ঘানা ভ্রমন -৩ কাকুম ন্যাশনাল পার্ক (দ্বিতীয় পর্ব)

কাকুম ন্যাশনাল পার্কে ক্যানোপী ওয়াক এর একটি ঝুলন্ত সেতুর দৃশ্য।

‘কাকুম ন্যাশনাল পার্ক’এ একটি বিকেল থেকে সন্ধ্যা – ২

আমরা ক্যানোপী ওয়াকের কাছে গেলাম।
প্রথমে দেখে সত্যি অভিভূত হয়ে গেলাম। গহীন জঙ্গলের মাঝে উঁচু উঁচু গাছে ক্যানোপী সংযোগ করে ঝুলন্ত সেতু বানিয়েছে বেশ কায়দা করে। গাছে গাছে অ্যাংকরেজ গুলো বেশ মজবুত করে করা হয়েছে। আর তাই আমরা সবাই প্রায় একসঙ্গেই হেঁটে আসলাম পুরা পথ টুকু। মাঝে মাঝে গাছের সাথে অ্যাংকরেজ এর প্ল্যাটফর্মগুলোতে একটু অপেক্ষা। ছবি তোলাও চললো সাথে সাথে। উপর থেকে নীচে তাকালে বেশ ভয় ভয় করে। রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিয়ে শেষ করলাম ক্যানোপী ওয়াক।

আমার পাশে এসে আমার বন্ধুটি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো- ‘আমাদের দেশেও তো জঙ্গলে এরকম আয়োজন করা যেতে পারে। এই তামাশা করে এরা কত পর্যটক আকর্ষন করছে দেখেছিস।‘ আমি উত্তরে এদিক ওদিক মাথা নেড়ে বললাম- ‘হয়তো খুব সম্ভব; কিন্তু কেন উদ্যোগ নেয়া হয়না; সে উত্তর আমায় জিজ্ঞেস করিস না।‘ আমাদের অবিবেচনা পরায়নতা আর উদাসীনতার কথা মনে করে আমার ভিতরে আরও কিছু আফসোস এর জন্ম দিয়ে শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এলো।

এরপর, আমাদের পরবর্তী ইভেন্ট-হাইকিং। গহীন জঙ্গলের ভেতরে চিহ্ন করা পথে গাইড আমাদের হাঁটিয়ে নিয়ে গেল। মাঝে মাঝে সে কিছু বিরল গাছ দেখিয়ে তাদের সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিল। উঁচু নীচু পথে হাঁটতে অসুবিধা হওয়ায় এক বৃদ্ধা আমার কাধে হাত রেখে চলা শুরু করলেন। আমার বন্ধুর হাতেও তখন ওদের ব্যাগ আর ক্যামেরা। প্রথমে কিঞ্চিৎ বিরক্ত থাকলেও; তত্ক্ষনে চুটিয়ে গপ্পো শুরু করে দিয়েছে ও।

হাইকিং রুটে সূর্যের আলো ঢুকে না বললেই চলে। হঠাৎ হঠাৎ গাছের পাতা ভেদ করে আলোক রশ্মি চোখে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে এসে দেখলাম একটা মাচা করে খাট লাগানো আছে। মশারি টাঙ্গানো। পাশেই একটা টয়লেট। সেখানে হারিকেন জ্বালানোতে ব্যস্ত একজন বিদেশী কে দেখা গেল। গাইড বললো- এই ভদ্রলোক রাত কাটাবে এখানে। আর ভয়ংকর প্রানীদের থেকে রক্ষা করার জন্য বন্ধুকধারী গার্ড আছে জায়গায় জায়গায়। আমি মনে মনে ওস্তাদ কে সাবাশী দিলাম।

আমরা আফ্রিকার গহীন জঙ্গলে হাইকিং শেষ করে যখন পার্কের এক্সিট গেটের কাছে পৌঁছুলাম। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বাইরে এসে গাইড জানালো এখানে বাংলো আছে রাতে থাকার জন্য। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাও ভালো। আমরা ওকে ধন্যবাদ দিয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে পা বাড়ালাম। সেখানে একটি মাত্র গাড়ি দাঁড়ানো। পরে দেখলাম ঐটা আমাদের অপর তিন সদস্যাদের ভাড়া করা গাড়ী। পার্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা ট্যাক্সির জন্য একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম। এমন সময়, ঐ তিন আমেরিকান মহিলা আমাদের দিকে এগিয়ে এসে কয়েকবার করে ধন্যবাদ জানালো। ইমেইল অ্যাড্রেসও নিলেন একজন। তারপর ওদের মধ্যে সবচেয়ে বয়ষ্কা যিনি (৭৩ বছর) আমার কাধ চাপড়ে বললেন –
‘You had been excellent ambassador of your country BANGLADESH. Your mom must be very proud of you.’

আমি তার ভাষাতেই উত্তরে বললাম যে -এটা আমার অনেক আনন্দের স্মৃতি হয়ে থাকবে। আর তাদের আমন্ত্রন জানালাম বাংলাদেশ দেখার জন্য। আমার বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে সুন্দরবনের গল্প বলে ফেলেছে। আমি এবার বললাম কক্সবাজারের কথা। এরপর নাটকীয় টোনে বললাম যে – নতুন সপ্তমাশ্চর্যের এই দুটি কে নিজের চোখে না দেখলে অষ্টমাশ্চর্য মার্কা আফসোস নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে হবে । এ কথা শুনেই তারা সবাই অনেক হেসে উঠলেন এবং উৎসাহ দেখিয়ে বললেন অবশ্যই আসবেন তারা বাংলাদেশে।

এরপর ফিরবার পালা । তাদের গাড়িতে গাইড বাবাজীও এসে উঠলো। ফলে সৌজন্যতা যা দেখানো যেত – সেটাও তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়লো। আমরা হেঁটেই মেইন রোডে চলে এলাম। সামনে বাস স্ট্যান্ড এর সামনের বেঞ্চিতে বসে অপেক্ষা শুরু করলাম। পরপর ক’টা ভরা মাইক্রোবাস যাওয়ার পর আমরাও একটা মাইক্রোবাস পেয়ে গেলাম। পেছনে মুরগীর খাঁচা, লোকে গাদাগাদি, ক্ষুধার্ত বাচ্চার কান্না আর কন্ডাকটারের ডাক শুনতে শুনতে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মনে মনে যে কোন গানের সুর তুলে পারিপার্শ্বিকতা ভুলবার আয়োজন করলাম।
হঠাৎ করেই যেন মনে এলো-

রাঙ্গামাটির রঙে মন জুড়ালো।
সাম্পান মাঝির গানে মন ভরালো।
রূপের মধু সুরের জাদু কোন সে দেশে
মায়াবতী মধুমতি বাংলাদেশে।।

লম্বা সফরের পর অবশেষে ফিরলাম শহরে।
হোটেলের রূমে যেয়ে গোসল সারলাম দুজনে।
এরপর আমি বললাম- বন্ধু, এবারে আমার ভেতরে কিন্তু বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে…।
এবারে ও হেসে দিল। দুজনে ঝটপট তৈরী হয়ে নেমে পড়লাম রাস্তায়।
সামনে যে হোটেল পড়বে তাতেই হামলা চালাবো দুই বন্ধু।
কোন ছাড়াছাড়ি নাই …!

:gulti:

(-শেষ-)

২৭ টি মন্তব্য : “ঘানা ভ্রমন -৩ কাকুম ন্যাশনাল পার্ক (দ্বিতীয় পর্ব)”

  1. রকিব (০১-০৭)

    বস, গত ৬ দিনে ১১টা পোষ্ট... 😮 😮 😮 একটা আরেকটার চেয়ে দারুণ... :boss: :boss: :boss:

    প্লীজ ডুব দিয়েন না :no: :no:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. তানভীর (৯৪-০০)

    ভাইয়া, যথারীতি চমৎকার বর্ণনা। :clap: :clap:

    নতুন সপ্তমাশ্চর্যের এই দুটি কে নিজের চোখে না দেখলে অষ্টমাশ্চর্য মার্কা আফসোস নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে হবে ।

    বিদেশী কারো সাথে কথা হলেই আমি জিজ্ঞেস করি, তুমি কি জানো পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কোথায়? তারপরই শুরু করে দেই কক্সবাজারের গল্প।

    আপনার কাছ থেকে এইরকম আরও গল্প শুনতে চাই।

    জবাব দিন
  3. রাঙ্গামাটির রঙে মন জুড়ালো।
    সাম্পান মাঝির গানে মন ভরালো।
    রূপের মধু সুরের জাদু কোন সে দেশে
    মায়াবতী মধুমতি বাংলাদেশে।।

    এখন শুন্তেছি। আহা! কি দারুন। থ্যাঙ্কস ভাইয়া। 😀

    জবাব দিন
  4. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    ভালো লাগলো। ভ্রমণ কাহিনী আমার খুব প্রিয় বিষয়। এখানে বিনা পয়সায় ঘানা দেখার সুযোগ করে দিয়েছ। ধন্যবাদ তোমাকে। এরকম নিশ্চয়ই আরো লিখবে।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  5. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    ওবায়দুল্লাহ ভাই আরেকটা চমৎকার সিরিজ শেষ করলেন :clap: :clap:
    কবিতা দিয়ে যেভাবে ভ্রমন শুরু করেছিলেন ঠিক একই দক্ষতায় গদ্যাকারেও সেই মুগ্ধতা বজায় থাকলো। বস্ আপনাকে :salute:

    ‘You had been excellent ambassador of your country BANGLADESH. Your mom must be very proud of you.’

    এত দুঃসংবাদ কিংবা বিরূপ প্রচারণার মাঝেও আপনাদের মতো মানুষদের কারণে এখনো আমরা আমাদের দেশকে বাইরের বিশ্বে গর্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারছি। :boss: :boss:
    ঘানার ন্যাশনাল পার্ক দেখে আমাদের দেশের বন গুলো কিংবা ইকো বা সাফারি পার্ক গুলোর কঠা মনে পড়লো (ফয়েজ ভাইয়ের পোস্ট দ্রষ্টব্য) খুব অল্প আয়াসেই হয়তো আরো চমৎকার করে রাখতে পারি আমাদের এই জায়গাগুলোকে।

    তবে আমাদের দেশেও কয়েকটি সংরক্ষিত বনে দর্শনার্থীদের জন্য অরণ্যের ভারসাম্য নষ্ট না করে নিসর্গ নামে চমৎকার একটা প্রজেক্টের কাজ চলছে।
    দুটো ছবি দিয়ে দিলাম মন্তব্যে, মাইন্ড করবেননা আশা করি 🙂


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  6. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    "অসাধারণ" আর "অনন্যসাধারণের" পার্থক্য করতে পারতেছি না।
    কোনটার ওয়েটেজ বেশি???
    যেইটার বেশি সেইটা এইখানে বেশি বেশি করে প্রযোজ্য :boss: :boss: :boss: :boss: ।


    Life is Mad.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।