ব্যক্তিগত রেসিপি-৬

আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই, রাতভর ঝরে ঝরে ঢাকাশহরে প্লাবন নিয়ে আসবে বুঝি।
অনেক রাত হলো, একটুও ঘুম আসছেনা।
হুস করে একটা ট্রাক চলে গেলে পুরো মহল্লাটা পাশ ফিরে শুলো।

বাইরে রাস্তায় টিমটিম করে জ্বলতে থাকা ল্যাম্পপোস্টের বাতিটা কোনরকমে একফোঁটা আলো এনে ফেলেছে আমার বিছানার উল্টোদিকের দেয়ালটাতে।
সেখানে ঝুলছে পৃ-র দেয়া মুখোশটা, পহেলা বৈশাখে মেলা থেকে কিনে দেয়া।
হা করে মস্ত একটা নির্ঘুমতা নিয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকে একেকটা রাত, কিছুতেই এড়াতে পারিনা।
মুখোশের চোখের দিকে তাকিয়ে গা শিরশির করে ওঠে, অনুযোগে চোবানো পৃ-র দৃষ্টি মশারীর জাল পিছলে সরে যায়।

নাহ্‌! আর থাকতে না পেরে লাইট জ্বালিয়ে দিতেই পুরো রুম অলীক আলোয় ভেসে গেলো।
মুখোশটার দিকে তাকিয়ে নিজেকে কি ভীষণ বোকা মনে হয়।
আজ সারাদিন গুমোট গরমের ফাঁকে এই বর্ষণটুকু আমাকে একটু স্বস্তির মুখ দেখায়।
কতদিন পৃ-কে সামনাসামনি দেখিনা এ দুঃখটুকু ভুলবার একটা মিথ্যে অজুহাত হিসেবে বৃষ্টিকে দেখার চেষ্টা করি।

হঠাৎ-ই ফোন বেজে ওঠে, অজানা নাম্বার।

হ্যালো!
হ্যালো, কি করছিস?
পৃ!
হুঁ।
কি হলো,ক্লাসে মন লাগছেনা বুঝি?
ক্লাস? এ্তরাতে ঢাকায় কোন ক্লাস হয় বোকা!
ঢাকায়? মানে?
আমি এয়ারপোর্টে।মাত্র পৌঁছুলাম।নিয়ে যা।
উ-উ-উ-উ-উ……

উড়তে উড়তে
পৃ-কে নিয়ে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ভোর।লম্বা প্লেনসফর করে বেচারা একদম কাহিল।
কোনরকম জানান না দিয়ে কেন যে এলো তা আর জিজ্ঞেস করা হয়না, করেই বা কি লাভ!
শুধু ওর ক্লান্ত মুখখানা ফিরে ফিরে দেখি আর আঙুল নিয়ে খেলা করতে করতে বাড়ি ফিরে আসি।
ঘরে এসে দরজা বন্ধ করেছি কি করিনি,
পৃ আমাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকে।
ওর বিষণ্ণ স্পর্শগুলো একটু একটু করে সতেজ হতে হতে ডালপালা মেলে দ্যায়।
পৃ-র চুলে বিলি কেটে শুধাই, সোনা একটা ড্রিংক বানাই?
ঘাড় হেলিয়ে হুঁ জানালেও আরো আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। আচ্ছা বিপদ!

বাড়িতে কিছুই নেই বলতে গেলে।তবু পৃ এসেছে বলে কথা।
ওকে চটপট ফ্রেশ হতে বলে কাজে নেমে পড়লাম।
ফ্রিজ খুলে দেখি একটা আধখানা তরমুজ পড়ে রয়েছে, তাই সই!

১।তরমুজের জুস : ১ গ্লাস।
২।৫ পেগ Bacardi white rum।
৩।লেবুরস : ১/২ গ্লাস।
৪।গোটা বিশেক পুদিনা পাতা।
৫।চিনি : ৪ চা চামচ।
৬।আইসকিউব: আন্দাজমতো।
৭।লেবু স্লাইস: ২টা।

প্রথমে পুদিনা পাতা, চিনি আর ১/৪ গ্লাস লেবুরস নিয়ে ব্লেন্ড করে নিলাম; তারপর আইসকিউব ঢেলে
তরমুজ জুস, rum আর বাকী লেবুরস যোগ করে আচ্ছা করে ঝাঁকিয়ে নিয়ে দুটো গ্লাসে ছেঁকে নিলাম।
গ্লাসের কিনারায় একটা লেবু স্লাইস আর একজোড়া পুদিনা পাতা গুঁজে
পৃকে ডাকতে যাবো দেখি ও আমার পেছনেই কখন এসে দাঁড়িয়ে আছে।

পেছন থেকে জড়ি্যে ধরে বিড়বিড় করে চললো

সে কোন বাটিতে কও দিয়াছিলা এমন চুমুক
নীল হয়া গেছে ঠোঁট, হাত পাও শরীল অবশ
অথচ চাওনা তুমি এই ব্যাধি কখনো সারুক
আমার জানতে সাধ ছিলো কোন পাতার সে রস।
সে পাতা পানের পাতা মানুষের হিয়ার আকার
নাকি সে আমের পাতা বড় কচি ঠোঁটের মতন
অথবা বটের পাতা অবিকল মুখের গড়ন
তুঁতের পাতা কি তয়, বিষনিম নাকি ধুতুরার?
কতবার গেছি আমি গেরামের শেষ সীমানায়
আদারবাদাড় দিয়া অতিঘোর গহীন ভিতরে
কত না গাছের পাতা কতবার দিয়াছি জিহবায়
এমন তো পড়েনাই পানি এই পরাণে, শিকড়ে

আমাদের না ফুরনো গ্লাসদুটো অতঃপর
রাতভর বৃষ্টির ভেতর পরষ্পরকে পৌনপুনিক বলে যেতে থাকলো

তয় কি অচিন বৃক্ষ তুমি সেই ভুবনে আমার
আমারে দিয়াছো ব্যাধি, নিরাময় অসম্ভব যার

কবিতা: সৈয়দ শামসুল হক।

____________________________________________________________

কবিতার উদ্ধৃতিতে (বানান, যতিচিহ্ন সমেত) ভুল রয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা।শুধরে দেবার আমন্ত্রণ রইলো পানীয়ে চুমুক দেবার অবসরে।

২,৯৯৮ বার দেখা হয়েছে

৩৬ টি মন্তব্য : “ব্যক্তিগত রেসিপি-৬”

  1. রুম্মান (১৯৯৩-৯৯)

    :hatsoff: দাদা । আপনার ডাক্তারীর ডিসিশনটা আসলেই ভুল ছিল ।


    আমার কি সমস্ত কিছুই হলো ভুল
    ভুল কথা, ভুল সম্মোধন
    ভুল পথ, ভুল বাড়ি, ভুল ঘোরাফেরা
    সারাটা জীবন ভুল চিঠি লেখা হলো শুধু,
    ভুল দরজায় হলো ব্যর্থ করাঘাত
    আমার কেবল হলো সমস্ত জীবন শুধু ভুল বই পড়া ।

    জবাব দিন
  2. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    কোথায় জানি পড়েছিলাম - কবিরা যখন গদ্য লেখে তখন তা রিনিঝিনি সুরে বাজতে থাকে। আপনার এই লেখাটা পড়ে আমার তাই মনে হলো। সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে 'হা করে মস্ত একটা নির্ঘুমতা নিয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকে একেকটা রাত, কিছুতেই এড়াতে পারিনা।' - এই লাইনটা।

    আপনাকে বাংলা ছবির রোমান্টিক দৃশ্য চিত্রায়নের উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেওয়া উচিত। শিল্প হবে, অশ্লিলতা হবে না। দর্শকও খুশি মনে বাড়ি ফিরবে।

    আগের জামানার চেকভও ডাক্তার ছিলেন, এই জামানায় কাইট রানারের খালেদ হোসাইনও ডাক্তার। সুতরাং ডাক্তারীর দোহাই দিয়ে লেখা বন্ধ করতে পারবেন না।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  3. আন্দালিব (৯৬-০২)

    লেখাটা অসম্ভব অসম্ভব ভালো লাগলো, নূপুর'দা!
    আর কী কাব্যিকতা, আমি রীতিমত মুগ্ধ।
    যেমন-

    হুস করে একটা ট্রাক চলে গেলে পুরো মহল্লাটা পাশ ফিরে শুলো।

    কিংবা,

    হা করে মস্ত একটা নির্ঘুমতা নিয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকে একেকটা রাত

    অথবা,

    আমাদের না ফুরনো গ্লাসদুটো অতঃপর

    দুর্দান্ত সব লাইন! :boss: :boss: :boss:

    জবাব দিন
  4. ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

    নুপুর দা।
    আপনার হাতে বানানো তরমুজ এর জুস না খেয়ে পারলাম না।
    আপাততঃ মনে মনে - দেখা হলে না হয় পাওনাটুকু বুঝ নিব।

    কবিতাটাও - আমার মহাপছন্দ - সব মিলিয়ে সুপার ডুপার হিট।

    আপনার তুলনা - আপনিই।
    :boss:


    সৈয়দ সাফী

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফয়েজ (৮৭-৯৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।