নতুন ঠিকানা


গত বছর সামারে ঘুরতে গেছি ইউসেমিটি ন্যাশনাল পার্কে। পাহাড়, বনানী, ঝর্ণা, নীলাভ লেক আর গ্ল্যাসিয়ারের চাপে পাথুরে মাটি দিয়ে শিল্পীর এক অপূর্ব ভাস্কর্য। তো একদিন যাচ্ছিলাম বগা লেকের (পড়তে হবে তেনাইয়া লেক) পাশ দিয়ে। মে মাসেও সেই লেকের উপরিভাগ বরফ জমে স্থির-শীতল। ভাবলাম যাই কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখি বরফের ঘনত্ব কতখানি। পরিবারসহ, মানে স্বামী আর আণ্ডাবাচ্চা, লেকের পাশে গাড়ি থামিয়ে একটু জলকেলির ভাব নিলাম। তখন হঠাৎ করেই শুনি আশপাশে কারা যেন বাংলায় কথা বলছে। এখন প্রায় এক কোটির উপরে বাংলাদেশী সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে আছে। তাই দেশের বাইরে কোথাও গেলে বাংলায় কথা বলতে শোনাটা কোন অপ্রত্যাসিত ঘটনা নয়। তারপরও কৌতুহলবশতঃ আলাপ করে দেখলাম এরা আমাদের বুয়েটেরই জুনিয়র। সেই দশ-পনের বছর আগে যেমন বন্ধুবান্ধব মিলে পোঁটলাপুটলি বেঁধে বেড়িয়ে পরতাম, এরাও তেমনি বেড়িয়ে পরেছে। পিএলের আগে আমরা বিভিন্ন বিষয়ের চোথা পাই, কিন্তু পরবর্তীতে জীবনযাপনের কোন চোথা পাই না। তারপরও কমবেশি সেখানে একটা পরিচিত ছন্দ কাজ করে। আমি নিশ্চিত সেদিন সন্ধ্যায় ক্যাম্পফায়ার করার জন্য আগুণ জ্বালাতে ওদের অনেক ঘাম ঝরবে।


স্বভাবতই না চিনলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একই বলে তাদের সাথে এক ধররণের নৈকট্য বোধ করলাম। বগা লেকের ধারে সেদিন সে দলটির একজন বলল, ‘আপনি লেখেন না?’ যাই হোক বা যেভাবেই হোক সে এটি বলাতে আমি তো খুশীতে ডগমগ। শিক্ষা প্রাতিস্থানের কোন গ্রুপে লেখার কারণে সে হয়তো এটি বলছে। এই চেনাচিনির ব্যাপারটার মধ্যে এক ধরণের আনন্দ রয়েছে। সেটা আসলে নিজেকে কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবার আনন্দ। তারপর বগালেক ছাড়ার সময় গাড়িতে যখন বর বলল, ‘কী ব্যাপার এই বনজঙ্গলেও তোমার বইয়ের পাঠকের সন্ধান মিলল?’ তখন আমার ভাব দেখে কে!


আমি হচ্ছি এডভেঞ্চার‍্যাস মানুষ। ছেলে হয়ে জন্মালে নির্ঘাৎ এ যুগের ইবনে বতুতা হতাম। মেয়ে হয়ে জন্মেছি তাই যথা সম্ভব সিস্টেমের মধ্যে থাকার চেষ্টা করি। সিস্টেমের মধ্যে থেকেই সিস্টেমটাকে ঝালাই-মালাই করতে চাই। সিস্টেমের মধ্যে থাকার পেছনে একটা ইতিহাস আছে। সে ইতিহাস আজ থাক। সময়ে বলবক্ষণ। তো জীবনটা যখন বড্ড বেশি একই তালে চলতে থাকে তখন বরকে বলি, ‘চল নতুন কিছু করি।’
বর বলে, ‘কি করতে চাও?’
আমি বলি, ‘এই যেমন পাহাড় থেকে সমতলে, ডাঙ্গা থেকে সমুদ্রে, বন থেকে মরুভূমিতে – এই রকম একটা পরিবর্তন দরকার। একটু হাওয়া বদল আরকি।’
‘তুমি ইঞ্জিনিয়ার, আমিও ইঞ্জিনিয়ার। বদলী চাইলে তুমি যাও। আমার হাওয়া বদলের দরকার নেই।’


গত সতের বছর ধরে আমি এক ক্যালিফোর্নিয়াতেই রয়ে গেছি। যা কিছু হাওয়া বদল হয়েছে তা ঐ ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্যেই। এবার ইষ্টকোস্টে হাওয়া বদল করতে আসতে ইচ্ছে হল। ঐতিহাসিক থার্টিন স্টেটের মধ্যে কয়েক বছর না কাটালে কিভাবে হয়?
‘তুমি আলাভোলা মানুষ। তার উপর বরফের উপর গাড়ি চালানোর কোন অভিজ্ঞতা নেই। আমিও বরং তোমার সাথে যাই।’ বলতে বলতে এবার বরও তার বাক্স-প্যাটরা গোছাতে শুরু করলো। দিনক্ষণ দেখে আমরা সপরিবারে ভার্জিনিয়া চলে আসি। কিছুটা আগে-পরে। আমার ছেলে মনে করেছিল নতুন জায়গায় আমাদের তেমন পরিচিত মানুষ থাকবে না। কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখে এখানে আমাদের পরিচিত মানুষের অভাব নেই। প্রবাসে বাংলাদেশিদের নেটওয়ার্ক আসলে বেশ ভালো।
ভার্সিটির বান্ধবী সাবিহা তার বান্ধবীদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় লেখক হিসেবে। খুব লজ্জা পাই। আবার মনে মনে খুশীও হই। আবার আমার অনেক জুনিয়রের সাথে পরিচয় হল। একজন বলল, ‘আপনাকে তো চিনি। আপনি তো ঐ গ্রপে লেখেন।’
আমি একটু আমতা আমতা করে বলতে চাইলাম, ‘না মানে আমার তো ঠিক সেভাবে হাত খুলে লেখা হয়নি।’ পরে মনে হল কী দরকার? হয়তো সে আমাকে অন্যের সাথে মিলিয়ে ফেলছে, কিন্তু একজন পরিচিত মনে করছে এটাই বা কম কী? নতুন জায়গায় এ এক কম প্রাপ্তি নয়।


এই লেখাটা খুব আমি আমি হয়ে গেল – যাই হোক ছোটখাট (এবং আমি আমি) হলেও একটা দিনলিপি লিখছি। একটু আত্মশুদ্ধির চেষ্ঠা।

২,৫৯৪ বার দেখা হয়েছে

১৯ টি মন্তব্য : “নতুন ঠিকানা”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    (১) ক্যাম্পফায়ার ও তাবু খাটানোর কথা পড়লেই লজ্জায় চোখ বুজে ফেলি! যেই কারখানা করেছিলাম! বনে জঙ্গলে আগুন ধরে নাই এটাই বেশী।

    (২) আড়াই বছরে খুব বেশী নড়াচড়া আমার করা হয় নাই তবে আমার এলাকা বাদে মোটামুটি যেখানেই গিয়েছি বাঙলায় কথা বলার লোকজন পেয়ে গিয়েছি। এবং হ্যা খুব সুগঠিত নেটওয়ার্ক।

    (৪) ভার্জিনিয়া পর্যন্ত যখন এসেছেন, (শীতে দাওয়াত দেয়ার প্রশ্নই উঠে না তাই) এরপরের কোন এক গ্রীষ্মে আপার পেনিনসুলা মিশিগান চলে যেতে পারেন। পিকচার্ড রকস, কিংবা লেক অফ দ্য ক্লাউডস টাইপের জায়গা গুলোতে। ভালো লাগবে আশা করি। তবে ক্যালিফোর্নিয়াবাসী বলে হয়তো এরকম সবুজ দেখে আপনারা অভ্যস্ত তারপরেও পাহাড়, টলটলে নীল জলের হ্রদ, কটেজ, কায়াকিং সব মিলিয়ে ভালই লাগবে মনে হয়।


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      জানি না কতদিন তবে চার-পাঁচ বছর থাকার ইচ্ছা আছে এখানে। মূল পরিকল্পনা ইষ্ট কোস্টটা ঘুরে দেখা। আপাতত মিউজিয়ামের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছি। তবে প্রথম বছর আর্মি ট্রেইঙ্গিং মতো খাটতে হচ্ছে কাজে। দাওয়াত দিব চলেই তো গেলে।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
      • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

        ওহ আপা ভুল বুঝেছেন। আমি আপার পেনিনসুলা মিশিগানের প্রাক্তন বাসিন্দা + প্রেমিক হিসেবে আপনাকে শীতে দাওয়াত না দেয়ার কথা চিন্তা করছিলাম। ঐ এলাকায় ঘুরতে গেলে গ্রীষ্ম ছাড়া গতি নাই। বাকিসময় সাদা ধুধু প্রান্তর। শীতল মরুভূমি।


        \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
        অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

        জবাব দিন
  2. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

    বাঙালীর ভেতরে প্রকৃতিকে চিনবার জন্য পথে নামবার উন্মাদনার সঞ্চার ঘটিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বাঙালী আজ যখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন হাইকিং, ট্রেইলিং, ট্র্যাকিং, ক্যাম্পিং এগুলোকে ডালভাত বানাতে কিছুটা সময় লাগবে বৈকি। এই গতকাল ক্যালিডোনিয়া ট্রেইল ধরে হাইকিং শেষ করে ফিরে এলাম। সেখানের ক্যাম্প-সাইটে ৩ বছরের শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধারও দেখা পেয়েছি। ছোট ছোট শিশু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সাইক্লিং করছে। নিঃশঙ্কে নির্দ্বিধায়। আমাদেরও হবে একদিন।


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
  3. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "প্রবাসে বাংলাদেশিদের নেটওয়ার্ক আসলে বেশ ভালো" - আসলেই তাই। একবার নিউ ইয়র্কে এক সজ্জন ব্যক্তি উভয়ের পরিচিত এক স্বনামধন্য কবি বন্ধুর মাধ্যমে আমার পরিচয় পেয়ে টেলিফোনে অস্থির করে তুলেছিলেন তাকে কিছুটা সময় দেয়ার জন্য। তিন চার ঘন্টা সময় তিনি আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে নিয়ে এখানে ওখানে অনেক জায়গা ঘুরে দেখিয়েছিলেন, আর অনর্গল তার গল্প শুনিয়েছিলেন। অথচ তার সাথে এর আগে কোন পরিচয়ই ছিল না।
    "একটু আত্মশুদ্ধির চেষ্টা" - ভালো চেষ্টা। লেখাটা ভালো লেগেছে।

    জবাব দিন
  4. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    সালাম আপু। কেমন আছেন?

    সিসিবিতে ঢু মারলেও লগিন করা হয় না। এমনকি নিজের শেষ ব্লগটার একটা কমেন্টও রিপ্লাই করিনি। সময়ের কাজ সময়ে না করার কারণে একটু বিব্রতই তাই।

    টুকরো টুকরো লেখা গুলো ভালো লাগলো। দুয়েকটা বোধ হয় আগে দেখেছিলাম অন্য জায়গায়। তবে চেনা লোকদের অচেনা জায়গায় উপস্থিতি জানান দেয়া হয় নি। তবে এই লেখার সবচেয়ে ভালো লাগলো সংযুক্তিটাই। এই লেখাটা আমার কাছে আমি ময় অতটা লাগে নি যদিও আপনি অবলীলায় কনফেশন স্টাইলে বলে দিলেন। 'নার্সিসিজমে'র এই যুগে এমন সরল কনফেশন দেখতে পারা খুবই রিফ্রেশিং।

    অফটপিক: আপনি কি নতুন কোন লেখায় হাত দিচ্ছেন এর মাঝে?

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      অনেকদিন পর তোমাকে দেখলাম। আসলে আমার নিজের আমি মার্কা লেখা পড়তে খুবই বিরক্ত লাগে। কিন্তু নিজেকেই তা থেকে মুক্ত করতে পারিনা। এই যেমন সিসিবিতে শুধু পোষ্ট করলাম এটা তো ঠিক হল না - এটাকেও বড় স্বার্থপর আচরণ বলে মনে হয়। তবে নিজের কাছে সবারই একটা যুক্তি থাকে যা তাকে অপরাধবোধ থেকে মুক্ত রাখে।
      লেখা তো দূরের কথা কিছু পড়াই হচ্ছে না। তবে মনে হয় একমাস পর থেকে শুরু করতে পারব।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
  5. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    শান্তা,
    কতদিন পর তোমার লেখা পড়লাম! এখন আম্যাকেও নিয়ম করে অনিয়মিত হয়ে যেতে হচ্ছে -- এত ব্যস্ততা।
    যথারীতি সুস্বাদু লেখা -- জীবনের যাপন এবং বোধ দুইই মেলে এখানে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।