বই সমালোচনা “বিতংস”

খান আরিফা লোপা আমার বই “বিতংস”এর একটি সমালোচনা করে। সেটি এখানে পোস্ট করে দিলাম।
লোপা বুয়েটে আমার এক ক্লাস উপরে পড়তো – স্থাপত্যবিদ্যায়। যদিও আমেরিকাতে এসে সে বিষয় পরিবর্তন করে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়েছে। লোপার চিন্তা-ভাবনায় তার একটা নিজস্বতাবোধ কাজ করে। ওর বাবা কবি রফিক আজাদ যার “ভাত দে …” কবিতাটি মনে হয় সবারই কমবেশি জানা। যেহেতু এই কবিতাটি রচনাকালের সেই সময়টা আমার লেখায় উঠে এসেছে তাই আগ্রহ ছিল লোপা কি বলে তা জানার জন্য। না, দেখলাম সে আমাকে পাশ করিয়ে দিয়েছে। আমার সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী এবং একজন বইপ্রেমী বন্ধু হিসেবে এখন পর্যন্ত ওকেই আমার এই বইটি উপহার দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এই রিভিউটি আমার জন্য একটি সারপ্রাইজ।

—————————————————————————————————————–
বিষয় “বিতংস”
খান আরিফা লোপা

জীবনে কখনো কোনো বইয়ের সমালোচনা লিখিনি, নিজেকে সাহিত্য-সমঝদার ভাবার কোনো কারণও নেই, স্পর্ধাও নেই। তবে ছোটবেলা থেকেই বইয়ের পোকা হওয়ার কারণে গল্প, কবিতা, উপন্যাস এত বিস্তর পড়েছি যে আমার নিজস্ব ভাললাগা নালাগা থেকে একরকম বিচারবোধ জন্মেছে। একারণে কয়েক মাস আগে, যখন শান্তা ওর উপন্যাস ‘বিতংস’এর ম্যানিউসক্রিপ্ট পড়তে দিয়েছিল, তখনি ঠিক করেছিলাম এর একটা রিভিউ লিখব। ২৮০ পাতার ‘বিতংস’ সবে প্রকাশিত হয়েছে এই ফেব্রুআরিতে। ধন্যবাদ শান্তাকে, সাইন্ড কপি উপহার দেয়ার জন্য।

তো এই হলো আমার রিভিউএর পেছনের গল্প। যারা ধ্যর্য ধরে পুরোটা পড়বেন, তাদের আগাম ধন্যবাদ। আর শান্তা, আশা করি তুমি এই ক্রিটিক নিতে পারবে 🙂

====================================================================

বিতংস
লেখকঃ ওয়াহিদা নূর আফজা
প্রকাশকঃ আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০১৩

ওয়াহিদা নূর আফজার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘বিতংস’ আবর্তিত হয়েছে মূল চরিত্র ‘দেয়ার’ জীবনকে ঘিরে। প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশের এক মফস্বল শহর। গল্পের শুরু ফ্ল্যাশব্যাক দিয়ে। পুরনো কাগজপত্র হাতড়াতে গিয়ে মধ্যবয়েসি দেয়া হঠাৎ করেই খুঁজে পায় ফেলে আসা অতীতের এক অমূল্য উপহার; নিমিষে সে ফিরে যায় তার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের ঘটনাবহুল দিনগুলিতে।

দেয়ার শৈশব কাটছিল কুমিল্লা শহরের আর আট দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুর মতই। হঠাৎ ঝড়ের মত এল মুক্তিযুদ্ধ। নির্বিঘ্ন জীবন হঠাৎ হয়ে উঠল অশান্ত, উত্তাল আর আশংকাময়। যুদ্ধের ডামাডোলে দেয়ার পরিবার জড়িয়ে পড়ল শহরের এক বনেদী পরিবারের সাথে। এরই মধ্যে ঘটনাচক্রে ছোট্ট দেয়া দেখা পায় রাজপুত্রের মত একজনের, যে অবধারিতভাবে পরিণত হয় তার স্বপ্নপুরুষে। এই ‘হিরণ’ চরিত্রটিই দেয়ার গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। পুরো উপন্যাসের মূল উপজীব্যই হল দেয়ার সাথে তার স্বপ্নপুরুষের সম্পর্ক, তাকে নিয়ে দেয়ার দ্বিধা দ্বন্দ্ব, হতাশা, আবার তার কাছ থেকেই অনুপ্রানিত হওয়া।

শৈশব ও কৈশোর পেরিয়ে দেয়া বিকশিত হতে থাকে সুদর্শনা গুনী তরুনী হিসেবে। অন্যদিকে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশও এক বাক থেকে আরেক বাকে প্রবাহিত হতে থাকে। একাত্তর, পচাত্তর, জিয়াউর রহমান, এরশাদ আমল – সাম্প্রতিক ইতিহাসের মাইলস্টোনগুলো দেয়ার জীবনের সাথে জড়িয়ে যায়। এরপরও সে তার প্রতিভার জোরে আর প্রগতিশীল বাবামার উৎসাহে, মধ্যবিত্তের ছক বাঁধা গন্ডীর বাইরে আসার চেষ্টা করে। সফলও হতে থাকে, ঠিক মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত।

সে কঠিন পথে শেখে যে, সামান্য একটা ভুল কত অমোঘ পরিনতি টেনে আনতে পারে। যত গুণী বা খ্যাতিমানই হোক না কেন, আমাদের বাঙালি মুসলিম সমাজে একটা মেয়ের বিকশিত হওয়ার সুযোগ সীমিত,পথ কাটায় ভরা এবং সম্মান ক্ষণভংগুর। সামাজিক প্রতিকূলতার সাথে এরপর যোগ হয় কঠিন আঘাত। এতসব দুর্ভাগ্য, হতাশা আর গ্লানিকে জয় করে দেয়া আবার মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবে, নাকি অতল তলে তলিয়ে যাবে – বইয়ের শেষ পাতায় না পৌঁছানো পর্যন্ত পাঠক জানবেনা। এখানেই লেখিকা তাঁর প্রতিভা দেখিয়েছেন – পাঠককে ধরে রাখার কাজে পুরোদস্তুর সার্থক।

ওয়াহিদার লেখনির তিনটি দিক উল্লেখ করতে চাই। এক হল, তার ইতিহাসকে একনিষ্ঠভাবে তুলে আনার চেষ্টা, সন্দেহ নেই এই নিয়ে তাকে তুমুল পড়াশোনা/গবেষণা করতে হয়েছে। স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা একটা সাধারণ পরিবারকে কতখানি অনিশ্চয়তায় ফেলতে পারে, ওয়াহিদা তার বিশ্বাসযোগ্য ছবি এঁকেছেন। দ্বিতীয়ত, সমাজে ধর্মীয় গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িকতা আর প্রতিক্রিয়াশীলতার হ্মতিকর প্রভাব তুলে ধরেছেন খুবই সূক্ষ্মভাবে, নিজের (ধরে নিচ্ছি প্রগতিশীল) দর্শনকে পাঠকের উপর চাপিয়ে দেননি। তিন নম্বর হল, লেখিকা তার নায়িকা দেয়ার মনস্তাত্তিক বিশ্লেষণে পারদর্শীতা দেখিয়েছেন, যদিও কখনো কখনো সেটা গল্পের গতিকে কিছুটা হলেও শ্লথ করেছে।

শুধু ছোট্ট একটা অভিযোগ, লেখক বেশ কিছু জায়গায় সাধু-চলিত মিশিয়ে ফেলেছেন – তবে সেটা খুবই সামান্য খুঁত। ওয়াহিদা লেখালেখি করছেন বেশীদিন হয়নি, বয়সেও তরুণী – আশা করি তার লেখা আরো পরিণত হবে, ইতিমধ্যেই সেই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে ‘বিতংস’এর মধ্য দিয়ে। অভিনন্দন তাকে। — with Wahida Afza.

১,৪৬৭ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “বই সমালোচনা “বিতংস””

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    লোপা আপার আপন মামা হচ্ছেন টাংগাইল জেলার মুক্তিযুদ্ধের প্রধান আনোয়ারুল আলম শহীদ।
    উনার মার নাম খুব সম্ভবত রুবি।

    রিভিউ অনবদ্য হয়েছে।

    বাংলাদেশের প্রকাশকদের পেপার ব্যাক ছাপানো উচিত, এতে বইএর দাম পাঠকের নাগালে আসবে বলে আমি মনে করি।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      হ্যাঁ, লোপার মুখেই শুনেছি ওর পরিবার মুক্তিযুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল।
      দাম প্রসংগে প্রকাশককে কিছু বললে উল্টা আমাকে ঝাড়ি মারে। কি আর করা! যার যা কাজ তাই নিয়েই ব্যস্ত থাকি। দাম নিয়ে আর না হয় না'ই ভাবি যদি না ব্যবসা করি।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
      • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

        আপা আপনার বইএর দাম নিয়ে কিছু বলার নেই।
        হঠাত করে বাংলাদেশের প্রকাশোনার ট্রেন্ডের কথা মনে হতে ওকথা বললাম। বিশেষ করে আগামী তো বেশ ঠাস বুনোটে ছাপে।
        বাকিদের কথা ভাবেন। প্রতি পেজে কয়টা শব্দ বা বাক্য থাকে।
        ভালো কাগজে ছাপালে বইএর দাম বাড়বেই।
        কিন্তু একই সাথে কমদামী কাগজে ছাপালে আর পেপারব্যাকে করলে দাম অনেক অনেক কমে যায়।
        যদি সমমনা লোকজন পাই তবে কোন একদিন প্রকাশোনায় নেমে যাবো।
        আর বইমেলা সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে সম্প্রসারিত করার যে কথা এবার প্রদান মন্ত্রী বললেন তা পরের বার করা গেলে বেশ হয়।


        এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

        জবাব দিন
    • বিতংসের ছোট্ট পরিচিতিমূলক লেখা পড়লাম ।
      ভালো লাগলো । বইটি পড়তে অনুপ্রাণিত করলো । কারণ আমি মুক্তিযুদ্ধ সময়ের সন্তান ।
      এটা ঠিক সমালোচনা নয় । সম্যক যে আলোচনা--তা সমালোচনা ।
      শান্তাকে আমি বেশ ছোটোবেলায় দেখেছি । তখন বোধহয় ফোর ফা্‌ইভে পড়ত । সেটা গত শতাব্দীর তিরাশি সালের কথা হবে মনে হয় ।
      ওই একদিনই আমি ওকে দেখেছি । কিন্তু অবাক হয়েছিলাম শান্তা সঙ্গে বছর দু তিন আগে দেখা হয়েছিল, ঢাকার গুলশান মার্কেটে । আমার আর্ট গ্যালারিতে । অবাক শান্তা আমাকে ভিনে ফেললেন । ভাগ্যিস পরিচয় নিজে থেকে দিয়েছিল । সো গুড, সো নাইস । না হলে আমি চিনতে পারতাম না । আমি খুব খুশি, আনন্দিত, শান্তা একজন লেখক । আমি নিজে একজন চিত্রশিল্পী ।আরও খুশি যে, ওর 'বিতংস' উপন্যাসটি আবুল হাসনাত -এর' কালি ও কলম পুরস্কার ২০১৩' পেয়েছে । যেদিন গ্যালারিতে দেখা হয়েছিল শান্তার সঙ্গে শান্তাই খবরটি আমাকে দিয়েছিল আর সম্ভবত আমার ল্যাপটপে 'বিতংসের লিঙ্কটিও দিয়েছিলেন । পরে আমি আর খুঁজে পেলাম না ।
      বইটি অনলাইনে পেলাম না । গণি ভাইয়ের আগামী প্রকাশনীতে পাবো হয়ত ।

      আনোবারুল আলম শহীদ ভাই আমার পরিচিত ছিলেন ।
      তিনি রক্ষীবাহিনীর প্রধান ও রষ্ট্রদূতও ছিলেন । আমার একাধিক আর্ট এগজিবিশনে এসেছিলেন ।

      আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানবেন ।

      +রফী হক
      শিল্পী, সম্পাদক
      ১০ মাঘ ১৪২৮ । মঙ্গলবার
      ২৫ জানুয়ারি ২০২২ । ঢাকা।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।