গর্ভ

(গল্পটি ২০০৯ লেখা। ব্লগে পোষ্ট করলে লেখাটির একটি অস্তিত্ব থাকে। তাই পোষ্ট করা।)

নদীটি খুব একটা প্রশস্ত নয়। আবার নালার মতো সরুও নয়। তবে নামটি এর কাছাকাছি। একটু অদ্ভুত। নলছিটি। আর বাদবাকী সবকিছু একই রকম। সেই চিরাচরিত গ্রামের দৃশ্য – নগরে বাস করা ট্রেনিংপ্রাপ্ত দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুরা যেরকমটা এঁকে থাকে। একটি নদী। তারপাশে দিগন্তজোড়া ধানক্ষেত। দূরে একটি প্রকাণ্ড বটগাছ। সেই বটগাছ থেকে পাকানো রশির মতো লম্বা লম্বা ঝুল নেমে এসেছে। হতে পারে কাকতলীয়, কিন্তু এই গ্রামেই ঠিক তেমনি একটি বটগাছ আছে। গাঁয়ের মেয়ে রাহেলা সেখানটায় প্রায়ই আসে। বয়স চৌদ্দ কি পনের। ওর বান্ধবীদের অনেকেরই বিয়ে হয়ে গেছে। গ্রামে এখন সেলফোন, টেলিভিশন চলে আসলেও বাল্যবিবাহ ঠেকানো যায়নি। আপাতত রাহেলার এই সমস্যা নেই। সে বিয়ে করতে চাইলেও তার বাবা আর ভাই তা হতে দিবে না। ওরা চায় রাহেলা লেখাপড়া করুক। লক্ষীমেয়ের মতো রাহেলা তা করেও যায়। সবার বড়ই আদরের সে। অপার স্বাধীনতা। যখন ইচ্ছে হয় তখন এই বটগাছের নিচে চলে আসে। দূরে নলছিটি নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। পাল তোলা নৌকাদের বহর দেখে। বাতাস বয়। নৌকার পাল ফুলে উঠে। ধানক্ষেতে দোলা লাগে। গত হাটবারে রাহেলা মায়ের সাথে গন্জের সিনেমা হলে গিয়ে ‘খাইরুন সুন্দরী’ ছবিটি দেখে এসেছিল। এখন ইচ্ছে করছে আইলের উপর দিয়ে নাচতে নাচতে গান গাইতে। নায়িকা মৌসুমীর মতো। বয়স হলে এই এক সমস্যা। 
সামনে একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ে কাদার মধ্যে নেমে লাফালাফি করছে। সবচেয়ে বেশি লাফাচ্ছে আকাশ। কদল মাঝির ছেলে। ছেলেটাকে এই সেদিন চোখের সামনে জন্ম নিতে দেখলো। আর এখন পাঁচ বছর হয়ে গেছে। আকাশ আজকেও ন্যাংটা হয়ে খেলছে। কাছে গিয়ে রাহেলা খপ করে আকাশের হাত ধরে ফেললো।
‘তোরে না একটা প্যান্ট সিলাইয়া দিছিলাম। ওইড্যা পরস নাই ক্যা?’
‘হি হি হি।’
চারপাশ থেকে সমস্বরে হাসি। শুধু আকাশের নাজেহাল অবস্থা। হাতটা না ছেড়ে রাহেলা উঠে দাড়াল,
‘চল তোর বাড়িত গিয়া প্যান্ট পরাইয়া নিয়া আসি।’
রাহেলা সত্যি সত্যিই রওনা হয়। সাথে শক্ত করে ধরে রাখে আকাশের হাত।
‘রাহেলা, রাহেলা?’ পেছন থেকে মজিদ ডাকতে থাকে। সম্পর্কে সে রাহেলার চাচাতো ভাই। ওদের বাসাতেই আশ্রিত হিসেবে থাকে।
রাহেলা পেছন ফিরল। বলল, ‘আবার ঝামা নিয়ে যান কই? এই না হাট থেকে আইলেন।’
‘চাচীর আরো কয়েকটা সদাই লাগবো। ‘
‘যাবেন কই?’
‘ভান্ডারিয়ার হাটে।’
‘সেই লঞ্চ ঘাটের পাশে! আজক্যে একবার না সেইখান থিকা আইলেন?’
মজিদ কিছু না বলে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে থাকলো। 
রাহেলার নিজের মায়ের উপর বড্ড রাগ হলো। তার মা গরু ছাগলের চেয়েও মজিদ ভাইকে খাটায় বেশি। তারপরও মানুষটার মুখ থেকে কখনও হাসি মিলিয়ে যায় না। জন্ম থেকেই সে মজিদকে তাদের বাড়িতে দেখে আসছে। শুনেছে যে বাবার এক জ্ঞাতিভাই মারা যাওয়ার পর তার বৌয়ের অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়। চার বছরের মজিদের যাওয়ার কোন জায়গা ছিল না। শেষে বাবা তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। নিজের ছেলের মতোই মানুষ করতে চেয়েছিল কিন্তু মার জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। মা নিজের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়েছে আর মজিদকে দিয়ে কামলার কাজ করিয়েছে। রাহেলার বড্ড মায়া হয়। সে বলে,’দূরে যাওনের দরকার নাই। কাছ থিক্যা সদাই কইর‍্যা নিয়েন।’
‘চিন্তা কইরো না। তুমার লাইগ্যা কিছু আনুম?’   
অনেকদিন থেকেই রাহেলার একগাছি রেশমি চুড়ির শখ হচ্ছিল। কিন্তু সে বলল না। এখনই বাসায় গিয়ে মায়ের সাথে বোঝাপড়া করতে হবে। উনি কেন এতো দূরের হাটে মজিদ ভাইকে দুইবার করে পাঠাচ্ছেন? মুখে বলল,
‘কিছু লাগবো না। নিজের লাইগ্যা একটা জামা কিনেন। আছে তো মোটে দুইড্যা। তার মদ্যি একটায় তালি আরেকটায় ফুটা।’
হাসতে হাসতে মজিদ ভাই বিদায় নিল। মানুষটা এতো সরল যে হাসার সময় আকাশের মতো একটা বাচ্চা ছেলে হয়ে যায়। রাহেলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ওর হাতটা ছেড়ে দেওয়ার আগে একটু শাসাল,
‘আইজক্যার মতো মাপ করলাম। এরপর আরেকদিন প্যান্ট ছাড়া দেখলে গোবর ল্যাপা প্যান্ট পরাইয়্যা দিমু।’
বাচ্চাদের দলটা আবারো সমস্বরে হেসে উঠলো। 

রাহেলাদের বাড়ির সামনে কোন উঠোন নেই। টিনের চাল আর বাঁশের বেড়া দিয়ে তাদের বাড়িটা তৈরি হয়েছে। মেঝে মাটির। মোট চারটা ঘর। সবগুলোই বেড়া দিয়ে বেড় দেওয়া। রাতের বেলা একটু হাঁচি-কাশি বা বিছালার এপাশ-ওপাশ হলে এ ঘরের শব্দ ও ঘরে চলে যায়। দরজা, জানালা অবশ্য কাঠের তৈরি। শক্ত-পোক্ত। বাড়ির পেছনের দরজা খুললে একটা ছোট্ট উঠোন পড়বে। তার পশ্চিম দিকে আছে রান্নাঘর, উত্তরে গোয়ালঘর। দক্ষিণ দিকটা খোলা। সেখান দিয়ে রাহেলাদের পাটক্ষেতে যাওয়া যায়। সারা উঠোন জুড়ে আমসত্ত্ব শুকোতে দেওয়া হয়েছে। রাহেলা নারকেল গাছের পাতা থেকে একটা সরু কাঠি বের করে। সেটা দিয়ে একটু খুঁচিয়ে দেখলো আমসত্ত্ব শুকলো কিনা। রান্নাঘরে বসে মা একা একাই গজগজ করছে। এক পাশে বাবা হুঁকোতে টান মারছেন।
‘চার মাইয়্যারে বিয়া দিছেন গেরামে। হেরা কোনদিন কুচি দিয়া শাড়ি পড়লো না, আর একটা বছরও হইলো না ছেলের বৌ শহরে গেলো, এখন গেরামে বেড়াইতে আসে কুচি দিয়া শাড়ি পইর‍্যা। হাতে আবার ভানিটি ব্যাগ।’
বাবা আর রাহেলা কেউ আর মায়ের কথার উত্তর দেয় না। মায়ের স্বভাব এরকমই। কখনও ছেলের বৌ, কখনও মজিদ কিম্বা প্র্তিবেশী কারও মুণ্ডুপাত করতে পারলে মায়ের শান্তি হয়। মায়ের কথা চলতে থাকে।
‘রাহেলারে আমি আর গেরামে বিয়া দিমু না। শহরে দিমু। আমার সারা জীবন তো গেলোই। কিছুই দেখবার পারলাম না। এখন আজাদ যেইড্যা কইছে সেইড্যাই করেন।’
আজাদ রাহেলার বড় ভাই। ঢাকা শহরে থাকে। সেখানে চাকরি করে।
বাবা বললেন, ‘ঘর বাড়ি ফেলাইয়্যা যাবা?’ 
‘হেইট্যা হইবো কেন? মজিদ পাহারা দিব।’
‘আগে তাইলে রাহেলার বিয়ার সমন্ধ করি।’
‘হের লাইগ্যাই তো যাওন। শহরে গিয়ে মাইয়ার সমন্ধ করুম।’
‘তোমরা মা-বেটি শহরে যাও। আমি এখানেই থাকি।’
‘শহরে থাকনের পয়সা লাগবো না? হেইড্যা কি আপনি গেরাম থেকে পাঠাইতে পারবেন? আর আজাদ তো আমাদের যাইতে কইছে আপনেরর লাইগ্যা। আপনি না যাইলে আমরা যাই কি কইর‍্যা?’
কথাটা ঠিকই। কিছুদিন আগে আজাদ ঢাকা থেকে চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছে যে তার ফ্যাক্টরীর মালিকের একটা খালি জমি পরে আছে। আজাদ মালিকের বেশ পছন্দের একজন বিশ্বাসী কর্মচারী। মালিক তার কাছে সেই জমিটা দেখাশোনার জন্য একজন কেয়ারটেকার চেয়েছেন। কেয়ারটেকার সেখানে বিনা ভাড়ায় থাকতে পারবে, উপরন্ত মাস গেলে হাতে কিছু টাকা পাবে। আজাদ চাইছে এতবড় সুযোগটা তার বাবা গ্রহন করুক। তাহলে তারা সবাই একসাথে থাকতে পারবে। এতে ঢাকা শহরে থাকার একটা বিশাল খরচ বেঁচে যায়। আর মা যদি আজাদের ছেলের দেখাশোনা করতে পারে তাহলে তার বৌ গার্মেন্টসে চাকরী শুরু করতে পারবে। এই শহরে আকাশে বাতাসে টাকা উড়ে বেড়ায়। এই সুযোগটা এখন নিতে না পারলে পরে পস্তাতে হবে। সেই সাথে রাহেলার লেখাপড়ার কথাও উল্লেখ করেছে। তার ছোটবোনটা যেহেতু ভাল ছাত্রী, ঢাকায় আসলে সে ভাল সুযোগ পাবে। সুযোগ সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি করে।
এ চিঠির পর থেকে রাহেলা স্বপ্নের ভুবনে উড়তে শুরু করেছে। গত কোরবানীর ঈদে শহর থেকে ভাই-ভাবি গ্রামে বেড়াতে এসেছিল। ভাবি ফাতেমার কাছে শহরের অনেক গল্প শুনেছে। সেখানে কত কিছু করার আছে। ভাবি নাকি নিজে চাকরি করবে। শহরে ভাবির বাসার কাছে মার্কেট। সে মার্কেট থেকে ভাবি নিজের হাতে রাহেলার জন্য শাড়ি, চুড়ি, স্নো আর লিপস্টিক কিনে এনেছে। ভাই-ভাবি নাকি প্রতি মাসে হলে গিয়ে একটা করে সিনেমা দেখে। এরপর থেকে তো রাহেলার আর পড়াশোনায় মন বসে না। নলছিটি নদী, পাল তোলা নৌকা, ধানক্ষেত, বটগাছ – এসব কিছুর প্রতি মায়াটা আলগা হয়ে গেছে। নিজের বোনদের জীবন তো দেখেছে। এক গ্রামে বড় হওয়া। তারপর আরেক গ্রামে বিয়ে হওয়া। রাহেলা সে জীবনের মধ্যে দিয়ে যেতে চায় না। সে চায় তার ভাবির মতো জীবন। স্বাধীনতা। বোতাম টিপেই টেলিভিশন দেখতে চায়, সুন্দর করে সাজতে চায়, ভালোমন্দ খেতে চায়। চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘুরতে চায়। রঙ-বেরঙের মানুষ দেখতে চায়। মাঠ থেকে তড়িঘড়ি করে বাড়িতে ছুটে এসেছিলো মাকে একটু বকে দেবে বলে। কিন্তু মজিদ ভাইয়ের প্রতি সেই দরদ এখন উড়ে গেছে। সেখানে এখন ঢুকে গেছে একটা পোকা। শহরে যাবার পোকা। কুরকুর করে তা এখন তার মাথার মগজ গিলে খাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত বাক্সপ্যাটরা বেঁধে একদিন সত্যি সত্যিই বাবা-মা সহ রাহেলা ভান্ডারিয়ার লঞ্চ ঘাটে এসে পৌছুলো। মজিদ ভাই তাদের বড় বোঁচকাটা মাথায় করে বহন করে এনেছে। এই ঘাট থেকে এখন চাচার পরিবারকে বিদায় দিয়ে চলে যাচ্ছে। রাহেলার সেদিকে খেয়াল নেই। সে তাকিয়ে আছে সামনে।  স্বপ্নময় দৃষ্টিতে। রোদের আলোয় চিকমিক করছে ধলেশ্বরী নদী। কে বলে স্বপ্ন রঙ্গীন নয়? সোনালী-রূপালী রং ছাড়া কি স্বপ্ন স্পষ্ট হয়? রাহেলা আর পেছন ফিরে না। তার কোন অতীত নেই, নেই কোন স্মৃতি। যা ছিল সব উড়ে গেছে। তাদেরকে মুক্ত করে দিয়ে রাহেলা নিজে মুক্তির পথে পা বাড়াচ্ছে। মজিদ ভাই তখনও ঘাটে দাড়িয়ে আছে। একসময় লন্চ চলতে শুরু করে। ধলেশ্বরী ছেড়ে দিক-বিদিকহীন বিশাল মেঘনার বুকে প্রবেশ করে। ভোলার ঘাটে থামে। একদল মানুষ নেমে যায়। আরেক দল উঠে। সাথে তাদের বোঁচকা-বুঁচকি। পরের স্টেশন চাঁদপুর। সেখানেও কোলাহল। যাত্রীদের ধাক্কাধাক্কি করে নিজেদের জায়গা করে নেওয়া। লঞ্চের একতলায় থার্ডক্লাস। বসার জন্য আলাদা কোন সীট নেই। খালি ফ্লোর। সেখানে যাত্রীরা বসে পড়ছে যে যার ইচ্ছে মতো। রাহেলা এক ঠায় বসে থাকে। উঠে না। উঠলে যদি জায়গাটা কেউ দখল করে নিয়ে যায়। নিজেদের মালপত্রও তো দেখে রাখতে হবে। মা-বাবা তো শুরু থেকেই ঘুমে আচ্ছন্ন। একসময় ঢাকা শহরের সদরঘাটে লঞ্চ ভীড়ে। লঞ্চ থেকে নামার পর রাহেলার স্বপ্নময় ঢাকা শহর বাস্তব রূপ ধারণ করে। সদরঘাট লোকে-লোকারণ্য। চারপাশের কোলাহল, ছুটে চলা তাকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। সে মায়ের হাত শক্ত করে ধরে রাখে। বাবা তার ভাইয়ের বাসায় আগেও কয়েকবার এসেছিলেন। এই শহরটা তার কাছে একেবারে নতুন নয়। তাই এবার নিরাপদ নিশ্চিন্তে মা আর মেয়েকে নিয়ে সদরঘাট থেকে মিরপুরে পৌঁছুতে অত বেগ পেতে হলো না। ভাই বাসায় ছিল না। ভাবি আন্তরিকতা দিয়ে তাদের গ্রহন করলো। 
মালিকের আট কাঠা জমির প্লটে একটা টিনের ঘরের মধ্যে আজাদ তার বৌ-বাচ্চা নিয়ে দুদিন আগেই উঠে গিয়েছিলো। এই জমির দুপাশের প্লটেই বিল্ডিং উঠে গেছে। পূর্বদিকের প্লটটা আমেনা বেগমের। সেখানেও একটা চারতলা বিল্ডিং। সে বিল্ডিং এর গেটের বাইরে একটি নেমপ্লেটে লেখা আছে “আমেনা ভিলা””। সেখানে মোট আটটা ফ্ল্যাট। তারমধ্যে সাতটাতে ভাড়াটিয়া বসবাস করছে। দোতলার দক্ষিনদিকের ফ্ল্যাটটা শুধু খালি পড়ে আছে। আমেনা বেগম সপরিবারে বিদেশে থাকেন। মাঝেমধ্যে দেশে আসলে খালি ফ্ল্যাটটায় উঠেন। ‘আমেনা ভিলা’র কেয়ারটেকারের নাম রহিম। ছাদের উপর চিলেকোঠার ঘরে রহিমের ব্যাচেলর সংসার। পশ্চিমদিকের প্লটটার মালিক এক সাবেক মেজর জেনারেল। সেখানেও একটা চারতলা বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। মাঝখানের এই খালি জমিটা নিয়ে এখনও আদালতে দখলদারীর মামলা মোকাদ্দমা চলছে। মূলত নিজের দখলে রাখার জন্যই মালিকের একজন কেয়ারটেকারের প্রয়োজন হয়েছিলো। 

রাহেলাদের শহরবাসের সবকিছুই এ পর্যন্ত পরিকল্পনামাফিক এগুচ্ছে। তাই এই বিশাল শহরে মিশে যেতে তাদের তেমন বেগ পেতে হয়নি। মা নাতির দায়িত্ব নেবার পর ভাবি গার্মেন্টসে চাকরী শুরু করেছে। বাজার সদাই আর টুকটাক বিল দেওয়া ছাড়া বাবাকে সব সময় বাসাতেই থাকতে হয়। এটাই বাবার কাজ। রাহেলাকে ওর ভাই কাছের একটা স্কুলে ক্লাস নাইনে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। এই স্কুলটা সরকারী। ছাত্রছাত্রিরা সবাই তার মতোই নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘর থেকে আসা। গ্রামের স্কুলে রাহেলা ক্লাসে প্রথম হতো।  এজন্য আজাদের তাকে নিয়ে খুব আশা-ভরসা। বোনকে সে ডাক্তারী পড়াতে চায়। তাকে নিয়ে ভাইয়ের এই উচ্চাশা দেখে রাহেলা ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যায়। ভাইতো আর জানে না গ্রামের স্কুলে লেখাপড়ার অবস্থা কি রকম! সে স্কুলে খাতা কলমে বিশজন ছাত্রীর নাম থাকলেও তারা মোটে পাঁচ ছয়জন নিয়মিত ক্লাস করতো। শিক্ষক- শিক্ষিকার অবস্থা আরো করুন। ইংরেজি বিষয় শিক্ষা দেবার মতো কেউ ছিল না। দু’জন পরীক্ষা দিলেও একজন প্রথম হয়। সেভাবে তাই নাম কা ওয়াস্তে ক্লাসে রাহেলার প্রথম হওয়া। এখন ঢাকার স্কুলে ভর্তি হয়ে বুঝতে পারছে তার লেখাপড়ার অবস্থা আসলে কিরকম। দুর্বল ভিত্তির উপর ইমারত দাঁড়াতে পারে না। ক্লাসে গিয়ে রাহেলাও বুঝতে পারে না শিক্ষকের কথা। সবচেয়ে বড় কষ্ট যে এই সমস্যার কথা সে কাউকে বলতেও পারে না। নিজের মধ্যে এখনও গ্রামের তরতাজা সীল। সহপাঠীরা বস্তিবাসী হলেও অনেকদিন ধরে শহরে থাকে। অন্য সবার থেকে তার দূরত্বটা অস্পষ্ট হলেও প্রচ্ছন্ন। সে কোন বান্ধবী খুঁজে পায়না। পড়াশোনার ব্যাপারে কার কাছ থেকে সাহায্য চাইবে? কাকেই বা বলবে এই সমস্যার কথা? যার ফলে দিন দিন তার লেখাপড়ার সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে। হয়ে পড়ে সে অমনযোগী ছাত্রী। আর এই ফাঁকে মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাড়ায় পাশের বাড়ির কেয়ারটেকার রহিম।
মালিকের জমিটার একদিকে রাহেলাদের জন্য টিনের চালা ঘর তৈরি করা হয়েছে। আর বাকী অংশ পুরোটাই খালি। আজাদ একদিকে দড়ি টানিয়ে কাপড় শুকোনোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বিকালে গোছলের পর রাহেলা সেখানে কাপড় মেলতে আসে। সে রাস্তার দিকে মুখ করে ‘আমেনা ভিলা’র দিকে উল্টো ঘুরে দাড়ায়। এমনটা সে ইচ্ছে করেই করে। সে সুযোগ দেয় রহিমকে। চারতলা থেকে রহিমকে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকবার জন্য। সে কাপড় মেলে ধীরে ধীরে। প্রয়োজনের থেকে অতিরিক্ত সময় নিয়ে। এই সময়টা তার বুক ধরফর করতে থাকে। হাতের তালু ঘেমে উঠে। মুখ লজ্জায় রাঙ্গিয়ে যায়। তারপরো সে এমনটা করে। ঘোরলাগা ভালোলাগায় সে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। এই আচ্ছন্নতা নেশার মতো। তাকে এড়িয়ে যাবার শক্তি রাহেলার নেই। আবার এক ধরণের অপরাধবোধ তাকে এই শক্তির মুখোমুখি হতে বাঁধা দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে পারে না। একদিন সে ‘আমেনা ভিলা’র মুখোমুখী হয়। ছাদের দিকে তাকায়। আর সেদিনই তার রহিমের সাথে প্রথম চোখাচোখী হয়। রাহেলার জীবনে বিপদের শুরুটা এই ঘটনার পর থেকেই।
রাহেলা এরপর থেকে যখন-তখন ঘরের বাইরে চলে আসে। ‘আমেনা ভিলা’র ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছাদে বসে থাকা ছাড়া তো রহিমের আর কোন কাজ নেই। থাকলেও রহিম তা ভুলে যায়। রাহেলা যখন স্কুলে যায় রহিম তখন নিচে নেমে আসে। ‘আমেনা ভিলা’র গেটের কাছে দাড়িয়ে থাকে। এক ঠায়। রাহেলার হাঁটার গতি কমে আসে। সে মাটির দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে এগুতে থাকে। শুধু সে জানে যে রহিম তাকে দেখছে। খুব ইচ্ছে করে রহিমের দিকে একবার তাকাতে। চক্ষুলজ্জা, লোকলজ্জা সবকিছু তখন বাধা হয়ে দাড়ায়। আগে পড়াশোনা কঠিন লাগতো বলে করতো কম। এখন সেই কমটুকুও শূণ্যের কোঠায় নেমে আসে। বইয়ের মধ্যে রহিম। স্কুলের ব্ল্যাক বোর্ডে রহিম। চোখ বন্ধ করলে রহিম। আর জেগে থাকলে অকারনে খালি কাপড় মেলতে ঘরের বাইরে চলে আসা। ক্ষণে ক্ষণে আপন মনে হেসে উঠা। ষোল বয়সের আনন্দময় যন্ত্রণা সে হাড়ে হাড়েই বুঝতে পারছে। এ যেন তার সুখের অসুখ। বুদ্ধিমান মা কিছুটা আঁচ করতে পারে। একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করে,
‘পাশের বাড়ির পোলাড্যা দেখতে শুনতে বেশ সোন্দর। হের সমন্ধে ভালো মন্দ কিছু জান?’
‘বাড়ির ভাড়া তোলে আর দেখা শোনা করে। মাসে বার হাজার টাকা বেতন পায়।’
‘কও কি? দ্যাশ কোথায়?’
‘বাগের হাট।’ 
‘হেইড্যা কোথায় খুলনার কাছে না? ত খুলনার মানুষ খারাপ হয় না। কি কন?’
কথাটা বলেই মা আড় চোখে মেয়ের দিকে তাকায়।  রাহেলা মায়ের উপর কৃতজ্ঞ হয়ে উঠে। এরপর তার মনে আর কোন দ্বিধাদ্বন্ধ থাকে না। শুধু ভেতরের অস্থিরতা হু হু করে বেড়ে যেতে থাকে; ভালবাসার কলি কবে ফুটবে? অজানা আশংকায় বুক কেঁপে উঠে – আদৌ ফুটবে তো?
সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। সোডিয়ামের আলো আর উঁচু উঁচু দালানকোঠা শহুরে মানুষজনের কাছে পূর্ণিমার চাঁদকে রূপকথার গল্প বানিয়ে দিয়েছে। তারপরও যারা একটু-আধটু কবিতা পাঠ করে, তাদের মনোলোকে সুকান্তের পূর্ণিমার চাঁদ। রাহেলার চোখে পূর্ণিমা কেমন তা বুঝতে হলে খোলা মাঠে যেতে হবে। যেতে হবে নদী, ধানক্ষেত আর বটগাছের কাছে। রাহেলা এখন আর সেখানে যেতে পারে না। তবে সে সাথে করে নিয়ে এসেছে একটি বিস্তীর্ণ প্রান্তর, জোনাক পোকা আর পূর্ণিমার রাতের আবেদন। তাদের মালিকের জমিটা এখনও খালি পড়ে রয়েছে। একট-আধটু হলেও জোছনা এখানে উঁকি মারে। আর সে আবেদনেই রাহেলার পাগল-পাগল অবস্থা প্রায়। সে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। তৃষাতুর দৃষ্টিতে ‘আমেনা ভিলা’র ছাদের দিকে তাকায়। সেখানে একটা জ্বলন্ত ফুলকির উঠানামা। রহিম তার জন্য অপেক্ষা করছে। এইটুকুই যথেষ্ট। রাহেলার এই জীবনে আর কিছু না পেলেও চলবে। তারা দুজন চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। দুজনের মধ্যেখানে পূর্ণিমার চাঁদ সাক্ষী হয়ে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে। রহিম উপর থেকে ঝুপ করে রাহেলার পায়ের কাছে কি একটা জানি ছুড়ে মারল। রাহেলা সেটা কুড়িয়ে নিতে যাবে আর তখনই পেছন থেকে আজাদের কণ্ঠস্বর, ‘এ তো রাতে ঘরের বাইরে কি করিস? এক্ষুনি ভেতরে যা।’ 
সে তড়িঘরি করে ভেতরে চলে আসে। বুকটা ঢেঁকির মতো উঠানামা করছে। আরেকটু হলে ভাইয়ের কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছিল। ভাবিও কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। ভাই ভাবি দুজনের কেউ রাহেলার এই বিষয়টি পছন্দ করতে পারছে না। একদিন তো ভাবি রাহেলাকে বোঝাতে যায়, ‘বুঝলা ননদ, প্রেমে পড়া মানে জ্বীনের আসর। জ্বীনরে ঘাড়ে চড়তে দিতে নাই। হয় ঘাড় ভাঙ্গবে নয়তো গলা টিপে ধরবে।’ ভাবি একটু শহুরে ঢঙ্গে কথা বলে। তা শুনতে রাহেলার খারাপ লাগে না। কিন্তু সে কথায় তো আর তার মন তো আর ফিরে আসবে না। মন বড়ই বিচিত্র। সব সময়ই ছুটছে। কিন্তু একবার কোথাও লেগে গেলে সেখান থেকে তো আর সহজে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এতোদিন ভাই কিছু বলেনি। কিন্তু এখন ভাই আর চুপ করে থাকতে পারে না।  
ঘরে ঢুকে আজাদ তার মায়ের কাছে গেল। ফিসফিস করে কিছু বললো। বোঝা যাচ্ছে মা কথাটা তেমন আমলে নিল না। তাদের মধ্যে আরো কিছুক্ষন ফিসফিস করে কথা চলল। রাহেলা শংকিত। সদ্য ছোড়া ইটের আধুলিতে মোড়া প্রেমপত্র সে মুঠির মধ্যে শক্ত করে ধরে রাখে।
অবশেষে সবাই ঘুমিয়ে পরলে রাহেলা আবার জেগে উঠে। মাঝরাতে চাদরের নীচে টর্চের আলো জ্বেলে লুকিয়ে লুকিয়ে চিঠিটা পড়লো। ছোট্ট চিঠি। সে একশবার করে পড়লো। তারপরও আশ মেটে না। 
পরানের পাখি রাহেলা,
আমার জন্য যদি তোমার পরান কাঁদে তবে আগামীকাল দুপুর দুইটার সময় বোটানিক্যাল গার্ডেনের গেটের সামনে দাড়িয়ে থেক। আমার দেখা পাবে।
ইতি
তোমার প্রেম দিওয়ানা  

প্রয়োজন মানুষকে সাহসী করে তোলে। আর জীবনে প্রেমটাও প্রয়োজন। ভীরু রাহেলা পরেরদিন আর স্কুলে যায় না। একটা রিক্সা ঠিক করে সে বোটানিক্যাল গার্ডেনে চলে আসলো। রহিম আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিল। এগিয়ে এসে হাত ধরে তাকে রিক্সা থেকে নামাল। তারপর তারা গার্ডেনের ভেতরে চলে গেল। এর পরের দিন একসাথে পাশাপাশি বসে পূরবী সিনেমা হলে ’আমার জান আমার প্রাণ’ সিনেমাটা দেখল। তারপরের দিন চুপিসারে রহিমের চিলেকোঠার ঘরে দুজনের একান্ত সাক্ষাৎ। এরপর থেকে এখানটাতেই দুজনে দেখা করতে লাগলো। প্রথমদিকে রাহেলা ছিল বেশ আড়ষ্ট। তীব্র অনুভূতিময় প্রেম হঠাৎ করেই সত্যি সত্যিই তার প্রেম-পুরুষকে সামনে এনে হাজির করবে এটা হজম করতে একটু সময় লাগছিলো। কিন্তু রহিম ছিল বেশ অগ্রগামী। রাহেলাকে একান্তভাবে পাবার জন্য তার তর সইছিলো না। আবার এই মিষ্টি মিষ্টি প্রেমটাও তাড়িয়ে উপভোগ করছিলো। বিশেষ করে রাহেলার স্বপ্নাতুর চোখ তাকে পাগল করে তুলতো। সেই চোখে আরো আবির মাখিয়ে দিতে নিজের সব স্বপ্নের কথা অকপটে রাহেলাকে বলে যেতে থাকে। চিলেকোঠার ঘরে বসেই একদিন তাদের কথা হচ্ছিল। রহিম বলল, ‘বুঝলা আজকে আমেনা আপার সাথে কথা হলো। আমার আমেরিকা যাওয়া একদম নিশ্চিত। দুইদিন পরে তো তুমি শার্ট প্যান্ট পইরা মেম হইয়া যাবা। ওইদেশে সব সমান। ইঞ্জিনিয়ার আর ঝাড়ুদারের একই সন্মান। ডলার কামানো দিয়া কথা। ঔখানে আকাশে বাতাসে ডলার উইড়্যা বেড়ায়। শুধু দুইহাতে কত ডলার ধরতে পার এইট্যা হইলো আসল কথা।’ 
রাহেলা ভাবছিল রহিম, এইসব টুকিটাকি কথাবার্তা, এই চিলেকোঠার ঘর, গোপন অভিসার আর স্বপ্নময় ভবিষৎ – সবকিছু মিলে মিশে যেটা হয় সেটাই তাহলে প্রেম। সে তার মাথাটা আধশোয়া রহিমের বুকের মাঝে নিয়ে আসে। রহিম রাহেলাকে আদর করতে শুরু করে। কিন্তু একটা পর্যায়ের পর আর এগুতে পারে না। বাঁধা আসে। রাহেলা মৃদু ভাবে বলে উঠে, ‘বিয়ের আগে কইরেন না।’
অধের্য্য রহিম বলে উঠে, ‘চল কালকেই আমরা বিয়ে করি।’ 
‘এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে হইবো? বন্দোবস্ত করণ লাগবো না? আপনে তো এখনও প্রস্তাব নিয়াই গেলেন না?’
রহিম বড় ফাপঁরে পরে। মিষ্টি করে বলে উঠে, ‘আজকাল বড় বড় লোকদের বিয়েতেও আগে বিয়ে পড়ানো হয় পরে অনুষ্ঠান হয়। আমাগো তো আর তাদের মতো অবস্থা না। মনে করো আমি তুমি মিইল্যাই আমাদের বিয়ে পড়ায়ে ফেললাম। পরে ধীরে সুস্থে তোমারে উঠায় আনলাম। হেইড্যাতে তো একটু সময় লাগবো। এইখানে তো আর তোমারে নিয়ে সংসার করতে পারি না। তোমারে লইয়া একবারে আমেরিকা নিয়ে সংসার শুরু করবো।’ 
‘তাই না হয় করলেন তবে শুধু দুইজন মিইল্যা কেন? উঠাইয়্যা না হয় না নিলেন কিন্তু দুই পরিবার নিয়াই তো বিয়ে পড়ানো যায়।’
‘বিয়ের কথা জানাজানি হলে আমেরিকা যাইতে একটু অসুবিধা আছে। আমেনা আপা বইল্যা দিছে কাগজ পত্রে আমারে অবিবাহিত থাকতে হবে।’
এ কথা শুনে রাহেলা একটু দ্বিধান্নিত হয়ে পরে। আসলেও তো আর কত অপেক্ষা? দুটি হৃদয়ে তো একই কামনা বহমান।  
মা সবই বুঝতে পারে। মেয়েকে নিরব সমর্থনও দিয়ে যায়। রাহেলা এসে যখন রহিমের আমেরিকা যাবার গল্প বলে মায়ের চোখ তখন জ্বলজ্বল করে উঠে। মায়ের বড় আশা ছিল মেয়েকে শহরে বিয়ে দিবে। এই মেয়ে এখন দেশ ছেড়ে বিদেশ চলে। এতোটা স্বপ্ন তো তিনি দেখেননি। সুবাহানআল্লাহ। মনে মনে যা চেয়েছেন তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছেন। কিন্তু ভাবতে পারেননি ছেলে আজাদ মাঝপথে বাঁধা হয়ে দাড়াবে। সে রাতেই এই বিষয়ে মা আর ছেলের বাকযুদ্ধ হয়। আজাদ ক্রদ্ধস্বরে বলে উঠে, ‘আমি যেই সুযোগ পাই নাই রাহেলারা সেই সুযোগ কইর‍্যা দিছি। গার্মেন্টসের কাজে না লাগাইয়্যা স্কুলে ভর্তি করাইছি। ভাবছিলাম কি সুন্দর মতো সে লেখাপড়া করব। আর হেই কিনা রহিম্যার লগে সিনেমা দেখতে যায়। এই ব্যাডা বহুত খারাপ মানুষ। রাহেলারে কইলাম সাবধান কইরা দিও।’
মা বলে উঠে, ‘তুই এতো গোস্বা করিস কেন? হ্যাতে কি এতোই খারাপ? দেখতে শুনতে বালা, চাকরীড্যাও পাকাপোক্ত, নির্ঝঞ্ঝাট। মালিক আমেরিকা থাকে। দুদিন বাদে হেইও আমেরিকা চলে যাবে।’ 
‘মা তুমি কোন দুনিয়ায় আছ? আমেরিকায় যাওয়ন এতোই সহজ? এইসব কিছু ভুইল্যা তোমার মেয়েরে কও পড়ালেখা করতে। আর যদি কিছু শুনি তাইল্যে ভালো ছেলে দেইখ্যা দুইদিনের মধ্যে বিয়ে দিয়ে দিব। এই লোকের কোন ঠিক ঠিকানা আছেনি?’ 
রাহেলার আর কিছুই কানে আসে না। তার ভাই বলে কি? রহিমকে ছাড়া আর কাউকে সে বিয়ে করার কথা কল্পনাও করতে পারে না। তাদের জন্মই হয়েছে একজন আরেকজনের জন্য। সারারাত তার ঘুম আসে না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকে। দূর ছাই এই বেড়ার ঘরে মনের সুখে কান্নাকাটিও করা যায়না। রাহেলার জীবনে এর আগে এতো দীর্ঘরাত কখনও আসেনি। পরেরদিন ভাই-ভাবি কাজে চলে যাওয়ার পর পরই সে রহিমের কাছে ছুটে আসে। সব শোনার পর তারা ঠিক করে আজই তারা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে আসবে। 
সেই দিন রাহেলার বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। আজ তার জীবনে একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে। সে এখন বিবাহিত এবং পরিপূর্ণ রমনী। গতকাল রাতেও যে ভয়ে তার সারারাত ঘুম আসেনি এখন তা পুরোপুরিই উধাও হয়ে গেছে। বরং মনে হচ্ছে জানাজানি হয়ে গেলেই বরং ভাল। সে তাহলে এ ঘর ছেড়ে এখনই রহিমের ঘরে গিয়ে উঠতে পারে। পরদিন মা সব জানলো। সেই দুপুরেই মা রহিমকে খাওয়ার আমন্ত্রন জানালো। রাহেলা রহিমকে নিয়ে দুপুরবেলা বাসায় এসে দেখলো এরমধ্যেই মা খাওয়ার এলাহী আয়োজন করে ফেলেছে। একেবারে রীতিমতো জামাই খাতির। সেই খাতিরের আড়মোড়া ভাংতে ভাংতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। প্রথমে ভাবি কাজ থেকে ফিরে সব ঘটনা জানলো। পরে ভাই আসার পর ভাবিই তাকে সব জানাল। আজাদ একটাও উচ্চবাক্য করলো না। চুপচাপ রহিমের পাশে বসে রাতের খাবার খেল। তারপর ঘুমাতে চলে গেল। সেই রাতে রহিম রাহেলাদের ঘরেই রাত কাটাল। 
দিন এভাবেই চলে যেতে লাগলো। একবার মিনিট আর ঘন্টার কাঁটা ঠিক করে চাবি দিয়ে দিলে ঘড়ি চলতে থাকে। জীবনটাও এরকম। পরিবর্তন আসে। আবার সেটাই একসময় পৌনপুনিক ছন্দে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। তবে জীবন আর ঘড়ির মধ্যে পার্থক্য হলো এই যে ঘড়ির কাঁটার দাগ নির্দিষ্ট। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে তা কখনও বাড়ে, আবার কখনও কমে। রহিমের জীবনে নতুন যোজন সে এখন রাহেলার বাড়িতে দুপুরে খায়, প্রায়ই রাত কাটায়। একটি বিষয় ছাড়া আজাদের জীবন আগের মতোই আছে। । সে এখন তার মা আর বোনের সাথে কথা বলা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। তবে তার আগে জানিয়ে দিয়েছে যে রাহেলা এবং তার মার প্রতি সে আর কোন দায়িত্ব পালন করবে না। সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হয়েছে রাহেলার জীবনে। সে এখন আর স্কুলে যায় না। প্রতিরাতে স্বামীর অপেক্ষায় থাকে। তেমন ভাবে জীবন কি সেটা বুঝে উঠার আগেই অনেক কিছু ঘটে গেছে। প্রেম-বিয়ে যে জীবনকে এতো বদলে দেয় তা সে আগে বুঝে উঠতে পারেনি। তার উপর সে এখন মা হতে চলেছে। এ ব্যাপারে সে এতোই অনভিজ্ঞ ছিল যে গর্ভবতী হবার তিনমাস পরে সে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। তবে এতোবড় ঘটনায় সে উত্তেজিত হতে পারছে না রহিমের আচরনের কারণে। রহিম ঘটনাটা শুনেই তাদের আরেকটু সময় নিয়ে জীবনটা গুছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন এই অজুহাতে তাকে গর্ভপাতের পরামর্শ দিয়েছিলো। রাহেলা রীতিমতো গোঁ ধরেছিল। স্বামীর প্রস্তাবে একদমই রাজী হয়নি। তারপর থেকেই রহিমের কেমন যেন আলগা আলগা ভাব। ভালবাসার মানুষটার অন্যরকম চেহারা। ওর এখন পাঁচমাস চলছে। অথচ স্বামী একবারও তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল না। আর গত একমাস ধরে রহিম  ওর কাছে আসছে না। উপরন্ত কিছুদিনের জন্য তাকে চিলেকোঠার ঘরে আসতে মানা করেছে।  অবশ্য রাহেলা অবুঝ না। আমেনা বেগম এখন দেশে। রহিম এখন মনিবের কাজে পুরোপুরিই ব্যস্ত। এই মনিবকে খুশি রাখতে পারলেই না তাদের আমেরিকা যাওয়া হবে। অবশ্য বিয়ের আগে রহিম আমেরিকা যাওয়া নিয়ে কথা বলতে যতটা না পছন্দ করতো, বিয়ের পরে এ বিষয় নিয়ে কথা বলাটা ছিল ততটাই অপছন্দের। গত ছয়মাস রাহেলাকে অনেক বদলে দিয়েছে। এক লাফে যেন তার দশ বছর বেড়ে গেছে। মাঝেমধ্যে তার আর তার অজানা সন্তানের কথা ভাবলে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। ভাই তো সেই কবে থেকেই তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। মা এখনও ভরসা দিয়ে যায়। বাচ্চা হয়ে গেলে তার মুখ দেখে নাকি রহিমের মতিগতি ফিরবে। ছেলেরা নাকি এরকমই। রাহেলা এখন সে আশাতেই কোন রকম দিন পার করছে।
একদিন সকালে গেটের বাইরে কোলাহলে রাহেলার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ভাই-ভাবি আগেই বেড়িয়ে গেছে। রাহেলা বাইরে বেড়িয়ে আসে। গেটের কাছে এক মহিলা চিৎকার চেচামেচি করছে। রাহেলাকে দেখেই তার গলার স্বর দ্বিগুন হয়ে যায়, ‘ ওই বেশ্যা, খানকীর ম্যাইয়া, ডাইনী এদিকে আয় দেখি কতো বেশ্যাগিরি করতে পারোস।’
রাহেলা হতভম্ব হয়ে পড়ে। পেছন থেকে মায়ের চিৎকার শুনতে পায়। 
‘বেশ্যা কেডা? যে নিজে বেশ্যা সে হজ্ঞলরে বেশ্যা ঠেড়ায়। এখান থেকে ভাগ। অন্য জায়গায় গিয়া ব্যবসা কর গিয়ে।’
‘নিজের ঘরে ব্যবসা খুইলা বসছে। আর আমাকে উপদেশ দেয়। ঘর থেকে আমার স্বামীরে এক্ষনই বাইর কইরা দে।’
এবার রাহেলার মায়ের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে পড়ে। কী বলছে এই মহিলা! হঠাৎ করে রাহেলার চারপাশে অন্ধকার নেমে আসে। সে দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠে, ‘ না, এইডা অসম্ভব কতা। আমার স্বামী আর যাই করুক আমার লগে এই বাটপারী করনের না। আমি ছাড়া হের আর কোন বউ নাই।’
পেছন পেছন মাও রাহেলাকে সমর্থন করে। এবার সেই মহিলা তার লড়াইয়ের পদ্ধতি পাল্টে ফেলে। হয়তো অবসন্ন-শান্ত-সোম্য রাহেলাকে দেখে বুঝতে পারে দোষটা তার স্বামীর, এই মেয়ের নয়। কিন্তু যে অধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে সে এসেছে তা উদ্ধার না করে তো সে বাড়ি ফিরবে না।
‘এই ছবিডা দেখেন। তারপর কতা কন।’ গেট খুলে এগিয়ে এসে সে রাহেলার মায়ের হাতে একটি ছবি দেয়। রাহেলা আর নিজে সে ছবি দেখে না। কিন্তু মায়ের চোখ দেখে সে সবকিছু বুঝে নেয়। মহিলা তখন বলে যাচ্ছে, ‘জানতেন না হের আগের বউ-বাচ্চা আছে? কোন খোঁজ না কইরাই মেয়ের বিয়া দিলেন? আমি গাঙ্গে ভাসা মাইয়া না। আমার বাপের সতের কানি জমি আছে। দুই ভাই কুয়েতে চাকরি করে। এর আগেও হেতেনে এই কাজ করছিলো। শ্যাষ-ম্যাস আমার কাছেই আইয়া মাপ চায়। আগের বউরে ছাড়ান দেয়।’
রাহেলা তো প্রথম থেকেই লড়াই করেনি। এবার মাও হার স্বীকার করে। ছবিটা সেই মহিলার হাতে ফিরিয়ে দেয়। শক্ত প্রতিপক্ষ না দেখে মহিলাও লড়াইয়ের ইতি টানে। সে হঠাৎ যেমন এসেছিলো, তেমনিভাবে হঠাৎ করেই চলে গেল। তবে যাওয়ার আগে তার স্বামীর দিকে আর হাত না বাড়ানোর জন্য শাসিয়ে গেল। মা রাহেলাকে আশ্বাস দেওয়ার চেষ্ঠা করলো যে রহিম রাহেলারই থাকবে। তার জন্য একটু চেষ্টা করতে হবে। মিরপুর এক নাম্বারে এক বড় ফকির বাবা আছে তার থেকে পানি পড়া নিয়ে আসলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। রাহেলা নির্বাক হয়ে শুনে। তবে কোন ভরসা পায় না। মহিলা সুন্দরী না হলে একটা কথা ছিল। কিন্তু তা তো নয়। রাহেলার গায়ের রং অনেক কালো। মহিলার তা নয়। সে নিজের পেটের উপর হাত দিয়ে নতুন প্রাণের স্পর্শ পায়। সেই স্পর্শে সে শোক আর শক্তি দুটোই অনুভব করে। আর যেটা বোধ করে সেটা হলো প্রচণ্ড রাগ। কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা সে চিলেকোঠার ঘরে চলে যায়। ঘর তালা বদ্ধ দেখে দোতলায় চলে আসে। আমেনা বেগমের কাছে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলে। আমেনা বেগম তাকে জানিয়ে দেয় যে কয়েকদিন আগেই রহিমকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বাড়ি ভাড়ার হিসেবে অনেক টাকার গড়মিল ছিল। রহিম ঠিকমতো হিসেব দিতে পারেনি। দুদিন আগে রহিম এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। অথচ রাহেলাকে সে কিছুই বলে যায়নি। রাহেলা তার ঘরে ফিরে আসে। বসে থাকে চুপচাপ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এত বড় শহরে রাহেলা এখন কিভাবে জানবে তার সন্তানের পিতা এখন কোথায় আছে?
বিপদ যখন আসে তখন সব দিক দিয়েই আসে। আজাদের কোম্পানীর মালিক জমির দখলদারীর মামলায় হেরে যায়। এখন আর তার কেয়ার টেকারের দরকার নেই। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদেরকে এই ঘর ছেড়ে দিতে হবে। রাহেলার বিয়ের ঘটনা নিয়ে সেই যে ভাইয়ের সাথে সম্পর্কে চির ধরেছিল তা আর ঠিক হয়নি। বরং এই বিপদের সময় অভিমানী ভাইকে স্বার্থপর আচরন করতে দ্বিধাগ্রস্ত হতে হয়নি। ভাই তার পরিবার নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। আর রাহেলারা পাশের বস্তিতে ঘর ভাড়া নিয়ে উঠে পড়ে। গ্রামে ফিরে যাওয়ারও আর কোন উপায় নেই। যেটুকু ধানি জমি ছিল তা এক ইটের ভাটার মালিকের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আর শহরে কেউ কাউকে তেমন ভাবে চেনে না। এখানে কোন সম্মান যাওয়ারও ভয় নেই। রাহেলার মতো কাহিনী বস্তির ঘরে ঘরে ঘটছে। বস্তির পরিবেশে এটি কোন নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু ফেলে আসা গ্রামে তো আর তারা শিকড়হীন নয়। সেখানে তাদের কমবেশি হলেও একটু সম্মান আছে, পরিচয় আছে। এতো কলংকের পর তো আর গ্রামে ফিরে যাওয়া যায় না। কোন মুখ নিয়ে তারা ফিরবে সেখানে?
রাহেলা গার্মেন্টসে চাকরী নেয়। কেয়ারটেকারের কাজের সময় কিছু টাকা জমেছিল। সে টাকা পুঁজি করে বাবা মা রাস্তার পাশে রুটি ভাজি খাওয়ার দোকান দেয়। কোন রকমে সংসারটা চলে যায়। রাহেলার শরীর ক্রমশ ভারী হতে থাকে। এ শরীর নিয়েই সে কাজে যায়। মধ্যে দিয়ে একবার রহিমের সাথে দেখা হয়েছিল। রাহেলা ভেবেছিল আবার সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। রহিম তাকে নিয়ে ঘর-সংসার করতে শুরু করবে। কিন্তু না। সে আশাটুকুও শেষ হয়ে যায়। তাদের তালাক হয়ে যায়। বিয়ের সময় কোন লেখা জোখা হয়নি এবং তালাকের সময়ও হলো না। 
গর্ভে থাকা অবস্থাতেই বোধহয় বাচ্চাটা মায়ের দুঃখ বুঝতে পেরেছিল। তাই মাকে কোনরকম কষ্ট না দিয়েই সময় মতোই বাচ্চাটা এই পৃথিবীর আলোবাতাসের মধ্যে বেড়িয়ে এলো। শান্তশিষ্ঠ লক্ষ্মী মেয়েটার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রাহেলা তার সব দুঃখ ভুলে যায়। এখন সে একজন মা। এই চিন্তাটাই তাকে এক অদম্য শক্তি যোগায়। মেয়ের নাম রাখে সুখী। দেড় মাস পর শরীরটা আবার ঠিক হয়ে আসে। রাহেলা আবার পুরোনো গার্মেন্টসেই যোগ দেয়। সুখীকে পাশে শুইয়ে রেখে রাহেলার বাবা মা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারে। এতে তো সংসারের অনটন কাটে না। মা তাই একটা বাড়িতে ঠিকে বুয়ার কাজ নেয়। রাহেলা আর তার বাবা-মায়ের জীবনে অনেক কিছু ঘটে গেছে। এসেছে অনেক পরিবর্তন। জীবনের গতিপথে পরিবর্তন আসে। একসময় সেই পরিবর্তিত পথেই জীবন স্বাভাবিক নিয়মে চলতে শুরু করে।
রাহেলা এখন নাগরিক কর্মজীবি মহিলা। গার্মেন্টস কর্মী। বয়স বিশের কোঠা না পেরুতেই বাবা-মা আর নিজের সন্তানের দায়িত্ব ঘাড়ের উপর। কাজ শেষ যখন ঘরে ফেরার সময় হয় তখন অসম্ভব ক্লান্তি ভর করে। অনেকটা পথ হেঁটে হেঁটে ঘরে ফিরতে হয়। ঘরে ফিরেও তো কাজের শেষ নেই। মেয়েটা আছে। বাবা-মায়েরও বয়স হচ্ছে। তারাও আর কতো করবেন? সেই নলছিটি নদী এখন শুধুই মরিচীকা। রাহেলা বুঝতে পারে না এর শেষ কোথায়? অবশ্য তার এই কর্মব্যস্ত জীবনে ভবিষৎ এর চিন্তা খুব একটা হানা দেয় না। যাচ্ছে যাক। হয়তো সত্যিই একদিন সে একটি লটারির টিকিট পেয়ে যাবে। তখন আবার সে জীবনটাকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিতে পারবে। সে যদি নাও পারে তবে তার মেয়ে পারবে। এই এক জীবনে অভিজ্ঞতা তো কম হলো না। নিজের ভুল থেকে মেয়েকে কি সে শিক্ষা দিতে পারবে না? কাজ শেষে পথে চলতে চলতে এসব বিষয় নিয়ে অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা সে করে। সেদিনও করছিল। কিন্তু সেদিনটা আর অন্যদিনের মতো ছিল না। ঘরের দরজা আলতো করে খুলতেই বুঝতে পারে কেউ একজন এসেছে। মজিদ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। অনেকদিন পর তাদের দেখা হলো। মজিদকে এই ঠিকানা খুঁজতে কম বেগ পেতে হয়নি। ভাবি ফাতেমার বাপের বাড়ির দিককার কারো কাছ থেকে মজিদ রাহেলার সব কাহিনী শুনেছে। আর সে সব শুনেই পাগলের মতো রাহেলার খোঁজে এখানে ছুটে এসেছে। রাহেলারাও অবশ্য রহিমের আয় উন্নতির কথা শুনেছিল। তারা শহরে চলে আসার পর মজিদ প্রথমে এখানে সেখানে কামলার কাজ করতো। পরে কিছু টাকা জমিয়ে আর কিছু টাকা ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে রাহেলার প্রিয় সেই বটগাছটার নিচে একটা মুদি দোকান দিয়েছে। অনেকদিন ধরেই গ্রামবাসীর এরকম একটা দোকানের চাহিদা ছিল। ব্যবসার থেকেও গ্রামবাসীর প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে মজিদ অসম্ভব পরিশ্রম করতো। অবশেষে সে তার কাজের ফল পেয়েছে। এখন তার ব্যবসাটা খুব ভালোভাবেই দাড়িয়ে গেছে। এসব পেয়ে রাহেলা খুব খুশী হয়েছিল। তাদের গ্রামের বাড়িতে মা মজিদ ভাইয়ের সাথে কখনই সেরকম ভালো ব্যবহার করেনি। রাহেলার এই বিষয়টি ভালো লাগতো না। সে কষ্ট পেত। এখন সেই মা মজিদ ভাইকে খুব আদর যত্ন করে খাওয়াচ্ছে। রাহেলা বলল, ‘আপনার বৌ কই মজিদ ভাই?’
‘এখনও বিয়া করিনাই।’ মজিদ উত্তর দিল।
রাহেলা মায়ের দিকে তাকাল। মনে হলো মা হঠাৎ করেই মজিদ ভাইয়ের সাথে খুব উদারতা দেখাচ্ছে। উদ্দেশ্য ছাড়া কি মা কিছু করতে পারেনা?
পরেরদিন রাহেলার গার্মেন্টস দুপুরের পর ছুটি হয়ে যায়। সে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে। এই সময়টা তাদের এই বস্তিটা একটু নিরব থাকে। সুখীকে কোলে নিয়ে রাহেলা ঘরের বাইরে দাড়িয়েছিল। খাওয়া শেষ করে মজিদ পেছনে এসে দাড়ায় তারপর খুব আস্তে করে বলে,
‘তুমি যে এতো কষ্টের মধ্যে দিয়া যাইতাছো তা একবারও আমারে জানাইতে ইচ্ছা করলো না?’
রাহেলা তাকিয়ে দেখে মজিদের চোখ ছলছল। ওর মনে পরে না যে গ্রামে থাকতে সে কখনও মজিদের বিষন্ন মুখ দেখেছিলো। রাহেলাও আস্তে করে উত্তর দেয়, ‘এসব কি কওনের কথা?’
‘আল্লাহর কাছে আমার কখনও চাওয়ার কিছু ছিল না, তারপরও একদিন সাহস কইর‍্যা তোমারে চাইছিলাম। …’ মজিদ আরও কিছু বলতে যায়। কিন্তু রাহেলার ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে মাঝপথে কথা হারিয়ে ফেলে। কথা সবসময় বলতেই যে হবে এমন তো নয়। মজিদ সুখীকে নিজের কোলে নিয়ে নেয়। নির্ভরতার ভাষা অনেক ভাবেই প্রকাশ করা যায়। 
দিনক্ষণ ধরে রাহেলা আর মজিদের বিয়ে হয়। সেদিন সব রাগ-অভিমান ভুলে ভাই তার পরিবারকে নিয়ে আসে। মূলত বিয়ের অনুষ্ঠান পুরোটা ভাবিই পরিচালিত করে। ননদের বরের সাথে দুষ্টুমী করতে ভোলে না। তার কিছুদিন পরে রাহেলা আর তার মেয়ে সুখীকে নিয়ে মজিদ ভান্ডারিয়ায় উদ্দেশ্যে সদরঘাটে আসে। রাহেলার বাবা-মা আপাতত ভাইয়ের ওখানে গিয়ে উঠলেও পরে ভাণ্ডারিয়াতে চলে আসবেন। একদিন অনেক স্বপ্ন নিয়ে রাহেলা ভাণ্ডারিয়া ছেড়েছিল। কয়েক বছর পর আবার ভাণ্ডারিয়ায় ফিরে আসে তার থেকেও কয়েকগুন স্বপ্ন নিয়ে। নতুন সংসারের স্বপ্ন। সেই সাথে নিজের একটা টেইলারিং এর দোকান। লঞ্চ য্খন মেঘনার বুক থেকে ধলেশ্বরীর দিকে মুখ ফেরালো, রাহেলা একবুক শ্বাস নিল। কতদিন এরকম স্বচ্ছ বাতাসে মুখ ভেজায় না। তার প্রথমবারের বিয়েটা ছিল একটা দুঃস্বপ্নের মতো। তখন সংসার কি জিনিস সেটা বোঝার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এবার সে তা সুদে আসলে তা বুঝে নিবে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, সুখী যেন তার জীবনে সত্যিই সুখ বয়ে নিয়ে এসেছে। 
মজিদ একদিন বড় হাট থেকে অনেক ঝুনঝুনি সওদা করে নিয়ে আসে। রাহেলা চোখ কপালে তুলে বলে উঠে, ‘এত্তো ঝুনঝুনি কিসের লাইগ্যা?’
‘নিজের ম্যায়ার জন্য কিনতে গিয়া এই গ্রামের বাচ্চাগুলার কথাও মনে পড়লো। একটা শুধু সুখীর লাইগ্যা আর বাকীগুলি দোকানে নিয়া রাখবো।’
‘আপনে বড়ই সমঝদার বাপ হইছেন।’
‘বটগাছটা তোমার এতো পছন্দের জায়গা ছিল, তোমার কথা ভাইব্যাই সেখানে দোকান দিলাম। তুমি তো দেখি একবারও গিয়া আমার দোকান দেখলা না। একটা দর্জির দোকান দিবা বলছিলা তার খবর কি?’
‘ঘরের মধ্যে কাজ তো শুরু কইর‍্যা দিছি। এই মধ্যে কয়জন আমারে বেলাউজ বানাইতে দিয়া গেছে।’ 
বাইরে বেরুতে রাহেলার আসলে খুবই সংকোচ লাগে। খালি মনে হয় চেনা পরিচিতজনদের সাথে দেখা হলে কখন না জানি আবার কথায় কথায় সুখীর আসল বাপের কথা উঠে আসে। সেদিন বেশ জোর করেই মজিদ রাহেলাকে তার দোকানে নিয়ে আসে।  
রাহেলা দোকানের সামনে কাঠের বেঞ্চিটার উপর বসে পরে। আগে এ জায়গা থেকে নদী পর্যন্ত স্বচ্ছ দৃষ্টি ছিল। এখন মধ্যেখানে একটা ইটের ভাঁটা হয়েছে। কালো ধোঁয়ায় মাঝখান থেকে নদীটা আর পরিস্কার দেখা যাচ্ছে না। রাহেলা ভাবছে এক রহিম তার জীবনটা প্রায় গ্রাস করে ফেলেছিল। সেখান থেকে মজিদ এসে তাকে একরকম উদ্ধার করলো। কিন্তু আরো শক্তিশালী রহিমেরা প্রকৃতিকে গ্রাস করে ফেলে। স্বচ্ছ আর কোমল প্রকৃতি কালো ধোঁয়ায় ভরে তোলে। এ ধোঁয়াকে নির্মল করার জন্য আরো বেশী শক্তিশালী মজিদদের প্রয়োজন।  রাহেলা আশা ছাড়তে পারে না যে সুখীও একদিন বড় হয়ে এখানটায় বসে তার মতো নির্মল প্রকৃতি দেখবে। এই প্রকৃতি আমাদের গর্ভের মতো। নির্মল হতে এর কাছে ফিরে আসতে হয়। একে কলুষিত করতে চাইলেও এখানে আসতে হয়।  
নির্মল হতে আমরা প্রকৃতির কাছে ফিরে আসি। একে কলুষিত করি। প্রকৃতি সব সহ্য করে। ঠিক যেন গর্ভের মতো।

১,১৮৯ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “গর্ভ”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    দারুণ লাগলো গল্পটা। খোয়াবের মই বেয়ে উঠতে উঠতে ধপ করে পড়ে যাবার ব্যাপারটা আগে থেকেই অনুমান করা গেলেও টানটান কাহিনী।শেষটা নাটকীয় -- ভীষণভাবে আশা জাগানিয়া, এ মুহূর্তে যার খুব প্রয়োজন। মজিদের মতো মানুষ সমাজে একেবারে কম নেই -- কমে যাচ্ছে সেই মানিসকতাকে জীবনের ধ্রুবতারা করার সাহস।

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      আসলে রাহেলাদের কাহিনী তো একটি বাস্তবতা। দেশ বলেন আর বিদেশ বলেন নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেয়েদের এই সমস্যা অনেক। তবে এই কাহিনীটি লেখার কারণ হচ্ছে এটি একটি বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে লেখা। মজিদরা আছে। আমি শুধু এই টুকুই জানাতে চেয়েছিলাম যে এই সমাজে অনেক মজিদ আছে।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।