স্বপ্ন ! চতুর্থ পর্ব।

প্রথম- তৃতীয় পর্ব


ক’দিন হলো, অফিসে কাজের চাপ বেড়েছে। আকাশে’র দুইটা প্রজেক্ট ফাইনাল অ্যাপ্রুভাল পেয়ে যাওয়ায় ও এখন পুরা দৌড়ের উপর আছে। প্রজেক্ট দু’টি হচ্ছে- ধানমন্ডিতে একটা তিন তালা বাড়ী আর বনানীতে একটি কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স। ব্যস্ততার যাতাকলে – পেরিয়ে গেল গোটা এক পক্ষ। এ সময়ের মধ্যে সেই বিশেষ দিনটি মনের আয়নায় যে আচড় কেটেছিল, ঐ দিকে তাকানোর আর সু্যোগ আকাশে’র হয়ে উঠলো না ।

আজ খানিকটা অবসর পাওয়ায়, ঐ দিনের ভাবনাটা আবার হুট্‌ করে উঁকি দিলো। আর একই সাথে সাথে ওর বন্ধু সৈকতের ফিলোসফিটাও মনে পড়ে গেলো। স্কুল থেকে কলেজ অবধি সৈকত আর আকাশ একসঙ্গে পড়াশোনা করেছে। প্রথম থেকেই সৈকতটা বেশ matured ছিল। ছেলেবেলায় মোটা মোটা সব বই দেখলে যখন বাকিদের চোখ কপালে উঠতো, তখন থেকেই ও আগ্রহ ভরে দূর্বোধ্য সে সব পাহাড়সম বইগুলোর পাঠোদ্ধার করে আত্মস্থ করতো আনায়াসে। তারপর অবসরে ও ঐসব বই’য়ের সারমর্ম শুনিয়ে আকাশ’কে জ্ঞানী করে তুলতো। তখন, কৈশোর পেরিয়ে প্রানের জোয়ারে ডুব দেয়ার সময় ওদের। অন্য সবার মত চোখে রঙ্গীন চশমা লাগিয়ে তখন প্রেম প্রেম ভাবনা আর মিষ্টি অনুভূতি গুলো লুকোচুরি খেলতো আকাশে’র বুকেও। যে কোন আড্ডায় তাই সেই বিষয় গুলো ঠাঁই পেতো স্বাভাবিক ভাবেই। সে ব্যাপারটা আসলে সৈকতে’র ভাল লাগতোনা। একদিন সে নিরালায় আকাশ’কে বললো- বন্ধু, তোমার বান্ধবী ভাগ্য সুপ্রসন্ন। এতে আমার কিছুই বলার নাই। তোকে দেখে যে কেউ- বহু কষ্টে তার জমানো নীলপদ্ম গুলো অকাতরে দিয়ে দিবে । এটাই স্বাভাবিক। তবে মাঝে মাঝে এই ভেবে বিচলিত হই যে, শুধু বাইরেরটা দেখে যে মেয়েরা তোর বন্ধুত্ব কামনা করে-তারা আসলে তোর অন্তরের সৌন্দর্য সমন্ধে বিন্দু মাত্রও কল্পনা করতে পারেনা। আমায় ভুল বুঝিস না রে। ওদের জন্য আমার সহানুভূতি রইলো আর তোর জন্য তাই আমার করুনা হয় বন্ধু!

প্রিয় বন্ধু সৈকতের এহেন অভিমত- আকাশে’র বুকে উথাল পাথাল ঝড় তুললো। সে এক ঝটকায় -নিজেকে নতুন রুপে আবিষ্কার করলো। দৃশ্যমান বহিঃপ্রকাশ কে পাশ কাটিয়ে নিজের অর্ন্তনিহিত আলো জ্বেলে অপেক্ষায় রইলো কোন একজন মায়াবতী’র …।

বোধকরি, সে কারনেই আকাশের আর বন্ধু মেলেনি। এরপর, পড়াশোনা শেষ করে ঢুকে পড়লো ফার্মে। আজ এত গুলো বছর পর্‌ নীলিমা’র আবির্ভাব যেন মানব জীবনের স্বাভাবিক পরিণতির কথাই মনে করিয়ে দেয় । সৈকত’কে আজ বড্ড মনে পড়ছে। ও তো আজ ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ঐ পাড়েও বুঝি -ভাল মানুষদের কদর বেশী ! তাই যেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে – কোন্‌ অভিমান বুকে নিয়ে অসময়ে সব্বাইকে ফাঁকি দিয়ে আগেভাগেই সৈকতটা চলে গেল! ও নেই আজ প্রায় ৩ বছর হতে চললো।

কেন জানি, বারেবারে তাকে আজ খুব মনে পড়ছে। কারো সাথে একটু মন খুলে কথা বলা গেলে এখন ভাল লাগতো। সব ব্যাপারে বাবা’র সাথেই সে কথা বলে; তবে এ বিষয়টা নিয়ে বাবার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কেননা সেইদিন বাবা আর মা – দুজনের চোখেই যে দীপ্তি ছিল, তা দেখে যে কেউ বলে দিতে পারে একজন সন্তানের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হওয়া উচিৎ।

সৈকতের দেওয়া দর্শনের কারনেই – আজ এই সন্ধিক্ষনে আকাশ নিজেকেই প্রশ্ন করছে – এই কি সেই মায়াবতী? যে শুধু আপন মহিমায় চারপাশ জয় করে, আকাশে’র সমস্ত সত্ত্বাকে এক নতুন আলোয় রাঙ্গিয়ে দেবে। ভাবতে অবাক লাগে- আজ যে নীলিমা হবু জীবনসাথী রুপে আবির্ভাব হলো, সে প্রায় এক যুগ আগে আকাশে’র কৈশোরে রেখেছিল তার চঞ্চল পদচারনা। ঘটনাটি সময়ের যাতাকলে এক প্রকার হারিয়েই গিয়েছিল। আজ তাই, আকাশের পুরাতন ডায়েরীতে সৈকতের লেখা ঘাটতে যেয়ে, এই পাতাটি হঠাৎ যেন নিজ থেকেই বেরিয়ে এলো-
————————————————————————-
আমরা সব্বাই মিলে সোনারগাঁতে পিকনিকে গেছি। যেখানে রান্না হচ্ছে-বড়’রা সেখানে দেখাশোনা করছে। ঐ দিকে কাচ্চি বিরিয়ানী আর মুরগী রান্না হচ্ছে। আর আমরা, ছোট’রাও বসে নেই। আমাদের দলে আছে ছোট খালা, সুরভি, সুমি, মিশু, লিমা (পুরা নাম নীলিমা), রনি, খুশী, আমি আর নাযিম ভাই। আমরা জোর করেই একটা আইটেম রান্নার দায়িত্ব নিলাম। শুরু হলো আমাদের ‘ডিম ভুনা রান্না’ অভিযান। সবাই মিলে রান্না করতে খুব্বি মজা হচ্ছিলো। ছোট খালা বলছে আর নাযিম ভাই সব রেডি করে দিচ্ছে। আমরা ওদের কে হেল্প করেছি। সুমি টা এত্ত বোকা! ও বলে কি, ‘ইশ্‌। যদি প্রতিদিন পিকনিক হয় – খুব মজা হবে’। ছোটখালা ওকে দিয়েছে একটা বকা- ‘যে প্রতিদিন বাইরে এসে এত ঝামেলা করে রান্না করা যাবে নাকি!’ সবাই হেসে দিস্‌লো। কিন্তু আমারও প্রতিদিন পিকনিক করার ইচ্ছা পেয়ে বসলো। লিমা আমার সব কথা শুনে, তাই আমি ওকে বললাম – তুমি কি আমার জন্য প্রতি পিকনিকে রান্না করে দিবে? ও বলে যে – আমি বলে ওর ঝাল রান্না খেতেই পারবো না। লাগলাম চ্যালেঞ্জ! খাবার রেডি হলো দুপুরে। লিমা আমাকে ডিমের তরকারি বেড়ে দেয়ার সময় মনে হয় ইচ্ছা করেই আরো মরিচ মিশিয়ে দিস্‌লো। ওরে মা…। মুখে দিয়ে আমার তো অবস্থা খারাপ। কিন্তু আমার কি জেদ কম? তাই সব্বাইকে অবাক করে দিয়ে, চোখের পানি-নাকের পানি এক করে, আমি পুরা প্লেট খেয়ে ফেল্‌লাম। এই দেখে লিমা’র যে কি কান্না! আর, আমি জিতে গেলাম।,হুর্‌রে…।
——————————————————————————–

আকাশ মা’র কাছে পরে শুনেছে – ঐ রাতে লিমা অর্থাৎ নীলিমা’র আম্মু ফোন করে বলেছিল, লিমা তো বাসায় এসেও আবার কান্না শুরু করেছিলো। অনেক কষ্টে থামানো হয়েছে; এই বলে যে – তুমি আকাশ’কে ফোন করে সরি বলে ফেলো। অবশেষে, তাই করেই রক্ষা পেল লিমা’র মা।

আকাশ আজ ঠিক বুঝতে পারছে- সেদিন পরাজয়ের গ্লানি ছাপিয়েও আকাশকে কষ্ট দেয়ায় অনুতপ্ত ছিল লিমার ছোট্ট মনটি। আর তাই, কোন ভাবেই তাকে মানানো যাচ্ছিলো না। আহারে বেচারী! …আকাশ হেসে ফেললো।

ধূলো জমা স্মৃতির গহবর হতে – এই এতটুকু ঝিলিক যেন সকল দ্বিধার অবসান করে দিল। আকাশ চকিতে উপলব্ধি করে – এ নিশ্চিত প্রকৃতির খেয়াল…! পথহারা জাহাজের নাবিক আঁধার ঠেলে ঠিক্‌রে আসা লাইট হাউস এর আলোক রশ্মি দেখে যেভাবে আশ্বস্ত হয়, আকাশে’রও অনেকটা সেইরকম বোধ হলো।

সে জানালার ধারে এসে এক মনে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। কাছে – দূরে অনেক তারা জ্বলজ্বল করছে। আকাশে’র চোখ দুটি তার প্রিয় একটি আলোকবর্তিকা এখনও খুঁজে ফেরে। …ঐ ডান দিকে হঠাৎ করে একটা তারা খসে পড়লো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশ একটা সিগারেট ধরালো। কুন্ডুলী পাকিয়ে কিছু ধোঁয়া বাতাসে ছেড়ে দিয়ে- সে খুব আলতো করে বললো,

‘ সৈকত, থ্যাংকস্‌।’
O:-)
(চলবে)

১৯ টি মন্তব্য : “স্বপ্ন ! চতুর্থ পর্ব।”

মওন্তব্য করুন : জ়ে এম সারোয়ার মুজিব ( এডিসন) (১৯৭৯-১৯৮৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।