হুম্‌ম, অবশেষে…!

তখন আকাশের ইঞ্জিনিয়ারিং এ চতুর্থ লেভেলের শেষ টার্ম চলছে।
ও খুব শখ করে একটা লাইটার কিনেছিল। ক্যাপ খুললেই বাজনা বাজে আর নীলচে একটু লাইট জ্বলে।

ও সিগারেট ছুঁয়েছে সেই ক্লাস নাইনে। শুরুটা স্বাদ নেয়ার অভিপ্রায়ে রোমাঞ্চকর অভিযান। তারপর সময়ের হাত ধরে এক সময় সে নিজেকে আবিষ্কার করলো মোটামুটি শেকলে বাধা ধুমপায়ী’র আদলে। শুরুতে লুকিয়ে লুকিয়ে অভিসার চলতো। খাবার পর এই একটু হেঁটে আসা টাইপ আর কি! ধীরে ধীরে ছাদে – বারান্দায়- শেষে -রুম পর্যন্ত।

আসুন এবারে আমরা, ইতিহাসের দিকে খানিকটা নজর দিই-

আকাশের বাবা আগে সিগারেট খেতেন। ছেড়ে দিয়েছেন বেশ আগেই।
বয়সের কারনে নয়; বরং অদ্ভুত একটা মানবিক ঘটনা তাকে সিগেরেট থেকে মুক্তি দিয়েছে।

তখন সীমান্ত চৌধুরীর নতুন চাকরি। স্বল্প আয়ে তার সুনিয়ন্ত্রিত গোছানো সংসার। মাসের শেষ ভাগ। অফিস থেকে ফিরবার সময় বাজারে গেছেন। অভ্যাস-বশতঃ সিগারেট কিনে ফেললেন গোটা দশেক। তারপর বাজারের লিস্ট বের করে দেখলেন – এক নম্বরে লেখা আছে কমলা। তারপরে আরো টুকটাক দিনের বাজার।
বেশ কয়েকদিন ধরেই আকশের মা মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে -বাচ্চাটা কমলা পছন্দ করে। বাজারে কমলা উঠেছে । নতুন – তাই দাম একটু চড়া। তবুও এক / দুই হালি নেয়া যায় অনায়াসে ছেলের মুখে এক চিলতে হাসির জন্য। এই ভেবে উনি কমলাওয়ালার কাছে যেয়ে দামদর শুরু করলেন।
যতখানি ভেবেছিলেন – বাজার তার চেয়েও চড়া এবং পুরা বাজারে এই একজনের কাছেই কমলা আছে। আর যায় কোথায়? নিজেকে অর্থ-মন্ত্রী ভেবে চাচা মিয়া এক পয়সাও কমাবেন না – পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন।

মানিব্যাগ বের করে হিসাব নিকাশ করার সময় সীমান্ত চৌধুরী একটু বিপাকে পড়ে গেলেন। খুচরা টাকা গুলোও দুইবার গুনলেন।
নাহ! হচ্ছে না। সব জড় করেও দুই হালির দাম উঠছে না।
নিজের উপর ভীষন রাগ হলো তার। ইশশ… !
শুরুতেই সিগারেট গুলি না কিনলে বাচ্চাটার জন্য কয়েকটা কমলা বেশী কিনে নেয়া যেত!

কোলাহলপূর্ণ ব্যস্ত বাজারের মাঝে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হলো তার। বারবার বাচ্চাটার হাসোজ্জ্বল মুখটার ছবি ফুটে উঠছিলো যেন!
পরম পিতৃস্নেহে নিজেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছিলেন – না এরপর সিগারেট আর কখ্‌খনো না।

এই ঘটনা’টা আকাশের মা ওকে বলেছিলেন।
সেই ছোটবেলাতেই ও ঠিক করে রেখেছিল সিগারেট খাবে না ও কখনো। কিন্তু, সময়ের যাতাকলে আর কৈশোরের জোয়ারে ওর সেই ভাবনা হারিয়ে গিয়েছিল অতি সন্তর্পনে।

………………………………………………………………………………………
সে অনেক আগেকার কথা।
এখন আকাশ চৌধুরী কেবল গুরু জনদের এড়িয়ে সিগারেট চালিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত ভাবেই। ব্যতিক্রম শুধু তার গাড়ীতে। ইদানীং আরেকটা ব্যতিক্রম এর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ নিয়ে আকাশ একটু চিন্তিতও বটে।
নীলিমা আজকাল সিগারেট নিয়ে জোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে। প্রথম থেকেই ওর আপত্তি ছিল। দিনে দিনে সম্পর্কটা গভীরতা পাচ্ছে আর দাবীটাও যেন তীব্রতর হয়ে উঠছে। নিজের চোখের সামনে নীলিমা তার দাদাকে ক্যান্সারে নিঃশেষ হতে হতে ফুরিয়ে যেতে দেখেছে। আর তাই সিগারেটের বিপক্ষে ওর এই দৃঢ় অবস্থান। সে কারনেই অনুযোগ আর অনুরাগ এর পালা বদলে সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল ওদের।
…………………………………………………………………………………………

সেদিন বিকালে অনেকদিন পর ফুসরত পাওয়ায় আকাশ আর নীলিমা পার্কে হাঁটতে এসেছে। খানিক বাদে পুকুরের দিকে মুখ করা একটা বেঞ্চিতে ওরা নিবিড় ভাবে বসলো। চমৎকার মায়াবী পরিবেশ যেন যাদুটোনা করে রাখলো ওদের দুটি মনকে।

আকাশের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে- নীলিমা আকুতি জড়ানো কন্ঠে বললো ,
‘আজ একটা জিনিস চাইলে তুমি আমায় ফিরিয়ে দেবে না তো?’
আকাশ ওর চোখে চোখ রেখে ইশারায় জানতে চায় কি?
নীলিমা আরও কাছে এসে বললো-
‘আমায় ছুঁয়ে বলো – তুমি আর সিগারেট খাবে না।‘

আকাশ একটু থতমত খেয়ে গেল।
এতদিন যেসব বন্ধুরা প্রেয়সী বা মেয়ে বন্ধুর অনুরোধে সিগারেট ছেড়েছে তাদের কটাক্ষ করার সুযোগ সেও হাতছাড়া করেনি কখনও। আর আজ এভাবে …?

আকাশকে ভাবতে দেখে নীলিমা আবার বলে চলে –
‘কি লাভ বলো এইসব ছাইপাশ খেয়ে ?
আর নিজেকে পোড়াতেই যদি চাও ; তবে সিগারেট কেন ?
এই যে আমি র‌য়েছি।
এখন থেকে না হয় তোমাকে পোড়ানোর ভার’টা আমিই নিলাম।‘

এরকম কড়া একটা কথা শোনার পর, কোন যুক্তিই দাঁড় করানোর স্পৃহা হয় না আর…। 🙁

আকাশ কিছু না বলে পকেট থেকে ওর প্রিয় লাইটারটা আর আধখাওয়া সিগারেটএর প্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল সামনের পুকুরে। হাত লেগে লাইটারটির ক্যাপ খুলে গিয়েছিল হয়তো । তাই নীলচে আলো নিয়ে বাজনা ছড়াতে ছড়াতে লাইটারটি আর বেনসনএর প্যাকেটটা টুপ -টাপ করে পুকুরের পানিতে পড়ে নিমিষেই তলিয়ে গেল।
:no:

নীলিমা চকিতে জড়িয়ে ধরলো আকাশকে। আর প্রায় সাথে সাথেই ফুঁপিয়ে উঠলো। আকাশ ভাবলো – উফ্‌ফ ! এই মেয়েটা এখন আবার কাঁদছে কেন – কে জানে!

ইদানীং অনেক কিছুই ও ভাল বুঝতে পারে না।
এই যেমন, নিজেকে এভাবে হারিয়ে দিয়ে ভালবাসার মানুষটিকে জিতিয়ে দেওয়ায় এতখানি আনন্দ কেন হবে -এর কোন ব্যাখ্যাও সে দাঁড় করাতে পারলো না ।
:dreamy:
আকাশ নীলিমার মুখটা উঁচু করে ধরলো।
যত্ন করে চোখের জল টুকু মুছে দিল।
তারপর ওর চোখে চোখ রেখে বললো –
হুম্‌ম, অবশেষে…!
:guitar:

( প্রিয় সিগারেট কে ‘না’ বলার ইতিকথা ! )

৫৪ টি মন্তব্য : “হুম্‌ম, অবশেষে…!”

  1. সামি হক (৯০-৯৬)

    আমি আবারো মনে হয় প্রথম 😀

    মেয়েরা কেমন করে যেন আদায় করে নেয় তাদের দাবী 🙁 কিন্তু সেই দাবীগুলো পূরণ করতে কেন যেন আবার বেশ ভালোই লাগে 😀 ...

    ওবায়দুল্লাহ ভাই অসাধারণ লেখাটার জন্য :salute:

    জবাব দিন
  2. শার্লী (১৯৯৯-২০০৫)

    ওবায়দুল্লাহ ভাইয়ের পোস্টে মইনুল ভাইয়ের মন্তব্যের জবাবে হাসির ওপর বেশ কষে একটা চপেটাঘাত এই পোস্ট।

    দেখি আমারও ছাড়তে হবে বোধহয়। তার আগ পর্যন্ত ঈদ পালন করি নাহয়। 😀

    জবাব দিন
  3. নাজমুল (০২-০৮)

    আমার আম্মু বলছে সিগেরেট খাওয়া খুব খারাপ তাই কখনো আত্মীয় স্বজন দের সামনে আমি সিগেরেট খাইনা এবং খাবোওনা B-)
    এবং সবাইকে অনু্রোধ করলাম না খাওউয়ার জন্য 😕

    জবাব দিন
  4. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    বলি আকাশদা আচেন নিকি?কলকাতায় তো মশাই বিড়ি ফুঁকতেন, সিগারেট খেতে গেলে অতগুলো টাকা খরচ হয় তা কি আর করা যায়? 😛 😛
    (এইটা আহসান আকাশ ভাইয়ের প্রতি)

    ওবায়দুল্লাহ ভাই,আমি সিগারেট খাইনাই কখনো তাই ছাড়ার প্রয়োজনও পড়ে নাই। তবে আপনাকে অনেক খারাপ একটা অভ্যাস থেকে দূর করানোর জন্য ভাবীকে সেলাম।সিগারেট খাওয়া খুব খ্রাপ x-( x-(

    জবাব দিন
  5. ফয়েজ (৮৭-৯৩)
    আর নিজেকে পোড়াতেই যদি চাও ; তবে সিগারেট কেন ?
    এই যে আমি র‌য়েছি।
    নীলিমা চকিতে জড়িয়ে ধরলো আকাশকে। আর প্রায় সাথে সাথেই ফুঁপিয়ে উঠলো। আকাশ ভাবলো - উফ্‌ফ ! এই মেয়েটা এখন আবার কাঁদছে কেন - কে জানে!

    আরে দূরও, এত কিছু লাগে নাকি সিগারেট ছাড়তে, এটা তো এমনেই ছাড়া যায়।

    সিগারেট খাওয়াতে কোন বীরত্ব নেই, বরং না খাওয়াটাই বীরের মত কাজ।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  6. ইউসুফ (১৯৮৩-৮৯)

    .....................
    .............................
    ....................................

    বি এম এ তে জয়েন করবার পর যে ব্যাপারটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছিল, তা হল, ওখানে সিগারেট খাবার কোন বাঁধা নেই।

    সিগারেট কে ঘিরে কলেজে আমার অনেক সময় গিয়েছে। অন্যদের যেমন গার্লফ্রেন্ড - আমার ছিল সিগারেট। এতই সিরিয়াস।

    সিগারেট ছাড়ার ব্যাপারটা কখনই সিরিয়াসলি নিতে পারিনি। তবে, আজ ভাবি, আমাকে জীবনের একটা ভুল সংশোধন করতে দিলে আমি সিগারেট ধরার এই ভুলটা সংশোধন করতাম।

    অভিনন্দন ওবায়দুল্লাহ!

    জবাব দিন
  7. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    বন্ধু,
    অভিনন্দন এরকম একটা সুন্দর লেখার জন্য...আমিও তোর সাথে সবাইকে আহবান জানাতে চাই ধুমপান কে না বলার জন্য...

    আরেকটা কথা, কবে আমি তোর মত এত সুন্দর করে লিখতে পারবো রে? এই একটা ব্যাপারে আমি তোকে ভীষন হিংসে করি...তুই কষ্ট পেলেও আমি এটা করেছি, করি এবং করবো... 🙂

    জবাব দিন
    • ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

      🙂
      অনেক দেরী হলো উত্তর দিতে।
      এ দিকে আসা হয়না নিয়মিত।
      আজ ঘাটাইলে এসে হঠাৎ মনে হওয়ায় ঢু দিলাম।
      দেখি - তোর প্রশ্রয় আর ভালবাসায় মাখামাখি হয়ে আছি এ আঙ্গিনা।
      আর তাই লগ ইন করলাম ধন্যবাদ জানাতে। :shy:

      ধনাত্নম হিংসে আর ভালো কিছু উপহার দেয়।
      এ আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি।

      ভাল থাকিস প্রিয়।


      সৈয়দ সাফী

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।