টুকিটাকি – ৩


কারমা আর নিউটনের তৃতীয় সূত্র এক নিয়ম মেনেই কাজ করে। কে ভেবেছিল পলাশীতে যে সূর্য ডুবেছিল ২৫০ বছর পরে তাই আবার একদিন উদিত হবে সিলিকন ভ্যালিতে। স্বর্গ আর নরকের মাঝামাঝি নো ম্যানস ল্যান্ডে এসে নবাব সিরাজুদ্দৌলা নাকি উত্তেজিত স্বরে লর্ড ক্লাইভকে প্রায়ই শাসিয়ে যায়, ‘ তোমাদের ছিল কূট বুদ্ধি আর আমাদের হলো ইঞ্জিনিয়ারিং বুদ্ধি।’
‘ইয়োর মাজেস্টি, তার জন্য কী আমাডের প্রণীট এডুকেশন দায়ী নয়?’, বরাবরের মতোই শান্ত লর্ড ক্লাইভ।
সে তর্কের বাকীটা আর শোনা হয়না। আপাতত আমরা পৃথিবীতে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনি এবং সাক্ষী হই ডিজিটাল যুগে সিলিকন ভ্যালির ক্রমশ মিনি এশিয়ায় পরিণত হওয়ার। প্রথমে ইঞ্জিনিয়ারিং চাকরীগুলো দখলে গেল বাদামী আর হলুদদের, এরপর যাচ্ছে তাদের (সাদাদের) বাড়িগুলো। ফী বছর চায়না থেকে বস্তায় বস্তায় ডলার এনে ঢালা হয় সিলিকন ভ্যালির রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্টে। বাদামীরা সুন্দর করে না পিছিয়ে বরং এক’পা এক’পা এগিয়ে গিয়ে সুন্দর পিচাইয়ের মতো হয়ে যাচ্ছে কোম্পানির বিগ বস। ফলে সাদারা ক্রমশ পিছু হটতে থাকে আরও সস্তা কোন জায়গার সন্ধানে।

আন্টিয়ক শহরটি আগে কেমন ছিল তা বলতে পারবো না তবে বর্তমানে এশিয়ান আর আফ্রিকান-আমেরিকানদের আধিক্য। তার মধ্যে শেষের সম্প্রদায়টি অধিকাংশই এশিয়ানদের ইনভেস্টমেন্ট প্রপার্টির ভাড়াটিয়া। শহরটি মূল সিলিকন ভ্যালি থেকে খানিকটা দূরে। তবে সিলিকন ভ্যালি দিন দিন উত্তপ্ত কড়াই হয়ে পড়াতে নতুন এশিয়ান ইঞ্জিনিয়াররা ধীরে ধীরে এ অঞ্চলে বসতি গড়তে শুরু করে। আরেক শ্রেণির এশিয়ান আছে যারা রিয়েল এস্টেটে ইনভেস্ট করছে। আশপাশের প্রতিবেশীদের ভূগোল এতো দ্রুত বদলাতে দেখে ডোরা আর জ্যাক ঠিক করল তারাও তাদের প্রপার্টি বিক্রি করে দিয়ে কোন সিনিয়র সিটিজেন কম্যুনিটিতে গিয়ে উঠবে। আর ঠিক এ কারণেরই সে সময়টাতে ডোরা আর জ্যাক দম্পত্তির সাথে আমাদের পরিচয়। সালটা ২০১১ এর দিকে হবে। আন্দাজ করতে পারি দুজনেই পঞ্চান্ন পার করেছেন। নিঃসন্তান। তবে জ্যাককে বয়সের তুলনায় অনেক বুড়ো লাগে। একটু খেয়াল করলে বোঝা যায় জ্যাক কিছুটা অসুস্থ। পারকিন্সনের প্রাথমিক অবস্থা। এখন আর কোন চাকরী করে না। অনেকদিন ধরেই। সারাদিন বাসাতেই থাকেন।পেশায় ছিলেন মিউজিশিয়ান। স্যাক্সোফোনের মতো ভারী একটা ইন্সট্রুমেন্ট বাজাতেন। সে তুলনায় ডোরা অনেক ফিট। এক শ্রেণির আমেরিকান আছে যাদের কাছে নিজেকে ফিট আর ঘরবাড়ি টিপটপ রাখা হচ্ছে প্রতিদিনকার প্রার্থণার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ডোরা সেই শ্রেণীর। বাড়ির কাজ, চাকরি আবার অসুস্থ জ্যাককে দেখা সবই করছেন নিজে নিজে। আবার সংসারের ফ্যাইনেন্সের পুরোটাই ডোরার ডিপার্টমেন্ট। ফেইরি টেইল ওয়াইফ। একটানা পঁচিশ বছরের সংসার। খেয়াল করে দেখলাম বাড়িটা ডোরার নামে। হয়তো সেই কিনেছিল এক সময়।

সেদিন বাসায় যেতে যেতে ভাবছিলাম একেই বলে প্রেম। হয়তো অল্প বয়সে জ্যাকের মিউজিক শুনে সেই যে ডোরা পটল এখনও তাতে খাঁদ পড়েনি। স্বামী অসুস্থ, এমনকি নিজেদের কোন সন্তান নেই, তারপরও ডোরা সংসারটাকে ধরে রেখেছে। পরম মমতায়। সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ উপন্যাসের মাধবীলতার পরে এই আরেক ডোরাকে দেখলাম। কিন্তু মাধবীলতা তো কাল্পনিক। আর ডোরা বড়ই বাস্তব। তাও আবার পশ্চিমা কন্যা। এই বিষয়টা নিয়ে একটা সুন্দর গল্প লেখা যায়। পাশে ড্রাইভ করা বরকে কথাটা বললাম।
‘গল্পের নামটা যদি দাও “বেকার ছেলে আর কর্মজীবি মেয়ে” তাহলে জমবে ভালো।’, বরের নির্বিকার মতামত।
‘বেকার শব্দটির ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে। ছেলেদের প্রতি এ বড়ই অন্যায়। পয়সা উপার্জন করতে না পারে কিন্তু বস্তুত কেউ কখনই পুরোপুরি কর্মহীন থাকতে পারেনা। মেয়েদের ব্যাপারে অনেক অবিচার হলেও বাংলায় ভাষার দিক থেকে তাদেরকে বরং কিছুটা আহ্লাদীপনা করে তোলা হয়। দেখবে বাংলায় কখনও বেকার মেয়ে কথাটি বলা হয়না। বড়জোর বলে আইবুড়ো মেয়ে। তাও একবার যদি বিয়ে হয়ে যায় তো মেয়েদের আইবুড়োত্ব পুরোপুরি ঘুচে গেল। জ্যাকের বেকারের বদলে আমি বরং বোহেমিয়ান বাঁ ভ্যাগাবন্ড ব্যবহার করবো।’

পরদিন জ্যাক আর ডোরার বাসায় আমাদের আবার যেতে হলো। ওদের ছবির মতো সাজানো লিভিংরুমে বসে অনেক কথা হল। আমি ইন্টেল করপোরেশনে চাকরী করছি শুনে জ্যাক জানালো তার বাবাও ইন্টেলে কাজ করতেন। তো সেখানে তো কতজনই কাজ করে তাই আমি আর অতো উৎসাহ দেখালাম না। জ্যাক নিজেই বলতে শুরু করলো, ‘আমার বাবা হচ্ছে ইন্টেলের চার নম্বর এমপ্লয়ি।’ এবার আমার হতবিহ্বল হবার পালা। আমরা যারা সিলিকন ভ্যালি থাকি এবং সেই সাথে টেক লাইনে আছি তারা জানি যে আইবিএম, এইচপি, ইন্টেল, সান, মাইক্রোসফট, অ্যাপেল, ইয়াহু, গুগল কিম্বা হালের ফেসবুকের মতো কোম্পানিগুলোর পাওনীয়ার বা প্রথমদিককার এমপ্লয়ীরা একেকজন এক-একটা জিনিয়াস। তাঁদের সামাজিক সম্মান আর ব্যাংক ব্যালেন্স দুটোই আকাশচুম্বী। তাঁরা থাকেন সিলিকন ভ্যালির পালো আল্টো, লস আল্টোস কিম্বা এথারটনের মতো এলাকাগুলোতে। এথারটনের মিডিয়ান হাউজের দাম ছয় মিলিয়ন।
জ্যাক জানালো এই বছরই তার বাবা প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছ থেকে প্রেসিডেন্ট পদক পেয়েছেন। তা তো পাবেই। এতো বড় ইঞ্জিনিয়ার! জ্যাক বড় হয়েছে লস আল্টোসে। তারা দুইভাই। আরেক ভাই ম্যানহ্যাটনে থাকে। জ্যাক ডিগ্রি নিয়েছিল মিউজিকের উপরে।
হঠাৎ করেই দেখলাম জ্যাকের ব্যাপারে আমার প্যারাডাইম বদলে গেল। ভাবলাম জ্যাকের তো আসলে মিউজিক পড়ারই কথা। ওয়ারেন বাফের ছেলে স্যান ফ্রান্সিস্কোতে পিয়ানো বাজায়। তবে তার ব্যাংক ব্যাল্যান্স দশ মিলিয়ন ডলার। বাবার থেকে নাকি শুধু অতোটুকুই পেয়েছে। ওয়ারেন বাফে মনে করেন বিত্তশালীর ঘরে সন্তানরা আসলে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ না, তারা জন্মগ্রহণ করে পিঠের পেছনে সোনার ড্যাগার নিয়ে। তাই এ যুগের বিলিয়নিয়ার ক্লাবের সদস্যরা ছেলেমেয়েদের সব দিয়ে যাচ্ছেন না। তাঁরা বরং মনোযোগী হচ্ছে পৃথিবীর বৈষম্য দূর করার জন্য। হালের মার্ক যাক্যারবার্গও এর ব্যাতিক্রম নন। তাঁর মেয়ে পাচ্ছে ১%, আর বাকী সবাই ৯৯%।
সাইড টেবিলে মধ্যে জ্যাক আর ডোরার বিয়ের এলবাম ছিল। আমি এবার তা উৎসাহ নিয়ে দেখতে শুরু করলাম। রীতিমতো একটা ফেইরী টেইল বিয়ে। ডোরা আসলেই ফেইরী টেইল ওয়াইফ।

সেদিন বাসার ফিরবার পথে বর জিজ্ঞেস করলো, ‘ তোমার গল্পটা কি এবার বদলে দিচ্ছ?’
আমি বললাম, ‘ না। শুধু টাইটেলের ভ্যাগাবন্ড শব্দটা বদলে যাবে।’
‘বদলী শব্দটা কি হবে?’
‘জ্যাকপট।

৫,৪৫২ বার দেখা হয়েছে

২৪ টি মন্তব্য : “টুকিটাকি – ৩”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    বটে ! এমন জ্যাক তো জ্যাকপটই হবে।
    দারুন একটা গল্পের গন্ধ পেতেই থেমে যেতে হলো।
    এটা কি বড় গল্প হয়ে পরের পর্বে আমাদের টেনে নিয়ে যাবে? নাকি আদর্শ ছোটো গল্পের তকমা এঁটে এখানেই যতি টানবে !
    জানা নেই তবু অপেক্ষায় থাকলাম। অনবদ্য কথার গাঁথুনি টেনে ধরেছে বেশ। অপেক্ষা তাই অনিবার্য।

    জবাব দিন
  2. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    পড়েছি জানান দিতে কমেন্ট করলাম।
    'বেকার' আর 'আইবুড়ো' টার্মদুটো আমাদের রক্ষণশীল সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে চোখে আঙুলে দেখিয়ে দেয় যেন ছেলেদের কাজ কোন কাজে ঢুকে ফ্যামিলির ভরণপোষণ করা আর মেয়েদের কাজ বিয়ে করে স্বামীর সংসার দেখা শোনা করা।

    জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    বিলিওনিয়ারের সন্তান হবার চেয়ে তাহলে মিলিওনিয়ারের সন্তান হওয়াই ভাল দেখছি। 😀
    বড় হয়ে আমিও জ্যাকের মতন হতে চাই... :dreamy:

    বাই দ্যা ওয়ে, শুভ জন্মদিন, আপা! :party:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    ফেইরি টেইল ওয়াইফ কল্পনা করতেও ভালো লাগে! 🙂
    জ্যাকের বেকারের বদলে আমি বরং বোহেমিয়ান বাঁ ভ্যাগাবন্ড ব্যবহার করবো।’ -- যথার্থ!
    ভ্যাগাবন্ড থেকে জ্যাকপট-- জ্যাকের প্রতি ধারণার এ রূপান্তরটা ভালো লেগেছে।
    সুন্দর করে বলা টুকিটাকি কথাগুলো ভালো লাগলো।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।