কিন্নরকণ্ঠী নদী – ১৪

(পিলখানার শহীদদের স্মরণে আমার প্রথম উপন্যাসের এই অধ্যায়টি এখানে দিলাম। পিলখানা বিষয়ক অনেক তথ্য আমি এখানকার ব্লগার সাইফের ব্লগ থেকে নিয়েছিলাম।)

চৌদ্দ

হিয়া ভেবেছিলো বয়স্ক কোন ড্রাইভার আর অফিসের পিয়নের সাথে বোধহয় তাকে বান্দর বনে যেতে হবে। কিন্তু হোটেল লাউঞ্জ থেকে ফোন পেয়ে ভোর ছয়টায় যখন নিচে নেমে এল তখন দেখল যে তার অপেক্ষায় অল্পবয়সী এক আর্মি অফিসার একটা জীপের মধ্যে বসে আছে।
-আমি ক্যাপ্টেন রেজওয়ান।
-আমি হিয়া।
-চিনতে পেরেছি।
-কিভাবে চিনলেন? আমাদের আগে কোথাও দেখা হয়েছে বলে তো মনে হয়না।
-ভাবির এ্যালবামে আপনার ছবি দেখেছি।
বান্দরবনের উদ্দেশ্য গাড়ি চলতে শুরু করল।
রেজওয়ান আবার কথা শুরু করল,
-আমি একজন ভদ্রলোক। তাই বোধহয় ভাবি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন আপনাকে ঠিকঠাক মতো ওনার জিম্মায় পৌছে দেওয়ার জন্য।
-চিন্তা করবেন না। সময়মতো পৌছে দিলে আপনার গুড উইল আগের মতোই অক্ষুন্ন থাকবে।
-ভাবি কিন্তু আমাকে একটু সাবধান করে দিয়েছেন।
-আমার ব্যাপারে তো? আমি খুব জেরা করি। তাই বলেছে নিশ্চয়?
-এতে অবশ্য আপনার সহযাত্রী হতে পারার আগ্রহ কয়েকগুন বেড়ে গেছে।
-বাদী না বিবাদী – কোন পক্ষ সেটা জানলে সেই অনুযায়ী জেরা শুরু করতে পারতাম?
হিয়ার কথা শুনে রেজওয়ান একটা প্রাণ খোলা হাসি দিল। হাসি থামিয়ে বলল,
-মনে হচ্ছে আপনার সাথে ভ্রমনের এই সময়টুকু বেশ উপভোগ্য হবে।
রসবোধ, স্মার্টনেস সেই সাথে এক ধরনের সরলতা সব মিলিয়ে রেজওয়ানকে চারদিকের অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে যাত্রা পথের সহযাত্রী হিসেবে পেয়ে হিয়ারও বেশ লাগছিলো। কিন্তু স্মার্টলি সেটা সে বলতে পারবে না। অবশ্য গাড়িতে উঠলেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। আপন মনে হিয়া তাই বাইরে তাকিয়ে থাকলো।
রেজওয়ান খেয়াল করে দেখলো হিয়ার বিভোর হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকা। বলল,
-আমাদের দেশটা কত সুন্দর সেটা বোঝার জন্য হিলট্রাকসে আসা দরকার। এখানকার পর্যটন শিল্পের প্রচার হলে লোকজন বেশি পয়সা খরচ করে অন্য কোথাও যাওয়ার আগে তাহলে এখানে একবার ঘুরে যেত। আপনার কোথায় থামতে ইচ্ছে হলে বলবেন। আজকে আমি শুধু আপনার ড্রাইভারের দায়িত্বই পালন করছি না সেই সাথে টুরিস্ট গাইডও।
-আসলেও অদ্ভুত সুন্দর! এর আগে শুধু ছবিতেই এতো সুন্দর দৃশ্য দেখেছি। তাও আবার অন্য দেশের। আমাদের দেশের এই অপার সৌন্দর্য কেন যে সবার কাছে পৌছে দেওয়া হয় না কে জানে। নিরাপত্তার কারণে বোধহয়।
-নিরাপত্তার জন্য তো আমরা আমাদের জীবন উৎসর্গ করছি। শুধু বান্দরবনেই যদি ধরেন এখানে অনেক টুরিস্ট স্পট আছে। এখানকার রুমা উপজেলায় একটা লেক আছে। নামটা একটু হাস্যকর – বগা লেক। সমুদ্রপৃষ্ট অনেক উঁচুতে। পাশের পাহাড় থেকে এই লেকের পুরোটা দেখা যায়। পানির রং গাঢ় নীল। আবার নীলগিরি নামে একটা জায়গা আছে। সেখানকার সৌন্দর্য বর্ণনায় প্রকাশ করা যাবে না। সেখানে গেলে মনে হবে হঠাৎ যেন কোন স্বপ্নপুরীতে চলে এসেছি। পাহারের নিচে তাকালে সাদা সাদা তুলোর মতো মেঘদের দেখা যাবে। হাত বাড়ালেই ঠান্ডা আর ভেজা মেঘ ছোঁয়া যায়।
হিয়া এতো কাছ থেকে আগে কখনও কোন সামরিক অফিসার দেখেনি। বুদ্ধিজীবিদের কলাম পড়ে আর্মিদের সম্পর্কে তার আর দশজনের মতোই সাধারণ মানুষের মতোই তার ধারণা আমাদের গরীব দেশে আর্মি পোষা মানে গরীবের হাতি পোষার মতো। আর্মি অফিসাররা মানুষ হিসেবে খুবই উন্নাসিক আর নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়ে থাকে। কিন্তু রেজওয়ানকে দেখে ধারণাটা বদলাতে শুরু করেছে। শুধু টাকার উপার্জনের কথা চিন্তা না করে নিজের দেশকে নিয়েও চিন্তা করে।
-এখানে আদিবাসিদেরা কেমন?
-বান্দরবনের আদিবাসিরা একটু রক্ষনশীল। ওরা নতুন লোকদের এখানে বসতি গড়াটা অতো পছন্দ করে না। তবে ঘুরতে তো কোন বাঁধা নেই। সব টুরিস্ট স্পটগুলোতে আর্মিরা শেলটার দেয়।
-কিছু মনে করবেন না, একবার মধুপুরের আদিবাসি চলেশ রিছিলের কথা শুনেছিলাম। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামেও নাকি আর্মিরা আদিবাসিদের উপর খুব অত্যাচার করে?
-আপনি যে প্রশ্নটা করেছেন তাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। অনেকেই এসব প্রশ্নের আসল উত্তর না খুঁজে তাদের মন গড়া চিন্তাভাবনা সব জায়গায় প্রচার করে বেড়ায়। পৃথিবী থেকে সীমান্েতর ধারণাটা যদি উঠে যেত তাহলে কিন্তু আর আর্মিদের দরকার পরতোা না। ’দেশ’ নামক আইডিয়ার জন্যই কিন্তু আর্মির অস্তিত্ব। আর্মিরা কিন্তু শুধু দেশের পলিশি ইমপ্লিমেন্ট করে। কাপ্তাই বাঁধ করে লাখ লাখ আদিবাসিকে কি আর্মিরা সরিয়ে দিয়েছে? নিরপেক্ষ বিচারে সব সমগোত্রীয় মানুষদের নিয়ে এক একটা করে দেশ হওয়া উচিত। সেটা না মানলে এসব নিয়ে কোন কথা বলা উচিত না। আর্মিদের যত দোষ সেটা আসলে ’দেশ’ কনসেÌেটর কারণে।
-আগে যদিও এভাবে ভেবে দেখিনি তবে এখন মনে হচ্ছে আপনার কথার মধ্যে অনেক যুক্তি আছে। একটা উপন্যাস পড়েছিলাম, নামটা ’অল কোয়াইট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। সেখানে লেখক খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে কিভাবে হঠাৎ করেই একটা দেশের রাষ্ট্র নায়ক ঠিক করল যুদ্ধ করবে, আর অমনি দুদেশের হাজার হাজার তরুন একে অপরের শত্রু হয়ে গেল। জার্মানীর এক সৈন্য তার সম্পূর্ণ অপরিচিত ফ্রান্সের এক সৈন্যকে হাতের কাছে পেয়ে বিভৎসভাবে খুন করার খেলায় মেতে উঠল। তবে এটা কি মনে করেন না আমাদের গরীব দেশের জন্য আর্মি খুব দামী একটা কমোডিটি?
-হ্যাঁ, দেশের টাকায় আমাদের পোষাক আর অস্ত্র কেনা হচ্ছে, ফ্রী বাসা বা মেসে থাকতে পারি, মোটা চালের রেশন পাই। কিছু সুবিধা কি অন্যান্য সরকারী অফিসাররাও পাচ্ছে না? একমাত্র আর্মিতেই দূর্নীতি করে ধরা পরলে সাথে সাথে চাকরি চলে যায়। বাংলাদেশে এক লক্ষ আর্মির মধ্যে দূর্নীতিবাজের সংখ্যা দুই ডিজিটের কোঠা পেরুবে কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। সেখানে অন্যান্য সরকারী বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা কেমন? সেসব জায়গায় দূর্নীতির জন্য কয়জনের চাকরি চলে যায়? হ্যাঁ, মিশনে গেলে আমরা কিছু টাকা করতে পারি। কিন্তু সেই মিশনের জীবন আরামের কিছু না। যে কোন মুহূর্তে মৃত্যু ঘটতে পারে। তারপরও পরিবারের স্বচ্ছলতার জন্য মিশনে যাই। দেশের জন্য সুনাম আর রেমিটেনস দুটোই নিয়ে আসি। দামী কমোডিটি, শো পিস কত নামেই আর্মিদের ডাকা হয়। কিন্তু এই কমোডিটিই দেশের প্রয়োজনে যে কোন কাজ করতে প্রস্তুত। আমাদেরকে দিয়ে হাল চাষ, গবাদি পালন, সব্জী চাষ, ত্রান বিতরন, দেশকে সংঘাতের হাত থেকে রক্ষা করা,দোকানদারী, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রন, পানি বিতরন, উদ্ধার অভিযান, বন্যা, খরা, সিডর, গার্মেন্টস এ আগুন নিভানো, আইন শৃঙ্গখলা রক্ষা করা এই রকম আরো কত কি হবে -তারপরও সবাই বলবে আর্মি জনগণের টাকায় ফুলে ফেঁপে উঠছে।
-আসলে আপনাকে কষ্ট দেবার জন্য এই সব কথা বলছি না। আমাদের মতো সাধারণ জনগণ পেপারে বুদ্ধিজীবিদের কলাম পড়ে আর্মি সম্পর্কে একটু আধটু ধারণা পাই। আর্মি আর সিভিল সোসাইটির মধ্যে এতোটা দ্বন্ধ জিইয়ে রাখা হয় কেন সেটা বুঝতে পারি না।
-আমরা তো এই দেশেরই সিভিল সমাজের সন্তান এটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। তাই যখন মানবাধিকারের কথা বলা হয় তখন আমাদেরকে এর বাইরে রাখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন একজন ছাত্রীকে কোন এক ক্যাডার লাঞ্চিত করে তখন বুদ্ধিজীবিরা কোন শোরগোল করেন না। তাদের শোরগোল শোনা যাবে যখন একজন সৈনিকের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্রের গন্ডগোল হয়। সিভিলিয়ানদের সাথে ব্যবহারের ব্যাপারে আর্মি আইন খুবই কঠিন। ঐ সৈনিকের চাকরী সাথে সাথেই চলে যায়। অথচ তার উপর কি না পরিবারের আর দশজন মানুষ নির্ভর করছিলো। আর বুদ্ধিজীবিদের কথা বলছেন, খোঁজ নিয়ে দেখেন এরা অনেকেই বয়স থাকা সত্ত্বেও একাত্তুরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেনি। অথচ তখন বাঙ্গালি সব আর্মি নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যারাক থেকে বের হয়ে এসেছিলো। গণতন্ত্র সংহত রাখার কথা চিন্তা করলে তখনও তো আর্মিদের সেই ঝুঁকি নেওয়াটা যুক্তিযুক্ত ছিল না। বাংলাদেশে আর্মির ইতিহাস একেবারেই অন্যরকম। আর একটা কথা আপনাকে বলে রাখছি নতুন প্রজন্মের আর্মিরা কিন্তু অনেক বেশি মাত্রায় দেশপ্রেমিক। পাকিস্থানফেরত বা মুক্তিযোদ্ধা আর্মি এই বিরোধটা না থাকাতে তারা অনেক বেশি একাত্ম।
-আসলে আপনার কথা শুনে আর্মিদের ব্যাপারে অন্যরকম ধারণা হচ্ছে। অনেক শ্রদ্ধাবোধ জাগছে।
-কী যে কষ্ট করি তা বলে বোঝাতে পারবো না। ভোটার তালিকা করার সময় রাত নেই, দিন নেই নিজেদের পকেট থেকে মোবাইল ফোনের বিল দিয়ে কাজ করে গেছি। সে সময় ছোট বোনটার বিয়ে হলো, একদিনের জন্যও ছুটি যোগার করে যেতে পারলাম না। প্রমোশন পেয়ে কোনদিন উঁচু পদে যেতে পারবো সেই স্বপ্নও আর দেখি না। তারপরও আমরা চোখ-কান বন্ধ করে কাজ করে যাই শুধুমাত্র দেশের প্রতি আমাদের অকৃত্রিম ভালবাসা আর প্যাশনের কারণে। নয় বছর ধরে আর্মিতে আছি। বেতন সর্বসাকুল্যে চৌদ্দ হাজার টাকা। ভাইবোন, বাবা কারো কোন প্রয়োজনে কাউকে কোন অর্থ সাহায্য করতে পারিনা। তারা সেটা মেনে নিয়েছে বলেছে টাকাই সব না, সন্মানের সাথে চাকরী করাটাও একটা বড় ব্যাপার। কিন্তু তারপরও যখন এই স্বাধীন দেশের মাটিতে পিলখানার মতো ট্রাজিক ঘটনা ঘটে তখন বাবা এই চাকরী ছেড়ে দিতে বলে। আমাদের সব মেধাবী, সৎ অফিসারদের যখন নিরস্ত্র অবস্থায় কুকুরের মতো মেরে সুয়ারেজ লাইনে ফেলে দিল, গণকবর দিল, স্ত্রী-সন্তানদের নির্যাতিত করল- তারপরও সব দোষ আমাদের? আমরা কি আসলেই এতোই খারাপ যে আমাদের লাশ ড্রেনে পরে থাকলেও আত্মীয় স্বজন ছাড়া আর কেউ একফোঁটা কষ্ট পায় না?
হিয়া দেখলো কথা বলতে বলতে রেজওয়ানের চোখটা ছলছল করে উঠল। হিয়ার নিজেরও খুব খারাপ লাগছে। সে বলল,
-আমি খুব দুঃখিত। আপনাকে এতোসব প্রশ্ন করা বোধহয় ঠিক হয়নি।
-আপনি যে কোন ভনিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছেন সেটা কিন্তু আমার খুব ভালো লেগেছে। মন খুলে কথা বলতে পেরে আজ নিজেকে খুব হালকা লাগছে। আসলে খুব ইমোশন্যাল হয়ে গিয়েছিলাম কারণ পিলখানা ট্র্যাজেডিতে আমার এক কাছের বন্ধু শহিদ হয়। তার লাশ আমাকে কাঁধে তুলতে হয়েছিল। মনের মধ্যে সেই স্মৃতি এখনও খুব জীবনত। এতো কষ্টের জীবনের পরে কী তার পরিনতি! মাঝে মধ্যে নিজেদেরকে টিস্যু পেপার বলে মনে হয়। যখন যার ইচ্ছা ব্যবহার করবে, তারপর ব্যবহার শেষে ছুড়ে ফেলে দেবে। থাক, এসব কথা। আমি তো আপনার এই সুন্দর ভ্রমনটা প্রায় মাটি করে দিলাম। যদি অনুমতি দেন তাহলে একটু পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো।
-কিভাবে?
-বান্দরবন সদরে যাওয়ার পথে একটা সুন্দর জায়গা পরবে। জায়গাটার নাম লামা। সেখানে একটা জায়গায় কিছুক্ষণ থামতে চাই।
-তা যাওয়া যেতে পারে।
এরপর ওদের দুজনের মধ্যে হালকা টুকটাক কথাবার্তা হলো। এই যেমন কার কি বই পছন্দ, কে কি সিনেমা পছন্দ করে কিম্বা অবসর সময়ে তারা কে কি করে -এই জাতীয়। সময়টা যে কখন খুব দ্রুত চলে গেল তা কেউই বুঝতে পারলো না।
এর কিছুক্ষণ পরেই ওরা লামাতে পৌছালো। শহরটা ছোট নীঁচু পাহাড়ের উপর অবস্থিত। পাহাড়ের বুকের উপর এখানকার রাস্তাঘাট তৈরী করা হয়েছে। তাই রাস্তার পাশ দিয়েই খাড়া নীচু ঢাল। তার এক পাশে গাড়ি পার্ক করে ওরা দুজন পর্যটকদের জন্যই বানানো একটা ট্যুরিস্ট স্পটে ঢুকলো। এলাকাটা পাহাড়ি, উঁচুনীচু। তাই কখনও সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হয়, কখনওবা নামতে হয়। কোন কোন জায়গায় ছাউনী ঘেরা বসার ব্যবস্থা রয়েছে। সেরকম একটা জায়গা থেকে দৃষ্টি প্রসারিত দিগন্তরেখা দেখা যায়। মাথার উপর থেকে দিগন্ত রেখা পর্যন্ত ছাউনী আকাশ আর তার নিচে সবুজ-সমারোহের হাজারো বিন্যাস। হিয়া গাছপালার নাম একটু কম জানে। পাতা দেখে বুঝতে পারছে চারপাশে হরেক রকম গাছপালায় ভরে আছে।
আবারো তারা চলতে শুরু করল। সেন্টি আপার বাসায় পৌছানোর সাথে সাথে আপা, দুলাভাই, দুই বাচ্চা বাসা থেকে বেড়িয়ে এল।
সেন্টি আপা জিজ্ঞেস করল,
-পথে আসতে কোন সমস্যা হয়নি তো?
পেছন থেকে রেজওয়ান বলে উঠল,
-বুঝতেই পারছেন এখন আমার সুখ্যাতি আর কুখ্যাতি যাই বলেন সেটা আপনার হাতে।
হিয়া সেদিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,
-চিন্তার কিছু নেই। জার্নিটা তো আসলেই সুন্দর ছিল। সেন্টি আপা তোমরা অসম্ভব সুন্দর জায়গায় থাক। আমি তো রীতিমতো মুগ্ধ।
-ভাবি আপনার বোনকে মুগ্ধ করার পুরষ্কারটা আমিই আগ বাড়িয়ে নিয়ে নিচ্ছি। আজকে রাতে আপনার এখানে ডিনার করতে আসছি।
-এই পুরষ্কার তো আপনার জন্য সব সময়ই উন্মুক্ত ছিল। এর আগে তো কখনও আগ বাড়িয়ে নিতে দেখিনি।
রেজওয়ানকে উদ্ধার করতে দুলাভাই এগিয়ে আসলেন,
-আহা সেন্টি, বেচারা এতোটা পথ গাড়ি চালিয়ে এল আর তুমি এর মধ্যেই চাপে ফেলে দিলে। মহিলারা কখনও পুরুষদের কষ্টটা বুঝে না।
সেন্টি আপা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল,
– আসেন একটু চা নাস্তা করবেন।
-ভাবি এখন না। রাতে আসবো।
রেজওয়ান চলে যাবার পর সেন্টি আপা হিয়াকে বলল,
-ভালই তো রেজওয়ানের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিস। এর আগে রাতের দাওয়াতটা ঝুলিয়ে রেখেছিলো। এখন তো দেখি আমি মনে করিয়ে দেবার আগেই সে মনে করিয়ে দিল। তা রেজওয়ানকে তোর কেমন লাগলো?
হিয়া কিছুর একটা আভাস বুঝতে পারছে। আম্মা, সেন্টি আপা মিলে মঞ্চের পিছনে কোথাও কোন নাটক রচনা করার খেলা খেলছে। নইলে আম্মাই বা কেন লাবণীদের সাথে এই ট্যুরটাতে আসার ব্যাপারে এতো উৎসাহ দিল, আর এখানে এসে দেখছে সেন্টি আপার ভূমিকা। হিয়া মনে মনে হাসলো, ধীরে ধীরে সবার সব ষড়যন্ত্রের জাল পরিষ্কার হয়ে পরছে।
একগুচ্ছ সাদাগোলাপ হাতে নিয়ে রেজওয়ান সন্ধ্যার দিকে এল। দুলাভাই রসিকতা করে বলল,
-ভাই যুদ্ধের দামামাই এখন বেজে উঠল না আর তুমি সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে এলে।
আসার পথে হিয়া রেজওয়ানকে বলেছিল যে কোন রংএর সাদা ফুল ওর খুব পছন্দ। রেজওয়ান সেটা মনে রেখেছে।
ডিনারের সময় খাওয়ার টেবিলে ভালোই জমে উঠল। দুলাভাই আর রেজওয়ান মাতিয়ে রাখলো। এর পরের রাতেও রেজওয়ান এল। তার পরের রাতেও।
দুইদিন পর ছুটির দিনে ওরা বগা লেকে ঘুরতে গেল। পাহাড়ের উপর থেকে বগা লেকের দৃশ্য দেখে হিয়া স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। সৌন্দর্য কী করে এরকম মাত্রাজ্ঞানহীন হয়! এ অপরূপ প্রাকৃতিক নিঃসর্গের সৌন্দর্য বর্ণনা করার ভাষা হিয়ার জানা নেই। ওরা সবাই পাহাড় ভেঙ্গে বগা লেকের ধারে এলো। এখানে নৌকা চড়ার ব্যবস্থা আছে। হিয়ার খুব ইচ্ছে করছিলো কিন্তু সেই সাথে একটু ভয় ভয়ও করছিলো। সে বলল,
-আমি তো সাঁতার পারি না।
রেজওয়ান কানের পাশ দিয়ে আস্তে করে বলল,
-ভয় নেই আমি পারি।
তারপর পরই হিয়া দেখতে পেল নাটকের দৃশ্যের মতো আশপাশ থেকে সবাই উধাও হয়ে যাচ্ছে। এর কিছুক্ষণ পরই হিয়া নিজেকে আবিষ্কার করল একটা ডিঙ্গি নৌকার উপরে। সেখানে শুধু রেজওয়ান আর তাকে নিয়ে বগা লেকের নীল পানির মধ্যে একটা নৌকাটা ভাসছে।

৪,৮৭৬ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “কিন্নরকণ্ঠী নদী – ১৪”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    বান্দরবান সত্যিই এক অপার সৌন্দর্যের যায়গা। তার আশেপাশে বিভিন্ন জায়গাগুলো এক একটা এমন সব নয়নাভিরাম দৃশ্যপট সাজিয়ে বসে আছে যে তা না জানা কেউ হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবে না ওটা বাংলাদেশ।
    এই সুন্দরের পাশাপাশি পিলখানার নরকগুলজার ঘটনাটা যা যারা জানে হজম করতে পারে না কিছুতেই। পুরো লেখাটা পড়লে বুঝবো সেই নির্মম সত্যটুকুন কতোটা উন্মোচিত হয়েছে লেখায়।
    এমন বিষয়টাকে এভাবে উপন্যাসের ভেতর নিয়ে আসার জন্য অগুন্তি অভিনন্দন ও ধন্যবাদ।
    লিংক থেকে পুরো লিখা পড়ে আবার মন্তব্য করবার ইচ্ছে উক্ত থাকলো।

    জবাব দিন
  2. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    আমার একটা ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা হলো, এই ঘটনা নিয়ে লিখা কোনো কিছুই আমি পড়তে পারি না।
    তোমার লিখা পড়তে খুব ভাল লাগে ঠিকই কিন্তু এইটা পড়া আমার ঐ সীমাবদ্ধতার জন্য সম্ভব হবে না।
    আমি দুঃখিত 🙁 🙁 🙁


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।