[প্রাক-কথন: ২০০৬ এ বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম ভারতের রাজস্থান প্রদেশটিতে। সেখানকার জয়সলমীর অঞ্চলটির নাম নিশ্চয়ই অনেকেরই জানা।
সত্যজিত রায় খ্যাত সোনার কেল্লা এখানেই অবস্থিত। তো জয়সলমীর থেকে প্রায় কুড়ি কি.মি. পশ্চিমে রয়েছে কূলধারা নামে একটি পরিত্যক্ত জনপদ। প্রায় দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে কেউ থাকেনা, অথচ এক-ইটের আনুমানিক পাঁচ হাজার ঘর দাঁড়িয়ে আছে মাথা তুলে। প্রচলিত ইতিহাস বলে,পঁচাশিটি গ্রাম জুড়ে এখানে বাস করতেন কৃষিজীবী ব্রাহ্মণদের একটি গোষ্ঠী।
একদিন স্হানীয় রাজকর-সংগ্রহকারীর নজরে পড়ে যায় গ্রাম-প্রধানের ছিপছিপে মেয়েটি। মেয়েটিকে সে বিয়ে করতে চায়, স্বাভাবিকভাবেই যা স্বাগত হয়না। এবার সে মেয়ের বাবাকে পনের দিনের সময় দেয় ভাববার জন্যে ; সময়সীমা শেষে মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার হুমকি দিয়ে ফিরে যায়। প্রবল আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন ব্রাহ্মণেরা মান হারাতে রাজী হননা, সাধারণ কৃষিজীবী হবার কারণে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথাও ভাবতে পারেননা কেউ। পরিবর্তে তাঁরা সবাই দল বেঁধে একরাতের মধ্যে সমস্ত জনপদ শূন্য করে পাড়ি জমান অজানার উদ্যেশ্যে। সেই থেকে,বলা হয়, সেই অভিশাপে আজ অব্দি কেউ সেখানে আস্তানা গাড়তে পারেনি।
এখন সেখানে গেলে নজরে পড়বে সারি সারি চালাবিহীন ঘর, কুয়া, সূর্যমন্দির (জনপদের একমাত্র দ্বিতল ভবন।যেখানে কোন বিগ্রহ নেই, দেয়ালে উৎকীর্ণ সকল দেব-দেবীর চেহারা বিনষ্ট করা হয়েছে, যেন বা আক্রোশের বশবর্তী হয়েই), তখনকার ব্যবহৃত একটি গরুর গাড়ি আর মেঠো জমিতে জালিকার মতো অসংখ্য গর্ত যা ইঁদুরের সদর্প বিচরণের প্রমাণ বহন করে; আর যেসব ঘর খানিকটা মেরামত করে রাখা হয়েছে পর্যটকদের দেখবার জন্যে, সেখানটায় প্রবেশ করতে গেলেই শুনতে পাওয়া যাবে অজস্র চামচিকের ডানা ঝাপটানো।]
ধূলো উড়িয়ে আমাদের জীপ
বিরান সেই গাঁয়ে গিয়ে
যখন দাঁড়ালো
তখন গনগনে দুপুর
তখন চালাবিহীন দেয়ালগুলো
মুখব্যাদান জানলা নিয়ে
উলংগ দাঁড়িয়ে
গলিপথের দু’পাশে
থমকে আছে হাওয়া
ইটের ভাঁজে ভাঁজে
এতক্ষণ চলতে থাকা ফিসফিসানি বন্ধ।
এখন শুধু এ ওর মুখে চাওয়া।।
ইটের খাঁজে আটকে আছে অশ্রু
উল্টে আছে মেঝের পরে ঘড়া
জল গড়ায় দেড়শো বছর ধরে।
মুচড়ে আসে গাঁয়ের রুখু বুক
অভিমানে গুমরে ওঠে একটি ধ্বনি শুধু্ঃ
আকাশ আর পাথর ছেনে গড়া
সুয্যিদেব আজ এতই কেন মূক!
মূকদেবতার পাথর-পায়ে
শিরের সঞ্চালনা
আঠালো আর তপ্ত শোণিত
দগদগে আল্পনা।
তবে কি নামেই রাজা ন্যায়ের ধ্বজাধারী?
রাজবাক্য পাল্লামাপে পাষাণ অধিক ভারী?
দর্প এসে
লাফায় তখন
ধূলো ওড়ায়
তর্জনীতে শাসায়,
তখন ভরদুপুরে
সমস্ত গাঁ
নিদান শোনে
মরণপারের ভাষায়।
শেষদুপুরে ঠিক তখুনি
ধুলোর আড়াল থেকে
আমরা ভেসে দেখি,
এ কি,
সমস্ত গ্রাম ভোজবাজিতে
মিলেয়ে গেছে, কেবল….
কেবল
তখনো
ইটের ভাঁজে
জানলা-পাশে
কড়ি-বরগা ধরে
রক্তমাখা
ধুলোমলিন
চোখের জলের ডেলা
লটকে আছে
ভীষণ জেদে,
ঝরবেনা
এই বেলা।
সেই ডেলাতে
ফুটছে দ্যাখো —–
ভাঙা বাসন
মাটির গেলাস
শুকিয়ে যাওয়া ফুল
চুলের কাঁটা
কাঁচের চুড়ি
দীঘল কালো চুল।
কালো চুলের কালো নদী
মেয়েটি তখন শুয়ে
নোন্তা চোখে প্রেমিক মাথা
একটুখানি নুয়েঃ
“কক্ষণো যাবোনা তোকে ছেড়ে
যতই আসুক রাজার ঘোড়া তেড়ে
ঠিক লুকিয়ে ফেলবো তোকে দেখে নিস
তুই তো আমাকেই স্বামী জেনেছিস?”
শিরশিরিয়ে কেঁপে ওঠে কাঁটাঝোপের ছায়া
ভরদুপুরে ঠা ঠা হাসে নিয়তি আর মায়া
ওরা জানে রাজার চোখে লোভের কালো জাল
ওরা জানে জালের ঘেরে থমকে যাবে কাল।
আমরা তখন
ঘোরের ভেতর
সিঁড়ি ঘুরে ঘুরে
মন্দিরে উঠছি
জুতো পায়ে’
বিগ্রহ নেই,
ভক্তি বিনেই
একনাগাড়ে ফুঁসছিঃ
“রাজার তেজে সুয্যি লুকোয়
কেমন ধারা দেব?
মাথা কুটে কাঁদন যত
মিথ্যে অতএব!”
ভীষণ কালো
ভীষণ তেজী
আসে রাজার ঘোড়া
পা দাপিয়ে
দর্প বাজায়
সমস্ত গ্রাম জোড়া।
শুনছো সবাই বহুদিনের
প্রাচীন অভ্যেসে
নতমুখে ওষ্ঠ চেপে
আমি, তোমরা, সে…..
বেসামাল অশ্ব রাজার
ফিরে গেলে
অপ্রস্তুত সূর্য
পালিয়েছে
দিগন্তের আড়ালে…..
আপনমনে সবাই তখন
শুরু বাধাছাঁদা
আপনমনে প্রত্যেকেই
নিজের সনে কথা
ইটগুলো সব গাঁয়ের পাঁজর
ইটগুলো সব ভাই
ইটগুলো সব ঠায় দাঁড়িয়ে
চোখ মোছে সব্বাই
একটু একটু করে গরুর গাড়ি ভরে ওঠে
কঁকিয়ে ওঠে অনিচ্ছুক চাকা
একেএকে সবাই বেরিয়ে আসে
সবগুলো ঘর খাঁ খাঁ
গাঁওপ্রধানের পাথর হয়ে থাকা
অশ্রুকণা থেকে’
পাকিয়ে ওঠে দীর্ঘশ্বাসের ঢেউ,
কত তারা ফুটেছে দ্যাখো
আজ আকাশ পথ দেখাবে
সূর্যকে প্রণতি দেবেনা কেউ
চোখে পড়ে
মেয়েটি সেঁটে আছে ছেলেটির বুকে,
প্রশ্রয়ে প্রশান্ত হয়ে আসে মন
আ হা, কত গণ্জ্ঞনা দিয়েছেন
ভালোবাসায় ফুটতে থাকা
কাঁটাঝোপের দুটি ফুলকে।
আজ ভালোবাসুক না প্রাণভরে
আজ মাতুক দুটিতে
করে যদি করুক না
আলিঙ্গন ভুলকে!
আমরা যখন
গাঁয়ের গলিপথে হাঁটছি
কেউ বজ্রাহত চৌকাঠে
কেউ উঁকি দিচ্ছি কুয়োয়
ফিরে যাবার তাড়া যখন
টিকটিক বাজছে আমাদের ঘড়িতে
তখন ফেলে যাওয়া ঘড়া
গড়াতে থাকা জল
নতুন শিশুর কান্না-কাঁথাকানি
ভালোবাসা-মুগ্ধ চোখ
অনিচ্ছুক গরুর গাড়ির চাকা
শেষমুহূর্তে কুয়োয় ঝাঁপিয়ে পড়ে
আত্মাহুতি দিয়েছিলো যে বালতি
সবকিছু, সমস্ত ফেলে যাওয়া স্মৃতি
মেঠো ইঁদুর হয়ে গর্তের জালিকা বানিয়ে
মাটির ভেতরে ভেতরে,
পিছুপিছু চলে ফেরা
অতৃপ্ত সাপ হয়ে
উল্টো ঝুলতে থাকা চামচিকে হয়ে,
সকলে ওরা অধীর প্রতীক্ষা করে আছে
সূর্যটি কখন ডুবে যাবে
আর আকাশে ফুটে উঠবে
লক্ষ লক্ষ লক্ষ লক্ষ লক্ষ কোটি তারা
সেদিন যখন ওরা
সক্কলে মিলে গাঁ ছেড়ে
আকাশে উঠে গিয়ে
হয়ে গেল আরো পঞ্চাশ হাজার তারা
সেইদিন থেকে
আকাশের সেইপথ বেয়ে
সকলের সমবেত দৃষ্টি চলে যায়ঃ
সন্ধ্যের পর যখন রাত্রি নামে প্রতিদিন,
প্রতিদিন অস্থির ফিসফিসানি শেষে
ধুলোওড়ানো ট্যুরিস্ট আর
সূর্যাক্রান্ত অভিশপ্ত দিন শেষে
পিলপিল করে ওরা আকাশের তলায়
এসে জড়ো হয় –
দেড়শো বছরের অশ্রু চোখে নিয়ে,
যে পথে গিয়েছে
পঞ্চাশ হাজার তারা
সেই পথ চেয়ে
সমস্ত রাত জেগে রয়।
:dreamy:
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
আপনি ভাই পুরা গুরু... :salute: :salute: :salute:
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
পড়তে পড়তে যতো নিচে নেমেছি মুগ্ধতা ততো বেড়েছে।
নূপুর ভাই, এতোদিন কোথায় ছিলেন?
---------------------------------------------------------------------------
বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
:dreamy: :dreamy: ~x( ~x(
দারুন লাগলো লেখাটা। :clap: :boss:
নূপুর ভাই এইটা কি দিলেন। আহা বলিহারি যাই... ঘুমুতে যাবার আগে জটিল একটা ভালোলাগা পেয়ে বসলো। এইরকম আরো নিয়মিত চাই।
এহসান ভাইতো ভালো কবিতা লেখেন 😀
মেয়েদের জন্য কত কিছু হয়, রাজ্য তৈরী হয়, নষ্ট হয়, গ্রাম বিরান হয়, তবু তারা বলে তারা বঞ্চিত।
এই যে নূপুর ভাই, কবিতা লেখে, অনু-কাব্য লেখে, গুনুক তো, কয়টা ছেলেকে নিয়ে, আর কয়টা মেয়েকে নিয়ে?
পুরুষ-দিবস একটা বানাইতে হবে,
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ঐ.. 😀
ঐ.. :(( :((
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
ঐ :grr:
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
একরাশ ভালোলাগা মাখা একটা কবিতা উপহার দেয়ার জন্য নূপুর ভাইকে :salute:
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
:boss: :boss:
সুন্দর কবিতা :hatsoff:
অ(তি)সাধারণ :hatsoff: 🙁
ভাই আপনি পুরা বস :boss: :boss:
নূপুর ভাই পুরা বস্! :boss: :boss:
আজ থেকে আমি উনার পাঙ্খা!