স্বপ্ন ! তৃতীয় পর্ব।

প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব

বিজ্ঞাপন চিত্রে যেমন বলে-চমকের উপর চমক। সকালে আকাশ যখন অফিসে পৌঁছুলো, ব্যাপারটা অনেকটা সেরকমই ঘটলো। রাতের ঘটনার রেশ নিয়ে অফিসের দরজা খুলে সে দেখলো যে- নানা রংএর বেলুন আর একটা ব্যানারে লেখা-
‘HAPPY BIRTHDAY TO DEAR AKASH’.
কাজটা ওদের বস্‌ এর। এই ভদ্র লোক সব্বার খুঁটিনাটি খবর রাখেন এবং অফিসের working environment টা কেমন সহজ করে রাখেন যে, সবাই নিজ গরজেই মন লাগিয়ে প্রতিটি কাজ করে।
‘Its just like a Family’.

লাঞ্চের সময় আকাশ ‘Boomers’ থেকে লাঞ্চ প্যাক আনালো। আফিস থেকে ‘Shumi’s Hot Cake’ এর একটা আড়াই পাউন্ড কেক (চকলেট ফ্লেভার) আনা হয়েছে। সব্বাই মিলে কোরাস গেয়ে কাটা হলো সেই কেক। পুরো আফিস জুড়ে একটা উৎসবের আমেজ। হীরা ভাই (ওর ২ বছর আগে জয়েন করেছে) কফি মগ হাতে কাছে এসে বললেন, হ্যাঁ রে আকাশ। তুই ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে’তে জন্মেছিস! তুইতো দেখছি, সীল মারা ‘বিশ্ব-প্রেমিক’। এ কথা শুনে আকাশ বললো, তা যা বলেছেন ভাইয়া। তবে সমস্যা কি জানেন- সব ভালবাসা যেন ঐ একদিনের বেড়াজালে আটকে পড়ে আছে। আর তাই, অন্য দিনগুলোতে এক ছটাক ভালবাসা বাদ দিন, কিঞ্চিত সহানুভূতিও মেলা ভার! সব কিছুই তো হিসেব করা আছে। একদিনে সব সাবাড় করে দিলে বাকি দিনগুলো চলবে কি করে ভাইজান? -ওর উত্তর শুনে অফিসে বেশএকটা হাসির কল্লোল উঠলো। সেদিন সবাই আগে আগে ছুটি করলো। বস্‌ বললেন, আমরা যেন আজকে আবার ভালবাসা বিলাতে পিছিয়ে না পড়ি। তাই সবাই মিলে ঝাপিয়ে পড়ো ভালবাসার লেন-দেন এ।
‘Good Luck Buddies’.

ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে বাড়ী ফিরলো আকাশ। কলিং বেল বাজাতেই মা দরজা খুলে দিলেন। দেখা গেল তিনি ড্রইং রুম গোছাচ্ছেন। জানা গেল সন্ধ্যায় মামা’রা আসবেন। নানুও আসতে পারেন। তথাপি, মা’কে প্রয়োজনের তুলনায় বেশী ব্যস্ত মনে হচ্ছে। রহস্যের উন্মোচন মা নিজেই করলেন। তিনি বললেন, আকাশ তোর বাবার বন্ধু ‘হাসান’ আংকেল’কে মনে আছে? তোর বাবা ওনাদেরকেও আসতে বলেছেন। তারা কানাডা থেকে চলে এসেছেন একেবারে। এ ক’বছরেই নাকি ওনার শখ মিটে গেছে। ফিরে এসে তোর বাবাকে ফোন করে বলে – নারে সীমান্ত, ওসব আমার পোষালো না ! ক’দিন আর বাঁচবো বল? এই বয়সে পুরানো বন্ধু-বান্ধব নিয়ে হৈ হুল্লোর করে সময় কাটাতে মন চায়। ওখানে তো আর তোরা নাই রে। তাই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলাম রে। বলেই দুজন পাল্লা দিয়ে হাসি (… হাঃ… হাঃ …হা… আ…হাঃ…)। আকাশ বললো, হুম্‌ম। ভালোই তো।বাবাও তো মিস্‌ করছিলো ওনাকে।
‘Happy days are back here again’
… মা কাজে মন দিলেন। সেও তার রুমে চলে আসলো।

সন্ধ্যায় আকাশ ওর রুমে বসে ডেস্কটপে ইন্টারনেট এ ইমেইল চেক করছিলো। এমন সময় ওর দরজায় টোকা পড়লো। আকাশ ভেতরে আসতে বললো।ওর মামাতো ভাই কিংশুক ভেতরে এসেই লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো। কিংশুক এবারে স্ট্যান্ডার্ড থ্রী’তে।
‘Happy Birthday Day Akash Vaia’.
Thanks -বললো আকাশ। তার সাথে কিংশুক’এর খুব ভাব। প্রয়োজনটা বোধকরি, কিংশুক’এরই বেশী। কেননা, আকাশে’র ডেস্কটপ এ লেটেস্ট ভার্সন এর গেমস্‌ গুলো আছে। কিংশুক এর প্রিয় MOTO RACE.
আকাশ ওকে সু্যোগ করে দিয়ে মামাদের সাথে দেখা করার জন্য বাইরে বেরুলো। সে আজ বাবা’র দেয়া কালো পাঞ্জাবীটা পড়েছে। বুকে, কাঁধে আর হাতের কাছে লাল সুতার কাজ করা। পাঞ্জাবীটা সুন্দর আর আকাশকে মানিয়েছেও দারুন। তার মাঝারী গড়ন, উচ্চতা ৫’ -৯” আর রং উজ্জ্বল শ্যামলা। ড্রইং রুমে যেতেই বাবা ওকে দেখিয়ে বললেন-
‘এই যে আকাশ । হুম্‌ম। My Prince! You look great today’.

মামা- মামী’র সাথে কুশল আদান প্রদান হলো। জন্মদিনের শুভেচ্ছাও নেওয়া গেল। আকাশ বললো, এই বয়সে এসব আর মানায় মামা – তুমিই বলো? মামী উত্তর দিলেন-অন্যদিন কি হবে জানি না। তবে আজ যে মানাচ্ছে -তা তো নিশ্চিত।
ঘরের বাকি সবাই হেসে উঠলো।
আকাশ যেন আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস টের পেল। ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। সেই অভিপ্রায়ে ও মা’র দিকে তাকালো। ঠিক সে সময়ে, কিংশুক দ্বিতীয় ঝড় হয়ে আকাশ’কে এক প্রকার টেনে ওর রুমে নিয়ে এলো। গেম খেলতে খেলতে ডেস্কটপটা হ্যাং করেছে বলে কিংশুক’এর এই আচমকা ‘জরুরী অবস্থা’ জারী। বুকের ভেতর একটা খচ্‌খচ্‌ নিয়ে নিরুপায় আকাশ কিংশুক’কে উদ্ধারের জন্য মনোনিবেশ করলো।

…খানিক বাদে ওর গেম খেলাটা জমে ঊঠলো আর আকাশও যেন ডুবে গেল তাতে। কিংশুক এর সামনে এখনো তিনটা মটর সাইকেল আছে, সময়ও নেই বেশী হাতে – লাস্ট ল্যাপ চলছে!
এহেন উত্তেজনা’র মধ্যে দরজায় কয়েকবার মৃদু টোকা পড়লো।
আকাশ উত্তর দেবার ফুসরত পেল না।
এবার দরজায় কিঞ্চিৎ জোরালো শব্দ হলো।
এতক্ষনে আকাশ অসহিষ্ণূ ভঙ্গীতে বললো-ভেতরে চলে এসো।
কেউ এলো না তো!
ও এবারে উঠে নিজেই দরজা খুলে দিল।
দরজার ওপাশে বড় একটা ফুলের তোড়া হাতে কে একজন দঁড়িয়ে!
তোড়ার উপর চিরকুটে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা-

‘…কি দিলাম তোমায় আমি-
রঙ্গীন আর রাংতা পাতায় মোড়া
ভালবাসা তো নয়…! ’
… ও গুলো আমার প্রিয় কিছু লাইন। অহেতুক বিভ্রান্ত হবেন না।
অনেক শুভেচ্ছা আপনার এই জন্মদিনে।
– নীলিমা
১৪/২/১৯৯৭


~কই, ধরুন ।
আকাশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।
ওহ্‌। দুঃখিত। তোড়াটা হাতে নিতে নিতে ও বললো- আন্তরিক ধন্যবাদ আপনাকে।
~ ভেতরে আসতে পারি?
– নিশ্চয়ই ( বলেই পথ করে দিল আকাশ)।
~ (চারপাশে চোখ বুলিয়ে) সুন্দর সাজানো গোছানো ঘর আপনার।
– কৃতিত্ব পুরোটা একাই নেয়া ঠিক হবেনা। মা’র ও অবদান আছে এতে।
~ ও আচ্ছাআচ্ছা। একদম্‌ লক্ষী ছেলে !

মিষ্টি এক টুকরো হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখে আকাশের বিছানায় খুব সাবলীল ভাবে বসলো নীলিমা। আকাশ এইবারে সম্পূর্ণ করে দেখলো ওকে। নীল রং এর শিফনের একটা শাড়ী পড়েছে সে। তাতে চুমকি’র কাজ করা। হাল্কা সাজ -কান-গলা -ভ্যানিটি ব্যাগ …সব কিছুতেই নিখুঁত সাদৃশ্য। তার মায়া মেশানো সপ্রতিভ চেহারা আর স্বভাবজাত কৌতুহল আকাশ’কে একদন্ড বিশ্রাম দিলনা।

কিছুক্ষন চুপ থেকে সে আবার বললো,
~ আচ্ছা ভ্যালেন্টাইন্স ডে আপনার বার্থ ডে। ব্যাপারটা মজার না?
এতক্ষনে আকাশ ধাতস্থ হয়ে গেছে। ওপেন ফ্লোর পাওয়ায় সে এইবারে শুরু করলো- আসলে, আমার জন্মের সময় বোধকরি এ দিবস ছিলনা। তবে ভালবাসা’র জন্য শুধুমাত্র একটা দিন নির্ধারন করাটা আমার কাছে বড্ড অবিচার বলে মনে হয়। আমার বিশ্বাস – বছরের ৩৬৫ দিনেই ‘ভালবাসা’ সমান অনুপাতে অপরিহার্য। আকাশের কন্ঠে এমন কিছু একটা ছিল; যে কিছু পুর্বের ব্যস্ত বক্তাটি এইবেলা শ্রোতার ভূমিকায় চলে এলো।

আকাশ ক্লাস নেয়ার ভঙ্গীতে তাকে বলে চললো-
‘Fall in Love’। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘ভালবাসার পতন’’।
পতন মাত্রেই পীড়াদায়ক। ‘ভালবাসার পতন’ এ উভয় পক্ষ যদি নিজেদের মধ্যে সমন্বয় এবং সমঝোতা বজায় রেখে পথ চলতে পারে-তবে ব্যাপারটা নির্দ্বিধায় আলোকিত। তবে দুজনের পথ হতে হয় নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত । এ যেন- সিড়ি’তে আরোহনের মত ঘটনা। দু’জনের পথ চলায় – কখনও, একজন অন্যের জন্য অপেক্ষা কখনো বা ধীরে চল অথবা জলদি চল…।
প্রকৃত ভালবাসা নিজে’কে অন্যের জন্য প্রতিনিয়ত তৈরী করে চলে।

এক মনে কথা শুনছিলো নীলিমা। আকাশ একটু থামলো।
কথায় ছেদ পড়ায়- কিংশুক এই সু্যোগে জিজ্ঞেস করলো-
– তুমি কে?
~ আমি নীলিমা।
– হুম্‌ম। ‘Neelima’! What does it mean?
আকাশ জানালো, আমার মামাতো ভাই কিংশুক। এবারে স্ট্যান্ডার্ড থ্রী’তে।
মজা করার ভঙ্গীতে নীলিমা বললো,
~ It’s a colour; the colour of the blue sky.
ঐটুকু ছেলে কি বুঝলো কে জানে! আচমকা বলে উঠলো-
-ও আচ্ছা। স্কাই ভাইয়া, She is the colour of sky.
So you got it back dear.
-বলেই সে আবার গেম খেলায় মন দিলো। :tuski:

কিংশুকের কথা শুনে এইবার নীলিমা লজ্জা পেয়ে গেল। ও মুখ নামিয়ে ফেললো। নীল সাজ ছাপিয়ে তার চেহারায় একটা লালচে আভা ফুটে উঠলো।
বেশ জব্দ হয়েছে…। আকাশ মনে মনে কিংশুক’কে ধন্যবাদ দিয়ে ফেললো। সাবাশ ! এই না হলে আমার সাগরেদ।
ওকে একদিন ভরপেট আইসক্রীম খাওয়াতে হবে।

এমন সময় ডাইনিং থেকে ডাক পড়লো।
ওরা সবাই বেরিয়ে এলো। টেবিলের সামনে হাসান আংকেল-আন্টি’র সাথে খানিকটা আলাপ হলো।

খাওয়ার পর কিছুক্ষন আড্ডা চললো। এরপর সবাই বিদায় নিল। নীলিমা অবশ্য সে সময় আর তেমন বেশী কিছু বললো না। কেবল, যাবার সময় সংক্ষেপে বিদায় নিল।

সবাই চলে গেলে- মা আকাশে’র কাছে এসে জানতে চাইলেন,
কি? নীলিমা’টা অনেক সুন্দর হয়ে গেছে না!
আকাশ মা’র পুরো পরিকল্পনাটা মিলিয়ে ফেললো।
উত্তরে -হাসলো একটু।
বললো, মা এখনই বলতে পারছিনা।
বাবা বললেন, আরেকটু বোঝাপড়া করা দরকার ওর সাথে?
আকাশ বললো, না বাবা। প্রথমে নিজের সাথে।

…কিছুক্ষন বাদে ‘তিলোত্তমা’ বাড়ীটি ঘুমিয়ে পড়লো। আর সঙ্গত কারনেই, আকাশ ঐ স্বপ্নটা আজ আবার দেখলো। ঘুম ভাঙ্গার পর – বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা সিগারেট ধরালো ও।
মুখ ভর্তি ধোয়া জোরে ফুঁ দিয়ে বাতাসে ছেড়ে নিজেকেই শুধায়-
‘এই বুঝি সেই জন…!’
:dreamy:
(চলবে)

২৮ টি মন্তব্য : “স্বপ্ন ! তৃতীয় পর্ব।”

  1. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    কাহিনীতো পুরা রোমান্টিক মোড় নিছে। 😀 আমা আবার :just: রোমান্টিক গল্প পছন্দ করি কিনা!

    ভালো লাগছে ওবায়দুল্লাহ :hatsoff:


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।