আমার শহীদ কাদরী

“সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো। ঘর-ফেরা রঙিন সন্ধ্যার ভীড়ে
যারা তন্দ্রালস দিগ্বিদিক ছুটলো, চৌদিকে
ঝাঁকে ঝাঁকে লাল আরশোলার মত যেন বা মড়কে
শহর উজাড় হবে, – বলে গেল কেউ – শহরের
পরিচিত ঘণ্টা নেড়ে খুব ঠাণ্ডা এক ভয়াল গলায়
এবং হঠাৎ
সুগোল তিমির মতো আকাশের পেটে
বিদ্ধ হলো বিদ্যুতের উড়ন্ত বল্লম!”

‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’ কবিতাটি প্রথম কখন পড়ি মনে নেই, হয়তো ২০/২১ বয়স হবে। পড়তে পড়তে আরো বছর কয়েক পিছিয়ে পৌঁছে গিয়েছি ক্লাস থ্রি কি ফোরের ক্লাসরুমে — যখন ভয়ার্ত চোখে আকাশে চিরে যাওয়া দেখতে না দেখতেই সম্পূর্ণ বধির করে দিয়ে ক্বড় ক্বড়ড় ক্বড়াৎ নেমে পড়েছে বাজ, টিনের চালে নেমে এসেছে একঝাঁক প্যারাট্রুপার। ‘সহসা সন্ত্রাস’ ছোঁবার শিহরণ কেবল কলোনীর অন্ধকারে ঠাস ঠাস গুলির শব্দে আটকে থাকেনি। আমি শহীদ কাদরীর প্রেমে পড়ে গেলাম। আরো লেখেননি কেন, কোথায় ডুব মেরেছেন আমার এমন উঠতি যৌবনে, যখন কিছু উদ্দাম, ‘উদ্যত লাফ’ কবিতা আমার চাই চাই-ই!
মনে পড়ে আন্দরকিল্লা, নিউমার্কেট, জলসা সিনেমার নীচে বইয়ের দোকানে আঁতিপাতি করে খুঁজেছি শহীদ কাদরীর একটি তরতাজা লেখা — যদি মিলে যায়! বদলে পেয়েছি কবির স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়ে গালগল্প, কিছু সাক্ষাৎকার, হয়তোবা কিছু আলোচনা। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। মুগ্ধ পাঠকের অভিমানের বুঝি কোন মূল্য নেই। শহীদ কাদরীকে আমি তখন বাধ্য হয়ে ওই তিন গ্রন্থের কাব্যসংগ্রহে বেঁধে নিয়েছি।
আরো কিছুটা সময় পরে যখন টিউশনি করে এক হেঁটে ফিরছি শ্রান্ত দেহে, গায়ে জুন মাসের ঘাম — মন যদিও নতুন শব্দে, নতুন কোন ছবিতে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের সোডিয়াম বাতির মতই উজ্জ্বল, চুলে কর্ণফুলীর এলো হাওয়া — তবু ঝনৎকারের মত বারবার বেজে চলেছে —

“টাকাগুলো কবে পাবো? সামনের শীতে?
আসন্ন গ্রীস্মে নয়?
তবে আর কবে! বৈশাখের ঝড়ের মতো
বিরূপ বাতাসে ঝরে পড়ছে অঝোরে
মণি মাণিক্যের মতো মূল্যবান চুলগুলো আমার এদিকে-
ওদিকে! এখনই মনি-অর্ডার না যদি পাঠাও হে সময়,”

আর সুমন চট্টোপাধ্যায় যখন গাইলেন — ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ — আমার একটুও ভালো লাগেনি। ঈর্ষায় আক্রান্ত হয়েছি। মনে হয়েছে অমন কবিতাকে সুরে ভারাক্রান্ত করতে নেই। ওটা তো নিজেই একটা সিম্ফনি।
তারপর বহু বছর পর — সময়ের সাথে সাথে অভিমান তো আর তেমন থাকেনি। বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে, সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে অন্য এক মহাদেশের ব্যস্ততম এক শহরে — মে মাসের এক সন্ধ্যায় একজন অগ্রজ কবি আমায় ফোন করেছেন, ‘নূপুর, আপনি কোথায়? শহীদ কাদরী বইমেলায় এসে পড়েছেন।’ আমি মিলনায়তন থেকে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে উড়তে উড়তে ভিড় ঠেলে কবির একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে টের পাই আমার সমস্ত অভিমান গলে গিয়ে হাডসন হয়ে ফেলে আসা সদ্যযৌবনের কর্ণফুলীতে গিয়ে পড়েছে। আমি শুধু ধরা গলায় বলতে পেরেছিলাম, ভালো আছেন?

জন্ম: ১৪ আগস্ট,১৯৪২
মৃত্যু: ২৮ আগস্ট,২০১৬

Shaid Quadri

৬,৬২৯ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “আমার শহীদ কাদরী”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    কবিতার পাঠক হতে পারলাম না। মাঝে মাঝে মনে হয় সে কারনে অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হচ্ছি


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভেবেছিলাম অন্তত সিসিবি র ব্যানারে শহীদ কাদরী আসবেন।
    ব্যানার এর ক্ষেত্রে সিসিবি পিছিয়ে থাকছে বা বলা যায় সময়ের সাথে চলছে না।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ধন্যবাদ দাদা। কবির চার নম্বর কবিতার বইটা কি পড়েছেন? আমি পড়িনি। ক্যামন তা জানতে চাচ্ছিলাম।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।