পুবের মানুষ যখন পশ্চিমে – ৬

অভিশপ্ত জীবন আমার। ঠিক করেছি লিখব না। অন্তত: আরও কয়েকটা মাস। ফোকাসটা একটা কাজে পারলে ভাল হয়। কিন্তু অনিদ্রা রোগটা এমন খ্যাপাটে হয়ে পড়ল যে আমি বুঝে গেলাম এবার সময় হয়েছে। লেখা ব্যাপারটা অনেকটা প্রসববেদনার মতো। পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায় না। সময় যখন হয় তখন তেড়ে-মেড়ে বেড়িয়ে আসে। হোক তা সুস্থ কিম্বা বিকলাঙ্গ; স্পষ্ট কিম্বা অস্পষ্ট; ভাল বা মন্দ – আমরা মনের আনন্দে অক্ষর দিয়ে সন্তান বানাই। অবশ্য মানব সন্তানদের মতো তাদের তেমন লালন-পালন করার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ লেখাদের সুবিধা আছে। খুব অগোচরেই তারা পানির দাগের মতো মিলিয়ে যেতে পারে। মানুষরা পারে না। তাদের পেটের তাগিদে ঘরের বাইরে যেতে হয় – তাতে আলু-পোড়া হবার সম্ভাবনা আছে জেনেও। কেউ শরীরে পোড়ে, কেউ মনে পোড়ে। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। তার মা আমার খুব পছন্দের মানুষের একজন। সেই খারাপ খবরটা শোনা এড়িয়ে যাবার জন্য বন্ধুর সাথে আর যোগাযোগ করছি না। এরকম আরও অনেক খারাপ খবর এড়িয়ে যাবার জন্য নিজের চারপাশে একটা অদৃশ্য লোহার প্রাচীর তৈরি করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু শেষতক মনসাকে আর আটকাতে পারলাম না। বেহুলা পারেনি। আমিও পারেনি। আসলে কেউই বোধহয় পারেনা। যা ঘটার তা ঘটবেই। এ বিষয়ে মার্ফির একটা সূত্রই তো আছে – “যা বিগড়াবার, তা বিগড়াবেই।” চারপাশে যখন দুঃখবোধের ছোবল তখন শুধু শুধু নিজের ভাল থাকা নিশ্চিত করার মানে হয় না। মানুষ কখনই একা ভাল থাকতে পারে না। পারে না তার শেকড় উপরে ফেলতে। কতরকমভাবে যে কথাটা বুঝলাম! তাই এখন আর ভাল থাকার চেষ্টা করিনা। বরং খুঁজে ফিরে পরম সত্যকে। সত্য মেনে নেওয়া সহজ। এতে অজানা আশংকা দূর হয়। তবে সহজ নয় তা হলো পরম সত্যের সন্ধান পাওয়া। এই যেমন পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে এই পরম সত্যটি খুঁজে পেতে মানব সভ্যতাকে কত হাজার বছর পাড়ি দিতে হয়েছে, কত প্রাণহানি কত তর্ক-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। গতবছর একটা এথিকসের ক্লাস করতে গিয়ে ইউটিলিট্যারিয়ান, কান্ট, হিডো, দিয়ান্টলোজি এরকম অনেক তত্বের সাথে পরিচয় হলো। এসবের মূল লক্ষ্য ছিল ভাল বা খারাপ এইসব ধারণাগুলোকে গণিতের মতো স্পষ্ট করে তোলা। এখন প্রযুক্তি খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে – ছড়িয়ে পরছে আরও দ্রুততায়। সে তুলনায় এথিকসের তেমন সামাজিক বিস্তার হচ্ছে না। এথিকসের দিকটা সমানুপাতিক হারে এগুচ্ছে না। হয়তো এই পৃথিবীতে একটা সময় আসবে যখন সেলফোনের ভেতরে এথিকসের চিপও থাকবে। সেলফোন কেন, আঙ্গুলের তর্জনীর মধ্যেই একটা মাইক্রোচিপ বসিয়ে দেওয়া হবে। তখন পার্লামেন্ট, সোশ্যাল মিডিয়া কিম্বা পাড়ার মোড় – তর্কটা যেখানেই চলুক না কেন – মানুষ তার তর্জনী টিপে পরম সত্যিটি জেনে নিবে। সেসময় হয়তো তর্জনী উঁচিয়ে শাসিয়ে দেওয়ার ঘটনা পুরোপুরিই মীথ হয়ে যাবে। স্কুলের ছেলেমেয়েরা অংক কষে বের করে ফেলবে কোন মতামতটি গ্রহণ করলে বেশি সংখ্যক মানুষ সুখী হবে। আচ্ছা, তখনও কি এই পৃথিবীতে এতো হানাহানি থাকবে, নিরপরাধ মানুষ অকারণে বেগুণ-পোড়া হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণায় কাতরাবে না? সভ্যতা এগুচ্ছে, মানুষের জীবন সহজ থেকে সহজতর হচ্ছে। সুতরাং এমন দিন আসবে, নিঃসন্দেহে আসবে – কিন্তু কবে তা আমরা জানি না। অতএব তার আগ পর্যন্ত ঝগড়া করি, গুলি ছুঁড়ি, কাদা মাখি, ঘৃণা করি, চামচা হই, পেট্রোল বোমায় চারপাশ জ্বালিয়ে দেই, ভিন্নমতকে উপেক্ষা করি, নিশ্চুপ থাকি, নিশ্চিন্তে লোহার প্রাসাদ গড়ে তুলি। ভুলে গেলে তো চলবে না আমরা আসলে সময়ের দাস। আজ থেকে দেড়শ বছর আগে যদি এই বাংলা অঞ্চলে আমার জন্ম হতো, তবে তখন কোলের উপর কম্পিউটারের বদলে একটা ট্যাঁ ট্যাঁ বাচ্চা থাকতো। কোলেরটা ছাড়াও আরও এক ডজন বাচ্চা-কাচ্চার খেদমত করতে করতেই পঞ্চাশে অক্কা পেতাম। তারও কয়েক হাজার বছর আগে জন্ম নিলে পশুর চামড়া কিম্বা গাছের ছাল-বাকল পড়ে শিকারি পুরুষ সঙ্গীদের পেছন পেছন ছুটতাম। গুহায় গুহায় জীবন কেটে যেত। হয়তোবা সেই বরফযুগে পদব্রজের মহাযাত্রায় কখনও আফ্রিকা থেকে ইউরোপ, কখনওবা ইউরোপ থেকে এশিয়া মাইনর – এভাবে চলতে চলতে অবশেষে কোন একজায়গায় এসে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাম। মানুষের ক্ষেত্রে নিশ্চিহ্ন কথাটা বোধহয় ঠিক নয়। মানুষ কখনও পানির দাগের মতো মিলিয়ে যেতে পারে না। আমি যতটুকু এসে থেমে গিয়েছিলাম আমার সন্তানকে যাত্রাটা শুরু করতে হতো ঠিক তার পর থেকে। এবার তার পদযাত্রা আফ্রিকা থেকে নয়, আরব মাইনর থেকে। এই মানব জীবন ভ্রমণ পছন্দ করে। ঠিক যেন নদীর মতো। ভ্রমণ শুধু স্থানান্তরে নয়, অবস্থানান্তরেও। ভাল বা খারাপ যে দিকেই হোক না কেন ক্রমশই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আমাদের অবস্থান বদলে যাচ্ছে, স্থান বদলে যাচ্ছে – একটা নির্দিষ্ট কক্ষ পথে।

এই অক্টোবরে আমার প্রবাস-জীবনের পনের বছর পূর্ণ হলো। পনের বছর আগে আর পরে প্রায় একই রকম একটা ভ্রমণ করলাম। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্লেনে করে টেক্সাসের ডালাস, তারপর সেখান থেকে গাড়িতে করে লুসিয়ানা, এ্যলাবামা, মিসিসিপি, টেনিসি হয়ে জর্জিয়ার আটলান্টায় আসলাম। সেখান থেকে আবার উড়াল দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায়। ডালাস তো পুরোদমে গ্রোয়িং সিটি। আটলান্টাও কিছুটা। আর বাদ-বাকী স্টেটগুলো তেমন গরিবি হালেই রয়ে গেছে। তেমন পরিবর্তন নেই। তবে আমার আগ্রহ মানুষের মধ্যে। এরই মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে আরও কয়েকবার এইসব জায়গায় এসেছি, তাই গত পনের বছরের ব্যবধানে একই মানুষদের বার বার দেখা হয়েছে। আজকে না হয় আমার এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতাই বয়ান করি।

আমেরিকাতে আমার আসার কথা ছিল ছাত্র ভিসায় – এফ-ওয়ান ভিসায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসা হয় এইচ ফোর ভিসায় – অর্থাৎ একজন চাকুরীজীবীর স্ত্রী হিসেবে। এফ-ওয়ান আর এইচ-ফোরে আমেরিকাতে আসার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ছাত্রজীবনের কঠোরতার মধ্যে দিয়ে গেলে যে আমেরিকাকে আমার দেখা হতো তা আর হলো না। আরেকজনের রেডিমেড সংসারে এসে আমেরিকাকে বুঝতে আমার কিছুটা সময় লেগেছিল। আমেরিকায় বাংলাদেশিদের প্রবাস-জীবন আর দাওয়াত খাওয়া প্রায় ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। ১৯৯৮ সালে অক্টোবরে এদেশে এসে প্রথমেই দাওয়াত খাই (আমরা বাংলাদেশীরা খালি খাই খাই করি – এই যেমন বিয়ে খাওয়া দাওয়াত খাওয়া) আপা আর ভাইজানের বাসায় (এটাও এপার্টমেন্ট)। বাসাটা আপার ভাইয়ের – যিনি আবার আমার বরের বন্ধু। আমি আসার কয়েক মাস আগেই ডিভি-ওয়ান পেয়ে সপরিবারে আপা তার ভাইয়ের বাসায় এসে উঠেছেন। ভাইজান ছিলেন ভেড়ামাড়া কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। আমেরিকাতে এসে তাকে গ্যাস স্টেশনে কাজ করতে হচ্ছে। তখন তাদের জীবনের সবচেয়ে হতাশাচ্ছ্ন্ন সময়। শিক্ষকরা সব সমাজেই সম্মানিত ব্যক্তি। সেই সম্মানকে ধূলায় মিশিয়ে তখন ভাইজান আরেকজনের গাড়ি ধুয়ে দিচ্ছেন, ক্যাশিয়ারে দাড়িয়ে বিক্রি-বাটার লেনদেন করছেন। আর এতোসব করেও যখন দেখেন স্ত্রী আর তিনবছরের ছেলে আর সাত বছরের মেয়েসহ এই চারজনের পরিবারটির জন্য যথেষ্ট পয়সা উপার্জন করতে পারছেন না তখন উনি প্রায় মনস্থির করে ফেলেছিলেন বাংলাদেশে ফিরে যাবেন। তখন উনি শ্যালকের এপার্টমেন্টে থাকতেন। আমাদের এপার্টমেন্ট ছিল একই কমপ্লেক্সে। আমি আসার আগে আমার বর প্রায়ই ভাইজানকে নিয়ে হাঁটতে বেড়াতেন এবং নানান সুখ-দুঃখের কথা বলে উনার মনটা হালকা করার চেষ্টা করতেন। আমি আসার পরও ভাইজানের সাথে খুব জমে যায়। আর ভাইজান বলতেন, আচ্ছা তোমরা স্বামী-স্ত্রী একই রকম হলে কিভাবে? কম খরচের জায়গা বলে সেই ভাইজান পরে তার পরিবার নিয়ে ডালাসে থিতু হন। প্রতিবার ডালাস গেলে অল্পসময়ের জন্য হলেও একবার আমরা ভাইজানের সাথে দেখা করে আসবই।

ডালাসে আমাদের প্রথম স্টপেজ আমাদের এক কাছের আত্মীয়। ধরা যাক তার নাম রাকীব। পনের বছর আগে অবশ্য রাকীব ইউনিভার্সিটি অব ডালাস আর্লিংটনের ছাত্র ছিল। সেবারই প্রথম আমার প্র্বাসী ছাত্রদের জীবন খুব কাছ থেকে দেখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কম ভাড়ার এপার্টমেন্টগুলো ছিল ছাত্রাবাসের মতো। ভাগ্যিস সেখানে আমাদের থাকতে হয়নি। কারণ বছরের পর বছর এখানে ছাত্ররা থেকে আসছে। স্কলারশিপ পেলেও ছাত্রজীবন টানাটানির। সেখানে এখানে অধিকাংশ ছাত্রকেই রোজগার করে পড়তে হয়। সেবারই আমি প্রথম অনুধাবন করি রুচি কিম্বা পয়সা তা সে যেটাই হোক দীনতার সাথে অপরিচ্ছন্নতার একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। এই আমেরিকাতেও দেখেছি গরীব জায়গাগুলো বেশ নোংরা। পরবর্তীতে ক্যালিফোর্নিয়াতে অনেক চাকরিজীবী ব্যাচেলর দেখার সুযোগ হয়েছিল। তখন তাদের দেখে মনে হয়েছে বাংলাদেশি ছেলেরা বোধহয় অপেক্ষাই করে বৌ এসে তাদের জীবনটা সাজিয়ে দেবে। তার আগ পর্যন্ত যেন-তেনভাবে থাকা জায়েজ। এইদিক দিয়ে চিন্তা করলে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা একে অপরের পরিপূরক। কারণ মেয়েরাও তো বলতে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিয়ের অপেক্ষায় থাকে। প্রবাসী পেশাজীবী বাংলাদেশীদের মধ্যে তেমন কোন বিয়ে ভাঙ্গার গল্প শোনা যায় না। সম্পর্ক ভাঙ্গে না যে তা নয়, তবে তা তুলনামূলক বিচারে খুব একটা বেশি নয়। এক্ষেত্রে অবশ্য তারা খুব সুখী প্রজাতি এই কথাটাও নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায় না। এই টেক্সাসে এসেই একটা ঘটনা শুনলাম। এক বিধবা মা খুব কষ্ট করে ছেলেকে ছোটবেলা থেকে মানুষ করেছে। সেই ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। পরে আমেরিকায় এসে মাস্টার্স করে চাকরি পেয়ে বিয়ে করেছে। মায়েরও একসময় গ্রিন কার্ড হয়। সেই মা আর ছেলে এখন একই শহরে থাকে। কিন্তু ছেলে মায়ের সাথে দেখা পর্যন্ত করতে পারে না। কারণ বউয়ের নির্দেশ। এদিকে বউয়ের মা এবং ভাই ঠিকই তাদের বাসায় থাকছে। বউ আবার খুব ধার্মিক। মসজিদে অনেকটা সময় কাটায়। এ ব্যাপারে একজন প্রশ্ন করাতে তার উত্তর ছিল ইসলাম বলেছে নিজের বাবা-মার দেখাশোনা করতে, স্বামীর বাবা-মাকে নয়। এই প্রবাস জীবনে এসে আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম। তা হচ্ছে প্রবাসী ধার্মিক। তারা আমেরিকার সব সুবিধা ভোগ করে দিনরাত আমেরিকার নিন্দা করবে। এখানে বর্ণিত ধার্মিক বউএর মতো নানান অবিবেচক আচরণ করে তার আবার ধর্মীয় ব্যাখ্যা দেবে। অথচ যতটুকু জানি ইসলাম গীবত করা এবং আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কথা বলেছে। আমি নিজে সমালোচনায় সমার্থক। ভারসাম্যয় সমালোচনা মানুষকে আরও ঋদ্ধ হতে সাহায্য করে। কিন্তু গীবত হচ্ছে সোজা-সাপটা ভাষায় একপেশে গালিগালাজ। গীবত হচ্ছে অতৃপ্ত, অসুখী মানুষের সুখ অন্বেষণের প্রচেষ্টা। যে ছেলে মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্মগ্রহণই করেনি, তাকে আমরা জোর করে রাজাকার বানিয়ে দিই। যে ছেলে ভারতীয় পণ্য, অনুষ্ঠান বর্জন করে চলে তাকে আমরা জোর করে ভারতের দালাল বানিয়ে দিই। এইসব কি দেশ প্রেমের নমুনা? হয়ত কিছুটা দেশপ্রেম আর বাকীটা অসুখী মনের আউটলেট। পরিশেষে যা দাঁড়াচ্ছে তা হলো দেশকে আফগানিস্তান বানাবো না এরকম ভাব নিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁকে উগান্ডা আর সোমালিয়া বানিয়ে দিচ্ছে। মৌলবাদ ঠেকাচ্ছে হিংসা আর ঘৃণার মন্ত্রতে জাতিকে দুইভাগ করে। কিম্বা কে জানে এটাই হয়তো একটি দেশের স্বাভাবিক পরিণতি। শ্রীলংকা একটা সময় তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল। তারপর তামিল আর সিংহলিদের মারামারিতে দেশটা আবার তরতর করে পিছিয়ে যেতে থাকল। একদল ক্ষমতায় আসলে শুধু হিন্দুদেরই নয় আরেক দলের লোকদের পালিয়ে থাকতে হয়। আবার আরেক দল ক্ষমতায় আসলে তখন আগের ক্ষমতাবান দলের লোকদের গ্রাম ছাড়া হতে হয়। এটাই তো এখন নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে কতিপয় মুষ্টিমেয় ক্ষমতাবান ছাড়া আর সবাই সংখ্যালঘু। এই দেশে গরীব মানেই সংখ্যালঘুদের মতো নিরাপত্তাহীন জীবন। তাই আজকে সুরঞ্জিতের কারণে তাঁর গাড়িচালক আজমকে ফেরারি জীবন কাটাতে হচ্ছে। মানবতার নামে যখন এক চোখ দিয়ে পানি ঝড়ে আরেক চোখ দিয়ে ঝড়ে না তখন বুঝতে হবে এটা গ্লিসারিণ মাখানো কান্না। সত্যিকারের দেশপ্রেম নয়।

যাই হোক প্রবাসে থেকে প্রবাসের কথা বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত। দেশের কথা বলার অনেক লোক আছে – তারা তা বলবে। যে সেই রাকীবের কথা বলছিলাম, পনের বছর পর সেই রাকীবই খুব সুন্দর একটা গোছানো জীবনযাপন করছে। যাকে বলে আমেরিকান ড্রিম। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আইটিতে কাজ করে। দু’টো সুস্থ সবল ছেলেমেয়ে। বড় বাড়ি, দামী গাড়ী। সপ্তাহে পাঁচদিন কাজ করা আর সপ্তাহান্তে প্রবাসীদের দাওয়াত। ব্যস বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা একটি ছেলে আর কী’ই বা স্বপ্ন দেখতে পারে। বাংলাদেশ কেন এতোটুকুই বা এই পৃথিবীর কয়জনের ভাগ্যে জোটে। আর আমেরিকাতে একটা চাকরি থাকলে মধ্যবিত্তের জীবনের মধ্যে কোন গ্লানি নেই। সেই সোয়াশ বছর আগে আমেরিকার সংবিধান প্রণেতারা এমনভাবে এদেশের সংবিধান সাজিয়েছেন যে কেউ যাতে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হতে না পারে এবং প্রতিটি মানুষ যাতে আলাদা আলাদা ভাবে একটি সুখের জীবনযাপন করতে পারে। প্যারসুয়েট অব হ্যাপিনেস শব্দ-গুচ্ছটি এদেশের সংবিধানে খুঁজে পাওয়া যায়। এদেশে ছুটিছাটাগুলো এমনভাবে দেয় যে সবাই যাতে একনাগাড়ে তিন-চার দিন ছুটি কাটাতে পারে। তখন সবাই ঘুরতে বেড়িয়ে যায়। এদেশে খাওয়া-দাওয়া, ঘোরাঘুরির খরচ নাগালের মধ্যেই রাখা হয়। তবে এখানে সুখের একটাই মূলমন্ত্র। একটা চাকরি। আর ভালো বেতনের চাকরি পেতে গেলে থাকতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক কোন বিষয়ে একটা ডিগ্রী। ১৯৯২ সালে ক্লিনটন ক্ষমতায় এসে ভাগ্যিস আমেরিকান আর্মিদের জন্য ব্যবহৃত ক্ল্যাসিফাইড ইন্টারনেটকে ডিক্ল্যাসিফাইড করে দিয়েছিলেন তাই তো আমাদের মতো ইঞ্জিনিয়ারদের আমেরিকায় এখন এতো কদর। ইন্টারনেট ওপেন করে দেওয়ার পর এই সেক্টরে অনেক চাকরির বাজার তৈরি হয়। নব্বই দশকের পর তাই সারা পৃথিবীতেই মধ্যবিত্তের সংখ্যা এক লাফে অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। অধিক সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করে ভারত আর চীন তো প্রায় পরাশক্তির কাছাকাছি। দুঃখের বিষয় সে তুলনায় বাংলাদেশ সুযোগটা নিতে পেরেছে কম। এমনকি পাকিস্তান পর্যন্ত আইটি সেক্টরে বাংলাদেশকে ফেলে অনেক সামনে এগিয়ে গেছে। এই বে-এড়িয়াতে থাকেন হেলাল ভাই যখন প্রথম এই তথ্যটি আমাকে দেন তখন প্রথমে আমি তা বিশ্বাস করতে পারিনি। গতবছর বেসিস (বাংলাদেশের আইটির চেম্বার অব কমার্সের মতো) আর এএবিবিএ (আমেরিকান এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ার্স এবং আর্কিটেকচার) যৌথ উদ্যোগে ইউএস বাংলাদেশ টেক ইনভেস্টমেন্ট সামিট আয়োজিত হয়। বেসিস থেকে বেশ অনেক বাংলাদেশি আইটি সেক্টরের উদ্যোক্তারা আমেরিকাতে আসেন ইনভেস্টটরের খোঁজে। তখন বেসিসের প্রেসিডেন্ট ফাহিম মাশরুরের কাছ থেকে জানতে পারি যে বিদেশিরা আইটি সেক্টরে ইনভেস্টমেন্টের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের থেকে পাকিস্তানকে অনেক গুরুত্ব দেন এবং সেখানে অনেক ইনভেস্ট করছে। অথচ এর আগে আমার ধারণা ছিল পাকিস্তান একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ। এখানে আমি এই তথ্যটি উল্লেখ করলাম পাকিস্তানের সাফাই গাওয়ার জন্য নয়। কাউকে শত্রু মনে করলে তার শক্তিমত্তা সম্পর্কেও সম্পূর্ণ সচেতন থাকা দরকার। পাকিস্তানকে যদি কেও আসলেও ঘৃণা করে থাকে তাহলে তার উচিত হবে এই ঘৃণার শক্তিকে জেদে পরিণত করে আইটি সেক্টরে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের থেকে এগিয়ে নেওয়া। অনর্থক ব্লগে বা ফেসবুকে ছাগু গদাম করে ক্ষণে ক্ষণে স্ট্যাটাস দিয়ে ক্ষণিকের জন্য জনপ্রিয় হওয়া যায় বটে কিন্তু দীর্ঘযাত্রায় কেউ’ই তাকে মনে রাখবে না আর এতে দেশেরও কোন প্রকৃত উন্নতি হয় না।

উপরে যে টেক সামিটের কথা বলছিলাম সেখানে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরর বক্তৃতা শুনলাম। প্রথমবার শুনি নিউইয়র্কে – মুক্তধারা আয়োজিত বাংলাদেশের বইমেলায়। দেড়-বছর আগের কথা। সেসময়টায় হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসা চলছিল। তখন মুক্তধারার আমেরিকা সেকশনের কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহার সাথে ফোনে কথা হলে জানাতেন হুমায়ূন আহমেদকে সার্ভিস দেওয়া নিয়ে উনি কতটা ব্যস্ত আছেন। এই প্রবাসে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের জন্য কিছু করাটা সত্যিই প্রসংশাযোগ্য। পরে অবশ্য এই অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে বিশ্বজিত সাহা একটা বই লিখেছিলেন। সে বইয়ের কিছু অংশ পড়ে বুঝলাম দিন শেষে আসলে সবই ব্যবসা। নিঃস্বার্থভাবে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা মুখে অতো খই ফোটাননা। এই বাংলাদেশের কথাই ধরি না কেন যারা সত্যিকার অর্থে কিছু গড়েছেন, যেমন ডায়াবেটিকস সেন্টার, গণস্বাস্থ্য, ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে, তাঁরা কিন্তু প্রতিটা আলোচিত ঘটনার পদে পদে বিবৃতি দিয়ে বেড়াননি। একটা প্রতিষ্ঠান গড়তেই অখণ্ড মনঃসংযোগের দরকার হয়। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের এই কথাটা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি: নিজের কাজটা ঠিকঠাক মতো করাই হচ্ছে সত্যিকারের দেশপ্রেম। আমি যে এলাকায় থাকি সে এলাকার কথাই ধরি। কিভাবে সম্ভব হলো এই সিলিকন ভ্যালিতে প্রযুক্তির অঙ্গনে লাখ লাখ চাকরির বাজার তৈরি করা। শুধু তাই’ই নয় – এখানকার পরিবেশটাই এমন যে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ তার আইডিয়া দিয়ে নতুন কিছু উদ্ভাবন করার স্বপ্ন দেখতে পারবে। আর একটি সফল উদ্ভাবিত পণ্য মানেই কিছু চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হওয়া। আর একটা ভদ্রস্ত বেতনের চাকরিই (সহজ ভাষায় যাকে হোয়াইট কালার জব বলা হয়) হচ্ছে সেই আলাদীনের প্রদীপ যা হাতে পেলেই এক প্রজন্মেই কেউ তার নিম্নবিত্ত অবস্থা থেকে মধ্যবিত্ত অবস্থায় লাফ দিতে পারবে। আজকের সিলিকন ভ্যালির সাফল্যের পেছনে বার্কলে আর স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের অবদান উল্লেখযোগ্য। আমেরিকাতে সে দেশের প্রেসিডেন্টের সফলতা বিচারের একটি মাপকাঠি হচ্ছে তাঁর আমলে কতগুলো চাকরি তৈরি হয়েছে সে সংখ্যাটি। আচ্ছা আমাকে কি কেউ এই তথ্যটি দিতে পারবে যে সিলেটে কোন আইটি সেক্টর তৈরি হয়েছে কিনা এবং মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কতটি চাকরি তৈরি করেছেন? উনার কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করলাম এ কারণে যে একটা জায়গায় দেখলাম উনি বলছেন বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়ে গেছে – এদেশের আর বিদেশী সাহায্যের দরকার নেই। স্যারের তো ভাল করেই জানার কথা গার্মেন্টস আর রেমিট্যান্স – এই দুটো হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার্জনের প্রধান উৎস। দুটোই আবার নির্ভর করে বিদেশীদের দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর। বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে বিদেশীরা যদি বাংলাদেশীদের তাদের দেশে চাকরি দেয় কিম্বা বাংলাদেশের গার্মেন্টসকে পোশাক বানানোর অর্ডার দেয় তাহলে বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ থাকে। বেসিস থেকে আসা বাংলাদেশের আইটি সেক্টরে কাজ করেন এমন অনেকের সাথে কথা হলো। অধিকাংশই সার্ভিস ভিত্তিক ওয়েব ডেভেলপমেন্টের সাথে জড়িত। এখন তো এপসের (App) যুগ। প্রতিটি মানুষ আলাদা ভাবেই উদ্ভাবক হতে পারে। বাংলাদেশের তরুণরা এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে থাকতে পারতো। কিন্তু আমার মতে বাংলাদেশে তারুণ্যময় সময়টা একটা অভিশপ্ত অধ্যায়। কেন তা ব্যাখ্যা করছি। তরুণমন এমনিতেই দিগভ্রান্ত, হতাশাচ্ছন্ন, বিক্ষিপ্ত এবং একই সাথে অহংকারী। এদের মধ্যে আবার যারা সুপার-একটিভ তারা হচ্ছে এক-একজন উত্তপ্ত তেলের কড়াই। এই তেলের কড়াইরাই সাধারণত নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকে। তাদের ভালবাসাও যেমন তীব্র, ঘৃণাও তেমনি প্রবল। জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখে আসছি তরুণ-মনের আবেগকে নিয়ে বাদুর নাচ খেলানো হয়। তাদের ঘৃণা-বোধকে উস্কে দেওয়া হয়। সাধারণত বিক্ষিপ্ত মন কোন উদ্ভাবনী চিন্তা করতে পারে না। যার লেখার হাত অসম্ভব ভাল, তার লেখা স্রোতস্বিনী নদী হবার বদলে অবশেষে বদ্ধ পানা-পুকুর হয়ে যায়। সেসব লেখা না পড়েও চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় এখানে কি আছে। পাঠককে আর নদীর চলার পথের বৈচিত্র্য দিতে পারে না – খালি কচুরিপানা দেখায়। বাংলাদেশে কি এমন কোন ক্যাফে আছে যেখানে তরুণরা তাদের সৃজনশীল আইডিয়া নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করছে? ইন্টারনেটে তো দেখি কে ছাগু আর কে হাগু সেটা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করতে। আরে বাবা তোরা দেখ না ইরাকের সাদ্দাম হোসেন কত শক্তিশালী ছিল – এক কুয়েত দখল করতে গিয়ে অবস্থা শেষে কী লেজে-গোবরে দাঁড়াল। এই যুগে কী পাকিস্তানের পক্ষে সম্ভব বাংলাদেশ আবার দখল করে নিয়ে যাওয়া? বাংলাদেশ যাতে আফগানিস্তানের মতো হয়ে না যায় তার জন্যই যদি এতো আয়োজন সেক্ষেত্রে আমার প্রশ্নটি হলো বাংলাদেশকে তাহলে কেন উগান্ডা বা সোমালিয়া হতে হবে? পাশের বাড়ির মেয়েকে অন্যপাড়ার ছেলে বিরক্ত করলে তাকে থাপ্পড় মেরে আসছো এদিকে খেয়াল নেই যে তুমি নিজেই আবার সে মেয়েকে বিরক্ত করছ।

সব ক্ষার ক্ষারক। কিন্তু সব ক্ষারক ক্ষার নয়। দেশে আইনের শাসন থাকলে একজন যুদ্ধাপোরাধীরও ছাড়া পাবার কথা নয়। আবার শুধুই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলো কিন্তু ওদিকে নোয়াখালীর খুনি বিপ্লব প্রেসিডেন্টের ক্ষমা পেয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গেল তাহলে কিন্তু দেশের মাটিতে নিজের স্বাভাবিক মৃত্যুর আশাটা ছাড়তে হবে। বর্তমানের এই পৃথিবীতে চাইলে পরে প্রতিটি মানুষই আলাদা আলাদা ভাবে এক-একজন উদ্ভাবক হতে পারে। এই সুযোগটি না নিয়ে এক তরুণকে অকারণে অকালে পৃথিবীতে থেকে ঝরে যেতে হবে তা ভাবতে খুব কষ্ট হয়। আর মৌলবাদ ঠেকানোর সবচেয়ে ভাল সমাধান হচ্ছে সাংস্কৃতিক বিপ্লব। কথাটি বলছি আমি দায়িত্ব নিয়ে। এই প্রবাসে বে-এড়িয়াতে একসময় আমার মনে হচ্ছিল বাংলাদেশী সমাজ স্থবির হয়ে পড়ছে। মরার আগে অনেকে মারা পড়ছে। তখন উদ্যোগ নিয়ে একজন কমিউনিটি অরগানাইজার হিসেবে একটা সুস্থ এবং পরিচ্ছন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করলাম। দেখলাম এতে আরও অনেকেই এগিয়ে আসল। পুরো পরিবেশটাই বদলে গেল। তবে এই পরিবর্তনটা স্থায়ী নয়। কাউকে না কাউকে এটি চালিয়ে যেতে হবে। নইলে আবার যোগফল শূন্য। আসলে আমি মনের মধ্যে যে ইচ্ছা ধারণ করি আর দশজনও কিন্তু সেরকমটাই ধারণ করে। হতে পারে কেউ একটু রক্ষণশীল, কেউ বা আবার বেশ উদার প্রকৃতির – এর মধ্যে থেকেই কিন্তু কমন গ্রাউন্ড বের করে নিতে হবে। পেট ভরাবার মতো একটি ভদ্রস্ত কাজ পেলে মানুষ তখন তার মন ভরাতে চায়। কাজ চাই কাজ – সেই কাজটাই এখন বাংলাদেশে নাই।

মুক্তধারার বই মেলায় প্রথম ডঃ আতিউর রহমানের বক্তৃতা শুনি। মেলাটি হচ্ছিল একটি স্কুল বিল্ডিঙে। সেখানে বিভিন্ন রুমে নানান রকম আয়োজন চলছিল। পুরো আয়োজনের পেছনে অনেক খরচ হয়েছে। সে তুলনায় লোকসংখ্যার উপস্থিতি কম। বুঝলাম বিশ্বজিত সাহার ভাল স্পন্সর কানেকশন রয়েছে। প্রবাসে এরকম একটি বই ভিত্তিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ভদ্রলোকের প্রশংসা করতে হয়। একটি রুমে বিশ-পঁচিশজনের সামনে ডঃ আতিউর রহমান কিছু বললেন। উনার বক্তৃতা শুনে কিছুটা হতাশ হলাম। পুরো বক্তব্যের বিষয়বস্তু ছিল ক্ষুদ্রঋণের আবিষ্কারক আসলে রবীন্দ্রনাথ, অন্য কেউ নয় – এই টাইপের। মনে মনে ভাবছিলাম ভদ্রলোক এই কথাগুলো বলার জন্য সরকারের এতোগুলো টাকা খরচ করে আমেরিকায় না আসলেও পারতেন। পরেরবার আবার উনার বক্তৃতা শোনার সুযোগ হলো সেই সিলিকন ভ্যালির টেক সামিটে। সেখানেও অনেকবার রবীন্দ্রনাথ টেনে আনলেন। তবে এবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিলেন। ইনভেস্টমেন্টের পক্ষে বাংলাদেশ কতটা আকর্ষণীয়। আসলে দেশ নিয়ে আমাদের অতো হতাশ হবার কারণ নেই। বাংলাদেশের জনসংখ্যা একটি প্লাস পয়েন্ট। দশ কোটি মানুষ ইন্টারনেটের আওতায় চলে এসেছে এবং এরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আইটি সেক্টরের ভোক্তা তা কিন্তু কম কথা নয়। তবে বাংলাদেশ থেকে আগত ডঃ আতিউর রহমানসহ আরও যারা বক্তা ছিলেন সবার বক্তব্যেই মূলত ভোক্তা হিসেবে বাংলাদেশের চেহারাটি উঠে আসছিল। বোঝা যাচ্ছিল আইটি সেক্টরে বাংলাদেশে আসলে তেমন কোন ইনভেস্টমেন্ট যাচ্ছে না। তবে আশার কথা হলো এই যে বাংলাদেশে একটা প্রস্তুতি চলছে। আইটি সেক্টর নিয়ে দেশে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আছে। এখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসলে বাইরের দেশগুলো বাংলাদেশে ইনভেস্টমেন্টের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। তবে তার আগ পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত এবং অর্থনীতি বোঝেন এমন একজন সরকার প্রধানের। মৌলবাদের পাকিস্তান এবং স্বৈরশাসকের মায়ানমারও বাংলাদেশের থেকে বেশি গুরুত্ব পায় তার কারণ ওসব দেশে গত বিশ বছর ধরে কোন অশিক্ষিত সরকার প্রধান ছিল না। শুধু পানিই উপর থেকে নীচে প্রবাহিত হয়না, চিন্তাভাবনার গতিও নিম্নবাহী। সরকার প্রধানের শিক্ষার অভাব থাকলে তাঁর মধ্যে হীনমন্যতা কাজ করবে। হীনমন্যতা থাকলে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্য স্বভাবতই তিনি চারপাশে চামচা টাইপের লোক জড়ো করবেন। আবার সেই চামচা তার নিজের এলাকায় ঠিক তত বড়ই ত্রাস। এলাকার সবাইকে সে তখন তার নিজের চামচা হিসেবে দেখতে চাইবে। এইজন্য একজন শামীম ওসমানকে আমরা একই সাথে দুই রূপে দেখি। বঙ্গভবনে উনি প্রায় দুধের শিশু, মাটিতে প্রায় সেজদা দিয়ে থাকেন – একই মানুষ আবার নায়ারণগন্জে ভয়ংকর ত্রাস। এভাবেই একজন সরকার প্রধানের চিন্তাভাবনা সমাজকে প্রভাবিত করে। এই চক্র থেকে বেড়িয়ে আসার উপায় হচ্ছে তরুণদের মানসিক পরিপক্বতা। তারা সঠিক সময়ে সঠিক প্রশ্নটি করবে। ভারতে কেন আম-আদমি পার্টি বের হয়ে আসতে পারলো তার কারণ বুঝতে সেদেশের কিছু পোস্ট স্ক্যান করলাম। বিভিন্ন কমেন্ট থেকে বুঝতে পারলাম ভারতের তরুণ সমাজ এখন যথেষ্ট পরিপক্ব। তারা এখন আর প্রিয়াঙ্কা গান্ধির কারিশমায় কিম্বা বিজেপিএর হিটলারি স্টাইলে বোকা বনতে রাজী নয়। তারা একটি সুন্দর জীবন চায়। অন্যের জীবনকে সুন্দর করার জন্য আর সিঁড়ি হতে রাজী নয়।

ডঃ আতিউর রহমানের বক্তৃতার পর লাঞ্চ ব্রেকের সময় আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বক্তব্যের ভোক্তা বাংলাদেশের পরিচয়টি পেলাম। এখন বাংলাদেশের একটি পরিবারের একজন সদস্য মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিকের কাজ করলেও দেশে তার পরিবারের সদস্যরা ভোক্তা হতে পারে। কিন্তু সেটা তো রেমিট্যান্সের অনুৎপাদিত ব্যবহার হলো। গত চার বছরে বাংলাদেশের মধ্যে সরকার কত নতুন চাকরি তৈরি করতে পেরেছে? এর উত্তর দিতে গিয়ে গভর্নর একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। প্রথমে বললেন, আসলে আমরা এই হিসেব করে দেখি নাই। তারপরেই ব্যস্ততা দেখিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। অথচ এর আগ পর্যন্ত উনি বেশ সময় নিয়েই কথা বলছিলেন। আমার মনে হলো এর আগে উনি কখনও এরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হননি। আমি বলব এটা আমাদের তরুণ সমাজের ব্যর্থতা। চাকরির বাজার তৈরি করার জন্য তারা প্রশাসনের উপর যথেষ্ট চাপ দিচ্ছে না। ডঃ আতিউর রহমানের আরেকটা জিনিষ ভাল লাগেনি। তা হলো উনি সুযোগ পেলেই উনার শৈশবের দারিদ্রকে বেচতে চান। এই টেক সামিটের ব্রোশিয়ারে উনার যে জীবনী এসেছে তাতে খালি কত দরিদ্র অবস্থা থেকে উঠে এসেছেন সেটাই হাইলাইট করা হয়েছে। অথচ একজন ফরেন উদ্যোক্তা কিন্তু দেখতে চাইবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে উনার সফল কাজগুলো। আমি নিশ্চিত উনি অনেক ভাল কাজ করেছেন। তার একটা বোধহয় ই-ব্যাংকিং। আইটি সেক্টরের জন্যেও আলাদা লোণের ব্যবস্থা করেছেন। অনেক মহিলা উদ্যোক্তা তৈরি করার চেষ্টা করছেন। আবার উনার আমলেই সোনালী ব্যাংক আর হলমার্কের দুর্নীতির মতো কলঙ্কময় ঘটনাগুলো ঘটেছে। আসলে এখন সময় এসেছে কে সওদাগর-পুত্র আর কে রাখাল-রাজপুত্র সেভাবে কাউকে মূল্যায়ন না করে মানুষটার কাছ থেকে সমাজ কি পাচ্ছে সেটা মূল্যায়ন করার।

লেখাটা এমনিতেই অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। তা এর শুরুতে যে ভাইজানের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম তার কথা দিয়েই না হয় আপাতত রাশ টানি। পনের বছর আগে দেখেছিলাম ভাইজানের হতাশময় জীবন। এবার ডালাসে এসে ভাইজানকে সবচেয়ে হাসিখুশী আর সুখী দেখলাম। উনার মেয়ে আমেরিকার একটি ভাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কলারশীপে পাবলিক রিলেশনশীপে পড়াশোনা করে ওয়াশিংটন ডিসিতে চাকরি পেয়েছে। এক লাফে আমেরিকার সিনেটদের সাথে চলাফেরা শুরু হবে। আর ছেলেটা আগামী বছর কম্পিউটার সায়েন্সে পড়তে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। ভাইজানের কাছে আমেরিকা এখন খুবই ভাল দেশ। ওনার কাছ থেকে বাংলাদেশের গ্রামগন্জের উন্নতির গল্পও শুনলাম। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। সত্তর আশির দশকেও সব কিছু রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছিল। তখন গ্রাম থেকে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুযোগ কমে গিয়েছিল। নকলের প্রবণতা শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমন করে গ্রাস করেছিল যে গ্রামের ছাত্ররা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারতেন না। এখন নাকি অবস্থা বদলেছে। গ্রামান্চ্ল থেকে ছেলেমেয়েরা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়্গুলোতে বিভিন্ন বিজ্ঞান ভিত্তিক বিষয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছে। অবশ্য দেশে সুযোগও বেড়েছে। বিশ্ব্বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। বাবা-মায়েরা বুঝেছে লেখাপড়ার পেছনে পয়সা খরচ করাটা সবচেয়ে ভাল ইনভেস্টমেন্ট। গার্মেন্টসে মেয়েদের কাজের সুযোগ বেড়েছে। গ্রামের ছেলেরা আর্মিতে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়ে মিশনে যাবার সুযোগ পাচ্ছে। গ্রামে উনার পরিচিত একটি পরিবার এই মিশনের টাকায় প্রায় ভিখারী অবস্থা থেকে একটি স্বচ্ছল অবস্থায় পৌছেছে। সে পরিবারের একটি মেয়ে আজকে ডাক্তারী পড়ছে।

সবার সুখীময় সুন্দর জীবন গড়ে উঠুক। নতুন বছরের শুভ কামনায়।

৩,২০৩ বার দেখা হয়েছে

৩৮ টি মন্তব্য : “পুবের মানুষ যখন পশ্চিমে – ৬”

  1. দিবস (২০০২-২০০৮)

    অনেক বিষয়েরই সুন্দর বিশ্লেষণ পেলাম। মূল ফোকাসটা যতদূর মনে হয়েছে বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশের দিকে করেছেন।

    কোরিয়ান হুন্দাই, স্যামসাং,এল,জি কোম্পানীগুলা বাংলাদেশে ইনভেস্টের ব্যাপারে বেশ আগ্রহী। কিন্তু সম্ভবত রাজনৈতিক কারনের তেমনটা হচ্ছে না। এতদিনে স্যামসাং এর শুধুমাত্র সফটওয্যার বেসিস একটা R&D চালু হয়েছে। হুন্দাই এর একটা কার প্ল্যান্ট হওয়ার কথা শুনে আসছি গত প্রায় চার বছর যাবৎ। এবং এই ইনভেস্টমেন্টগুলাই এখন মায়ানমারের দিকে চলে যাচ্ছে। কোম্পানীর রিক্রুটিংএ মায়ানমারের নাম থাকলেও বাংলাদেশের নাম থাকে না।

    আর প্রবাসী ধার্মিকদের বিষয়টা আপনার কোন এক লেখাতে পড়েছিলা বিদেশে আসার পরপরই। সেই লেখাগুলোর প্রমাণ গত প্রায় চার বছরে হারে হারে দেখলাম। প্রবাস কাউকে বেশী মুক্তমনা আর কাউকে বেশী সংকীর্ন বানিয়ে দেয়। এটা আমার উপলব্ধী।

    অ টঃ আপু আপনাকে একটা ই-মেইল করেছিলাম বেশ কিছুদিন আগে। আপনি হয়তো খেয়াল করেন নি অথবা এড্রেসটা সঠিক ছিল না।


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      আসলে রাজনীতি নিয়ে লিখব না পরিকল্পনা করেও এর উল্লেখ হয়ে যায়। ব্লগ বিষয়টি খুব ভালো লাগে কারণ স্যামসাং এর কথা লিখতে গিয়ে আর লেখা হলো না। তুমি ঠিকই লিখে দিলে। এই আলোচনাটাই ব্লগের প্রাণ।

      ইমেইল এড্রেসটা ঠিক ছিল না। দিবস নামে সার্চ দিয়ে আমি তোমার কোন ইমেইল দেখলাম না। আমার ইমেইল এড্রেস হচ্ছে wahidaafza@gmail.com
      ধন্যবাদ তোমার মন্তব্যের জন্য।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
  2. তাওসীফ হামীম (০২-০৬)

    কোন লেখায় প্রথম কমেন্ট দিতে পারতেছি না, 🙁 আপা আপনার লেখার অপেক্ষায় থাকি সবসময়েই। বহুদিন পর লেখা পাইলাম, যাই এখন পড়ে আসি। :clap:


    চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।

    জবাব দিন
  3. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    চমৎকার লাগলো আপা। একটা দেশের সার্বিক উন্নতি খুব সোজাসাপ্টা ভাবে বললে কানেকটিং ডটস খেলার মত। প্রায় সবগুলো না মিললে ঝামেলা থেকেই যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তরুণ প্রজন্মকে পথ দেখাতে বাকি ডট গুলো জোড়া লাগানো জরুরী। জাফর ইকবাল স্যার হয়তো দেশে চাকুরী তৈরী করতে হয়ত পারেন নাই কিন্তু মামাতো ভাইয়ের কাছে শুনেছি উনার ছাত্রগুলোকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পড়তে পাঠাতে বা উৎসাহিত করতে উনি পিছু পা হন না, যেখানে অন্যান্য সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকরা দেবতাসম। বেশ কয়েক বছর আগে একটা লেখায় পড়েছিলাম। লেখক উপমা দিয়ে যে কথাটা বলেছিলেন তা ছিল অনেকটা এরকম, "যেই দেশে গরুর চেয়ে রাখালের সংখ্যা বেশী সেই দেশের উন্নতি বিঘ্নিত হবেই।" কথাটা হয়তো এখন প্রযোজ্য নয়। প্রচুর ছেলেমেয়ে এখন দেখছি সায়েন্সের বিষয়গুলোতে পাশ করে বাইরে পড়তে আসছে। সংখ্যাটা আর যেকোন সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। আইটি সেক্টরে উন্নতিটা বাঙলাদেশে আর যেকোন সেক্টরের থেকে দ্রুত হওয়ার দরকার। বিশ্বের সাথে তাল মেলানোর জন্য নয়, নূন্যতম হলেও আভ্যন্তরীণ চাহিদা ও পাগলামি, ছাগলামি ট্যাকল দেয়ার জন্য। শিক্ষকের কথায় ফেরত আসি। বাঙলাদেশের শিক্ষক (সরকারী ও বেসরকারী উভয়ই) সমাজের বাক্সবন্দী চিন্তাভাবনা থেকে নিজেদের বের হয়ে আসতে হবে। সবাইকে নয়। যারা উপরে বসে আছেন তাঁরা। নতুন শিক্ষকতা পেশায় যোগ দিয়েছেন এরমক বেশ কয়েকজনকে চিনি যার কাজ করতে চান ছাত্রদের জন্য, নিজের জন্য তথা ডিপার্টমেন্টের জন্য। আইনের ডিগ্রী নেয়ার পরে কেন এনভায়রনমেন্টাল এ্যান্ড এনার্জি পলিসি নামক এক নাম না জানা বিষয় পড়তে যাচ্ছি এই প্রশ্ন যখন ল' ডিপার্টমেন্টের সিনিয়ার শিক্ষকরা পর্যন্ত করে বসেন (যাদের দুই একজনকে মিডিয়াতে দেখাও যায় অনেক সময়।) তখন আর কিছু বলার থাকে না। দূরদৃষ্টি দরকার। সাহসী চিন্তা দরকার। সেটা শিক্ষকের মধ্যে না থাকলে ছাত্রদের মধ্যে আসবে কি করে? (সম্পাদিত)


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
      • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

        আপা অনেক ব্যস্ত তারপরেও সময় পেলে উত্তরটা দিয়েন। অপেক্ষায় আছি। 🙂


        \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
        অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

        জবাব দিন
        • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

          আচ্ছা সরি জবাব দেওয়া হয়নি। আমি যখন বুয়েটে পড়তাম তখন ক্লাসে এসে টিচাররা বলতেন যে আমরা তো তোমাদের পড়াচ্ছি দেশের বাইরে পাঠানোর জন্য। সেই ১৯৭১এর পর থেকে তড়িৎ কৌশলের অধিকাংশই বিদেশে চলে আসছে এবং টীচাররা এ ব্যাপারে খুব সহায়তা করতেন। তাই টীচারগণ বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারে সাহায্য করছেন আমার কাছে এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু বুয়েটে তাই'ই দেখে এসেছি। আমি বরং দেখতে চাই সেরকম শিক্ষককে যিনি ছাত্রদেরকে কিছু একটা করার জন্য উদ্ভাবনী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করছেন। এজন্য শিক্ষককেও অনেক রিসার্চ করতে হবে, অনেক বেশি ফোকাস থাকতে হবে। আমার মনে হয় আমাদের শিক্ষকরা (জাফর স্যারও এর মধ্যে পড়েন) বেশি ফোকাসড নন। সমাজে যাই ঘটছে সবাই যদি সব ব্যাপারেই মতামত দিতে চায় তাহলে ফোকাসড হবে কি করে?
          তোমার পড়াশোনার কম্বিনেশন খুব ঠিক আছে। এটুকু বোঝার মতো আধুনিকতা আমাদের দেশের কয়টা শিক্ষকদের আছে? আমি বলব বুয়েট যেটা করে তা হলো ছাত্রদের রিস্ক টেকিং আর সৃষ্টিশীলতাকে শুষে নিয়ে একদম রোবট বানিয়ে দেয়। এজন্য দেখা যায় বুয়েটের প্রকৌশলীরা বিদেশে এসে একজন খুব অর্ডিনারি প্রকৌশলী হিসেবে জীবন কাটিয়ে দেয়।


          “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
          ― Mahatma Gandhi

          জবাব দিন
          • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

            ধন্যবাদ আপা। আপনার কথার এঙ্গেলটা শুরুতে ধরতে পারি নাই। যেটা বলছেন সেটা শতভাগ সঠিক। আমাদের শিক্ষকরা বেশী ফোকাসড নন এটা মনে হয় শুধু প্রকৌশল বিষয়গুল‌ো নয় প্রায় যেকোন অনুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। জাফর স্যার তার মাঝেও আমি বলবো এগিয়ে। উনার ছাত্ররা ভাল কিছু প্রজেক্টে কাজ করছে। তবে দেখার বিষয় হলো এই ধরনের পরিস্থিতে উনি ফোকাস ছেড়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে মন্তব্য করছেন নাকি উনাকে বাধ্য করা হচ্ছে এই ধরনের আলোচনায় টেনে নিয়ে আসতে? সেটা অবশ্য জানা আমাদের কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

            হয়তো আইনের জগতে থেকে রাজনৈতিক বিষয়গুলো থেকে নিজেকে ধরে রাখা কষ্টকর, তারপরেও নিজের ডিপার্টমেন্টের কথা বললে (সরাসরি নাম উল্লেখ করবো) ডঃ শাহদীন মালিক, ডঃ তুরিন আফরোজ চাইলে ছাত্রদের অনেক কিছু দিতে পারতেন। নিজে ব্র্যাকে পড়ার সময় উনাদের বেশীরভাগ রুটিন ক্লাশে আসতে দেখি নাই, শুক্র-শনি মেক-আপ ক্লাশ নিয়ে চালিয়ে দিয়েছেন, এখনো চালাচ্ছেন। তুরিন ম্যাডাম মুট কোর্ট দল, বিতর্ক দলের মেন্টর হিসেবে দেশে বিদেশ থেকে সুনাম বয়ে এনেছেন ডিপার্টমেন্টের জন্য কিন্তু বয়সে নবজাতক এই ল' ডিপার্টমেন্টের ভিত্তিটি শক্ত হবার জন্য দরকার ছিল একনিষ্ঠ কিছু শিক্ষক। পাই নাই। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে রেকমেন্ডেশান লিখে অবশ্য ঠিকই দিয়েছেন।

            একজন বহিরাগত হিসাবে বুয়েট ও ছাত্রদের দেখে যা মনে হয় লোহা ঠিক মত লাল অঙ্গার গরম করা হচ্ছে কিন্তু তারপরে হাতুড়ির বাড়িগুলো পড়ছে ভুল জায়গায়। অনেক অভিযোগ টাইপের মন্তব্য করে ফেললাম। চাপা ক্ষোভ কিছুটা পিছলে বের হয়ে গেল! 😕


            \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
            অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

            জবাব দিন
            • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

              ছাত্রদের যদি রাজনীতি করতে হয় তবে এইসব বিষয় নিয়ে রাজনীতি করবে। একজন শিক্ষক ক্লাসে ঠিকমতো আসবে না এই বিষয়টি কিভাবে মেনে নেওয়া যায়? প্রাইভেট ভার্সিটিতে তো ছাত্রদের আরও সচেতন থাকার কথা। একজন শিক্ষকের মানসিকতা আসলে সমাজের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায।


              “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
              ― Mahatma Gandhi

              জবাব দিন
  4. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    বেশ অনেকদিন পর লিখলেন শান্তা'পা। আর দুই একমাস এদিক ওদিক হলেই আপনার সিরিজটার দুই পর্বের গ্যাপ পুরো একবছর হয়ে যেতো মনে হয় 😀

    ইচ্ছাকৃত বা জোর করে লেখালেখিতে গ্যাপ দিয়ে ছিলেন কেন জানিনা, জীবনটা অভিশপ্তই বা কেন বললেন সেটাও জানিনা, তবে নিজের আর নিজের আশেপাশের কিংবা নিকটজনদের অভিজ্ঞতাগুলোর সাহসী বর্ণনা বড়ই সুখপাঠ্য হয় আপনার লেখনীতে। বাইরে থাকছেন অনেকদিন তাই উন্নত বিশ্বের অনেক দরকারি জায়গাগুলোয় বাংলাদেশের চেয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই অন্যদেশগুলোর বেটার এক্সেপ্টেন্সটাও আপনাদের চোখে ভালো ধরা পড়ে।

    হতাশাময় হলেও সত্য, আমাদের দেশের জন্য সামনেও তেমন কোন সুখবর নেই। ঘুরে দাঁড়ানোর সবকটা রাস্তাই সম্ভবতঃ নাই হয়ে যাচ্ছে, দেশের মানুষগুলো পাইকারি দরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছি।


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      এটা কি কাইয়ূম না কাইয়ূমের ভূত ঃ)

      প্লেটে অনেক জিনিষ নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। কিছু কমানোর জন্য ব্লগ থেকে বিরত ছিলাম। আর অভিশপ্ত বিষয়টি না বুঝলে কখনও সাক্ষাৎ হলে বুঝিয়ে বলব।
      আসলে মানুষের সুখের পরিমাণ উন্নত বা অনুন্নত দেশের উপর নির্ভর করে না। জীবনটা তো আসলে নদীর মতো প্রবাহমান। এর আনন্দ ছুটে চলার মধ্যে। দেশ বা বিদেশ যেখানেই আমাদের জীবন কাটুক না কেন যখন সামনে প্রবাহের পথ থাকে না তখন দিশেহারা হয়ে যাই। বাইরের খারাপ দিকটাও তো বলি। আমাদের দেশের ভোকাল তরুণরা সবসময় ফোকাস পয়েন্টটা এমন করে রাখে যে তা দেশকে অশান্ত করে তোলে।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
  5. টিটো মোস্তাফিজ
    লেখা ব্যাপারটা অনেকটা প্রসববেদনার মতো। পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায় না। সময় যখন হয় তখন তেড়ে-মেড়ে বেড়িয়ে আসে। হোক তা সুস্থ কিম্বা বিকলাঙ্গ

    :thumbup:


    পুরাদস্তুর বাঙ্গাল

    জবাব দিন
  6. জিহাদ (৯৯-০৫)

    মনখারাপের ভূতকে মন কিংবা মাথা থেকে নামাতে নানাজনে নানারকম কাজ করে। কিন্তু আমার জন্য লেখালেখি করাটা সবচে বেশি কাজে দেয়। বহুবার বহুসময়ে পরীক্ষিত আমার লাইফে।

    অনেকদিন পর লেখা পড়লাম আপু আপনার। ভালো আছেন সবমিলিয়ে আশা করি।

    অফটপিক: সিসিবি এডিটরে বাংলা কীবোর্ড কিন্তু আবার এড করে দেয়া হয়েছে কয়েকমাস আগে।


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  7. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    লেখাটার প্রথ চার প্যারা পড়লাম। অনেক কিছু বলবার ছিলো বিষয়গুলো নিয়ে। তবে আবার ফিরবো পুরো লেখা পড়তে।
    আপনার লেখার ধরণটা আসলেই দারুণ। বেশ ধরে রাখে। বড় লেখা পড়তে পারি না ইদানিং। তাই ভাগ করে পড়তে হলো। মন্তব্য পেন্ডিং থাকলো।

    ভালো থাকবেন।

    জবাব দিন
  8. শাহীন (৯৬-০২)

    আপু খুবই সুন্দর। অনেক কিছুই অনেক সময় বলার ইচ্ছা হয়, কিন্তু বিভিন্ন পরিস্থিতির কারনে বলা হয় না বা বলতে পারি না।

    আপনার প্রথম চার লাইনের সাথে বাংলাদেশে থাকা ৯০% লোকের উদাহরন দেয়া যায়। যতক্ষন না নিজের উপরে বা নিজেদের উপর কোন প্রভাব আসে না ততক্ষন আমরা কিছু বলি না বা বলতে চাইও না। আপনার এই অদৃশ্য দেয়াল আমাদেরকে যে কিভাবে আটকে রেখেছে তা বলা বাহুল্য।

    আর বাকি রাজনীতির কথা, শুধু একটাই প্রশ্ন, যারা রাজনীতি করে তাদের উদ্দেশ্য কি? কেন তারা রাজনীতি করে? আশা করি এই প্রশ্নের জবাব জানা থাকলে আর কোন প্রশ্ন জাগবে না মনে।

    আমাদের দেশের কয়টা উচ্চপদস্থ ব্যক্তি যাদের দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলার ক্ষমতা আছে, তারা তাদের ভবিষ্যত প্রজস্মকে এদেশের মাটিতে বড় হতে দেয়। এদেশের মানুষের কাছে আসতে দেয়। আমাদের সংস্কৃতিকে জানতে দেয়। আর আমার যদি কোন জিনিসের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকে তবে সেই জিনিসের প্রতি আমার আনুগত্যটা আশা করাটাই অনুচিত।

    মন থেকেই শুধু বলছি কথাগুলা, কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু না।


    The Bond Cadet

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      ধন্যবাদ শাহীন তোমার মন্তব্যের জন্য। আমার এই লেখাটি আসলে শেষ হয়নি। অনেক বড় হয়ে যাচ্ছিল দেখে রাশ টেনে ধরেছিলাম। পরের অংশে তোমার কথাগুলোর আমার ভার্সনের উত্তর পাবে। আসলে শুরু করেছিলাম না যে মানব প্রজাতি খালি চলছে তো চলছেই। সেই চলা এখনও শেষ হয়নি। হয়তো কখনই শেষ হবে না। আমরা শুধু আগের প্রজন্মের ধরিয়ে দেওয়া রিলে হাতে নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছি। তুমি, আমি আর রাজনীতিবিদ কেউ'ই তার ব্যতিক্রম নয়।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
  9. হক(০৩-০৯)

    "বাংলাদেশি ছেলেরা বোধহয় অপেক্ষাই করে বৌ এসে তাদের জীবনটা সাজিয়ে দেবে ।তার আগ পর্যন্ত যেন-তেনভাবে থাকা জায়েজ "
    কথা সত্য। আপু।
    আমি লস আঞ্জেলেসে আছি। তবে অপেক্ষা মায়ের জন্য। আরও ২ বছর।
    লেখাটা খুব ভালো লাগলো। লস আঞ্জেলেস আসলে জানাবেন ।

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      আমার কথা আবার লিটারেলি নিও না। আশপাশে যা দেখি তাই লিখি। কতটুকুই আর দেখতে পারি?
      লস এ্যঞ্জেলসে প্রায়ই যাওয়া হয়। আমার খুব ইচ্ছা একবার আমার এই এলাকায় একটা সিসিবি গেট-টুগেদারের ব্যবস্থা করব। কিন্তু আপাতত ব্যক্তিগত বিষয় ব্যস্ত থাকায় সেটা করতে পারছি না। কিন্তু খুব ইচ্ছা আছে করার। তখন পারলে এদিকটায় এসো।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
  10. তাশরীফ (২০০৭-১৩)

    প্রথম আপনার লেখা পড়ি ক্যাডেট কলেজের ৫০ বছর পুরতির ম্যাগাজিনে। ব্যাপক লেখেন আপনি। আশা করি নতুন জুগের এই বিশেশন আপনার খারাপ লাগবে না।


    আমাকে আমার মত থাকতে দাও...

    জবাব দিন
  11. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    আপু, যখন কোন বক্তব্যের বিপরীতে কোন যুক্তি খুজে পাওয়া যায় না তখন তা মেনে নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আপনার লেখার সাথে ১০০ ভাগ একমত।

    আপনার ব্লগটা বড় হয়েছে সত্যি কিন্তু পড়তে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। মনে হচ্ছে না, 'শেষ হয় না কেন।' অনেক দিন পর লিখলেন।

    একবার আপনি আমার ব্লগে কমেন্ট করেছিলেন, বিশ্বাস করেন, আমি প্রতিদিন ৩-৪ বার করে মুগ্ধতা নিয়ে দেখতাম। আপনার লেখা এতই ভালো লাগে যে, আপনি আমার ব্লগে কমেন্ট করছেন তাতেই আমি খুশিতে আত্নহারা :awesome: :awesome:

    পরের পর্বটা পড়ার জন্য বসে থাকলাম। আশা করি বেশি দেরী করাবেন না 🙂


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।