কিম এর একদম শেষ শহর ইয়োকসামে পৌছাই আমরা। ট্রেনিং এর প্রথম টেন্টিং এর শুরুটাও ইয়োকসামেই । টেন্ট আলাদা আলাদা রোপের জন্য হওয়ায় আমি আর পারভেজ দুজন দু জায়গায়। এমনকি আমাদের শিলিগুরির বাঙ্গালী বন্ধু দেবাশীষও আলাদা টেন্টে। দেবাশিষ হলো গিয়ে আমার আর পারভেজের গডফাদার, এস এস বি প্যারামিলিটারি ফোর্সের একজন অফিসার। ভাগ্যদেবীর আশির্বাদে হোস্টেলে এক রুম হওয়াতে আমাদের পরিচয়। এখন অবস্থাটা এমন যে পারভেজ এবং আমি অনেকটাই ওর ওপর নির্ভরশীল। ছেলেটা আবার সেরকম helpful ও বটে। যাই হোক, ইয়োকসামে কাল রাতটা কাটাতে বেশ কষ্ট হয়েছিল ৩ জনেরই। এর মধ্যে কনকনে ঠান্ডায় জীবন শেষ। প্রাকৃতিক কাজের জন্য টর্চ এবং ice-axe নিয়ে দলে দলে ১০ মিনিট দুরের ওই জঙ্গলটায় যাওয়া, কাজ শেষ করে ফিরে আসা, সব মিলিয়ে এই প্রথমবার যেন সবাই comfort level থেকে বেশ খানিকটা দূরে। যদিও খাবারটা বেশ ভালই দেয়া হলো, এমনকি গরম চাও দেয়া হলো ঘুমোতে যাওয়ার ঠিক আগে, তাও আজকের সকালের ট্রেকের কথা ভেবে কাল হতেই আমরা সবাই ভয়ে। তার আগে আমাদের এক ফ্যাকাল্টি একটা ফল ইন করিয়ে লেকচার দিলেন যার সারমর্ম হলো আমরা এখন পাহাড়ে। তাই পাহাড়ের নিয়মকানুন মেনে চলব। HMI তে আমাদের প্রথম লেকচার ক্লাসের সাবজেক্ট mountain manners এর কথা মনে করিয়ে দিলেন। বললেন পাহাড়ে ভুলের জন্য কোন ক্ষমা নেই। তাই প্রতিটা ব্যপারে থাকতে হবে সচেতন। শুনেই ভয় লাগে, তবে স্যার এটাও বললেন যে, কাল হতে শুরু হবে টিম ওয়ার্ক। একজন আরেকজনকে সাহায্য করতে করতেই আমরা পৌছে যাব আমাদের গন্তব্যে।
সারারাত স্লিপিং ব্যাগে এদিক ওদিক করে সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কর্ম বলেই মনে হলো এটাকে। খুব দ্রুত ২ ডিম এবং ৬ পাউরুটির ব্রেকফাস্ট করে সবাই রুকস্যাক কাঁধে নিয়ে তৈরি। হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো বেশ কিছু চকলেট। এতজন একসাথে যাবো অথচ আজ সকালের মতো আর কোনদিন নিজেকে এত একা মনে হয়নি। পারভেজ এবং দেবাশীষ কে খুজে বের করে নিজেদের মধ্যে হালকা চুক্তি করে ফেললাম একসাথে থাকার। শুরু হলো ট্রেকিং। বলে দেয়া হলো পথে ৪ টা ব্রিজ পড়বে, এরপর আর বেশিদূর নয়। বলা হয়েছিল ৬ ঘন্টার ট্রেক যদি সবকিছু ঠিকমত হয়। চলছি আর মনে দেখা দিচ্ছে অনেক প্রশ্ন, পাড়ব তো এত বিরাট ব্যাগটা নিয়ে গন্তব্যে পৌছাতে ? আমার সকল চিন্তা কেন যেন তখন ওই ২৫ কেজির রুকস্যাক টা নিয়েই। মনে সন্দেহ দেখা দিল যে ঠিক মত প্যাকিং হয়নি যার জন্য ওটা গায়ে comfy হচ্ছে না। তার পরেও সামনের জনের পায়ের দিকে তাকিয়ে চলছি। প্রথম ঘন্টাখানেক রাস্তা মোটামোটি ভালই ছিল, কিন্তু হটাত সামনে খাড়া রাস্তা দেখে মনটা চুপশে যায়, আবার বেশি নিচে নামলেও দুশ্চিন্তা দেখা দেয়, আজ আমাদের হাইট গেইন হবে প্রায় ২৫০০ ফিটের মতো । স্বাভাবিক ভাবেই এখন নিচে নামা মানে বাক্ষিমে পৌছাবার আগেই সেটা পুষিয়ে নিতে হবে। ঝামেলা আর কাকে বলে। যাই হোক ৩ ঘন্টায় আমরা মোটামোটি ২ টা ব্রিজ পার করে ফেললাম। তবে এই পর্যায়ে কেন যেন ব্রেক দেয়া হলেই আমি কিছুটা পিছিয়ে পড়তে থাকি। সাথে পারভেজ, তৃতীয় ব্রিজটা পার হতে হতে আমরা দুজন বেশ পিছে পড়ে যাই, শেষ ১৫ জনের মধ্যে, পিছে স্যাররা প্রায়ই প্রেরণা দিতে থাকেন । মাঝে মধ্যে সামনে থেকে আওয়াজ শুনি যে দাম লো । সবাই চেচিয়ে তখন ওটার রিপিট করে। আমার অবস্থা খারাপ। কোন একটা ভাল জায়গা দেখলেই মনে হয় যে ব্যাগের তলাটা ওখানে রেখে জিরিয়ে নেই ১০ সেকেন্ড। পারভেজ কে বলি যে, দোস্ত, মনে একটাই দুঃখ রে, কেউ জানলো না ঈদের দু-দিন আগে আমরা এখানে এরকম কামলা দিচ্ছি, তাও পকেটের পয়সা খরচ করে। ও যা উত্তর দিল এটা খুব সম্ভব আমার অনেকদিন মনে থাকবে।– দেখ ওমর, তোকে কেউ ফোর্স করে নিয়ে যাচ্ছেনা। যে কোন সময় তুই quit করতে পারিস। এখানেই রেস্কিউ ফোর্স রেডি। কিন্তু তুই তা করছিস না। তুই আর আমি কিছু গোল নিয়ে এসেছি, সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। চিন্তা করিস কেন ভাই ? কেউ না জানলেও আমি আর তুই তো সবসময়ই এটা জানবো, feel করব ।
17290007
শেষ ব্রিজটা পার হতে হতে বাজছে প্রায় ২ টা। রওনা দিয়েছি সেই সকাল ৬ টায় । আমার আর পারভেজের অবস্থা এ পর্যায়ে একদম শেষ। আগে পিছে হটাত কাউকে না দেখে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি বলেও মনে হলো কয়েকবার। তারপর সেই “দাম লো” ডাক শুনে আবার এগিয়ে চলা। হিসাব বলে যে আমাদের পিছে আর মাত্র একটা গ্রুপ আছে, সেই নিরাজ এবং আরো কয়েকজন সিভিলিয়ান। একটু চান্স পেলেই আমি আর পারভেজ থেমে থেমে রেস্ট নিচ্ছিলাম যেটা একদমই ঠিক নয়। শরীর কে ঠান্ডা হতে দেয়া মানে নিজেকে বিপদে ফেলা। একটা মুল্যবান চকলেট বার বের করে দুজনে মিলে খেয়েছি, এসময় দেখি সামনে আর্মির দুজন ছেলে হাজির, দুজনেই তিব্বতী। আমাদের ব্যাগ ক্যারী করতে চাইলো, ভেবেই পেলাম না নিজের ব্যাগ রেখে আবার ওরা আরেকজনেরটা নেয়ার কথা চিন্তা করে কিভাবে, তবে মনে আশা পেলাম যে আমরা প্রায় পৌছে গেছি, ব্যাগও হাতছাড়া করলাম না, নতুন উদ্দমে চলতে চলতে একসময় আসলেই পৌছে গেলাম বাক্ষিমে ৩ টার সময় প্রথম গ্রুপ হতে ১ ঘন্টা পরে আর শেষ গ্রুপ থেকে ২৫ মিনিট আগে। তারপর আরো অনেক কাহিনী, তবে এই মুহূর্তে আর লেখার শক্তি নেই, কাল আমরা acclimatization এর জন্য এখানেই থাকছি সারাদিন, ডাইরি লেখার ভাল টাইম পাব। এরকম সুন্দর একটা জায়গা দিয়ে আসলাম অথচ তখন কোন অনুভূতিই যেন কাজ করছিলনা। মনে হচ্ছিল আমার পূরো শরীর যেন একটা বিরাট ফুসফুস, যার কাজ শুধু শ্বাস নেয়া আর ছাড়া। এই রেঞ্জে বাক্ষিম জায়গাটার একটা বিশেষত্ব আছে, সেটা কাল লিখব। ভাবতেও অবাক লাগে সকালে যখন ট্রেক শুরু করেছি তখনো পারভেজ এর সাথে আমার সম্পর্কটা ছিল তুমি তুমি। এই ইয়োকসাম থেকে বাক্ষিম পর্যন্ত পৌছাতে পৌছাতে তুই। আমরা যেন যুদ্ধ জয় করে আসা দুই আহত সৈনিক, এখন আপন ভাই থেকেও কাছের মানুষ।
Fellow mountaineer Parvez Rashid

২,৪৪৩ বার দেখা হয়েছে

১৯ টি মন্তব্য : “একজন পর্বতারোহী ও কিছু কথা ২য় পর্ব”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    পড়ে যাচ্ছি আর শিহরিত হচ্ছি। গর্ব হচ্ছে তোমার জন্য, এই যে তোমাকে তুমি করে বলতে পারছি, সেজন্য 🙂

    তবে ভাইরে অফটপিকে একটা কথা বলে নেই, আমার হৃৎপিন্ডে কিন্তু একটা ছোট ফুটা আছে, ডাক্তার আমাকে বেশি পরিশ্রম করতে নিষেধ করেছে। তুমি যতই টোপ ফেল, আমি কিন্তু গিলছি না 😀


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
    • ওমর (৯৫-০১)

      অনেক অনেক ধন্যবাদ বস। তুই করে বললে বস আমার গর্ব আরেকটু বেড়ে যাবে। বস, ডাক্তার কি বলে তা আমি জানিনা, তবে এটুকু জানি যে, একটা মানুষ জীবনের যে কোন সময় যে কোন অবস্থায় তার কল্পনার মধ্যেও পড়ে না, এমন একটা কাজ করার ক্ষমতা রাখে। বিশ্বাস করেন বস, এক ফোটাও বাড়িয়ে বলিনি। ভেবে দেখেননা আরেকবার বস, টোপ গিলবেন কিনা ?? 😛

      জবাব দিন
  2. তানভীর (৯৪-০০)

    চমৎকার বর্ণনা ওমর।

    আমি নিশ্চিত, সামনের পর্বগুলো পড়ে সবাই আস্তে আস্তে তোমার মানসিক শক্তির জোর বুঝতে পারবে।

    বাক্ষিমের বিশেষত্ব জানার অপেক্ষায় রইলাম। 🙂

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ওমর (৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।