যখন বাজলো গেমস এর বাঁশী (১)

কলেজে প্রতিদিন সবচেয়ে মজার সময় ছিল গেমস টাইম।
আমি ক্লাস এইটের পর থেকে বাস্কেটবল খেলা শুরু করছি। তার আগে ফুটবল এর গোলকীপার খেলতাম। আমার বন্ধু তাজুল সেই ক্লাস সেভেন থেকেই দুর্দান্ত ফুটবল খেলতো। ওর নেশা ছিল শট নেয়া আর আমার ওকে ঠেকিয়ে দেয়া। ছুটির দিন গুলোতে ও আর আমি খুব ভোরেই মাঠে যেয়ে এই প্র্যাকটিস করতাম। ওর রেইন বো / ব্যানানা শট গুলো ঠেকানো ছিল ঐ সময় আমার বিশাল চ্যালেঞ্জ।

আর এছাড়াও বৃষ্টির মধ্যে লন এ কিংবা মাঠে ছোট পোস্টে খেলা গুলো ছিল সুপার ডুপার হিট।
আহ ! দিন গুলি কিভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। আর দিন দিন আমরা বুড়িয়ে যাই। হারিয়ে যাই সময়ের অতল গহবরে।

আচ্ছা। ঠিক আছে।
আজ আপনাদের এক ফুটবলপ্রেমী কিশরের গল্প শুনাই। শুরুতে ফুটবল জীবন থাকলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু সে আর ধরে রাখতে পারে নি এই মোহটুকু। বাকি আট দশ জনের মতই জীবনের ঘোড়দৌড়ে হারিয়ে গিয়েছিল তার কৈশোরের সেই স্বপ্ন। এ গল্পটা অন্য ভাবে আরো ক’জনকেও শুনিয়েছিলাম।
কিন্তু, আমি নিশ্চিত- এখানে আপনাদের শুনিয়ে আরো অনেক বেশী তৃপ্তি পাবো।
কেননা, চেনা পরিসরে অভিন্ন ভাবনা গুলো অনেক বেশী আপন হয়ে ধরা দেয়।

যে কিশোরের কথা বলতে যাচ্ছি, তার মূল নামটা তেমন জরুরী নয়। তাই, আমরা এখানে তার একটি নাম দিয়ে নিই। ধরা যাক -সুনীল। নাহ্‌, আরেকটু ঘষে বরং বলি – নীল। (আমার হাউস আবার ফজলুল হক হাউস কিনা ! 😀 )

ছোট বেলা থেকেই নীল বড্ড অভিমানী ছিল। ক্ষেত্র বিশেষে তাকে জেদী বলাটাও মানিয়ে যায়।
বেশ, আরো একটু সাহিত্য মিশিয়ে বলি।

কৈশোরের ঐ বয়সটাতে ওর তখন বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে পাগলা ঘোড়ার মত দৌড়াবার সাধ জাগতো কেবল। ওরা যেখানে থাকতো- কাছে ধারে কোন খোলা মাঠ ছিল না। তাই বিকেল হলেই সে ছুটে যেত দূরের পাড়ায়। সেখানকার নরম ঘাসের সবুজ মাঠটুকু তার কাছে জাজিমের মত মনে হতো। সটান করে শুয়ে শুয়ে সে দূরের আকাশের পানে চেয়ে থাকতো চুপটি করে। উড়ে চলা পাখির ডানায় ভর করে তার ছোট্ট মনটাও ঘুরে বেড়াতো মেঘের চাদর মেখে মেখে।

সেইবার স্কুলের পরীক্ষা শেষের ছুটিতে লম্বা সময় পাওয়া গেল। এক বিকেলে নীল ঐ মাঠে যেয়ে দেখে বেশ আয়োজন করে ফুটবল খেলা চলছে সেখানে। খেলোয়ার সবাই বয়সে ওর থেকে ৪-৫ বছরের বড় হবে। প্রথম দিন সাইড লাইনে বসে বসে সে পুরো খেলা দেখলো। পরীক্ষা শেষের সম্পূর্ণ স্বাধীনতাটুকু উপভোগ করে সন্ধ্যা নামলে বাড়ি ফিরে এলো নীল।

খাওয়া সেরে রাতে ঘুমিয়ে পড়লে তার দুচোখে ভর করলো ঐ সবুজ মাঠ – খোলা আকাশ আর ছুটে চলা বল- পা থেকে অন্যের পায়ে। শেষ মেষে গোল পোস্টের সামনে এসে দেখা গেল নীল সজোরে বলে লাথি মারলো। … লাথির ঝটকায় খাটে ব্যথা পেয়ে উঠে বসলো ও। কপালে জমে ওঠা ঘাম মুছে নিল। তারপর, ছোট ঘরে যেয়ে হাল্কা হয়ে এসেই আবার ঘুমিয়ে গেল বেচারা।

পরদিন, সারাটা দুপুর খুব লম্বা মনে হলো নীলের কাছে। রোদের তাপটুকু কমতে না কমতেই মা’র চোখ বাঁচিয়ে সোজা যেয়ে হাজির হলো ঐ পাড়ার মাঠে। সেখানে তখনও সবাই এসে পৌঁছায় নি। দুজনকে দেখা গেল বল নিয়ে কসরৎরত। নীল ওদের কাছে যেয়ে তার স্বভাবজাত সুরে বললো – ‘আমায় খেলতে নিবে?’

খেলার মাঠে এসে বয়সে বড়দের আপনি করে বলা ওর অভিধানে নেই। আর নীলের স্বরে কোন অনুরোধের অনুনয় ছিল না। বরং অধিকার ফলানোর ঢং ছিল অনেকটা। এহেন প্রশ্নে শূণ্যে ওঠা বলটা খপ করে হাতে ধরে নিয়ে একজন রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করলো-‘কে তুমি? আগে তো দেখি নি। তুমি কি এই পাড়ার? ‘

ধারাবাহিক প্রশ্নের উত্তরে ও ছোট করে বললো- নাহ্‌। দু দিকে মাথা নেড়ে বোঝালো যে সে এই পাড়ায় থাকে না।
এইবার অন্যজন বললো – ‘তাইলে চান্দু ফুটো এইখান থিকা।‘

নীল এবার আরো জোর দিয়ে একে একে জানালো ওর নাম। গত কয়েক দিনে সে প্রায়ই এই মাঠে এসেছে। গতকাল তাদের খেলা দেখে ওর ভাল লেগেছে। আজ তাই খেলতে চায় ওদের সাথে।

ইতিমধ্যে অনেকেই চলে এসেছে। আগন্তুক কে দেখে কেউই তেমন আমল দিল না। ওয়ার্ম আপ শুরু করে দিল তারা। এক পর্যায়ে টীম ক্যাপ্টেন গোছের একজন নীল কে বললো- এই বাবু। যাও। মাঠের বাইরে যাও। খেলা শুরু করবো আমরা। নীল এর উত্তরে আবারো বললো- আমি খেলতে চাই। এবারে স্বরে কিছুটা নমনীয়তা আসলেও তা যথেষ্ঠ ছিল না। তাই টীম ক্যাপ্টেন অধৈর্য হয়ে বললো – আচ্ছা আচ্ছা – খেলো। আরেকটু বড় হয়ে খেলো। এখন বাইরে যাও তো বাপু।

নীল এবারে একটু দমে গেল। মাথা নিচু করে সবুজ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে খুব মনোযোগ দিয়ে সে -যেন হারিয়ে যাওয়া দরকারী কিছু একটা খুঁজে খুঁজে ফিরে গেলো সাইড লাইনে। বিরস বদনে খেলা দেখলো পুরাটা। যতক্ষন মাঠে ছিল খেলোয়াড়রা ও দূর থেকেই চেয়ে দেখলো ওদের চলে যাওয়া পর্যন্ত। তারপর ফিরে যেয়ে মেঘ কালো মুখ করে বসে ছিল কোনার ঘরে। খেয়ে দেয়ে তাড়াতাড়ি এই রাতটা পার করে কালকের বিকালটাকে কত দ্রুত সামনে আনা যায়- সময়ের কাছে এই মিনতি করতে করতেই ঘুমিয়ে গেল সে।

পরদিন আরেকটু আগে গেল সে। আজও আগে আসা ক’জন কে প্রথমে প্রস্তাব – পরে অনুরোধ করেও আশাহত হলো সে। পরে, টীম ক্যাপ্টেন আসলে আজ তাকে গত দিনের থেকেও কঠোর ভাবে মাঠে থেকে বের হয়ে যেতে বললো।

সাইড লাইনে বসে বসে ঘাসের ডগা ছিড়তে ছিড়তে খেলা দেখছিল নীল। যতটুকু না খেলা দেখলো সে – তার চেয়ে অনেক বেশী ভাবলো যে-এই ছেলেদেরকে এই অপমানের কড়া একটা জবাব কি ভাবে দেওয়া যায়…?
:duel:

(২ আসছে…)

২৮ টি মন্তব্য : “যখন বাজলো গেমস এর বাঁশী (১)”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    অসাধারন সূচনা বস...বেশি অপেক্ষায় রাইখেন না, পরবর্তী পার্ট তাড়াতাড়ি ছাইড়েন।
    (আমার লাইফে passion বলতে কিছু থাকলে সেটা হলো ফুটবল)


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. তাইফুর (৯২-৯৮)

    তাজুল ভাই, তানিম ভাই, রাশিদুল ভাই, সাব্বির জামান ভাই ... দুর্দান্ত ফুটবল টীম ছিল আমাদের ... মনে পইরা গেলরে ... মনে পইরা গেল।
    বিকেএসপি'র সাথে আপনাদের ব্যাচের খেলার দিন সাইড লাইনে বইসা ছুট্ট এক ডাইলগ দিছিলাম ... তারপর বিকালের টি-ব্রেকের পর থিকা স্পেশাল ডিনারের আগ পর্যন্ত যা খাইছিলাম ...


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।