ঘরট্ট (প্রথম পর্বের কিছু অংশ)

আমরা এখন গুলিস্তান বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ আগে এইখানে বানরের খেলা দেখানো হলো। আমাদের এতো কাছে যে না চাইতেও আমরা গোল হয়ে ঘিরে থাকা দর্শকের ভীড়ে মিশে গেলাম। তাও আবার প্রথম সারিতে। বানরের নাম মন্টু মিয়া। খেলার সর্বশেষ আইটেম হিসেবে মন্টু মিয়া এখন বউ খুঁজতে বেরুবে। কী আর্শ্চয! মন্টু মিয়া আমার সামনে এসে লাফালাফি শুরু করে দিল। চারপাশ থেকে তুমুল হাততালি। এতো দুঃখের মাঝেও আমার খুব হাসি পেল। নিজেকে মুক্তার মতো দামী মনে হচ্ছে। বানরের গলায় মুক্তার মালা! আমার এখন যে অবস্থা তাতে বানরের পছন্দের তালিকায় থাকাটাকেও একটা বড় প্রাপ্তি বলে মনে হচ্ছে। মন্টু মিয়া তোমাকে ধন্যবাদ। খেলা শেষ। মন্টু মিয়ার অভিভাবক এবার ঘুরে ঘুরে সবার কাছ থেকে পয়সা সংগ্রহ করছে। আমার সামনে এসে বললেন, ‘আপনি আমার বউমা। আপনার কাছ থেকে পয়সা নিব না। সবাই লাগাও তালিয়া।’ 
আবার হাততালি। পেছন থেকে আব্বা দুই টাকা দিয়ে দিয়ে আমার সম্ভাব্য শ্বশুরমশাইকে খুশি করলেন। যাক, আমার হিজরতের প্রথম দিনে কম হাততালি পেলাম না। অথচ এই হাততালিকে চিরবিদায় জানালোর জন্যই এতো হুড়োহুড়ি করে ঢাকায় আসা। চোখ বন্ধ করে আজকের তারিখটা মনে করার চেষ্টা করলাম। ২১শে জুলাই, ১৯৮১। আজকে আমার জন্মদিন না? আজকে ভোরবেলায় ঠাকুরপাড়ার বাসা থেকে আমাকে বিদায় জানাবার সময় একথাটা কারও মনে হলো না? এমনকি আম্মারও? পা ভাঙ্গলে সে তার মাথা ব্যাথার কথা ভুলে যায়। আমাকে নিয়ে সবার এখন এই অবস্থা। আমার নিজেরও।   
বিআরটিসির লাল বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। গন্তব্য গুলিস্থান থেকে আজিমপুর। এর আগে কখনও দোতলা বাসে চড়িনি। কুমিল্লা থেকে সরাসরি আজিমপুরেও যাইনি। অনেক ঘটনাই নতুন ঘটছে। এই যেমন বানরের বৌ হওয়া অথবা এই ঢাকা শহরটা, আমাদের এরকম দাঁড়িয়ে থাকা – কেমন জানি অচেনা ঠেকছে। রাস্তার ওপাশে লাল ইটের একটা তিনতলা বিল্ডিং। স্কুল বিল্ডিঙ্গের মতো লম্বালম্বি করে বানানো। সাধারণত অফিস বিল্ডিং এরকম হয়। এর সামনের দিকটায় অনেকগুলো সাইনবোর্ড। জীবনবীমা, উকিলের চেম্বার, ঠিকাদারীর ফার্ম, আদমব্যাপারীর অফিস, টাইপিঙ্গের দোকান। একটা বিজ্ঞাপনের ফার্মও আছে। স্বাধীন দেশে বাংগালি এখন ব্যবসা করতে শিখে গেছে। সাইনবোর্ডগুলোর মধ্যে অনেক চটকদার বিজ্ঞাপন লেখা রয়েছে। তার একটা হচ্ছে ‘টাকা দেন, দুবাই যাব … আপনি কি চাকরি নিয়ে দুবাই কিম্বা মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে যেতে চান? তাহলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।’ খুবই আকর্ষনীয় বিজ্ঞাপন। আমারই তো এখন আদমব্যাপারীর অফিসটাতে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। শুনেছি কর্নেল গাদ্দাফি নাকি লিবিয়াতে অনেক চিকিৎসক নিচ্ছে। ওদের নিশ্চয় নার্সেরও দরকার হবে। কিম্বা আয়া-বুয়ার? অতীতকে তো আর বদলানো যায়না। কিন্তু ভুলে থাকা তো যায়। ভুলে থাকার জন্য ডুব মারতে হবে। অন্য কোথাও। সম্পূর্ণ অচেনা কোন পরিবেশে। না, আমার আর হারিয়ে যাওয়া হবে না। কারণ কিভাবে হারিয়ে যেতে হয় তা আমি জানি না। সেটা জানার সাহসও নেই। সাহস করার পেছনের যে ইচ্ছাটা – তা আর কোনদিন জাগবে না। জীবন আমাকে খুব নিষ্ঠুরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে একদিনের হঠাৎ সাহসের স্ফুলিঙ্গ কত বড় দানাবল ছড়াতে পারে। নিস্পৃহ চোখে সামনের লাল বিল্ডিঙ্গটার দিকে তাকাই। হরেকরকম মানুষ দেখতে থাকি। অনেকের ভীড়ে হঠাৎ একজনকে দেখে চমকে উঠলাম। একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটছে। গায়ে সাফারি শার্ট। ফ্যাশন প্রায় চলে গেছে তারপরও লোকটার বেল-বটম প্যান্ট পড়ে আছে। হয়তো হাল ফ্যাশনের প্যান্ট বানানোর পয়সা নেই। ভদ্রলোকটি বাম হাত দিয়ে একটা কালো রেক্সিনের ব্যাগ বুকের কাছে জড়িয়ে রেখেছে। 
‘আব্বা দেখেন দেখেন, ওই যে লোকটা, ফজলু ভাই না?’ উত্তেজিত গলায় কথাটা বলে আব্বার দিকে তাকালাম। তখনই মনে হলো আব্বা তো ফজলু ভাইকে চেনেন না। মানিকদাকে কিছুটা চিনলেও চিনতে পারেন। 
‘ফজলু ভাই কে মা?’ আব্বা খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। আজকে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসতে পাঁচ ঘন্টা লেগেছে। খেয়াল হলো গত পাঁচ ঘন্টায় এই প্রথম আমি একটি পূর্ণ বাক্য উচ্চারণ করলাম। এর আগে যাত্রাপথে আব্বা আমাকে কখনও শসা কখনওবা কলা কিনে দিতে চেয়েছিলেন। তখন শুধু মাথা নাড়িয়ে মানা করেছিলাম। আব্বা মনে হয়না ফজলু ভাই কে এই প্রশ্নটার উত্তর জানতে চাচ্ছেন। যা চাচ্ছেন তা হলো এই হঠাৎ কথা বলে উঠা আমাকে দিয়ে কথা বলাতে। 
‘কুমিল্লায় শাপলা-শালুক নামের একটা সংগঠনের সাথে ছিলেন। উনি এখন পলাতক। বিদেশে পাঠাবে বলে নাকি অনেক লোকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন।’
‘মা কিছু খাবি? ঐ লোকের কাছ থেকে ঝালমুড়ি কিনে দেব?’, যা ভেবেছিলাম তাই। ফজলু ভাইয়ের গল্পে আব্বার আগ্রহ নেই। এক ঠোঙ্গা ঝালমুড়ি কিনে আব্বাকে খুশী করবো নাকি?  
‘না আব্বা। একবারে ছোটমামার বাসায় গিয়ে খাব।’ ঝালমুড়ি যিনি বেঁচছেন তাকে দেখতেও খুব পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। এই ভদ্রলোকের থুতনীতে একটু দাড়ি থাকলেই … না, আর ভাবতে পারছি না। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। চোখ বন্ধ করলাম। কয়েকটা রং পর পর চোখের সামনে খেলে গেলো। লাল কৃষ্ণচূড়া। কালো গেট। সাদা বিল্ডিং। বড় বড় শ্বাস নিতে লাগলাম। এই রকম মুহূর্ত আমার জীবনে আগেও কয়েকবার এসেছে। তখন দেখতাম মোল্লা হাবেলীর বাথরুমের বন্ধ দরজা। এখন দেখি অন্যকিছু। চোখের সামনের দৃশ্য বদলে গেছে। কিন্তু এখনও আগের মতো বুক ধরফর করে উঠে। শ্বাস গলার কাছে আটকে আসে। কে বলে যে এই পৃথিবীতে ভূত নেই? খুব আছে। দুঃসহ স্মৃতিরা মাথায় গেড়ে গেলে ভূত হয়ে যায়। তারপর সময়-অসময়ে খালি তাড়িয়ে বেড়ায়। কী দরকার ছিল এই ভদ্রলোকের এ মুহূর্তে এখানে ঝালমুড়ি বিক্রি করার?  
ঘ্যাঁচ…
আমাদের সামনেই বাসটা থামলো। বাসটাতে উঠে পড়লাম। উঠার সময় ঠেলাঠেলি। কে কার আগে যাবে। আব্বা আমাকে দু’হাত দিয়ে আগলে রেখেছিলেন। লেডিস সীটে আমি বসার জায়গা পেলাম। আব্বা দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছু করার নেই। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। 

(চলবে না। মাঝে মাঝে অংশ বিশেষ দিতে পারি। আসলে সিসিবিতে কিছু পোস্ট করতে ইচ্ছে করছিল। আপাতত লেখা থেকে বিরত আছি। তাই আগের লেখা থেকেই কিছু পোস্ট করলাম।)

২,৭৩০ বার দেখা হয়েছে

২০ টি মন্তব্য : “ঘরট্ট (প্রথম পর্বের কিছু অংশ)”

    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      লোকে যাতে শুনে সে আশায় সুন্দর করার চেষ্টায় থাকি ... ফিকশন লেখার ক্ষেত্রে চরিত্রগুলোর ভূত একবার কাঁধে ভর করলে আর চিন্তা নেই। তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকে। তুমিও যদি কখনও এর মধ্যে দিয়ে যাও টের পাবে। তুমি কিছু ভাবার আগেই দেখবে এরা কথা বলছে।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
  1. সামিউল(২০০৪-১০)

    আপা আপনার দুইটা বইই পড়েছি, ঘরট্ট আর বিতংস। অদ্ভুত সুন্দর লেগেছে। আশির দশকের বাংলাদেশ সম্পরকে খুব ভাল একটা ধারণা পেয়েছি। জানাবো জানাবো করে আপনাকে জানানো হয়নি।

    তাছাড়া, একটা মেয়ের চোখে জীবনে কীরকম তা বুঝতে পেরেছি খুব ভাল করে।

    এরপরে আর কোন বই লিখছেন না??


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে শুরু করেছিলাম তখন একটা ফোন আসলো।
      যাই হোক, তাহলে কি পয়সা ফেরত দিতে হবে না 🙂 ? বিতংস, ঘরট্ট আসলে ট্রিলজী। শেষেরটা তো বের হয়নি। নামটা হবে তিতীক্ষা। বিতংসের খুনের কথা কী তুমি ভুলে গেছ? বাংলাদেশে থাকলে বোধহয় এতোদিনে আমারও সুবিচার না পাওয়া, হঠাৎ ভালো মানুষগুলোর খুন হয়ে যাওয়াকে ডাল-ভাত বলে মনে হতো। দেয়া কী মনে করছো শাহেনশাহকে এতো সহজে ছেড়ে দেবে? তবে আগে তো দেয়াকে নিজের জীবন গুছাতে হবে। সে তো ঘরট্টে আমেরিকায় আসলো। এখানে এসে সে আরও অনেক বিপদে পড়বে। তারপর দেশে ফিরে পঁচিশ বছরের পুরনো কেস আদালতে তুলবে। তিতীক্ষার একটা হালকা-পাতলা ড্রাফট লেখা আছে। তবে এখন সেটার পুরো কাঠামোটাই বদলে ফেলতে হবে। শাহেনশাহ চরিত্রটা ভাবছি এখনকার শামীম ওসমানের আদলে গড়ে তুলবো। কুমিল্লার গোমতী নদীতে সাতটা লাস ভেসে উঠবে। ক্ষমতাশালী দল রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে শাহেনশাহকে রক্ষা করতে চাইবে। কিন্তু দেয়া এখনকার খুনগুলো নয় সেই পঁচিশ বছরের একটা খুনের সুবিচার পাওয়ার আশায় অনড় থাকবে। দেয়াকে ঘিরে একসময় মফস্বল শহরের সব আশাহত স্বপ্নহীন মানুষেরা আবার জেগে উঠবে। এখন ভাবছি এই আইডিয়া নিয়ে কাজ করব। এর জন্য আমাকে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে শুরু করে প্রাসংগিক আইন, রিলেটেড কেস অনেক কিছু পড়তে হবে। এই বছর আমি কিছু সফটঅওয়ার ডেভেলেপমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত আছি। তাই টার্গেট ঠিক করেনি। তবে অবশ্যই ২০১৬র আগে বের হবে।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
  2. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    পড়লাম।
    ইদানিং প্রায় সব ধরণের ভার্চুয়াল একটিভিটি রেসত্রিক করে ফেলছি। কিছু না বলেই চলে যেতে চাচ্ছিলাম। পরে আবার মনে হলো জানান দিয়ে যাই।

    বিতংস যেখানে শেষ হয়েছিল সেখান থে। থেকেই শুরু। ট্রানজিশন ফেস এর লেখা পড়লাম। বেশ স্মুথ লাগলো। সময় করে উঠতে পারি না ইদানিং একদমই। সময় করে পড়বো আশা রাখি।

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      তুমি এখন কোথায়? আমারও তোমার মতো অবস্তা। তবে অনলাইন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে চাইলেও হওয়া সম্ভব নয়। কারণ আমি সাধারণত ফোন ব্যবহার করি না। লোকজনের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাই আমার ফেসবুক খুব কাজে আসে। আর কেন জানি অনেকটা দিন ব্লগে লেখা না দিলে কেমন জানি শূণ্যতা বোধ হয়। মজার ব্যাপার হলো অন্যন্যা, কালি ও কলম এই বছর আমার থেকে ওদের ঈদ সংখ্যার জন্য লেখা চাইছে।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
      • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

        আমি সপ্তাহ তিনেক হলো পুরান বাসভূমে ফেরত এসেছি পিএইচডির জন্য। নিজের সাথে নিজে কথা বলে যে সব বিষয় কমাবার সিদ্ধান্ত নেই সেটা হলো ভার্চুয়াল একটিভিটি। আর দেশে দীর্ঘদিন থাকার পরে বোধের কিছু জায়গাতেও পরিবর্তন এসেছে। লিখালিখি তাই মোটামুটি বন্ধ। পড়াও কমে যাচ্ছে।

        আপনার লেখা চাচ্ছে শুনে বেশ মজা লাগলো। দিন শেষে সবকিছুই জালের মত। চাইলেও অনেক কিছু ছাড়া যায় না। 🙂

        জবাব দিন
  3. সামিউল(২০০৪-১০)

    আপা, আমিও পড়ার সময় ভাবছি এত তারাতারি কেন হুট করেই শেষ হয়ে গেল,
    মনে হচ্ছিল যে আরেক পারট আসবে।

    লিখে ফেলেন দ্রুত, আমি আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছি।
    দেয়াকে একটু শান্তি দিয়েন এবার, : P


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  4. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    লিখাতো এই রকমই হওয়া চাই যা পড়তে চাইতে হবে না, জোর করে পড়িয়ে নেবে, চোখ সরাতে দেবে না।
    সমস্যা হলো কোথায় পাওয়া যাবে এখন এইটা?
    দেখি রকমারি কি বলে?

    অদ্ভুত গতিময়। মুদ্ধ হয়ে পড়ে গেলাম।
    :boss: :boss: :boss:


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোস্তাফিজ (১৯৮৩-১৯৮৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।