স্বপ্ন ! – প্রথম পর্ব।

আকাশের ঘুমটা আজকেও ভেঙ্গে গেল।
সে ঘড়িতে দেখলো আড়াইটা বাজে। রাতে ও যায় যায় দিন দিন পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। তখন জানালাটা খোলা ছিল। এখন বন্ধ। মা নিশ্চয় রাতে বন্ধ করে গেছেন। এ বাসায় সব কিছুই চলে এই মমতাময়ী’র নিপুণ হাতের ছোঁয়ায়।

আকাশ আজ আবার সেই স্বপ্নটা দেখেছে। এই নিয়ে বেশ কয়েকবার এই অদ্ভুত স্বপ্নটা দেখলো সে। কেমন একটা অস্বস্তিবোধ হচ্ছে তার। বেড সাইড টেবিলে রাখা গ্লাসের পানি পুরোটা একবারে খেয়ে ফেললো সে। তারপর বিছানায় আধশোয়া হয়ে বেনসন এর প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে রাখলো। কিছুক্ষন চুপ করে বসে সে তার লাইটার দিয়ে সিগারেটটি জ্বালালো। তার লাইটার জ্বালালে সুন্দর বাজনা বাজে। সেই বাজনা রাতের নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে দিল। একরাশ ধোঁয়া বাতাসে ছেড়ে দিয়ে সে তার অদ্ভুত স্বপ্নটা নিয়ে ভাবতে শুরু করলো।

…অফিস থেকে ফিরেই দেখা গেল আজ বাড়িতে অনেক মেহমান। ভীড় ঠেলে এগোতেই মা’কে দেখা গেল। মা’কে দেখে আকাশ তার কাছে যেতেই তিনি আব্‌দারের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, কি রে আজকের দিনে কী দেরী করে আসে? তিনি মিটিমিটি হাসছেন। আকাশ ভেবে পায়না আজকের দিনের বিশেষত্ব কোথায়! সে মনে মনে বললো-Some thing is wrong some where….! Grossly Wrong! সে মাথা-মুন্ডু কিছু না বুঝেই ধীর পায়ে নিজের রুমের দিকে এগুলো। দরজা ঠেলে আকাশ রুমে ঢুকলো। কিন্তু, এ কি কান্ড! ওর রুমটা ফুলে ফুলে সাজানো। মিষ্টি একটা গন্ধ মৌ মৌ করছে। এসব ছাপিয়েও একটি বিষয় তাকে অস্থির করে তুললো। একজন বেশ ঘোমটা টেনে বধূ বেশে তার বিছানায় বসে আছে। আকাশ বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে একটা উক্তি জানত, এলাম-দেখলাম-জয় করলাম। আর এতো- এলাম-দেখলাম-বিয়ে করলাম! তাকে চমকে দিয়ে মেয়েটি বললো, আমাকে একটু পানি দিবেন প্লীজ। সম্বিত ফিরে পেয়ে টেবিলে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢাললো। কাঁপা কাঁপা হাতে ধরা গ্লাসটি নিয়ে সে মেয়েটিকে এগিয়ে দিল। গ্লাস নেওয়ার সময় ওর হাতের সাথে মেয়েটির হাত লাগতেই যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। যাহ! আর অমনি হাত থেকে গ্লাসটি পড়ে গেল।…
ব্যাস এ পর্যন্তই। এরকম একটি স্বপ্ন বারবার দেখা বড্ড অস্বস্তিকর। ঘটনার আকস্মিকতাও ছাড়া এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করে তার ভেতর। মেয়েটির পানি খাওয়া হলো না!
ঘুম ভাঙ্গার পর তাকে বিছানায় আধশোয়া হয়েই রাতটা পার করতে হয়। এ সময় তার সঙ্গী হয় নিশ্চুপ রাত, গোটা কয়েক সিগারেট আর দূরের কিছু ঝিঁঝিঁ পোকা।
বৈচিত্রপূর্ণ জীবনে কত বিচিত্র স্বপ্ন দেখি আমরা!
O:-)

আকাশ’দের বাড়ীর নাম ‘তিলোত্তমা’। উত্তরা’র তিন নম্বর সেক্টরে সাদা রং এর ‘ওয়েদার কোট’ দেয়া দোতলা একটি ছিমছাম বাড়ী। খুব আহামরি খরচ ছাড়াই একজন রুচিশীল মানুষ যদি নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে কোন বাড়ী বানাতে চান, এই বাড়ীটি তার যথার্থ উদাহরন বটে। এই বাড়ীর সদস্য সংখ্যা তিনজন। সীমান্ত চৌধুরী, তার স্ত্রী সাগরিকা চৌধুরী এবং তাদের একমাত্র সন্তান আকাশ চৌধুরী।

সীমান্ত চৌধুরী একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা। নিষ্ঠা এবং যশ এর সাথে চাকরী করে গেল বছরে চাকুরীকাল শেষ করেছেন। সারা জীবনের পুঁজি আর সঞ্চয় দিয়ে এই বাড়ীটি বানিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরন করেছেন। পরম আত্মতৃপ্তিতে তিনি বাড়ির নাম রেখেছেন – ‘তিলোত্তমা’। এখন তিনি নির্ভেজাল অবসর কাটাচ্ছেন। বেশ কেটে যাচ্ছে তার দিনগুলো। বন্ধুমহলে ইদানীং তাকে বলতে শোনা যায়, এ্যাই – তোরা আমার লাল গাড়ীটার মত টুকটুকে কোন মেয়ে পেলে জানাস তো। ঘরে এবার বৌ আনতে হবে। হুম্‌ম। আমরা বুড়িয়ে গেলাম না, কিন্তু ছেলেটা কেমন করে যেন বড় হয়ে গেল! হ্যাঁ… ? ( তারপরই ওনার স্বভাবজাত অট্টহাসি- হাঃ…হাঃ…হাঃ…। )

সাগরিকা চৌধুরী একজন গার্হস্থ্য অর্থনীতির ছাত্রী ছিলেন। বিএ বিএড করে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। এখন পুরোপুরি গৃহিনী। এই মমতাময়ী মা, তার নিপুণ হাতে সংসারের হাল ধরে আছেন। আকাশের বাবা’র মত তিনিও এখন তার সময় কাটানোর জন্যে একজন সঙ্গী খুঁজছেন। তার নিজের মেয়ে নেই বলে, তিনি অধীর আগ্রহে ছেলের জন্য একটা ভাল মেয়ের অপেক্ষায় আছেন। তার বিশ্বাস ঘর আলো করে এক মেয়ে এসে তার আকাশের জীবনটা রাঙিয়ে দিবে। তিনি পরিচিত অনেক’কেই মেয়ে দেখতে অনুরোধ করেছেন। তার মা বলতেন, সব্বাইকে জোড়া মিলিয়ে বানানো হয়েছে। পবিত্র ‘কুরআন’এ কথা বলা আছে। আমাদের আকাশে’র জোড়াটা যে কোথায় আছে-সে ভাবনায় বিভোর তার মন।

আকাশ চৌধুরী সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ একজন বুয়েটের গ্র্যাজুয়েট। ও এখন একটা ফার্মে কাজ করছে। নিজের মাস্টার্স কমপ্লিট করতে তার শুধু থিসিস’টা বাকি। অফিসের কাজ ছাড়া বাকি সময়টা আকাশ বাড়ীতেই কাটায় বেশির ভাগ সময়। কিছু সময় বরাদ্দ আছে ওর বন্ধুদের জন্য, আর আরো নিবিড় কিছু সময় একান্ত আপনার। সে সময়ে ও সাধারনত গান শোনে, মুভি দেখে – না হয় নিজের ডায়েরীতে লেখালেখি করে। হঠাৎ হঠাৎ ,কয়েকটি শব্দ তো কয়েকটি লাইন যেন ওর মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ে! শত চেষ্টা করেও সেগুলোকে আর হঠানো যায় না। পরিচিত কোন কবিতার বিশেষ ক’টি লাইন কিংবা প্রিয় কোন গানের নির্দিষ্ট একটি লাইন মনে করতে না পারলে যে এক ধরনের অস্বস্তি হয়, ব্যাপারটা অনেকটা সেইরকম। তাই ঐ সময়গুলোতে আকাশ যেন কেমন বেশ ঘোরের মধ্যে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, এ সময়টা এলেই আকাশের বাবা বুঝতে পারেন এবং তিনি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন। কেননা, লেখাটা আকাশের ডাইরীবন্দী হয়ে গেলে সে প্রথমে তাকেই দেখায়। তিনি যত্ন নিয়ে সে লেখা পড়েন এবং মন্তব্য করেন। সে সময় আকাশের মা’ও কাছে থাকেন আর -পিতা-পুত্রের নিবিড় আলোচনা মন দিয়ে শোনেন। সে মূহুর্তটা বড় প্রানবন্ত হয়ে ওঠে। দুই বিশিষ্ট বোদ্ধা যেন তাদের সদ্য প্রসূত শিল্প নিয়ে কথোপকথনে মত্ত। মা ফিরে যান তার কলেজ জীবনের দিনগুলোতে। তখন টি এস সি’তে বসে উঠ্‌তি কবি আর লেখকদের নিজ ও অপরের লেখা নিয়ে জমজমাট আড্ডা চলতো ঘন্টার পর ঘন্টা। এখনো নিশ্চয় ক্যান্টিনগুলোতে চায়ের কাপে ঝড় ওঠে সহপাঠীদের মধ্যে…।

আশ্চর্য ! সময়টা কেমন করে যে আমাদের ফাঁকি দিয়ে ফুরুৎ করে উড়ে যায়। ভাবতে ভারী অবাক লাগে!
:dreamy:

(চলবে)

৪০ টি মন্তব্য : “স্বপ্ন ! – প্রথম পর্ব।”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ছিমছাম, গোছানো শুরু... :thumbup:
    পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম... 😀

    অফ টপিকঃ 'আকাশ' কে তো দেখি খাটিয়ে মারছেন...বেচারা সবখানে... 😛


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।