সান ফ্রান্সিসকোতে ফাঁস

(গল্পটি আগে একটি সাহিত্য ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।)

রুমমেট মেরি লী আর আমার সমস্যাটা এক। অথচ দু’জন এর সমাধান চাচ্ছি দুরকম পথে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ আমাদের মিলের থেকে অমিল বেশি। প্রথম এবং প্রধান মিলটার কথা আগে উল্লেখ করি। আমরা সমবয়সী। আমার বয়স চব্বিশ। মেরি লী আমার থেকে দু’বছরের ছোট। অমিল অনেক। সে বেশ সুন্দর। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় তাকে একজন প্রথম সারির সুন্দরী বলে বিবেচনা করা হতো। চায়নীজদেরকে বাংলাদেশি মহল নিজেদের মধ্যে চাংকু নামে ডাকে। মেরি লীকে দেখে কেউ চাংকু বলবে না। তার সৌন্দররয আন্তর্জাতিক মানের। সে তুলনায় আমি দেখতে খুব সাধারণ। বয়ফ্রেণ্ড জুটেনি। বাবা-মা চেষ্টা করলে একটা বর জুটলেও জুটতে পারে তবে সে বিষয়ে আপাতত আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। আর মেরি লীর জীবনে এটাই এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। জীবনের কোনকিছুতে সে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজী নয়। আমাদের প্রধান অমিলটা এই জায়গাতে। আমার ফোকাসটা শুধুমাত্র নিজের জীবনকে সুন্দর করে সাজানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অধিকাংশ মানুষই তো করছে। আমি না হয় ব্যস্ত হই অন্যকিছুতে। এই পৃথিবীর কিছুটা জন্জাল পরিষ্কার করতে চাই। কিভাবে করবো জানি না। আর মেরি লী জানে না কিভাবে একটা বয়ফ্রেণ্ড যোগার করবে। রুমে যতক্ষণ থাকছে সারাক্ষণই সৌন্দররয চর্চা করছে। আর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার সব কথাবার্তাও শেষ পররয্ন্ত একটা জায়গাতে এসে আবর্তিত হয়।  আমার কানের কাছে প্রায়ই ঘ্যান ঘ্যান করবে, “তোমাদের চোখদুটো এতো সুন্দর হয় কেন? বড় বড় আর টানা টানা।”
‘তোমাদের বলতে কি বোঝাচ্ছ?’উত্তরটা জানা সত্বেও প্র্শ্নটা ছুড়ে দেই।। 
মেরি লী উত্তর দিল,’ভারতীয়দের।’
‘আমি ভারতীয় না। আমার আব্বা-আম্মা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন।’
অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমার মধ্যে শেকড়ের জাতিয়তাবোধ প্রবল। অথচ আমি একজন দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশি-আমেরিকান। আমার এই টাইপের সমবয়সীরা নিজেদের শুধু আমেরিকান ভাবতেই পছন্দ করে। কেউ আমাকে ভারতীয়-আমেরিকান বললে সাথে সাথে ফুঁসে উঠি। স্কুলে পড়ার সময় অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেছি। সহপাঠীরাদের অনেকেই বাংলাদেশকে চিনতো না। কী রকম বোকা সব!
‘ঐ একই তো। এক সময় তো তোমাদের দেশগুলো মিলেমিশে তো একটা দেশই ছিল।’
মেরি লীর ইতিহাস জ্ঞান নিয়ে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই। গত বছর সে স্ট্যান্ডফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছে। ভবিষতে আইন নিয়ে পড়তে চায়। এখন একটা ল’ফার্মে চাকরি করে। কাজের অভিজ্ঞতা বাড়াচ্ছে। আমার প্রশ্নটা ইতিহাস বিষয়ক নয়, জাতিয়তাবোধের। শেকড়ের প্রশ্ন। আব্বাকে দেখতাম যে একদমই পাকিস্তানি সহ্য করতে পারতেন না, আর আম্মা ভারতীয়দের। সেই কতোদূরে বাংলাদেশ! এই স্যান ফ্রান্সিসকোতে মাটি খোড়া শুরু করলে আরেক প্রান্ত বাংলাদেশে গিয়ে ঠেকবে। জীবনে মাত্র তিনবার সে দেশে বেড়াতে গিয়েছিলাম। অথচ শেকড়ের টান বড্ড বেশি টনটনে। অস্বীকার করার উপায় নেই। মেরি লীকে বললাম,
‘তোমাকে যদি জাপানীজ বলা হয় কেমন লাগবে?’ এবার আমি ওর জাতিয়তাবোধে একটু চিমটি কাটলাম। হাজার হোক ম্যান্চুরিনে ওর পূর্বপুরুষের বাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানীরা সে এলাকা একেবারে তছনছ করে ছেড়েছিল। ওর দাদির বোন তো জাপানীজ সৈন্যদের ধর্ষণের কারণে মারাই গিয়েছিল। 
‘জাপান আর চীনের মধ্যে অনেক পার্থক্য।’
মেরি লী কি কিছুটা রেগে গেল? যাক, আমার লক্ষ্য অব্যর্থ। 
এবার একই উত্তরই ওকে ফিরিয়ে দিলাম। ‘বাংলাদেশ আর ভারতীয়দের মধ্যেও অনেক পার্থক্য।’


মাঝেমধ্যে মনে হয় আমেরিকাতে বসে জাতিয়তাবাদ নিয়ে এরকম বিভেদের কোন মানে হয়না। বিশেষ করে আমরা কেউই যেখানে আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটায় আর ফিরে যাচ্ছি না। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই বিষয়টাকে আসলে একদম পাশ কাটিয়ে চলা সম্ভব নয়। আমি ভালবাসি মুরগির কোরমা, আর মেরি লী লেমন চিকেন। আর এখন তো এই এথনিসিটি বোধটা রীতিমতো আমার গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশ করার পর থেকেই পৃথিবী বদলে দিব এমন একটা ভাব নিয়ে চলছি। আমার স্নাতকের বিষয় ছিল তুলনামূলক সাহিত্য। সেই সূত্রে এই এলাকায় এশিয়া ফাউন্ডেশনে একটা কাজ জুটে গেছে। কাজটা একটা প্রজেক্টের। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কিভাবে শিক্ষা বিপ্লব ঘটানো যায় তার উপর একটা গবেষণামূলক পেপার তৈরি করা। এতেই এখন নিমগ্ন হয়ে আছি। চাকরির বাইরেও পুরোটা সময় এই বিষয়ে লেখালেখি আর পড়াশোনা করি।  নো বয়ফ্রেন্ড, নো ফ্যামিলি। এসব নিয়ে কোন চিন্তা করছি না। আব্বা খুব চেয়েছিলেন আমাকে ইন্জিনিয়ারিং পড়াতে। আব্বার সাথে রীতিমতো তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে শেষ পররয্ন্ত সাহিত্য নিয়ে পড়তে পেরেছি।  সেই থেকে আব্বা-আম্মার সাথে সম্পর্কটা একটু আলগা হয়ে গেছে। তারপরও ভালবাসার বন্ধন তো আর এতো সহজে ছিঁড়ে যায় না। মাঝে মাঝে আম্মা ফোন করে জানতে চায় আমার কিছু ডলার লাগবে কিনা। আমি বলে দিই যে লাগবে না। কথাটা ঠিক নয়। আমার এখন খুবই অর্থের টানাটানি। ক্রেডিট কার্ডে দিন দিন ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। অবশ্য দোষটা আমারই। সস্তার কোন জায়গাতে বাসা ভাড়া নিলেই হতো। স্যান ফ্রান্সিসকো খুবই ব্যয়বহুল শহর। রুমমেট নিয়ে শেয়ারে একটা আদ্যিকালের পুরোনো এপার্টমেন্টে থাকছি। তাতেই মাসে বারশ ডলারের উপর খরচ হয়ে যাচ্ছে। তাও আবার শুধু বাড়িভাড়া।  আমার গবেষণার কিছু অংশ একটা ব্লগে প্রকাশ করেছিলাম। এতে একজন এজেন্ট জুটে গেছে। মিসেস জুডি উইলসন। ভদ্রমহিলা অনলাইনে আমার সে লেখাগুলো পড়েছিলেন। সেই থেকে বার বার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন নিজের কম্যুইনিটি নিয়ে কিছু লেখার। এতে ইউএনডিপির একটা বড় সড় প্রজেক্ট পেতে পারি। কি লিখবো? আম্মা আর আন্টিদেরকে দেখে ভাবতাম আর যাই হোক এরকম জীবন আমি চাই না। সারা সপ্তাহ চাকরি করো, সংসার কতো। আর সপ্তাহান্তে চল্লিশ জনের জন্য রাঁধতে বসে তাদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়াও নয়তো নিজে তাদের বাসায় দাওয়াত খাও। আম্মাকে দেখে মনে হয় সপ্তাহের পর সপ্তাহ, বছরের পর বছর প্রায় একই কথা বলে জীবন কাটিয়ে দিল। 
‘ভাবি আপনার রান্নাটা খুব ভাল হয়েছে’ … ‘আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে’ … ‘ওজন একটু কমলো নাকি’ … ‘শাড়িটা কী সুন্দর’ … ইত্যাদি, ইত্যাদি।   
আম্মাকে বলতাম, বার বার একই কথা নতুন করে না বলে বরং একটা টেপ রেকর্ডারে কথাগুলো রেকর্ড করে রাখ। দাওয়াতে যাবে আর টেপ রেকর্ডারটা ছেড়ে দেবে।
এখন মনে হচ্ছে আম্মা-আন্টিদের জীবনটা আরেকটু কাছ থেকে খেয়াল করা উচিত ছিল। বাইরে থেকে দেখে যতটা মনে হতো, ততটা বোরিং বোধহয় তা ছিল না। একই ভুল দু’বার করার মানে হয়না। তাই এখন মেরি লীকে খুব খেয়াল করে দেখি। মেয়েটা অবশ্য তা বুঝতে পারে না। ও জানে না যে আমাদের সমস্যাটা এক, সমাধানটা নয়।

৩   
সবাই খালি ব্যাকবেন্চারদের দুঃখের কথা বলে। মনে করে ইঁদুর দৌড়ে যারা এগিয়ে আছে তারা বোধহয় ভালই আছে। বোঝে না যে দৌড়ে প্রথম সারিতে থাকলেও শেষ পররযন্ত সে একজন ইঁদুরই। মেরি লীকে দেখে আমার এমনটা মনে হয়। গত এক বছর ধরে মেয়েটা একটা বয়ফ্রেন্ড খুঁজে মরছে। এখনও পায়নি। আবার লেখাপড়া শুরু করতে চাচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য বয়ফ্রেণ্ড যোগার করা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেতর গেলে তার একটা সম্ভাবনা থাকে। চাকরি-জীবনের থেকে ছাত্র-জীবনে নাকি ডেইট করা সহজ। মেরি লী যদি ওর স্ট্যান্ডার্ডটা একটু কমিয়ে আনে তাহলেই কিন্তু মুখে সবসময় হানি হানি করা একজন সুদর্শন বয়ফ্রেণ্ড সে পেতে পারে। কিন্তু তা তো সে করবে না, অন্ততঃ এই বয়সে। বয়স বাড়লে তেজ এমনিতেই কমে আসে। আমেরিকান মেয়েরা সম্পর্ক ভাংগা-গড়ার ব্যাপারে এতো বেশি সময় নষ্ট করে না। আমরা এশিয়ানরা আবার  ওদের মতো হুটহাটে বিশ্বাসী নই। তবে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের থেকে চায়নীজ মেয়েরা কয়েক ধাপ এগিয়ে।
‘আচ্ছা মেরি লী, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে কাউকে খুঁজে পেলে না?’ মেরি লীকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘ছিল তো একটা সম্পর্ক। সেটা এখন ভেংগে গেছে।’
না, মেরি লী এখন আর চায়নীজ নেই। আমেরিকান হয়ে গেছে। আমাদের আম্মারা ‘আমেরিকান’দের যেরকম মনে করে সেরকম। আম্মাদের ধারণা আমেরিকানদের পারিবারিক মূল্যবোধ ক্ষয়িষ্ণু। আসলে আমরা আম্মাদের বোঝাতে পারবো না ওদের ভেতরকার ব্যাপারগুলো। আবার আমরা নিজেরাও বুঝি না আম্মারা কেন তাদের কম্যুউনিটির একাত্মতা নিয়ে এতো গর্ব বোধ করে। এই কিছুদিন আগে থ্যাকংস গিভিঙ্গের ছুটিতে আরিজোনায় গেলাম। আব্বা-আম্মার কাছে। গত তিনদিনে ছয়টা দাওয়াত খেতে হলো। তার মধ্যে দুটো আবার ছিল আমাদের বাসায়। সবগুলো দাওয়াতে আম্মা আর আন্টিরা ঘুরেফিরে একটা বিষয় নিয়েই কথা বলতে লাগলো। আরিজোনা বাংগালি কম্যিউনিটির সবচেয়ে হট টপিক। মুজতবা আকেংল আর তিরু আন্টির ডিভোর্স হয়ে গেছে। কেন হলো, কি কারণে হলো, কার জন্য হলো – তিনদিন ধরে একই কথা শুনতে শুনতে টিকিট বদলে তাড়াতাড়ি স্যান ফ্রান্সিসকো চলে এলাম। তার উপর আরেক যন্ত্রণা সবাই কেবল বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করে। তাও ভালো যে আম্মা এখনও কিছু বলছে না। আসলে বুঝে গেছে বলে লাভ নেই। তারপরও আমরা মেরি লীর মতো এতো সহজে নিজের সম্পর্ক ভেংগে যাওয়ার কথা বলতে পারবো না। ব্যাপারটা যেন হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে যাওয়ার মতো। আমি নিশ্চিত এখন ওকে ভেংগে যাওয়ার কারণটা জিজ্ঞেস করলে বলবে যে সম্পর্কটা ঠিকঠাক মতো কাজ করছিল না।
‘ভেঙ্গে গেল কেন?’ তাও আবার জিজ্ঞেস করলাম।
‘সম্পর্কটা ঠিকঠাক মতো কাজ করছিল না।’
হাসিটা আর ধরে রাখতে পারলাম না। 
‘কী ব্যাপার? তুমি হাসছো কেন?’
‘হঠাৎ মনে হলো আগে জ্যোতিষীরা যে কাজ করতো সামনের দিনে কম্পিউটার সে কাজ করে দিবে।’
‘ভবিষৎ বলে দেওয়া? এরকম তো অনেক সফটওয়ার আছে।’
‘না, মানে একদম নির্ভুল ভবিষৎ বলে দেবে। এই যেমন ধরো আমি আমার আম্মার মতো জীবন কাটাবো না বলে সবাইকে ছেড়ে এতোদূরে চলে আসলাম। এখন মনে হয় আমার আগেও অনেক মেয়ে এই কাজ করেছে। সে তথ্য উপাত্তগুলো থাকলে কম্পিউটার বলে দিতে পারতো সামনে আমার জন্য কি পরিণতি অপেক্ষা করছে।’ 
‘মজার তো। তোমার মতো আমিও একই ভাবে চিন্তা করতাম। আমার বাবা-মা তো এই সিলিকন ভ্যালিতেই থাকে। নিজের মতো থাকবো বলে তাদের সাথে থাকছি না। আমিও চাইনা আমার জীবনটা ঠিক আমার মায়ের মতো হয়ে যাক।’
‘হু, জানতাম আমাদের সমস্যাটা এক। কিন্তু সমাধানটা ভিন্ন।’
‘সমস্যাটা কি?’
‘আমরা আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক বেশি স্বপ্ন দেখছি। মনে করছি খুব অন্যরকম একটা কিছু করে ফেলব।’
‘এখন তো মনে হচ্ছে যত কিছুই ভাবি না কেন শেষ পররয্ন্ত মায়ের মতোই হয়ে পড়ছি।’
‘আমি এখনও তা ভাবছি না।’ 
‘তোমার প্রজেক্টটার খবর কি?’  
‘এখন পররয্ন্ত কিছুই শুরু করিনি।’
‘তাহলে এতোদিন কি ধরে কি লিকছো?’
‘গবেষণার পেপারটা।’
‘শুরু করবে কবে?’
‘প্লট পাচ্ছি না। লেখাটা এখন উপন্যাসের আদলে দাঁড় করাতে চাচ্ছি।’
‘এই না গতকাল বললে যে তোমাদের প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবন নিয়ে লিখবে।’
‘কিন্তু একটা মূল ঘটনাকে কেন্দ্র করে লিখতে চাচ্ছি। থ্রিলার ধরনের। সেটার প্লট কি হবে তাই ভাবছি।’
‘এক লোক ভাড়ার জন্য বাড়ি দেখতে এসে বাড়িওয়ালাকে খুন করলো সেই প্লটটা তো ভালোই ছিল।’
‘হু, এখনও ভাবছি।’
এই ভাবার পেছনের কারণটা আর ওকে বললাম না। মেরি লীরও একটু আরিজোনার আন্টিদের মতো কৌতুহল রোগ আছে। হ্যান্ডব্যাগ থেকে মিস্টার চৌধুরির কার্ডটা বের করলাম। এখন এই  কাজটা আমি প্রায়ই করি। ভদ্রলোকের বাসা ল্যাম্বার্ট স্ট্রিটের উপর। এই জায়গায় বাসা মানে তো কয়েক মিলিয়ন ডলারের ব্যাপার। গতকাল জিলোডটকম ওয়েব সাইটে গিয়ে দেখেছি ভদ্রলোকের বাসার দাম ছয় মিলিয়ন ডলার। ইন্টারনেটে খুঁজে আরও তথ্য পেলাম। ভদ্রলোক একজন বড় রকমের ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট। তার মানে বহুৎ টাকার মালিক। অথচ আমি এই লোককে শুধু শুধু বেহুদা বুড়ো মনে করে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। না, মিস্টার চৌধুরিকে সেদিন আমার অতোটা অবহেলা করা উচিত হয়নি।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। বুঝতে পারছি আমি আসলে অতোটা ভাল মানুষ নই। মিস্টার চৌধুরির উপর আমার এখন যে আকর্ষণ তৈরি হয়েছে তার পেছনের কারণ ডলার। তবে আমাদের পরিচয়টা ছিল খুব কাকতলীয়। সেখানে কোন বিষয়-আসয়ের ব্যাপার ছিল না।  


ছোট্টবেলায় রাতের বেলা ঘুম পাড়ানোর সময় আম্মা একটা গল্প বলতো। জল দেবতার গল্প। হয়তো বাংলাদেশের কোন রূপকথা। একবার চারদিকে খুব ঝড় শুরু হলো। সাগরের বুকে আকাশ সমান ঢেউ জেগে উঠলো। সেই ঢেউ নেমে যাওয়ার পর দেখা গেল সেখানে এক জল দেবতা স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে। জল দেবতা আর সাগরে ফিরে যেতে চায় না। তারপর অনেক বছর সাধনার পর ধীরে ধীরে সে জল থেকে পাহাড়ে পরিনত হলো। এক সময় সেই পাহাড়ের ঢালে ঢালে জনপদ গড়ে উঠলো। তারপর ধীরে ধীরে জনভারে সে হয়ে গেলো এক ব্যস্ত নগরী। সেখানে আর জলদেবতার কোন চিহ্ন থাকল না। কিন্তু কেউ জানে না সেই জলদেবতার মনে আসলে কি ছিল। তবে মুখে মুখে কিছু গল্প প্রচলিত ছিল। এই জলদেবতা হঠাৎ যেমনি একদিন সাগর থেকে জেগে উঠেছিল, ঠিক তেমনি হঠাৎ একদিন সাগরে মিলে যেতে পারে। 
এখন তো অনেক বড় হয়ে গেছি। আম্মাও আর কাছে নেই। তারপরও প্রতিরাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে একবার করে সেই জলদেবতার গল্পটি মনে পড়ে। মনে হয় এই স্যান ফ্রান্সিসকো শহরটি আসলে সেই জলদেবতা। আমার এপার্টমেন্টটি সেই জেগে উঠা পাহাড়ের একটি খাঁজে বানানো হয়েছে। বেডরুমের জানালা খুললে দেখতে পাই এই শহরটি পাহাড়ের ধাপে ধাপে ক্রমশ নিচে নেমে এক সময় সাগরে মিশে গেছে। এতো সুন্দর একটা শহর! অথচ ভূমিকম্পে যে কোন একদিন মিলিয়ে যেতে পারে। অবশ্য শহরের ব্যস্ত মানুষ এইসব খুব একটা মনে রাখে না। খুব উচ্চাশা না থাকলে এই শহরে টিকে থাকা যায় না। আবার উচ্চাশা মানুষকে জীবনবাদী করে তোলে। জীবনবাদী মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। একেবারে মুখোমুখি না হওয়ার আগ পররয্ন্ত মৃত্যুচিন্তা সেখানে হানা দেয়না। জলদেবতার কথা যখন ভাবি তখন তার জেগে উঠার ইচ্ছাটি আমাকে খুব আকর্ষণ করে। কেন জানি তাকে খুব জীবন্ত বলে মনে হয়। মনে হয় জলদেবতার নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে আমরা জড়িয়ে আছি। জানালা খুললে সাগরের ঠাণ্ডা বাতাস হু হু করে ঘরে ঢুলে পড়ে। আমি প্রাণ ভরে শ্বাস নিই। মোটা কম্বলের মধ্যে জড়সড় হয়ে বাইরে সেখানে জেগে উঠা রাতের শহর। ঢালু জনপদের ভাজে ভাজে হাজার-হাজার, কোটি-কোটি তড়িৎ জোনাকী পোকা। ওরা নিভতে জানেনা। একেকটা আলো, একেকটা গল্প। আর আমার কি-বোর্ড স্থির আঙ্গুল গল্পের অভাবে।
আচ্ছা এই শহরের বুড়োরাও কি জীবনবাদী? হ্যাঁ, গতরাতে ঠিক এই কথাটি ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর পরদিন স্টারবাকস কফিশপে মিস্টার চৌধুরি আমাকে উনার বিজনেস কার্ড দিলেন। অথচ গত চারমাস ধরে এখানে আমি নিয়মিত আসছি। অফিস থেকে ফিরে ল্যাপটপ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি এখানটায়। আমার এপার্টমেন্ট থেকে দু’ব্লক দূরে। কিন্তু রাস্তা এতো খাঁড়া যে তাতেই প্রায় হাপাতে শুরু করে দেই। কাছেই বিখ্যাত ল্যাম্বার্ট স্ট্রীট। মিস্টার চৌধুরি সেখানেই থাকেন। উনিও দিনে অন্ততঃ দু’বার এখানে আসবেন। অনেকদিন ধরেই আমাকে খেয়াল করছিলেন। কিন্তু সেদিনই আমার টেবিলের সামনে এসে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন,’কি লিখছো?’ তাও আবার একেবারে বাংলায়।
‘আমি বাংলা জানি সেটা বুঝলেন কি করে?’আমি যথেষ্টই চমকে গিয়েছিলাম। 
‘সেল ফোনে বাংলায় কথা বলছিলে।’ 
‘ও হ্যাঁ। বাসার আম্মার মার্শাল ল’ জারি ছিল। পরিবারের সবার সাথে বাংলায় কথা বলতে হবে।’
‘তোমার কথা কিছুটা আড়ি পেতে শুনেছি। আরিজোনা থেকে এসেছো?’
‘তাও জানেন দেখি?’
‘কেমন গরম এখন ওখানে?’
‘গাড়ির বনেট একদম ফ্রাইপ্যান। একটা ডিম ভেংগে ছেড়ে দিলে ভাজি হয়ে যাবে।’
‘অথচ এখানে এখন জ্যাকেট পড়ে আছো।’
এই কফিশপটার জানালা দিয়ে সাগর দেখা যায়। অনেকটা নীচে। সাগর না বলে উপসাগর বলাটাই বেশি অসংগত। এখানে অবশ্য সবাই বে বলে। সাগরপাড়ের কোলাহল আর হু হু বাতাস দুটোই খুব জীবন্ত। জীবন জীবনকে জাগিয়ে দেয়। তাই এখানে আসা। 
‘বোঝা যাচ্ছে আপনি অনেকদিন ধরে আমেরিকাতে আছেন।’আমি বললাম।
‘তা আমি প্রায় পয়তাল্লিশ বছরের উপরে তো হবেই। তোমার জন্মের অনেক অনেক আগে থেকে। আমার পাকা চুল দেখে মনে হলো?’
‘না, আপনি জলবায়ু নিয়ে কথা বলছেন তাই। আমেরিকানরা সাধারণত পরিচয়ের শুরুতে তাই করে। বাংলাদেশি কমিউনিটির লোকজনদের আমি তা করতে দেখিনি।’
‘আমার আসলে বাংলাদেশ কমিউনিটির সাথে একদমই যোগাযোগ নেই।’
‘কিন্তু আগ্রহ তো আছে। এই আমাকে বাংলাতে কথা বলতে দেখেই এগিয়ে আসলেন।’
‘আমি বিয়ে করেছিলাম আমেরিকান। কাজ, সোসালাইজেশন সবই ছিল আমেরিকানদের সাথে। অথচ এখন নিজের দেশ, বাংলা এসব খুব টানে। একেই বোধহয় বলে শেকড়ের টান।’
‘আমার আব্বাও খুব শেকড়ের টানের কথা বলতেন। তাই আমাদের বাংলা শিখিয়েছেন। বলতে পারি কিন্তু লিখতে পারিনা।’
‘লেখালেখি কি তোমার শখ নাকি চাকরির প্রয়োজনে লেখো?’
‘দুটোই বলতে পারেন।  লিখতে পারলে ভাল লাগে। এখন বিভিন্ন প্রজক্টের সাথে জড়িয়ে আছি। তার প্রয়োজনে লিখতে হয়।’
‘তাই? কি লিখছো?’
‘এখন ভাবছি সান ফ্রানসিসকোর বয়স্ক লোকদের উপর একটা গবেষণা চালাতে পারি। এ বিষয়ে লেখার চেষ্ঠা করছি।’
‘আমি কিন্তু তোমার এ প্রজক্টের জন্য ভালো একটা বিষয় হতে পারি। আমার কার্ডটা রাখো।’
বুড়ো মানুষদের অনেক শখ থাকে। এপার্টমেন্টে ফিরে এসে মিস্টার চৌধুরির কার্ডটা ফেলে দিতে গিয়ে দেখি ভদ্রলোকের বাসা ল্যাম্বার্ট স্ট্রিটের উপর। খুব উচ্চস্তরের ধনী না হলে এখানে থাকা যায় না। কার্ডটা হাতে আটকে রইলো।


ল্যাম্বার্ট স্ট্রীটটা বড়ই অদ্ভুত। সাপের মতো এঁকেবেকে পাহাড়ের চুঁড়া থেকে ক্রমশ ঢালু হয়ে সৈকতের দিকে নেমে গেছে। রাস্তাটিতে পীচের বদলে ইটের গাঁথুনী। প্রাকৃতিক আর নাগরিক সৌন্দররযের যথার্থ যুথঃবন্ধন। আমেরিকানরা আসলে অনেক দূরদর্শী। আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল যে গিয়েছিল একদিন এই রাস্তার উপর দিয়ে প্রতিদিন শত শত পর্যটক গাড়ি চালিয়ে যাবে। সেভাবেই তারা প্রস্তুতি নিয়েছে। ল্যাম্বার্ট স্ট্রীটে উঠার পথট ভয়াবহ রকমের খাড়া। মেরি লী যেবার আমাকে সাথে করে প্রথম এই পথ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল আমি তো রীতিমতো চিৎকার চেচামেচি শুরু করেছিলাম। মনে হচ্ছিল গাড়ির বনেটটা উল্লম্ব হয়ে সোজা আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। যে কোন মুহূর্তে তা পিছলে পরে যেতে পারে। আমার পক্ষে এই রাস্তায় গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। তাই হেঁটে হেঁটেই মিস্টার চৌধুরির বাসা খুঁজে নিলাম।
‘আচ্ছা আপনার বাসার পাশ দিয়ে যে সবসময় এতো গাড়ি যাচ্ছে তাতে বিরক্ত হননা?’ মিস্টার চৌধুরির বাসার লিভিংরুমে জানালা দিয়ে এতো গাড়ির বহর যেতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম।
‘সরকার আমাদের এরজন্য ভর্তূকি দেয়।’
লিভিংরুম থেকে আমরা নুকে এসে বসলাম। রান্নাঘরের পাশে খাওয়ার জন্য ছোট্ট একটি জায়গা। ডাইনিং টেবিলটা গোল। পাশেই জানলা। বিশাল। ওপাশে বাগান। সেখানে নানা জাতের অর্কিড। আর রয়েছে সারিবদ্ধ ম্যাপল আর পাইন গাছ। বাগানটা মায়াময়। ছায়াময়। সীমানা জুড়ে কাঁটা তারের বেড়া। আর তার ওপাশেই পাহাড়টা হঠাৎ ঢালু হয়ে নেমে গেছে। তারপর বেলাভূমি। সেখানে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে আছড়ে পরছে। ঘরের মধ্যে মৃদুস্বরে বাজছে বিটোভেনের মিউজিক। আমার হাতে কফির মগ। মনে হচ্ছে ক্রমশ সম্মোহিত হয়ে পড়ছি। এরকম একটি পরিবেশ অনেকবার আমার কল্পনায় এসেছে, স্বপ্নে এসেছে। বাস্তবে আগে দেখিনি। 
‘নিজেকে আপনি কতোটা ভাগ্যবান বলে মনে করেন?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘সামিয়া, আমাকে তোমার খুব ভাগ্যবান বলে মনে হয়?’
‘এরকম একটা সুন্দর বাসায় থাকেন, ডাইনিং টেবিলে বসেই পাইনের বন,পাহাড় আর সাগরের ঢেউ দেখতে পারেন – ভাগ্যবান ভাববো না?’
‘জান, আমি খুবই একা।’
‘সেটা কি স্বাভাবিক নয়? যারা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যায় তাদের তেমন কোন বন্ধু-বান্ধব থাকে না।’
‘একদম আমার মনের কথাটা বলে দিলে। দুঃখটা এজন্য বেশি যে ছেলেদের সাথেও আমার ভালো সম্পর্ক নেই।’
‘কয় ছেলে আপনার?’
‘দুই ছেলে। সম্পর্কটা ডলার চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে আটকে গেছে। সবসময়ই ওদের সবচেয়ে দামী স্কুল-কলেজে পড়িয়েছি। বাড়ি-গাড়ি কেনার সময় যা চেয়েছে তাই দিয়েছি। ডলারে টান পরলেই শুধু আমার কথা ওদের মনে পড়ে। বড়ছেলে এখন আমাকে দশ মিলিয়ন ডলার লিখে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে।’
‘আপনি চাচ্ছেন না?’
‘এর আগেও কয়েক মিলিয়ন ডলার দিয়েছিলাম। কিন্তু দিলে কি হবে? ডিভোর্স করে পয়সা খুইয়ে ফেলে।’ 
‘আপনার আর কোন আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক নেই?’
‘ভাইবোনদের ইমিগ্রেশন দিয়ে আমেরিকায় নিয়ে এসেছিলাম। আসলে আমার স্ত্রী আমেরিকান ছিলো তো। তাই কারো সাথে অতোটা যোগাযোগ রাখতে পারিনি।’
‘শুধু কি আপনার স্ত্রীর কারণে? এমনও তো হতে পারে আপনি উনাদেরকে দোতলা থেকে উঁকি মেরে দেখেছেন শুধু? হয়তো আপনাদের ইন্টারেস্ট ম্যাচ করেনি বলে সম্পর্কগুলো টিকে থাকেনি।’
‘তুমি ঠিক মনের কথাটি বের করে নিতে পার। ঠিকই বলেছো। আত্মীয়স্বজন বলো আর বন্ধু-বান্ধবই বলো ইন্টারেস্ট ম্যাচ না করলে সম্পর্ক টিকে থাকে না। ডলারের প্রয়োজন ছাড়া পুরনো কেউ ফোন করেনা।’
‘ইন্টারেস্ট ম্যাচ করে এমন কোন বন্ধু-বান্ধব ছিল না?’
‘সপ্তাহান্তে যাদের সাথে পার্টি করেছি, বন্ধু-বান্ধব বলে ভেবে এসেছি, তাদের অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। এখন মনে হয় আমরা কি আসলেও বন্ধু ছিলাম?’
‘এই ব্যাপারটা আমার কাছেও বেশ গোলমেলে ঠেকে। আরিজোনাতে আমার আম্মা আর আন্টিরা মিলে প্রতি সপ্তাহে পার্টি করছে। দেখে মনে হবে সবাই কতো আপন। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে তাদের সতর্ক থেকে অন্যের মন জুগিয়ে কথা বলতে হয়। এজন্য সবসময় সবাই সবার প্রশংসা করছে। কেন জানি তাদের বন্ধুত্বতাকে মেকী বলে মনে হয়।’
‘আমাদের জন্য এখানে অনেক ক্লাব আছে। কিন্তু ঘরের মধ্যে ঢুকলেই নিরবতা। এই বিষয়টা আমাকে খুব ভাবায়। অনেকেই সাথে একটা পাহাড়াদার কুকুর রাখে। আমার আবার কুকুরে এলার্জি।’ মিস্টার চৌধুরি বলে যেতে থাকেন উনার কথা।
আমি শুধু চুপচাপ শুনে যাই। একজন দুঃখী বাবার কথা। একজন একাকী মানুষের কথা। পাহাড়ে উঠতে পারাটা এতো সহজ নয়। আমরা সেখানে উঠতে না পেরে অসহায় শেয়ালের মতো আঙ্গুর ফলকে টক বলি। মিস্টার চৌধুরিকে দেখে মনে হলো আঙ্গুর ফল আসলেই টক।
ঘরের মধ্যে হঠাৎ করে নাইটিংগেলের ডাক। পাখীটা দুইবার ডেকে থেমে গেল। আবার ডাকলো। 
বুঝতে একটু সময় লাগলো যে আসলে কলিং বেল বাজছে। 
এসেছিল উনার বড়ছেলে। ছেলের বয়স কমপক্ষে পঁয়তাল্লিশ তো হবেই। মিস্টার চৌধুরির সাথে চেহারায় অনেক  মিল আছে। তবে ছেলের শরীর উনার মতো পেটানো নয়। 
মিস্টার চৌধুরি আমার সাথে ছেলের পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘আমার বড় ছেলে আরশাদ চৌধুরি।’
‘আমাকে তুমি আরশাদ বলতে পারো।’ মিস্টার চৌধুরির ছেলে আমার দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলেন। চোখদুটি কেমন যেন ধূর্ত। সেখানে স্পষ্টত ব্যঙ্গতা ফুটে রয়েছে। 
মিস্টার চৌধুরি কিচেনে কফি মেকারের কাছে গেলেন। পেছন পেছন ছেলেও বাবাকে অনুসরণ করলেন। 
আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। বাবা-ছেলের কথোপকথান শোনাটা এড়িয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। পারলাম না। কানে এলো, ‘কী তোমার নতুন গার্লফ্রেন্ড নাকি?’ 


”আজকে দুপুরে ক্রেইজী বাফেতে যাবে?”
জুতোর ফিতে বাঁধা শেষ করে মেরি লির দিকে তাকাই। সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে। এখনও ঘুমের পোষাক পড়ে আছে। মুখের মধ্যে কি একটা ক্রিম মাখছে। আগে দূর থেকে দেখে ভাবতাম চায়নীজ-জাপানীজ মেয়েরা জন্মগতভাবেই মসৃণ ত্বক নিয়ে জন্মায়। এখন চায়নীজ বংশোদ্ভুত একটা মেয়েকে রুটমেট হিসেবে পেয়ে মনে হচ্ছে ওরা আসলে বেশ রূপচর্চার মধ্যে থাকে। সপ্তাহের পাঁচদিন অফিস থেকে ফিরে এসে কি সব লতা-পাতা সিদ্ধ করে দুটো কাঠি দিয়ে কচমচ করে খায়। শনিবার দুপুরবেলা আমাদের একসাথে রেস্টুরেন্টে যাওয়াটা একটা নিয়মের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। ক্রেইজী বাফেতে ওরিয়েন্টাল খাবার বেশি। যত রকম জাপানী শুশি থাকতে পারে তার সবই আছে। শুশি দেখতে খুব সুন্দর। কিন্তু খেতে গেলেই মনে হয় ভেতরে কাঁচা মাছ। গা গুলে আসে। খেতে পারি না। আমি শুধু যাই মাহি-মাহি, স্ন্যাপার আর স্যামনের মতো সামুদ্রিক মাছ খেতে। ওগুলো বেক করে রাখে। এখন অবশ্য শামুক খেতেও খুব ভালো লাগে। মেরি লি বোধহয় সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে গলদা চিংড়ি আর ক্র্যাব। আর নুডলস তো আছেই। মেয়েটা এই একটা দিনই খায়। চায়নীজ মেয়েগুলো এতো শুকনো তারপরও নিজেদেরকে মোটা ভেবে অভূক্ত থাকে। ক্রেইজী বাফের সমস্যা হলো এর দরজা খুললেই নাকে একটা বোঁটকা গন্ধ এসে ঢেকে। মনে হয় মাছ পঁচা গন্ধ। তার থেকে আফগান খাবার অনেক ভালো। 
বললাম,”চলো আজকে কাবাব আর নান খেতে যাই?”
আমার কথা শুনে মেরি লির কপালে কিছুটা কুচকে গেলো। মেয়েটা ভাবছে। কাবাব তো ওর পছন্দ তাহলে এতো ভাবছে কেন? পরমূর্হুতেই নিজের ভুলটা বুঝতে পারলাম। মেরি লির কাছে ক্রেইজী বাফেতে যাবার উদ্দেশ্য শুধু খাবারই নয়। অন্য আরও একটা কারণ থাকতে পারে।   
‘চল যাই।’ 
গাড়ি চালাচ্ছে মেরি লি। বলল, ‘আচ্ছা তোমার কোন বয়ফ্রেন্ড পেতে ইচ্ছে করে না?’
‘তোমার মতো সুন্দরী হলে ইচ্ছে করতো। অসুন্দর মেয়েদের অনেক সুবিধা আছে।’
‘কিরকম?’
‘ছেলেরা সাধারণত মেয়েদের চেহারা দেখে পছন্দ করে। তাই আমাকে তেমন কেউ একটা পছন্দ করে না। আর করলেও যারা করে তাদের আমার পছন্দ নয়। সব মিলিয়ে তাই মাথা থেকে প্রেমচিন্তা বাদ দিয়েছে।’
‘কতদিন আর একা থাকতে পারবে?’
‘তুমি তো দেখি আমার পূর্বপুরুষ বাংলাদেশিদের মতো কথা বলছো।’
‘ভুলে যাও কেন যে আমরা এশিয়ান-আমেরিকান। কিছুটা হলেও আমাদের দুজনের পূর্ব-পুরুষরা একইরকমভাবে চিন্তা করতেন।’
‘আমি আরিজোনা গেলে আমার আম্মার বান্ধবীরা সবাই আমাকে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে থাকে।’
‘তুমি আবার লেসবিয়ান নও তো? আমার প্রেমে পড়নি তো আবার?’
‘এইবার তুমি আমেরিকানদের মতো কথা বলছো।’
‘না, আমেরিকানরা এই বিষয় নিয়ে অতো হাসিঠাট্টা করে না।’
‘হু কথা ঠিক। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় নিজেদের আধুনিক প্রমাণ করার জন্য এশিয়ানরা বরং এই বিষয়ে অনেক খোলামেলা।’  
‘আজকে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।’
‘সেটা আমি জানি।’
টেবিলে খাবার নিয়ে বসার পর সারপ্রাইজটা কি তা বোঝা গেল। অবশেষে মেরি লির একজন বয়ফ্রেন্ড হয়েছে। আইনজীবি। তাও আবার ক্রাইম নিয়ে কাজ করে। সদ্যই বার-এর পরীক্ষায় পাশ করেছে। ছেলেটার বাবা আমেরিকান এবং মা চায়নিজ। স্টিভেন প্যাট। দুজনে পাশাপাশি বসেছে। মানিকজোড়। মনে হচ্ছে সম্পর্কটাটিকে যাবে।
‘মেরি লি বললো তুমি একজন লেখক।’
‘হ্যা জান, ও না ল্যাম্বার্ট স্ট্রিটে থাকে একজন বিলিয়নিয়ারের জীবনী লিখছে।’ মেরি লী খুব উচ্ছ্বসিতভাবে উত্তর দিল। 
‘না, সেই হিসেবে আমি লেখক নই। তবে রুটি-রুজির কারণে আমাকে এখন লিখতে হয়। আর যেই ভদ্রলোকের কথা বল্ছো তিনি খুব বড়লোক। তবে বিলিয়নিয়ার নয়।’ মেরি লির কথার একটু প্রতিবাদ জানালাম।
স্টিভেন হাসলো। আমার মনে পড়লো মিস্টার চৌধুরির বড় ছেলের কথা। আরশাদ চৌধুরি। উনার সাথে আরেকদিন দেখা হয়েছিল। আমার সেই পরিচিত কফিশপে। স্টারবাকসে। আরশাদ আগ বাড়িয়ে এসে কথা বলে গেল। যার অধিকাংশই শ্রুতিমধুর ছিল না।


এখন মনে হচ্ছে স্যান ফ্রান্সিসকোতে চলে আসার সিদ্ধান্তটি খারাপ ছিল না। হ্যাঁ, মানছি অনেক ঝুঁকি ছিল, ক্রেডিট কার্ডে দিন দিন ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু অনেক কিছু দেখছি, জানছি, শিখছি। মানুষ্জনের সাথে যোগাযোগ বাড়ছে। অস্পষ্ট ধারণাগুলো দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা আমার প্রজেক্টটাকে একটা কাঠামোতে আনতে পারছি। আর তাই গবেষণার থিসিসটা দিনদিন বেগবান হচ্ছে। এখন অফিস থেকেই সরাসরি স্টারবাকসে ছুটে আসি। কোনার দিকের টেবিলটা প্রায়ই খালি থাকে। ভাল লক্ষণ। এখানে বসতে পারলে মনোঃসংযোগে সমস্যা হয়না। পাশের জানালায় ফুটপাথে ব্যস্ত মানুষের ছুটে চলা। ল্যাপটপে খটাখট অক্ষরগুলো টাইপ করছিলাম।  
‘কেমন আছ?’
মনিটর থেকে মাথা তুলে তাকালাম। সামনে আরশাদ চৌধুরি দাঁড়িয়ে আছেন। আচ্ছা, এই লোক কি আমাকে অনুসরণ করছেন? এর আগেও এখানে দেখা হয়েছিল। এই কফি শপেই। সেদিনের মতো যদি আজকেও উল্টাপাল্টা কথা বলে তাহলে আমি কিন্তু খুব একটা ভালোমেয়ে থাকবো না।
একটু কড়া স্বরে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম,’ভালো আছি।’
‘কি আশ্চররয দেখ, আমাদের আজকেও এখানে দেখা হয়ে গেল।’
‘আশ্চররয হওয়ার কিছু নেই। আমি এখানে সবসময়ই আসি। আপনি নতুন আসা শুরু করেছেন তাই আমার সাথে দেখা হয়ে যাচ্ছে।’
‘বাহ, তুমি তো দেখি খুব বুদ্ধিমান। এজন্যই কি আমার বাবা তোমাকে এতো পছন্দ করেন?’
এই পন্চাশোর্ধ বয়সের লোকের আচরণ তো দেখি খুবই বালখিল্য! উনার বাবা আমাকে পছন্দ করেন বলে বাচ্চাদের মতো ঠোট ফোলাচ্ছেন। দ্রুতই আমার দৃষ্টি মনিটরের দিকে ফেরালাম। ভদ্রলোককে শুধু এড়িয়ে যেতে চাইলাম না, তা বোঝাতেও চাইলাম।
‘এখানে বসতে পারি? আফটার অল এটি একটি পাবলিক প্লেস’ আমার উত্তরের অপেক্ষাতে না থেকেই খালি চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়লেন।
‘সামিয়া, তোমাকে কয়েকটি কথা সরাসরি বলতে চাই।’
আরশাদ চৌধুরির দিকে আমার দৃষ্টি ফেরাতেই হলো। সুদর্শণ হবার সব উপকরণই ভদ্রলোকের ছিল। কিন্তু বেশ স্থূল হয়ে যাওয়ায় এখন আর তাকে হ্যান্ডশাম বলা যাবে না। মোটা মানুষরা সাধারণত দেখতে একটু কোমল হয়। এই লোকের চেহারাটা নিষ্টুর প্রকৃতির। হয়তো আমারই দেখার ভুল।   
‘কী বলবেন?’
‘আমার আব্বার সাথে তোমার কতদিনের সম্পর্ক?’
‘কি বলতে চান?’
‘আমার সম্পর্কে নিশ্চয় বাবার কাছে ভালো কিছু শোননি। আমার দিকের গল্পটাও তোমার জানা দরকার। আজকে বাবা এতো ধনী হয়েছে। কিন্তু বড় সন্তান হিসেবে আমি তো দেখেছিলাম একটা সময় আমরা কী পরিমাণ অর্থকষ্টের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। তখন আমাকে না পাঠিয়েছে ভাল স্কুলে, না দিয়েছে সময়। এই রকম অবস্থায় বড় হলে হাইস্কুলে যেয়ে একটা ছেলের বিগড়াতে সময় লাগে না। হতাশা এড়াবার জন্যই ত্খন আমি ড্রাগ নিতে শুরু করি। এখানে আমার দোষটা কোথায়?’
‘দেখুন আপনাদের পারিবারিক বিষয়ে আমি কিন্তু মডিয়েটর হতে পারবো না। আপনারা বাবা আর ছেলে মিলে আপনাদের পারিবারিক সমস্যাগুলো মিটিয়ে নিচ্ছেন না কেন?’
‘তোমাকে বলছি কারণ বাবার সাথে তোমার সম্পর্ক ভাল।’
‘আপনার ব্য্ক্তিগত সমস্যার মধ্যে আমাকে টানবেন না প্লীজ।’ 
‘ও হো, তাই? আচ্ছা বলো তো একজন মাল্টি-মিলিয়নার বৃদ্ধ পাত্র হিসেবে বেশ আকর্ষনীয় বলেই জানি। তুমি কি মনে কর?’
না, এই লোক আবারও আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছে। কম্পিউটার গুটিয়ে নিলাম। এখন কফিশপ থেকে ছুটে বেড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। আরশাদ চৌধুরি শুধু নোংরা নন, জঘ্ণ্যও।


’অনেকদিন পর কেউ আমার জন্য ফুল নিয়ে আসলো।’
‘কত বছরে পা দিলেন আজকে?’
‘আশি।’
মিস্টার চৌধুরির প্রতিদিন জগিং করা পেটানো শরীর দেখলে মনে হবে না আশি বছর বয়স।
‘গতকাল ডাক্তারের কাছে আপনার যাওয়ার কথা ছিল। কি বললো ডাক্তার?’
‘সব ঠিক আছে। আমি মনে করছি এই আশি বছরের দশকটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হবে। এবার কিন্তু তোমার এপার্টমেন্টে আমাকে দাওয়াত দিতে হবে।’
‘আগের এপার্টমেন্ট বদলে এখন আমি স্টুডিওতে উঠে গেছি।’
‘কেন?’
‘আমার রুমমেট মেরি লী এখন ওর বয়ফ্রেণ্ডের সাথে থাকছে। শীঘ্রই ওরা বিয়ে করছে।’
‘কফি চলবে তো?’
না চলার কোন কারণই নেই। আমার পছন্দ ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা ক্যাপাচিনো। মিস্টার চৌধুরি সেটা বানায় ভাল। কফির কাপ হাতে গোল ডাইনিং টেবিলটায় এসে বসি। এই টেবিলটার উপরটা আইভরির। সেখানে অসম্ভব সূক্ষ্মকাজ। চায়নীজ সামুরাই, কয়েক স্তর বিশিষ্ট টিনের চালার চায়নীজ ঘরবাড়ি, গাছপালা, পথঘাট, মানুষজন – সবকিছু মিলিয়ে একটা গল্প ফুটে উঠেছে। টেবিলটার উপর একটা মোটা কাঁচ বসানো। গল্পটাকে রক্ষা করছে। আচ্ছা, এই টেবিলটার বয়স কতো হবে? কোথাও কোন আচর নেই। প্রাণহীন বস্তু দীর্ঘ সময়ের জন্য  চিরযৌবনা। সেখানে প্রাণময় মানুষ খুব দ্রুত নিশেষঃ হয়ে যায়। জানালা দিয়ে বেলাভূমিতে আছরে পরা সাগরের ঢেউ গুণতে থাকি। আলতো চুমুক দিই কফির কাপে। আগে ভাবতাম মানুষ সারাজীবন ধরে খুব অনর্থকভাবে অর্থের পেছনে ছুটে। কিন্তু সাগরের মুখোমুখী ঠিক এই জায়গায় বসলে সেই অর্থকে অনেক পরমার্থ বলে মনে হয়। অর্থ থাকলে খুব আয়েসে সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। সৈকত,পাইন বন, পাহাড় আর ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা ক্যাপাচিনো – সবকিছু খুব সহজেই হাতের নাগালে। একটু নড়েচড়ে বসি।  নাইটিংগেল পাখীটা আবার একটু ডেকে উঠলো কি? আরশাদ চৌধুরী রীতি মতো দুঃস্বপ্ন। আমার পেছনে গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছে। না, বিষয়টিকে আর বাড়তে দেওয়া যায় না। মিস্টার চৌধুরীর সাথে এই ব্যাপারে একটু কথা বলা দরকার। আমি সিড়ির দিকে তাকালাম। উনি নামছেন। হাতে একটি বাক্স। সাদাটে। বোঝা যাচ্ছে আইভরির। কাছে আসার পর দেখলাম আমার অনুমান সথিক। এখানেও সূক্ষ্ম কারুকাজ। কোন চায়নিজ শিল্পী তার গ্রামের দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছে। লোকালয়, মানুষজন, হাটবাজার, গাছপালা। মিস্টার চৌধুরি বাক্সটির মুখ খুললেন। ভেতরে কি থাকতে পারে সে ব্যাপারে ধারণা করতে পারছিলাম। এটা মেয়েদের একটা স্বাভাবিক ইন্সটিংক্স। বাস্তবে তা মিলে গেল। তারপরও বেশ  হকচকিয়ে গেলাম। ভেতরটা দেখে আগেকার দিনের জলদস্যুদের গুপ্তধনের কথা মনে হলো। বাক্স ভর্তি হিরা-জহরত, মনি-মুক্তা। 
‘আমার স্ত্রীর গয়নার বাক্স।’মিস্টার চৌধুরি বললেন।
‘উনি নিশ্চয় খুব আইভরি পছন্দ করতেন?’
‘কিভাবে বুঝলে?’
‘আপনার বাসার সব জায়গাতেই তো আইভরি।’
‘আমার জন্মদিনে আমি তোমাকে একটা উপহার দিতে চাই। এই বাক্সের মধ্যে থেকে তোমার যা যা পছন্দ হয় তা তুমি নিয়ে যেতে পার।’
আমি রীতিমতো থ হয়ে গেলাম। মুখের উপর হঠাৎ গরম বাতাসের ঝাপটা। একটু বমির ভাব আসছে। মাথাটা একটু দুলে উঠলো। আবার মাইগ্রেনের ব্যাথাটা ফিরে আসবে নাকি? মিস্টার চৌধুরি কি আমাকে পরীক্ষা করে দেখছেন? এই গয়নার বাক্সটা কি তারই একটা সাজানো অংশ? এতোদিন ধরে আমাদের কথাবার্তা হবার পর উনি আমার সম্পর্কে এমন একটা ধারণায় আসতে পারলেন? এর পেছনে উনার বড় ছেলের হাত নেই তো? 
কিছু কথা শুনিয়ে দিতে চাইলাম, কিন্তু তার আগেই প্রাণহীন নাইটেংগল পাখীটা ডেকে উঠলো। সত্যি সত্যিই। এক বার। দু’বার। এ ডাকের অর্থ আমি এখন বুঝে গেছে। বুঝে গেছি দরজার ওপাশে এখন কে দাঁড়িয়ে আছে। মিস্টার চৌধুরি দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। তবে আবার দেখা হচ্ছে আরশাদ চৌধুরির সাথে!
আরশাদ সাহেব সরাসরি এদিকটাতে চলে আসলেন। আমার সামনে দাঁড়ালেন। ভদ্রলোকের চোখের ভাষা একেবারে পানির মতো স্বচ্ছ। সেখানে স্পষ্ট হয়ে উঠছে কৌতুকামিশ্রিত ঘৃণা। হয়তো আগেও তা এমনটা ছিল। তখন খেয়াল করিনি। করলাম আজকে। ঐ চোখজোড়া বার বার গয়নার বাক্সের দিকে চলে যাচ্ছে। বাক্সটা আমার সামনে হাট হয়ে খোলা আছে। কীরকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি! আরশাদ সাহেব তো এখন দু’য়ে দু’য়ে চার মেলাবেন। বানাতে পারবেন একটা বিশ্বাসযোগ্য গল্প। আমি তাড়াতাড়ি করে বাক্সটার মুখ বন্ধ করে দিলাম। এবার উঠে দাঁড়ালাম। তারপরই মনে হলো কাজটা ঠিক হলো না। এমন আচরণ করছি যেন চোরের মন পুলিশ পুলিশ। আজকে তো আরশাদ সাহেবের বাবার জন্মদিন। বাবা-ছেলের যতই শত্রুতা থাকুন না কেন জন্মদিনের কথা তো কেউ ভুলতে পারে না। আমার আগেই খেয়াল করা উচিত ছিল যে আরশাদ সাহেবের হাতে একটা বড়সড় বাক্স। এন্ডারশন’ বেকারীর কেকের প্যাকেট।  এবার আমি চলে যেতে চাইলাম। এই কেক কাটার ইভেন্টটাতে বাবা আর ছেলের মিলন হোক। 
‘আরে যাচ্ছ কোথায়? এখন সবাই মিলে আমরা কেক কাটবো।’আরশাদ সাহেব আমাকে পেছন থেকে ডাকলেন।
মিস্টার আলমও বলে উঠলেন, ‘অনেকদিন পর আরশাদ আমার জন্মদিনের কথা মনে করেছে। কেকটা কেটেই যাও সামিয়া।’
কিচেন পেড়িয়ে আমি অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলাম। দু’জনের কথা শুনে এবার পিছন ফিরলাম। তখন আরশাদ চৌধুরি অনুরোধ করলেন, ‘কিচেন থেকে একটা ছুড়ি আনবে, প্লিজ?’
নাইফ হোল্ডারে অনেকগুলো ছুড়ি সাজানো আছে। 
‘কেকটা বেশ বড়। সবচেয়ে বড়টা এনো কিন্তু।’ আবারও আরশাদ চৌধুরির কন্ঠস্বর।
মিস্টার আলম কেক কাটলেন আর আমরা দুজন একসাথে গেয়ে উঠলামঃ
হ্যাপি বার্থডে টু ইউ
হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ
‘তুমি কেকটা কেটে ফেলো। আমি ক্যাবিনেট থেকে কয়েকটা প্লেট নিয়ে আসছি।’ কথাগুলো বলে আরশাদ চৌধুরি কিচেনে চলে গেলেন। 
মিস্টার চৌধুরিকে দেখতে বেশ আনন্দিত লাগছে। হয়তো অনেকদিন পর একটা পরিবারের স্বাদ পাচ্ছেন। ডলার আর পরিবার পাশে থাকলে বৃদ্ধ বয়সটা তাহলে খুব একটা খারাপ সময় নয়। তিনটা প্লেট নিয়ে আরশাদ চৌধুরি ফিরে আসছেন। এখন আমার খারাপ লাগতে থাকল। আমি শুধু শুধুই সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠছিলাম। অযথা বাড়াবাড়ি। এতোসব কিছুর দরকার ছিল না।


সত্যি বলতে কি আরশাদ চৌধুরি অনেকভাবেই আমার উপকার করেছেন। বাবা-ছেলের লাভ-হেইট সম্পর্কটা আমাকে অনেক ভাবে ভাবিয়েছে। হয়তো আরশাদ সাহেবের অভিমানের অনেক যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। নিজেকে দিয়েই আমি তা অনুধাবণ করতে পারি।  আব্বা-আম্মার উপর আমার নিজের ভেতরেও অনেক অভিমান জমা হয়ে আছে। এই দিক থেকে আরশাদ সাহেব আর আমি কি এক অবস্থানে নেই? আমিও তো ভেবে বসে আছি যে আব্বা-আম্মা শুধু নিজেদের নিয়েই বড্ড বেশি ব্যস্ত সময় কাটায়। আমাকে জন্ম দিয়ে শুধু আমার বৈষয়িক প্রয়োজন মিটিয়ে পিতা-মাতার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কখনও আমার আবেগ-অনুভুতিকে বুঝতে চায়নি। বোঝার জন্য কখনও সময় পর্যন্ত দেয়নি। তাদের নিজেদের ইচ্ছা আমার উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। কে কতো ভাল রেজাল্ট করছে তার উপর নির্ভর করে সন্তানের ভালবাসা ভাগ করেছে। দুজনের কেউ একজন যদি কোন কথা না বলে কোন একদিন সারাটা বেলা আমার হাত ধরে বসে থাকতো, তাহলেও আমি ভুলে যেতাম আমার সব দুঃখ। কিন্তু এ দুঃখ্টুকু শুষে নেবার জন্য একটিদিনের জন্যও তারা ব্লটিং পেপার হতে রাজী হয়নি। নিজেদের অর্জনে তারা পরিপূর্ণ। সেখানে সন্তানের জন্য কোন স্থান নেই। আমার এই অভিমান-প্রসূত ধারণা নিয়ে অনেক দূরে চলে যেতে চেয়েছিলাম। ঝিলিক ঝিলিক জেগে উঠা অভিমানের তোড়ে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলাম সব যোগাযোগ। আরিজোনা থেকে সান ফ্রান্সিসকো তো অনেক দূরেই। মধ্যে দিয়ে দু’হাজার মাইল। দূরত্বের একটা নিজস্ব শক্তি আছে। দূরে এসে বুঝতে পারলাম মানুষ কিন্তু সবার সাথে অভিমান করতে পারে না। এই পৃথিবীতে আর কেউই আমাকে এই অভিমানটুকু করার সুযোগ দেবে না। তাদের থেকে অনেক দূরে এসে কাছ থেকে আরেক পিতাকে দেখে আবিষ্কার করলাম সন্তান আর বাবা-মাদের সম্পর্কের জটিলতার আরেকটা দিক। সবার আসলে সন্তান নেবার দরকার হয় না। মানুষ মনে করে সন্তান তাদের সুখী করবে, অতৃপ্ত স্বপ্ন পূরণ করবে। বাস্তবিক ক্ষেত্রে খুব কম ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটতে দেখা যায়। আর আত্মতৃপ্ত মানুষদেরকে সন্তান কিভাবে তৃপ্ত করবে? এটি এখনও অপ্রচলিত কিন্তু কঠিন বাস্তব। এই সত্য্টি বুঝতে পারার জন্য এক জীবন য্থেষ্ট নয়। মিস্টার চৌধুরির কাছ এসে একজন বাবার দৃষ্টিতে সন্তানকে দেখতে চেষ্টা করি। আর তখন থেকেই গলে যেতে শুরু করে আমার সব জমাট বাঁধা অভিমান। অতীত নিয়ে এখন আর আমার কোন হা-হুতাশ নেই।  একটাই জীবন। অনর্থক রাগ পুষে রেখে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। আসলে এই বাবা-ছেলে এপিসোড আমার ভেতরে একটা চিমনি তৈরি করে দিয়েছে। এখন পুরনো পুষে রাখা রাগ ধীরে ধীরে সেই চিমনি দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি এখন ক্ষমা করতে শিখে গেছি। বিষে বিষ ক্ষয়। গতরাতে অনেকটা সময় নিয়ে আব্বা আর আম্মার সাথে ফোনে কথা বললাম।  দুজনে মিলে বিশ্বভ্রমণে বের হবেন। এই বয়সেও খুব রোমান্টিক। সবসময়ই। আজকে সকালে ফ্লাইট। প্রথমে আফ্রিকা যাবেন। সহজে আর যোগাযোগ করা যাবে না। অনেকদিন আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ন’টা বেজে গেছে। আব্বা-আম্মা এখন প্লেনে। ফোন করে লাভ নেই। যাক বাবা কথা তো হয়েছে। অভ্যেসবশত ফোনটা হাতে নিলাম। ঘুমানোর আগে এটা সাইলেন্সর মুডে থাকে। আমি এমন কেষ্টু-বিষ্টু নয় যে লোকে আমাকে রাত-বিরাতে ফোন করবে। এই মূহুর্তে হাতেগোণা কয়েকজন মাত্র আমার ফোন নাম্বার জানে। তার মধ্যে একজন মিস্টার চৌধুরি। ফোনে দেখলাম আজ ভোরে উনি আমাকে কয়েকবার ফোন করেছিলেন। আমি কলব্যাক করার চেষ্টা করি। ফোন ধরছেন না। আবার করি। না। এবারও কোন সাড়া নেই। আচ্ছা উনার ছেলের ফোন নাম্বারটা কতো? আর সেই মুহূর্তে একটি নাইটিংগেল পাখী ডেকে উঠলো। বিছানা থেকে তড়াৎ উঠে দাঁড়ালাম। পাখী …  কলিংবেল … বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো। আমি কি রাতটা তাহলে মিস্টার চৌধুরির বাড়িতে ছিলাম! না, তা হবে কেন। হঠাৎ করে কে আমার কলিংবেল পাল্টে দিল? স্বপ্ন ছাড়া এরকম ভয় আগে কখনই পাইনি। মাথা ঠান্ডা করে পুরো অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করলাম। আমি আমার স্টুডিওর মধ্যে স্লিংপি গাউন পড়ে ঘরের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে আছি। আমার এ বাসায় আজকেই কেউ প্রথম এলো। তাই আগে কখনও কলিংবেলও বেজে উঠেনি। ভয়টা কাটিয়ে উঠলাম। কিন্তু কথা হলো এই অসময়ে আমার কাছে কে আসবে?
ফ্রেস হয়ে পোষাক পাল্টে দরজার কাছে পৌছাতে একটু সময় লাগলো। 
‘খোলার আগে জিজ্ঞেস করে নিলাম, ‘কে?’
‘স্যান ফ্রান্সিসকো পুলিশ।’
অবাক করা ব্যাপার! আমার কাছে পুলিশ! আমি কোনদিন একটা পিঁপড়াও মারিনি। বোধহয় এই এপার্টমেন্ট বিল্ডিংএর অন্য কোন জায়গায় কিছু একটা হয়েছে। তড়িঘড়ি করে দরজা খুললাম। 
সাথে সাথে দু’জন পুলিশ ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। ‘এই যে আপনার ওয়ারেন্ট। আমার সাথে আপনাকে থানায় যেতে হবে।’
‘কি ব্যাপার? কেন?’
‘গতরাতে মিস্টার চৌধুরি খুন হয়েছেন।’
কথাটা পরিষ্কার শুনতে পেলাম। আশ্চররযের বিষয় হতভম্ব হবার বদলে পরবর্তী  পদক্ষেপ নিয়ে আমি ভাবতে থাকলাম। এই মূহুর্তে কোন শোক আমাকে স্পর্শ করছে না। আমার মাথা একদম পরিষ্কার। উদ্দেশ্য একটাই আমাকে এখন এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে হবে। পুলিশের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললাম,’আমি কি একটা ফোন করতে পারি?’

     
১০
জেলখানার ভিজিটর রুমে স্টিভেন প্যাট আর আমি বসে আছি। মেরি লী অনেক উপকার করেছে। স্টিভেন প্যাট একজন উঠতি ক্রাইম ল’ইয়ার। ইতিমধ্যে কিছু নাম-ডাক করে ফেলেছে। আমার কেসটা জটিল। খুবই জটিল। তাই প্রথম বার জামিন হয়নি। মিস্টার চৌধুরিকে যে ছুড়ি দিয়ে খুন করা হয়েছিল তাতে আমার হাতের আঙ্গুলের ছাপ আছে। স্টিভেন প্যাট ছুড়িটার ছবি দেখালো। আমি বেশ চিনলাম। বললাম,
‘এইটা দিয়ে আমি উনার জন্মদিনের কেক কেটেছিলাম।’
‘গয়নার বাক্স?’
‘হ্যা, ওটার মুখও আমি বন্ধ করেছিলাম। তবে কিছু নিইনি।’
‘কেসটা তোমার বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো অনেক উপাদান আছে।’
‘আমার ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা কতোখানি?’
‘গয়না তো আর তোমার কাছে পাওয়া যায়নি। তাই গয়না চুরির অপরাধে তুমি খুন করেছো তা প্র্মাণ করা সহজ হবে না। তবে আজকে একটা নতুন তথ্য জানলাম। মিস্টার চৌধুরির ট্রাস্ট সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা আছে?’
‘না একদম নেই। আমি সাধারণত উনার সম্পদ নিয়ে কোন আলোচনা করতাম না।’
‘উনি একটা একশ মিলিয়ন ডলারের স্ট্রাস্ট করে গেছেন।’
‘তা করতেই পারেন।’
‘তোমাকে সেই স্ট্রাস্টের স্ট্রাস্টি করে গেছেন।’

১,৭৯৯ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “সান ফ্রান্সিসকোতে ফাঁস”

  1. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    এত ভাল কিভাবে লিখেন আপু? B-) গল্পটা বড় কিন্তু পড়ে মনে হচ্ছে আরেকটু বড় হলে মন্দ হতো না।

    বরাবরের মতই অসাধারন :boss: :boss: :boss:


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    লম্বা পোস্ট দেখে সময় নিয়ে পড়বো বলে তুলে রেখেছিলাম, এখন পড়তে গিয়ে তেমন আর বড় মনে হলো না, একটানে পড়ে ফেললাম, বেশ ভাল লাগলো :thumbup:

    অফটপিকঃ ইদানিং নিয়মিত বিভিন্ন কোর্ট রুম ড্রামা বেজড টিভি সিরিজ দেখা হয়, মনে মনে তাই ফারিয়ার কোর্টকেসটা দেখার/জানার ইচ্ছে হচ্ছে 😛


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. সামিউল(২০০৪-১০)

    অনেক বড় লেখা দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম। এখন সময় নিয়ে পড়তে বসে দেখি একটানে পড়ে ফেললাম। 😀

    সুন্দর একটা গল্প, কাহিনীটা একটু অন্যরকম।


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাহমুদুল (২০০০-০৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।