রেডিও সাইলেন্স -২

রেডিও সাইলেন্স -১

২৬তম – ২৮তম ঘন্টা ০৯০০ – ১২০০
বুধবার সকালের প্রথম ক্লাস ম্যানেজেরিয়াল ফিন্যান্স। আজ ক্লাসে আজ সবাই প্রেজেন্ট। স্যার ডিক্লেয়ার করলেন – ইমপ্রমচু কুইজ। সবাই নড়ে চড়ে বসলো। আকাশ অনড় বসে রইলো; শুধু ওর শক্ত চোয়াল দেখে বোঝা যাবে সে মহা বিরক্ত। কারন, ঐ রেডিও সাইলেন্স এর পাল্লায় পড়ে ও এখন মোবাইল বিহীন বীরপুরুষ। আর মোবাইলে ডাউনলোড করা ফিনান্সিয়াল ক্যালকুলেটর এর অ্যাপস ছাড়া কুইজ হবে সিমপ্লি ফাল্‌তু।
কুইজ শুরুর আগে দেখা গেল আরো চারজন ক্যালকুলেটর ছাড়া। স্যার হতাশ হয়ে বললেন – ক্লাস সিরিয়াসলি না নিলে তোমরা লেসন কি বুঝবে, আর গ্রেডই বা কি পাবে ! একে তো মেজাজ খারাপ, তার উপর ফ্রি ‘হোপ লেস’ লেবেল জুটে গেল সকাল সকাল।

নীলা ইশারায় ওর ক্যালকুলেটর সাধলো – আকাশ মাথা নেড়ে না করে দিল; নীলাও জানত ও এখন নিবে না।
স্যার জানালেন – সবার কুইজ শেষ হলে উনি ১০ মিনিট দেবেন ওদের ৫ জনকে। অন্যের ক্যালকুলেটর ব্যবহারের জন্য ওদের তিনি অর্ধেক সময় পেনাল্টি আরোপ করেছেন ।
ওর লাইফে, এই প্রথম ফুল ক্লাস প্রেজেন্ট দেখে ওর মন খারাপ হলো। আকাশ বেচারার ‘ব্যাড লাক’ এরও ভাগ্য খারাপ।
বোর্ডে লেখা প্রশ্নের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আকাশ বিড়বিড় করে রবি ঠাকুর এর লেখা এক কবিতার দু’লাইন “ভাগ্যটা আমার ঘোলা জলের ডোবা, বড় কোন ইতিহাস ধরে না সেখানে”

এরপর ছিল অপারেশন ম্যানেজমেন্ট এর ক্লাস। লেকচার শেষে স্যার ‘ফীল্ড গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট’ এর গ্রুপ এবং সেক্টর ডিক্লেয়ার করলেন। আকাশের সেক্টর পড়েছে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি; গ্রুপে আছে আরেকটা ছেলে আর দুইটা মেয়ে। ছেলেটা বিশাল ‘পেইন’। এর আগে একবার অন্য কোর্সে একটা গ্রপে ছিল। চান্দু ফীল্ডে যাবে না – কিছু করবে না। কিন্তু শেষে এসে ওনাকে ইম্পরটেন্ট একটা পার্ট প্রেজেন্ট করতে দিতে হবে। হ্যাঁ, ওর ডেলিবারেশন ভাল; কিন্তু তাই বলে কোন কাজ না করে স্টেজে নাচা পার্টি আকাশের সহ্য হয় না। আহলাদ!

গতবারই ভেবেছিল, এই ব্যাটা’র সাথে আর গ্রুপ না। আর আজকে সেই তার গ্রুপে – স্যার বলেছেন কোন চেঞ্জ হবে না। গ্রুপ ডিনামিক্স এ অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রসেসও নাকি শিখবার ব্যাপার। আজ সবাই সব থিওরি ঝাড়বে- এরকমই তো হওয়ার কথা। চালাও – মামারা চালাও – আজ আমার ‘রেডিও সাইলেন্স’ – আর বাকি সবার ঈদের দিন। আসেন ভাই – কোলাকুলি করি…যত্তসব।।

২৯তম ঘন্টা ১২০০ – ১৩০০
মেজাজ টং করে লাঞ্চ এ যেয়ে দেখা গেল তেহারী শেষ হয়ে গেছে। সবাই বলা বলি করছে – আজ জোস হইছিল বলে পোলাপান নাকি ভাল টানছে। কেউ কেউ বাসায় পার্সেলও নিয়ে গেছে। এখন শুধু আলু’র সিংগারা আছে – তাও সকালের। বিরস বদনে ঠান্ডা সিঙ্গারা চা’য়ে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাচ্ছে আকাশ। সামনে নীলা বসা, কানে হেডফোন লাগানো। ও অবশ্য আইসক্রীম খাচ্ছে।

লাঞ্চ ব্রেক শেষে ক্লাসে যাওয়ার সময় মেহেদী’র সাথে দেখা। ও আকাশ’কে জিজ্ঞেস করে, দোস্ত যমুনা ব্লক বাস্টারে সুপ্পার একটা অ্যাকশন মুভি আসছে। কাল শুক্রবার, চল সবাই মিলে দেখতে যাই। এইবার তোর ট্রীট; তুই মোবাইলে টিকেট কিনে ফেল এখনি। আকাশ নিরুত্তর।
– ওর নিরুত্তাপ চেহারার দিকে তাকিয়ে মেহেদী একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কেননা, আকাশই ওকে বলেছিল খবর দিতে। বন্ধুত্ব অনেকদিনের হওয়ায় মেহেদী চেপে গেল – আকাশে সূর্য – চাঁদ কিছুই দেখা যাচ্ছে না – শুধু কালো মেঘ আর মেঘ। কলেজে হাউস বেয়ারার রউফ ভাই কালবৈশাখী এলে যেমন বলতেন, “বীষম ম্যাঘ করছে – বীষম ম্যাঘ; আইজক্যা খবর আছে। সব জানালা – দরজা ভাল কইর‍্যা খিল মারেন সবাই।“ আহ! ফেলে আসা দিন গুলি…

৩০তম – ৩৫তম ঘন্টা ১৩০০ – ১৯০০
দুপুরে এখন ছিল সাপ্লাই চেইন এর ক্লাস। স্যারও কালবৈশাখী ঝড়ের গতিতে কি পড়িয়ে গেলেন ওরা কেউই ভালো করে ফলো করতে পারলো না। এ ধরনের প্র্যাক্টিকাল ওরিয়েন্টেড ক্লাসে খালি স্লাইড না দেখিয়ে রিয়েল মার্কেট থেকে প্র্যাকটিশনার আনলে- ওনা’রা আরো ভাল ব্যাখা করতে পারতেন। সব সময় পাশ্চাত্যের জ্ঞান ‘কাট-পেস্ট’ করে এখানে প্রয়োগ করা কি যায়? চাই কাস্টমাইজেশন – চাই টেইলরিং। এভাবে সব হয় না – আর আজ তো কিছুই হচ্ছে না – হবেও না।

দিনের শেষ ক্লাস – মার্কেটিং। দিনের রেকর্ড ভংগ করে একটা চালু ক্লাস হলো। জাহাঙ্গীর নগরের ফ্যাকাল্টি। SWOT Analysis এর পুরো ব্যাপারটা স্যার ঝাল মুড়ি স্টাইলে মাখিয়ে সবাইকে খাইয়ে দিলেন। ক্লাস ভাল হলে টাইম ক্যামনে যায় – বুঝাই যায় না। ক্লাশ শেষে স্যার সবাইকে লাস্ট উইক এর অ্যাসাইমেন্ট এর হার্ড কপি ওনার বক্সে জমা দিয়ে যেতে বললেন। সবাই কম্পিউটার ল্যাবের দিকে ছুটলো।
আকাশ এর জিমেইলে অ্যাসাইমেন্ট টা Sent বক্সে আছে। ও গত পরশু দিন স্যারকে পাঠিয়েছিল; খুলে প্রিন্ট দিলেই হবে। কী বোর্ডে পাসওয়ার্ড চাপতেই 2 Step Verification এর জন্য Code ওর মোবাইলে প্রেরন করা হয়েছে এ মর্মে ম্যাসেজ ভেসে উঠলো স্ক্রীনে। সর্বনাশ! এখানেও রেডিও সাইলেন্স এর কষাঘাত !
দিনের শেষ ভাল হলো না। অগত্যা – পুরা অ্যাসাইনমেন্ট’টা আকাশ আবার নতুন করে বানিয়ে প্রিন্ট করলো। তারপর স্যারের ড্রপ বক্সে পেপারটা জমা দিয়ে সন্ধ্যায় ও বাসার দিকে রওনা দিলো।

৩৬তম ১৯০০ – ২০০০
বাড়ি ফিরে আকাশ জানতে পারে বিকেল থেকে আফরা’র শ্বাস কষ্ট শুরু হয়েছে। ওর ইনহেইলার শেষ হয়ে
গেছে। আকাশের মোবাইল অন না থাকায় মা অনেকবার কল করেও ওকে পায়নি। ঐদিকে আজ বাবা’র আসতে দেরী হবে। অফিসে মিটিং আছে – সাথে ডিনার। তাই এখনই ইনহেলারটা কিনতে যেতে হবে আকাশ’কে। না হলে, রাতে বেচারীর শ্বাসকষ্ট আরো বেড়ে যাবে। মা ওর জন্য চা- বিস্কুট এনেছিলেন; দুইটা বিস্কুট হাতে নিয়ে তাড়াহুড়া করে আকাশ বেরিয়ে পড়ে।

৩৭তম – ৩৯তম ঘন্টা ২০০০ – ২৩০০
মোড়ের ফার্মেসী তে ইনহেইলার টা পাওয়া গেল না। দোকানদার আকাশ’কে দেখেই বললো, “ভাইয়া সরি।
আপু’র ইনহেইলারটা ফুরায়ে গেছে। কালকে আইসেন।“

আকাশ চোখ বুজে চিন্তা করতে থাকে – আশে পাশে আর কোথায় পাওয়া যেতে পারে?
এমন সময় জাহিদ সাহেব এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কোন সমস্যা?”
আফরা’র ইনহেলার পাওয়া না যাওয়ায় মনে হয় এখন লাজফার্মা যাওয়া লাগবে । কথা বলতে বলতেই,
আকাশ রাস্তা ধরে দৌড়াতে শুরু করলো; একটা সি এন জি খুঁজছে ও। জাহিদ সাহেবও ওর পিছে পিছে
দৌড়াচ্ছেন।
বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে একটা সি এন জি পাওয়া গেল। আকাশ থামিয়ে উঠে পড়লো, সি এন জি তে উঠে
পিছনে তাকিয়ে দেখে জাহিস সাহেব মোবাইলে কি জানি টাইপ করছেন। দেখে মনে হলো – লাইভ আপডেট
দিচ্ছেন তার বস’কে।
আকাশ রওনা দিতেই তার মোটর সাইকেল স্টার্ট দিয়ে তিনি ঐ সিএনজি’র পিছু নিলেন।

তিলোত্তমা ঢাকা শহরে কল্যানপুর থেকে গাড়ীর ভিড় ঠেলে লাজফার্মা এ পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে গেল। আকাশ ঘাবড়ে গেল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। প্রিয় মানুষের অসুস্থতা সবাইকেই অসহায় করে তোলে। এত রাতেও ফার্মেসীতে মোটামুটি ভিড়।
আকাশ অস্থির ভাবে জানতে চাইলো – ভাই শ্বাসকষ্টের ইনহেলার আছে?
দোকানী’র প্রশ্ন – কোন টা ভাই?
এই যে – এইটা – ছবি টা দেখেন বলে পকেট হাতড়ে দেখে মোবাইল তো নাই। আকাশ এবার দিশেহারা হয়ে
গেল।
দোকানী আবার জিজ্ঞেস করলেন – আচ্ছা ভাই কোন কোম্পানী ?
Beximco/ Square/ GlaxoSmithKine? ডোজ কত? 100/125/250?
MDI না DPI ?
-ভাই, এগুলা’র মানে কি?
দোকানী জানালেন –MDI হলো metered dose inhaler আর DPI হলো dry powder inhaler
আকাশ অসহায় ভাবে বললো – ভাই তাড়াহুড়াতে মোবাইল ছেড়ে আসছি। ডোজ মনে নাই – আপনি কাইন্ডলি কয়েকটা বের করেন। আমি দেখলেই চিনবো।
হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে দোকানী ইনহেলার বের করতে লাগলেন।

এ সময় দোকানে আরেক ক্রেতা তার সঙ্গীকে বললেন – “বাসায় অ্যাজমা রোগী থাকলে তো ঔষধের নামটা
ঠিক মত জানতে হবে। আজকালকার পোলাপাইন – কোন কিছুতে সিরিয়াস না। এদের দিয়ে কিস্সু হবে না। সারাদিন খালি ফেসবুক আর ফেসবুক।“

কথাটা শুনতে পেরেও আকাশ দমে রইলো। সাধারনতঃ বাবা বাসার জন্য একবারে ঔষধ কেনেন। আর মাঝে মধ্যে হঠাৎ ইনহেলার শেষ হয়ে গেলে মোড়ের দোকান থেকে ও নিয়ে আসে। কিন্তু একমাত্র বোনের ইনহেলার এর ছবি মোবাইলে নিয়ে ঘুরে এতদিনেও ভাল করে দেখেনি বলে নিজেকেই ধিক্কার দিচ্ছিলো ও মনে মনে।

কাউন্টারে আকাশের সামনে গোটা সাতেক ইনহেলারঃ
AZMASOL MDI Beximco
AZMASOL HFA 100 MDI Beximco
Ticamet 125 MDI Square
Ticamet 250 MDI Square
Beclomin 100 MDI Square
Beclomin MDI Square
Seretide Accuhaler 100 DPI GlaxoSmithKine
আকাশ ইনহেলার গুলো দেখেই চিনতে পারলো যে আফরা Seretide Accuhaler 100 DPI GlaxoSmithKine ব্যবহার করে।

ইনহেলার নিয়ে টাকা পরিশোধ করে আকাশ বাইরে এসে দেখে জাহিদ সাহেব মটর সাইকেল এ বসা। ওকে ইশারায় উঠে বসতে বললেন। আকাশ ঘড়িতে সময় দেখলো। কান্নায় বুজে আসা কন্ঠে বললো- প্লিজ একটু জোরে চালান – আফরা’র কিছু হলে আমি কোন দিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। দু’টা সিগন্যাল ব্রেক করে – অলি গলি ঘুরে ঘুরে ভালই রিক্স নিয়ে আকাশ’কে দ্রুত বাসায় পৌঁছে দিলেন
জাহিদ সাহেব। নেমেই সে দৌড়ে বাসার ভেতরে চলে গেল ও।

কলিং বাজতেই মা দ্রুত দরজা খুললেন। আফরা ? ইনেহেলার টা তাড়াতাড়ি নিয়ে যা – মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে।
ইনহেলার হাতে নিয়ে আফরা সাথে সাথেই এক পাফ নিলো।
মা বললেন – ইনশাআল্লাহ, একটু শান্ত হও মা, একটু পরেই ভাল লাগবে। যাক, সময়মত ইনহেলার’টা কিনে
আনায় রাতে হাসপাতাল নিয়ে ছুটতে হবে না, আলহামদুলিল্লাহ। আর আকাশ, তোর ফোনের কি হয়েছে? সব সময় অফ থাকে। একটা ভাল মোবাইল কিনে নিস তো বাবা; মানুষের কত রকম বিপদ আপদ আসে।
আকাশ নিশ্চুপ।
নে খাবার দিচ্ছি – হাত মুখ ধুয়ে খেতে বস। আমিও না খেয়ে বসে আছি তোর জন্য।

মা – এক মিনিট বলে ও দৌড়ে আবার বাইরে গিয়ে দেখলো- গেটের কাছে জাহিদ সাহেব তখনও মোটর সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আকাশ কাছে যেতেই – তিনি আফরা’র কথা জিজ্ঞেস করলেন।
ও বললো – পাফ নেয়ার পর একটু বেটার; আস্তে আস্তে নরমাল হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
তিনি হাল্কা মাথা নাড়লেন। হেলমেট এর কারনে তার চেহারাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।
আকাশ বলবে – আপনি বাইকে এ লিফট না দিলে আজ একটা বড় বিপদ হতে পারতো। থ্যাঙ্ক ইউ সো ভেরী মাচ, জাহিদ সাহেব।
তিনি আবার একটু মাথা নাড়বেন। একটু সময় নিয়ে তারপর আকাশকে বললেন – যান। খেয়ে নিন; আপনার তো দুপুরেও খাওয়া হয়নি।
তারপর মোটর সাইকেল স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে পড়বেন।

আকাশ তার চলে যাওয়ার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকবে। তারপর ঘরে ফিরে মা’র সাথে ডিনার করতে বসলো।
অধিক ক্ষুধা থাকলে খাওয়া যায়না। ওর ও ব্যতিক্রম হলো না। ভাত আর মাছ নিয়ে ও নাড়া চাড়া করছে দেখে মা বললেন – কিরে বেশী করে মরিচ পেয়াজ দিয়ে একটা ডিম ভেজে দিই বাবা? লেবু চিপে – ডাল দিয়ে খেয়ে নে। রাতে না খেলে তো এ বয়সে গ্যাস্ট্রিক বাঁধিয়ে ফেলবি।
মা’রা সব বুঝে ফেলেন – তারা সন্তানদের তাদের ভালবাসায় সিক্ত করে আগলে রাখেন।
আকাশ কিচেন এ যেয়ে মা’য়ের পাশে দাঁড়িয়ে ডিম ভাজি করা দেখলো। টেবিলে ফিরে খেতে বসার আগে
আকাশ মা’কে জড়িয়ে ধরে বলবে – আই লাভ ইয়্যু মা। মা একটু মুচকি হেসে- ওকে ইশারায় ভাত শেষ করতে বলবেন।

৪০তম – ৪৬তম ঘন্টা – ২৩০০ – ০৬০০
কিছুক্ষন টিভি চ্যানেল ঘুরে ফিরে রুমে ফিরে এলো আকাশ। তারপর একটা অ্যাাসাইনমেন্ট এর কাজ একটু গোছানোর চেষ্টা করলো; কিন্তু তেমন এগুলো না। টায়ার্ড লাগছে ভালোই। নীলাকে নতুন চিঠি লিখতে ইচ্ছা থাকলেও আজ আর লেখা হলো না।
আজ সারাদিন যা গেছে – ওর সাথে ভাল করে কথাও বলা হয়নি। আর নীলাও কেমন জানি চুপচাপ ছিল। এলোমেলো ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো আকাশ। ক্লান্তির কারনে ওর ঘুমের শুরুটা ভালই হলো। তবে শেষ রাতের দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। এপাশ ওপাশ করেও আর ঘুম এলো না। ও তবু চোখ বুজে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকলো।

৪৭তম ঘন্টা ০৬০০ – ০৭০০
বাবার সাথে আজ মর্নিং ওয়াক এ যাওয়ার জন্য আকাশ ট্র্যাক স্যুট পড়ে তৈরী হয়ে গেল। বাবা’র সাথে দু’রাউন্ড হাঁটার পর বাড়ি চলে এলো ও। গোসল করে রেডি হয়ে গেল প্রায় সাথে সাথেই।

৪৮তম ঘন্টা ০৭০০ – ০৮০০
মা’কে বলে নাস্তা না করেই আকাশ বেরিয়ে যায়। ভার্সিটিতে ওকে আজ আট’টার আগে পৌঁছাতে হবে।
ভার্সিটি তে যেয়ে ক্যাফে’তে বসলো ও।

রেডিও সাইলেন্স লিফ্‌টেড ০৮০১ ঘটিকা
ঠিক আট’টা বেজে ০১ মিনিটে জাহিদ সাহেব এলেন। আকাশ’কে ওর মোবাইল ফেরত দিলেন তিনি। মোবাইল অন করতেই – অনেকগুলি নোটিফিকেশন শোনা গেল।
চলে যাওয়ার সময় জাহিদ সাহেব ওকে কংগ্রেচুলেট করে গেছেন।
এখন কি হবে – আকাশের এ প্রশ্নের উত্তরে জাহিদ সাহেব অবশ্য কিছু বলতে চাননি। আকাশের চোখে তাকে আজ অনেক মাই ডিয়ার টাইপ মনে হয়েছে।
হেসে বলেছেন – সময়মত আপনাকে সব জানানো হবে। কাইন্ডলি মোবাইলটা চালু রেখেন; ভাল থাকবেন।আফরা’র শরীরটা এখন কেমন?
আকাশ জানালো – জ্বী ভাল। ধন্যবাদ। আপনিও ভাল থাকবেন।

তিনি দৃষ্টির আড়ালে যেতেই, আকাশ অর্ডার করে নাস্তা – পরটা – সব্জী ডাল।
আর নাস্তা শেষে মামা-স্পেশাল একটা ডবল চা।

এরপর রুটিন অনুযায়ী ক্লাস। উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা ছাড়াই সময়টা গড়িয়ে সকালের সূর্য হেলে বিকালে চলে গেলো। সারা দিন নীলাও একটু চুপচাপ ছিল। মনে হলো – কিছু ভাবছে। আকাশ স্বভাবজাত ভাবেই নীলা’কে স্পেস দিয়েছে।
ঐদিকে ‘ছায়া জাহিদ’ আর সাথে নাই, কিন্তু কেন জানি হাল্কা হাল্কা লাগছে। হয়তো একটু মিস্‌ও করছে; কেননা পুরো ব্যাপারটা’র মধ্যে কেমন যেন একটা অ্যাাডভেঞ্চার ফিলিং ছিল।
‘লাইফ মাইনাস মোবাইল’ বিষয়টি আকাশ এর মনে দারুন নাড়া দিয়েছে। রেডিও সাইলেন্স – ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। আর,ও এ দুদিনে ঠেকে শিখেছে যে, মোবাইলের উপর আমাদের ক্রমবর্ধিষ্ণু নির্ভরতা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে হয়তো….!

(নোটিফিকেশন) ওর ভাবনার স্রোতে বাঁধ দিলো নীলার নতুন ফেসবুক স্ট্যাটাসঃ
“প্রতীক্ষা শেষে আজ আচমকা দেখা মিললো –
পুকুরের জলে রঙীন মাছরাঙা ছোঁ মেরে, রুপালী মাছ তুলে নিলো ঠোঁটে।
আমি মোবাইল তাক করার ফুসরতই পাইনি,তবে এ হৃদয়ে ফ্রেমবন্দী হলো ঐ দৃশ্যখানি।“

🙂feeling loved
……………………………………………………………………………………………………
পরিশিষ্টঃ
বৃহস্পতিবার রাতে আকাশকে গাড়িতে করে আনা হলো একটি জমকালো আয়োজনে। বাজারে আসছে নতুন মোবাইল; আজ তার মোড়ক উন্মোচন। মোবাইল লঞ্চিং অনুষ্ঠানে একজন সেলিব্রেটি মোড়ক খুলবেন। পুরো অনুষ্ঠানটি লাইভ যাচ্ছে একটি জনপ্রিয় চ্যানেলে। টিভির সামনে গভীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে – আকাশের প্রিয় মুখগুলি। অনুষ্ঠানে মার্কেক্টিং ফ্যাকাল্টিকে দেখতে পেল সে। দূর থেকে হাত নেড়ে তিনি কড়া একটা ‘থাম্বস আপ’ দিলেন।
মূলতঃ আকাশে’র রিয়েলিটি চালেঞ্জটি তৈরী করা হয়েছিল প্রোডাক্ট ব্র্যান্ডিং এর উদ্দেশ্যে। স্টেজের মাঝখানে বড় একটা এলইডি স্ক্রীনে আকাশে’র লাইভ ফুটেজের হাইলাইটস দেখানো হলো। এরপর আকাশ’কে মঞ্চে ডেকে প্রাইজ মানি দেয়া হলো। তাকে কংগ্রেচুলেট করে জিজ্ঞাসা করা হলো – এখন কি করবে ও?

মাইক্রোফোন হাতে আকাশ উত্তর দিলো’ “ প্রথমেই একটা ভাল মোবাইল কিনবো”।
পুরো হলরুম সজোরে হেসে উঠবে।
– হাসি থেমে গেলে আকাশ স্টেটমেন্ট দিলোঃ
“ তবে বিগত ৪৮ ঘন্টায় শিখেছি লাইফের কন্ট্রোল খুব যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে; আর আমি অনেক ভাবেই মোবাইলের কাছে পরাধীন ছিলাম। ।
We hardly can escape from the digital boundary and it can take away our privacy and security too unless we know how to manage it. I humbly request to all mobile users to get educated for safeguarding your security and interests. (করতালি)

আজ আমি প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি, হ্যাঁ, মোবাইল অতি প্রয়োজনীয়। কিন্তু আমি জানি মোবাইল ব্যবহার করেও কিভাবে জীবনে ব্যালেন্স এর চেষ্টা করা যায় – অ্যাডজাস্ট করে চলার চেষ্টা করা যায় – স্বনির্ভর থাকার চেষ্টা করা যায়। আমি এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই এবং বিষয়টিতে আমাকে সম্পৃক্ত করার ম্যানেজমেন্ট’কে আন্তরিক ধন্যবাদ দিতে চাই। (করতালি)

Finally, Dear Audience, let us try to keep life simple and secured. YES! Enjoy the Radio Silence at your will. I guess, Radio Silence is kind of a Code Word to regain our control over our life. Thank you ladies and gentlemen. Happy Freedom to you all.” (করতালি)

আকাশ স্টেজ থেকে নামতে নামতেই স্ক্রীনে ভেসে উঠলো প্রোডাক্ট ট্যাগ লাইনঃ
“Radio Silence is the New Freedom”
(করতালি)

পশ্চিম সাহারা, ২৩ মে ২০১৮

৭ টি মন্তব্য : “রেডিও সাইলেন্স -২”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    কলেজে হাউস বেয়ারার রউফ ভাই - উনি আমার সময়েও হাউস বেয়ারার ছিলেন। আমাদের থেকে ৫/৬ বছরের বড় ছিলেন, কিন্তু সদ্য বিবাহিত অবস্থায় আমাদের মাস ছয়েক আগে এমসিসিতে (চাকুরীতে) জয়েন করেছিলেন জেনে অবাক হয়েছিলাম।
    ও এ দুদিনে ঠেকে শিখেছে যে, মোবাইলের উপর আমাদের ক্রমবর্ধিষ্ণু নির্ভরতা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে হয়তো….! - চমৎকার একটা গল্পের মাধ্যমে একটি অপরিহার্য নিত্যব্যবহার্য জিনিসের উপর পরিমিত নির্ভরশীলতার গুরুত্ব খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয়া হলো।
    “Radio Silence is the New Freedom” - :clap: :clap: :clap:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহ্সান (৮৮-৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।