টুকিটাকি – ৪


আমাদের সময় এই সমস্যাটি অতো প্রকট আকারে ছিল না। এটি এই জেনারেশনের সমস্যা। তা হল ব্যক্তিগত সম্পর্কে ফেসবুক হানা দেওয়া। গত বছর শুনলাম আমার এক আত্মীয় বিয়ে করেছে। খুব ধুমধামে বিয়ে হল। ছেলে আর মেয়ে দুজনের বাবাই একসময় প্রভাবশালী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। ছেলেমেয়েরা সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। তাদের উপর তেমন অর্থনৈতিক চাপ নেই। বাবারাই ঢাকা শহরে ঘরবাড়ি করেছেন। সন্তান সংখ্যাও কম। চাকরীটা তাদের দরকার সামাজিক স্ট্যাটাসের জন্য। সেটাও তারা করছে। সবকিছুই মধুরেণ সমাপয়েৎ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হলো না। কয়েকমাস পর শুনলাম ছেলে আর মেয়ে আলাদা হয়ে গেছে। ছেলে বলছে মেয়ে রাগী। মেয়ে বলছে ছেলে রাগী। শুধু রাগী না খালি ফেসবুকে পড়ে থাকে। কয়েক হাজার ফলোয়ার। অফিস থেকে এসে মেয়ের সাথে কথা না বলে ফেসবুকে বসে পড়ে। এর ওর সাথে চ্যাট করে। ছেলে বলছে মেয়ে বাতিকগ্রস্থ। ইত্যাদি, ইত্যাদি। অতএব সম্পর্ক শেষ। এতো খরচের বিয়ে মাঠে মারা গেল!


নিউক্লিয়ার পরিবারগুলোতে সব পেয়ে বড় হওয়া সন্তানেরা কেন জানি তেমন একটা ভালো নেই। কেন নেই? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা দেখি সেটা হল ছেলেমেয়েরা আজকাল পণ্য হয়ে গেছে। বাবামায়ের সফলতার পরিমাপক হিসেবে তারা ব্যবহৃত হচ্ছে। সেবার দেশে গিয়ে দেখলাম আমার এক আত্মীয় সারাক্ষণ তার সন্তানরা লেখাপড়ায় কতো ভালো, কতো র্ধামিক এই নিয়ে খুব বড়াই করলেন। কিছুক্ষণ পরেই শুরু হল অমুকের সন্তানের বদনাম, তমুকের সন্তানের অপবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি। বাংলাদেশে আজকে যে একটা প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যে একে অন্যকে গালাগালি না করে থাকতে পারে না এর মূলে আমি মায়েদের ভূমিকাকে দায়ী করবো। মায়েদের একটা বিশাল অংশই আসলে নিজেদের হতাশবোধকে ভুলে থাকার জন্য অন্যের সমালোচনাকে বেছে নেন। এজন্য এই প্রজন্ম একাত্মবোধ শূণ্যতায় ভূগছে। চারপাশে এত্তো এত্তো সমালোচনা, এর মধ্যে সুস্থভাবে বাঁচা যায়? লেখাপড়ায় ভাল না করলেই জীবন শেষ! আরে বাবা সবাই যদি খালি এ প্লাস পায় তাহলে বি প্লাস, সি প্লাসের কাজগুলো কে করবে? আমাকে কেউ ভালো ছাত্রী হবার পরামর্শ দিতে আসলে আমি তাকে নাচ শেখাতে শুরু করবো। সে যদি বলে আমি কেন উদ্ভব নাচ শিখবো, উত্তরে আমিও বলবো আমি কেন ভালো ছাত্রী হবো?

অর্কেস্ট্রা জানে একটি সফল মিউজিক পরিচালনা করতে হলে কমবেশি সব রকম ইন্সট্রুমেন্টেরই দরকার হয়। একটা পাজল সমাধান করবেন তো দেখবেন যে একেক টুকরোও একেক রকম ছবি। সব টুকরোতেই যদি স্কুল ড্রেসের মতো একই রকম ছবি থাকতো তাহলে তো আর পূর্ণাংগ কোন দৃশ্য ফুটে উঠত না। যে অর্কেস্ট্রা বা প্রকৃতি এই পৃথিবী সাজিয়েছেন তিনি ভালো করেই জানেন যে এক একটি মানুষ জন্মে এক একটি ভিন্ন দায়িত্ব পালনের জন্য। এই পৃথিবীতে কেউ খালি হাতে আসে না। দুখের বিষয় এই পরম সত্যটি শুধু আমরাই জানি না।

৫,৪২৯ বার দেখা হয়েছে

২০ টি মন্তব্য : “টুকিটাকি – ৪”

  1. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    এবার একটা লিঙ্ক দিচ্ছি, টেকনোলজি আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলোর উপর কেমন প্রভাব ফেলছে, তার উপর একটা দারুণ বক্তব্য

    (সম্পাদিত)

    https://www.ted.com/talks/sherry_turkle_alone_together?language=en (সম্পাদিত)


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  2. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    আমাদের প্রথম হবার দৌড়, আমাদের জাগতিক প্রাপ্তির অদম্য ক্ষুধা। আহা যুদ্ধে প্রাণ বাঁচানো বা প্রাণ হরনের চেয়ে যেনো ভয়াবহ যুদ্ধে নামিয়ে দিতে মরনপণ, এই হলো জীবন।
    সেই দৃশ্যপটে প্রাপ্তি আর অর্জনের মিনার গড়তে হালে এন্ড্রয়েড প্রযুক্তি যোগ করেছে এক কল্পবাস্তবতার জগৎ। ওখানে বাস্তবতার গায়ে বেলুনের মতো কেবলি ফুকে উঠছে যেনো কল্পজরার ফুসকুড়ি।
    এ যাত্রাপথ আমাদের যে কোন গন্তব্যে নিয়ে পৌঁছাবে কে জানে !

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      খুব ভালো বলেছেন লুৎফুর ভাই। এতোসব কিছুর মাঝে কিভাবে মাথা ঠাণ্ডা করে যে একটি নির্দিষ্ট পথ বেছে নেবে সেটাই আসল গোলক ধাঁধা। আগের সময় যে খুব ভালো ছিল তাও তো বলা যায় না - অন্তত নারীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। তখন তো আমাদের জন্য সুযোগ কম ছিল। এই সময়ে অন্যের ব্যাপারে কম মনোযোগ দিয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখাটাই বড় কথা।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
  3. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    ১) নিজের সন্তান ভাল আর অন্যেরগুলা খারাপ, এটা বলার মাঝে অন্যকে সন্তান প্রতিপালনে নিজের থেকে ছোট করার একটা চেষ্টা থাকে। আর সেটা যদি হয় নিজ থেকে সফল কারো বিপক্ষে, তাইলে তো সোনায় সোহাগা।
    আরেকটা মজার ব্যাপার, যেটা তুমিও উল্লেখ করেছো, ভাল খারাপের পরিমানের মন গড়া ক্রাইটেরিয়া নির্ধারন: লেখাপড়া মানে রেজাল্ট আর ধার্মিক হওয়া।
    অথচ সন্তানের সুনাগরিক হওয়ার আসল অনুষঙ্গ হওয়া উচিৎ তাঁর সচেতনতা, সামাজিকতা, জ্ঞানার্জনে আগ্রহ, ইত্যাদি। এই ব্যাপারগুলো বড়ই উপেক্ষিত...
    ২) মানুষে মানুষে যে পার্থক্য বা ভ্যারাইটি, সেটা নিয়ে সংকুচিত না হয়ে সেটাকে সেলিব্রেট করাটা যতদিন না শিখবো, ততদিন এই স্টেরিওটাইপিং থেকে মুক্তি নাই!!!


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      আমাদের স্কুলের একদম শুরু থেকে সুনাগরিক হওয়াটাকে রেজাল্টসীটে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। মানুষ মানুষের জন্য এটি কিভাবে মানুষের কোর মূল্যবোধে আনা যায় তার জন্য একটা পরিকল্পনা করা দরকার। বাংলাদেশের মতো গিজগিজ করা একটি অঞ্চলে যদি একজন আরেকজনকে ল্যাং মারতে চায় তাহলে কিভাবে কী? ধন্যবাদ ভাইয়া আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্য।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
      • পারভেজ (৭৮-৮৪)

        "আমাদের স্কুলের একদম শুরু থেকে সুনাগরিক হওয়াটাকে রেজাল্টসীটে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে" - এইটা খুবই ভাল বলেছো।
        একদমই যে হয় না, তা কিন্তু না। তবে খুব কনশাসলি সেটা করা উচিৎ এবং আরও ব্যাপক ভাবে।
        আমার কন্যাদের স্কুলে আজকাল শুনি হঠাৎ হঠাৎ এক এক দিন ওঁদের টিফিন শেয়ারিং করায়।
        র‍্যানডমলি পেয়ার করে দেয় টিফিন টাইমে আর নিজেদের টিফিন ভাগাভাগি করে খেতে বলে।
        কথা বলে জেনেছি, প্রথম প্রথম ওরা ব্যাপারটা নিয়ে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরী করতো।
        আজকাল দেখি ওরা ব্যাপারটা খুবই এনজয় করে।
        যেদিন টিফিন শেয়ারিং থাকে, বাসায় ফিরে দীর্ঘ সময় ধরে ঘটনাগুলো আমাকে শুনায়।
        এরকম ছোট ছোট ইনিশিয়েটিভ নিয়েও শিশুদের মধ্যে সচেতনতা জাগানো যে সম্ভব, সেটাও ধর্তব্যে রাখা যেতে পারে...


        Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

        জবাব দিন
  4. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    আপা, আমার ধারনাটা শেয়ার করি-
    পশ্চিমা বিশ্বের যুব সমাজ '৭০, '৮০ দিকে যে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল (মাদকের আধিক্য, বেকারত্ব, পুরনো ধ্যান-ধারনায় আঘাত লাগা, পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারনে) আমাদের দেশে সেই অস্থিরতা শুরু হয়েছে '৯০ এর পর যা ২০০০ এর পরে প্রকট আকার ধারন করেছে। এর সাথে রয়েছে প্রযুক্তি এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব। সবমিলিয়ে বেড়া-ছেড়া অবস্থা! তবে, আমি আশাবাদী আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে এই অস্থিরতা অনেক কমে যাবে। (কারণ তা না হলে পরিস্থিতি হয়ে উঠবে ভয়াবহ খারাপ!)

    যাই হোক, একান্তই নিজস্ব মতামত। ভুলও হতে পারে... O:-)


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      জুনা তুমি অনেক ভাবেই আমাকে অবাক করো। কারণ পৃথিবীর অনেক দেখা মানুষ যা ভাবতে পারে না, বুঝতে পারে না, তুমি কিভবে কিভাবে জানি বুঝে ফেলো। তোমার সব ধারণার সাথে আমি একমত সেটা বলব না। কিন্তু লিমিটেড রিসোর্সের মধ্যে যেভাবে তুমি ভাব সেটা কিন্তু অনেক। তোমার নিজেকে আরও অনেক সিরিয়াসলি নিতে হবে।
      অ্যামেরিকায় এখন বড়লোকরা বেশ সাবধানী। সবচেয়ে কষ্টে আছে এই দেশের সাদা গরীবরা। এরা কোনভাবে নীচে পড়ে গেলে জীবনটা নষ্ঠ করে দেয়। লো-পেইড জব এরা করতে চায় না।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
  5. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    (১) এরকম ঘটনা যে ঘটতে পারে এরকম হাসি ঠাট্টা করেছি কিন্তু ঠিক মনে সায় দেয়নি। এখন মনে হচ্ছে অসম্ভব কিছুই নয় এই দেশে।

    (২) সন্তান বড় করে তোলা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতেও ইচ্ছা করে না। সন্তান নেই কি করে বলি? আমি নৈরাশ্যবাদী মানুষ। পড়ি আর মন খারাপ করি। যা বলছেন সব ঘটছে আমাদের আশেপাশে। তাই আরো বেশী খারাপ লাগে। ঠিক কিসের দিকে আঙ্গুল তুলবো তা জানি না তবে প্রযুক্তির ভাবনাহীন বিস্তার তালিকায় স্থান পেতে পারে। বছর কয়েক আগেও সম্ভবত এই নিয়ে সিসিবিতে আলোচনা শুরু হয়েছিল। তখন সম্ভবত আমি খুব কড়া ভাষায় বলেছিলাম আমরা বর্তমান প্রযুক্তি গ্রহণ করার মত সভ্য আমরা হইনি। কেউ একজন এই কথাটির প্রতিবাদও করেছিলেন। ঠিক মনে আসছেনা বিস্তারিত। যাই হোক। কিন্তু ঘুরেফিরে আবারো মনে হচ্ছে এই নিয়ে ভাববার দরকার রয়েছে এবং দুঃখজনক হলেও সেটা নিয়ে ভাববার কেউ নেই।


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      কথাটা শুনতে খুব রুক্ষ শোনালেও বলব সংকীর্ণমনা মায়েদের সংকীর্ণমনা মেয়ে হচ্ছে। আমি নিজে মা। আমি চাই আমার সন্তানরা আমাকে অন্ধভক্তি না করে আমার সমালোচনাও করুক। নিজের আশপাশের মানুষদের দেখছি আর ভাবছি যে প্রযুক্তি বা আধুনিকতা একটি অর্জনের বিষয়। এই অর্জনটি আসে এনলাইটেনের মাধ্যমে।
      তুমি কী আইন পেশায় আছ?


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
      • মোকাব্বির (৯৮-০৪)
        সংকীর্ণমনা মায়েদের সংকীর্ণমনা মেয়ে হচ্ছে

        এটা সম্ভবত আমি নিজের পরিবারের আশেপাশেই দেখছি। সেই হিসেবে চিন্তা করলে মায়েদের নিজেদের ঠিক হওয়াটা অত্যাব্শ্যক। আমি চিন্তা করি আমাদের প্রজন্ম ও পরবর্তীরা যখন মা হবেন তখন কি হবে? ট্রেন্ড কি পরিবর্তন হবে না? সমাজবিজ্ঞানীরা তো বলে ঠিক মত ঠেলা দিলে নাকি এক প্রজন্ম পরে পরিবর্তন হয়।

        সরাসরি আইন পেশায় অর্থাৎ কোর্ট-কাচারিতে আপাতত নেই আপা। এখন আছি বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইনান্স ফান্ড লিঃ নামক অর্থ মন্ত্রনালয়ের অধীন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। সেখানে লীগ্যাল ডিপার্টমেন্টে কাগজে-কলমে-বেতনে ইন্টার্ন হিসেবে আছি।


        \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
        অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

        জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।