ধারাবাহিক উপন্যাস – ১১,১২, ১৩

(এই উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট আর সময় বোঝাতে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা এবং চরিত্র উল্লেখ করা হয়েছে। আর বাদবাকী ঘটনা আর চরিত্রগুলো কাল্পনিক, তবে অবাস্তব নয়। অনেক ঘটনাই বাস্তব আমজনতার অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া হয়েছে।)

এক দুই তিন চার এবং পাঁচ
ছয়
সাত
নয়-আট
দশ

বার

এগার

আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা ঠাকুরপাড়ায় নিজেদের বাসায় চলে আসি। এলাকা পরিবর্তন আমাকে এক প্রকার বাঁচিয়ে দিল। শূন্য খান মঞ্জিল আর সহ্য হচ্ছিল না। এ বাসায় আমি আর কেয়া নিজেদের জন্য একটা আলাদা রুম পাই। তবে কেয়া এখনও আব্বা-আম্মার সাথে ঘুমোয়। বলতে গেলে রুমটা আমার একার দখলে। দাদামনুও তার জন্য আলাদা ঘর পেয়েছে। আম্মার আনন্দ সবচেয়ে বেশি। ঘরের কাজের থেকে বাইরের কাজে ব্যস্ত বেশি। বাইরে মানে বাড়ির চারপাশ। বাড়ির সামনের উঠোনে বেশ ঘটা করে আম, জাম,নারকেলের গাছ লাগিয়ে দিলেন। আমি লাগালাম একটা শেফালি ফুলের গাছ। এ বাসায় আগে থেকেই কিছু গাছ ছিল। পেছনের দিকটাতেও বেশ খানিকটা খালি জায়গা আছে। সেখানটায় সুনয়নার স্থায়ী ঠিকানা। সুনয়না আমাদের গরুর নাম। বাড়ির সবার আদরের একমাত্র গৃহপালিত পোষা প্রাণী। তাকে মূলত কেনা হয়েছিল কোরবানির জন্য। আম্মার একটা মানত ছিল। একটা গরু জবাই দিয়ে পাড়া-প্রতিবেশী, ফকির-মিসকিন খাওয়ানোর। কিন্তু সেই গরুর উপর কেয়ার এতো মায়া জন্মে যায় যে শেষে আর তাকে কোরবানি দেওয়া হয়নি। ভদ্রগরু এখন বহাল তবিয়তে আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে গেছে। পরে বাজার থেকে আস্ত একটা গরুর মাংশ কিনে আম্মা মানত পূরণ করেছিলেন। এ শহরে আশপাশের পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে পরিচয় হতে সময় লাগে না। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে কোন না কোনভাবে আমরা লতায় পাতায় আত্মীয় কিম্বা পূর্ব পরিচিত। বাসায় একদম সামনে রাস্তার উল্টোদিকের বাসায় থাকে হালিমারা। সে ফয়জুন্নেসা স্কুলে আমার এক ক্লাস নিচে পড়ে। সেই সূত্রে ওকে আগে থেকেই চিনতাম। তবে শিপ্রাদের বাসা আগের থেকে এখন আরও অনেক কাছে হওয়াতে আমি আর নতুন বান্ধবীর প্রয়োজন বোধ করেনি। আমাদের বাড়ির বা পাশের প্রাচীর ঘেঁষে মজিদ চাচিদের বাড়ি। ওনার সাথে আম্মার খুব ভাব হয়ে গেল। আমরা এ বাড়িতে উঠার পরদিন সকালে উনি আমাদের সবার জন্য ভুনা খিচুরি আর ডিম-ভাজি রান্না করে পাঠিয়েছিলেন। সাথে ছিল জলপাইয়ের আঁচার। সে আঁচার এতো মজা যে আমি একাই পুরোটা খেয়ে ফেলেছিলাম। তাই শুনে মজিদ চাচি সাথে সাথে আমার জন্য এক বোতল আঁচার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। চাচির শখ আঁচার বানানো। আর আমার শখ আঁচার খাওয়া। ভাল সেতু বন্ধন। আরও কাছে চলে আসাতে শিপ্রা এখন আগের থেকেও বেশি আমাদের বাসায় আসে। এইসময় থেকেই আমরা দুজন গান নিয়ে খুব মাতামাতি শুরু করে দিই। আমি এখন নীলিমাদির বাঁধা ছাত্রী। শিপ্রা আমার থেকে গান তুলে নেয়। অথচ এই সময় এই শিপ্রাই ছিল আমার প্রথম গানের গুরু। এক শিপ্রা আর গান ছাড়া করার আর কিছু নেই বলে লেখাপড়ায় মধ্যে বেশ ডুবে গেলাম। এমনই ডুবে গেলাম যে বাইরের পৃথিবীর কথা এক রকম ভুলেই গেলাম। আমাদের বাসায় খান দাদার বৈঠকখানার মতো কোন আড্ডা হয় না। তাই আর এখন দেশ নিয়ে মানুষের স্বপ্ন আর স্বপ্ন-ভগ্নের কথা আর শুনতে পাই না। আমার পৃথিবীতে থেকে দেশ উধাও। সেখানে শুধু আমি আর এ শহর।
এক সকালে প্রচণ্ড ঝাঁকি দিয়ে দেশ বুঝিয়ে দিলো তার অস্তিত্বের কথা। আমরা আবার সবাই সেই একাত্তরের পঁচিশে মার্চের রাতের মতো রেডিওর সামনে জড়ো হয়ে বসলাম। এবার আর পাকিস্তানি রেডিও নয়। বাংলাদেশ বেতার থেকে ভেসে আসা তরঙ্গ জানিয়ে দিল এক নারকীয় হত্যাকাণ্ডের কথা। দিনটা ছিল ১৫ই আগস্ট। শুধু শেখ মজিবুর রহমানকেই নয়,তার পুরো পরিবারকেও ক্যু ঘটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর এর নেতৃত্ব দিয়েছে সামরিক বাহিনীর কিছু মেজর। এরকম আকস্মিকতা খবরে আব্বা-আম্মা দুজনেই হতভম্ব। অনেকদিন পর স্মৃতি থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়টুকু আবার জেগে উঠল। সেই ট্রাংক, লরি, মিলিটারি … সব মিলিয়ে এক বিভীষিকাময় স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল। আমি বুঝে গেলাম এ জীবন কখনও নিজের করে পাওয়া হবে না। রাষ্ট্র বলে একটা পেয়ালা আছে। জীবনটা সেই পেয়ালার ছাঁচে আকার ধারণ করে মাত্র। ঘটনা শুধু পনের আগস্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না। এরপর পুরো বছর জুড়ে একটার পর একটা অঘটন ঘটেই চলল। জেলে চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ড … বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশারফের পালটা ক্যু … ব্যর্থ ক্যু …হত্যা …জাসদ … বিপ্লব … সিপাহী জনতার হঠাৎ অস্ত্র হাতে ক্ষেপে উঠা। একসময় কর্নেল তাহেরের থেকে সামরিক বাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমানের কাছে পরিস্থিতির নেতৃত্ব চলে গেল। সবকিছুই খুব দ্রুত ঘটে গেল। সময়টা ছিল খুব অনিশ্চয়তার এবং শ্বাসরূদ্ধকর। বাংলাদেশ বেতারটা অনেকদিন পর স্বাধীন বাংলা বেতারের মতো অভিজাত হয়ে উঠে। আমাদের মনের অবস্থা বিপদসংকুল রেলগাড়িতে চড়ে বসে যাত্রীর মতো। সেই রেলগাড়িটা যেন খুব দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। আর যাত্রীরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছে থম থম পরিস্থিতি। আমরা ভেতরে আটকে পড়ে অবরুদ্ধ হয়ে আছি। কেউ জানে না গন্তব্যের শেষে কি আছে। কিম্বা আদৌ সেখানে পৌছনো যাবে কিনা।

শেষ পর্যন্ত একটা দফারফা হল বটে। রেলগাড়িটা একটা স্টেশনে এসে থামল বটে। আপাত দৃষ্টিতে চারপাশের বন্দুক বন্দুক যুদ্ধও একসময় থেমে গেল। অন্তত: পর্দার সামনে। ছাপোষা মানুষেরা দু মুঠো অন্ন যোগার করতেই গলদঘর্ম। দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখার সময় তাদের কই? তাই আবার নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনে প্রবেশ করে আমরা ভুলে যাই দেশের কথা। ব্যস্ত হয়ে উঠি আমি-সর্বস্ব পৃথিবীতে। সেখানে শুধুই আমার পরিবার, স্কুল, লেখাপড়া, গান, বান্ধবীরা। আর কিছু সুখ-দুঃখ। হয়তো আমাদের বাবা-মায়েদের সবচেয়ে বড় আশা আমরা। তারা স্বপ্ন দেখে যে জীবন তারা চেয়েছিলেন কিন্তু পায়নি – একদিন তাদের ছেলেমেয়েরা সে জীবন পাবে। এভাবেই তাদের দিন যায়। রাত নামে। আশা ভাঙ্গে। আশা গড়ে। আর ওদিকে কাদের মোল্লারা আবার তাদের শীত-নিদ্রা থেকে জেগে উঠে। একা না, পুরো দলসহ। নিষিদ্ধ জামাত স্বরূপে, সমহিমায় আত্মপ্রকাশ করে। রাজাকার দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়। শর্টকাটে কিছু রাজনীতিবিদ তৈরি হয়। কিছুদিন পর তারাই একলাফে মন্ত্রী হয়ে যায়। শর্টকাটে তৈরি হওয়া বড়লোকদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে এই শর্টকাট পদ্ধতিটা দেশের সংস্কৃতিতেও গভীরভাবে গেড়ে যেতে থাকে। সংস্কৃতি,শিল্পসাহিত্যে এক স্থবির সময় নেমে আসে। সেখান থেকে বাংলাদেশের মানুষ খুঁজে পায়না তার মানসগঠনের রূপরেখা। রাষ্ট্র-যন্ত্র যখন দুর্বল হয় তখন স্বভাবতই ধর্ম এগিয়ে আসে সে শূন্যস্থান পূরণ করতে। ন্যায়-অন্যায়-বোধ এক সময় পেছনের সারিতে চলে যায়। সামনের সারিতে চলে আসে পাপপূণ্যবোধ।

এখন স্কুলে যাওয়ার পথে কান্দির পাড়ের মোড়ে মাঝে মধ্যে কাদের মোল্লাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। সেই আগের মতো এখনও লুঙ্গি পড়ে চলাফেরা করেন। এই কাদের মোল্লাও দিন দিন বড় ব্যবসায়ী হয়ে উঠছেন। তার ব্যবসা আদম-ব্যবসা। ভালোই উত্তরণ বলতে হবে। আদার পরিবর্তে আদম নিয়ে ব্যবসা। লোকজনদের মিডল-ইস্ট পাঠায়। আমাদের বাসায় এখনও মাঝে মধ্যে আসেন। আব্বা মিডল-ইস্ট যাবে কিনা তা জানতে চান। আম্মা এখনও উনাকে খুব সমাদরে আপ্যায়ন করেন। কিছুদিন আগে কাদের মোল্লার স্ত্রী আমাদের বাসায় এসেছিলেন। সাথে ছিল জমজমের পানি, একটা তসবি আর একটা বোরখা। এ বছর উনি হজ্ব করে এসেছেন। বোরখাটা আম্মার হাতে দিয়ে বললেন, ‘স্কুলে যাওয়ার সময় দেয়াকে বোরখাটা পড়তে দিয়েন।’
আমি বোরখা পড়ব! অসম্ভব। বাইরে তখন কাক ফাটা রোদ্দুর। উনাকে বললাম, ‘চাচি এতো গরমের মধ্যে যে আপনি বোরখা পড়ে আছেন, আপনার কষ্ট হয়না?’
‘মা, জাহান্নামের কষ্টের থেইক্যা এই কষ্ট কিছু নাগো। একবার বোরখা পরলে বুঝবা লোকে তোমারে কত ইজ্জতের সাথে দ্যাখতাছে।’
আমি আর কথা না বাড়িয়ে পাশে দাদামনুর ঘরে চলে গেলাম। দাদামনু কেয়ার সাথে লুডু খেলছিল। ওদের পাশে ধপ করে বসে পড়লাম। হতাশার সুরে বললাম,’কাদের চাচি আমার জন্য বোরখা নিয়ে আসছে।’
লুডু খেলতে খেলতেই দাদামনু উত্তর দিল।’ভালোই তো। নিশ্চিত জাহান্নাম থেকে এক কদম দূরে সরে গেলি।’
‘জাহান্নাম খুবই ভয়ংকর। কিন্তু আমি ভাবছি কাদের চাচির সাথে যদি একই বেহেশতে থাকতে হয় তাহলে সেটাও তো তেমন সুখের জায়গা হবে না।’
আমার কথা শুনে কেয়া খেলা থামিয়ে বলল, ‘তোমাকে কাদের চাচির সাথে থাকতে হবে কেন? তুমি তোমার পছন্দের মানুষদের সাথে থাকবে।’
‘আমার পছন্দ তো শিপ্রাকে। কিন্তু ওর তো টিকিট জুটবে না।’
‘সেখানে তুমি নতুন নতুন পরী বান্ধবী পাবে।’
কেয়ার পৃথিবী এখনও কত সরল। কিন্তু আমার পৃথিবী যে দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। এখন মনে হয় মেয়েদের জন্য আসলে বড় হওয়াটাই মস্ত বড় পাপ। সেদিন ইসলামিয়াৎ ক্লাসে পড়াতে গিয়ে হুজুর আরও ভয়ংকর কথা শোনালেন। একটা ছেলে যদি রাতের বেলা স্বপ্নে কোন মেয়েকে দেখে তাহলে সেই মেয়েটার কবিরা গুনা হবে। এসব কথা মাথা থেকে তাড়ানোর জন্য হালকা চালে কেয়াকে বললাম, ‘ওরা কি আমার সাথে গান গাইতে চাইবে?’
খুব আহত স্বরে কেয়া বলে উঠল, ‘আপুনি তোমার কিন্তু খুব গুনা হবে।’
কেয়ার সামনে কথাটা বলা ঠিক হল না। দাদামনুর সাথে আমার যে কথাবার্তার তরঙ্গ সেটা কেয়ার বোঝার কথা নয়। কেয়াকে বললাম, ‘তওবা কাটলাম। আর এরকম কথা বলব না।’
খুশি মনে কেয়া আবার গুটি চালতে শুরু করল। ইচ্ছা করছিল দাদামনুকে জিজ্ঞাস করি ওর কি এখনও কাদের চাচিকে পচা ডিম ছুড়ে মারার পরিকল্পনা আছে কিনা। এখন নয়। অন্যসময় জিজ্ঞেস করব। যখন কেয়া সামনে থাকবে না। চাচি যদি জানতেন মনে মনে দাদামনু তাকে কত ইজ্জত করে!
তবে মাঝে মধ্যে নিজেকে খুবই আড়াল করতে ইচ্ছা করে। বিশেষ করে যখন স্কুলের মোড়টা পার হই। ল্যাম্পপোস্টটার নিচে একদল বখাটে ছেলে দাঁড়িয়ে থাকে। ওদের মাথাটাকে খুব ভাল করেই চিনি। শফিক। এলাকার উঠতি মাস্তান। এদের দলটাকে দেখলেই রক্ত হিম হয়ে আসতে চায়। আমাদের ক্লাসের রোজিনার খুব সাহস। একদিন নাকি পেছন থেকে কে ওকে শীষ বাজিয়েছিল। আর রোজিনা পেছন ঘুরে ছেলেটাকে আচ্ছা মতন বকে দিয়েছিল। আমি কোনদিনই তা পারব না। শুনেছি এই শফিকের এক চাচা নাকি খালেক মজুমদারের ডান হাত। সেই লোক এমন কোন অপরাধ নেই যে করেনি। কিন্তু জেলের মধ্যে তাকে বেশিদিন আটকে রাখা যায় না। কয়েকদিনের মধ্যেই খালেক মজুমদার তাকে বের করে নিয়ে আসে। আর খালেক মজুমদারও একটা চরিত্র বটে। সাপের খোলস পালটাবার মতো করে এখন গায়ে জাতীয়তাবাদীর খোলস চাপিয়েছে। আর তার বাহিনীর নাম হয়েছে খালেক বাহিনী। আগে এলাকার রক্ষী বাহিনীর প্রধান হয়ে যা করত, এখনও তা করে যাচ্ছে। উপরন্তু যোগ হয়েছে চাঁদাবাজি। বাস স্টেশন, দোকানপাট, বাজার এমন কোন জায়গা নেই যে সেখান থেকে খালেক মজুমদারের লোকেরা চাঁদা তোলে না। কেউ ভোলেনি কাজলের বাবার ঘটনা। তাই প্রতিবাদ করে কেউ তাদের ছা-পোষা জীবনে বিপদ ডেকে আনতে চায় না। কোন প্রতিরোধ নেই। তাই সহজেই সমাজের শরীরে ক্যান্সারের মতো খালেক মজুমদাররা ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

এর মধ্যেও আমরা ভাল থাকি। এলাকার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি। জীবনের মানে নিয়ে অতো মাথা ঘামাই না। প্রেসিডেন্ট জিয়া খাল কাটা কর্মসূচী আর সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়ে দেশটার মধ্যে একটা ঝাঁকুনি লাগিয়ে দিতে সক্ষম হন। ভাল-খারাপ অতো বুঝি না তবে আমাদের কিশোর-মনে আশা জাগে। দেশ গড়ার স্বপ্ন। স্কুল-কলেজ থেকে ছেলেমেয়েরা দলে দলে খাল কাটতে যায়। মধ্যপ্রাচ্যে অনেক ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার চাকরি করতে যায়। দেশের মধ্যে মানুষের হাতে পেট্রো-ডলার আসতে থাকে। ধীরে ধীরে শহরে নতুন মানুষ আসতে থাকে। চারপাশের খালি জায়গা ভরে যাচ্ছে নতুন নতুন ঘরবাড়িতে। আমরা শুনি আদম ব্যাপারী একটা লাভজনক পেশা।
পঁচাত্তরের পরবর্তী ধাক্কায় আরও কিছু হিন্দু ধর্মাবলম্বী অনেকটা অভিমান নিয়েই দেশ ত্যাগ করে। এদের একজন শিপ্রার দূরসম্পর্কের এক মামা। উনি আবার তাপসীদিদের আত্মীয়। নজরুল এভিনিউয়ের উপর উনাদের একটা বইয়ের দোকান ছিল। নাম ছিল সরস্বতী স্টোর। সে দোকান থেকে দাদামনু আর আমি প্রায়ই স্কুলের উপকরণ-সামগ্রী কিনতাম। শিপ্রার সেই মামির সাথে আম্মার বেশ ভাব ছিল। কলকাতায় চলে যাওয়ার আগে বেশ কম দামে দোকানটা আমাদের কাছে বিক্রি করে যান। আম্মার গয়না বেচা টাকায় সেই দোকান কেনা হয়। আব্বার চাকরী ছাড়াও আমাদের একটা বাড়তি ইনকামের খুব দরকার হয়ে পরেছিল। সাংসারিক খরচ দিন দিন বেড়েই চলছে। বইয়ের দোকানটা আমাদের সংসারে কিছুটা স্বস্তি এনে দেয়। অফিস ছুটির পর আব্বা সোজা বইয়ের দোকানে চলে যান।

আমি মোটামুটিভাবে একটা আলোড়নহীন একটা নিস্তরঙ্গ জীবন কাটিয়ে দিচ্ছিলাম। অনেকদিন পর্যন্ত একটা চিঠির প্রতীক্ষায় থেকেছিলাম। নিয়মিত চিঠি পাই বটে। তবে যার চিঠি চেয়েছিলাম তার নয়। ছোট মামির। প্রথম যখন ছোটমামিকে দেখলাম তখন থেকেই আমাদের খুব ভাব হয়ে গেল। বয়সে সাত-আট বছরের বড় হলেও মামির সাথে আমার সম্পর্কটা একদম বন্ধুর মতো। আমাদের মধ্যে এখন চিঠি লেখালেখি হয়। মামির চিঠি পেতে খুব ভাল লাগে। তারপরও প্রতিবার ডাকপিয়ন যখন গেটের ওপাশ থেকে চিঠির জন্য ডাকাডাকি করে প্রতিবার আমি দৌড়ে যাই একটা বিদেশী স্ট্যাম্পের চিঠির আশায়। সে আশা আর পূরণ হয় না। তবে হটাৎ করেই এ বছর আশাতীতভাবে জাতীয়ভাবে আয়োজিত সংগীত প্রতিযোগিতায় রবীন্দ্রসংগীত আর নজরুল গীতি দু শাখাতেই প্রথম হই। বাংলাদেশ টেলিভিশনেও একবার গান গেয়ে আসি। এই ছোট্ট মফস্বল শহরে আমি এখন রীতিমতো তারকা। একই সাথে তারকার খ্যাতি আর বিড়ম্বনা দুটোই উপভোগ করতে থাকি। শফিক আমাকে দেখে এখন আর শীষ বাজায় না। মনে হয় একটু সমঝে চলে। তবে বান্ধবীরা ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকে। তারা আমাকে ভালবাসে আবার বাসে না। অনেকেই মনে করে আমার অনেক দাম বেড়ে গেছে। তাই তারা আর আগের মতো সহজভাবে কথা বলে না। আমার সাথে কথা বলতে গেলে হয় খালি প্রশংসা করে নয়তো খোঁচা মারে। বেশিরভাগ সময়ই এড়িয়ে যায়। এর মধ্যে তো দু-একজন হিংসুটে মেয়ে পেছন পেছন আমার নামে নানারকম রঙ চড়াতে শুরু করে দিয়েছে। কবে কোনদিন তারা আমাকে কোন ছেলের সাথে কথা বলতে দেখেছে। আরও কত কি। এসব দেখে আমার মজাই লাগে। মাঝে মধ্যে অবাক হয়ে ভাবি আমি এখন অনেকের মেলিতা আপা হয়ে গেছি। আর আশপাশে সব দেয়ার দল গোপন ঈর্ষায় পুড়ছে। তবে শিপ্রা এখনও আমার অকৃত্রিম বান্ধবী। হয়তো আমি তা চেয়েছি বলে। হয়তো আমি নিঃসগ্ন হতে চাইনি বলে।

বার
(এই পর্ব সিসিবিতে আগে পোস্ট করেছিলাম। তখন অবশ্য পর্বের সিরিয়াল ভিন্ন ছিল। আগের থেকে একটু সামান্য পরিবর্তন করতে হয়েছে।)

তের
তের

কিছুদিন আগে স্কুল প্রবেশিকা পরীক্ষা শেষ হল। পরীক্ষার সাল ১৯৭৯। পরীক্ষা শেষ হবার পরপরই একটা না একটা গানের অনুষ্ঠান করে যাচ্ছি। কিছুদিন আগে টাউন হাউজে গানের অনুষ্ঠান করে এসেছি। এখন হাতে একটু সময় আছে। আম্মা কয়দিন ধরে মফিজ দারোগার কথা জিজ্ঞেস করছিল। ঠিক করলাম ওই বাসায় গিয়ে একটু খোঁজ নিয়ে আসব। মফিজ দারোগা আমাদের এলাকার লোক। কোন একটা অস্পষ্ঠ কারণে সেই ভদ্রলোক এখন জেলে। তার বিরুদ্ধে মামলা চলছে। বাজারে তিন রকমের কানাঘুষা শুনতে পাওয়া যায়। এক- উনি ডাকাতদের কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে তাদের ছেড়ে দিয়েছেন,দুই -চুরির মাল সীজ করতে গিয়ে তা নিজেই গায়েব করে দিয়েছেন, তিন – থানায় লক আপে থাকা একটা মেয়েকে রেপ করেছেন। কারণ যেটাই হোক জেলে থাকাটা উনার জন্য খুবই লজ্জাজনক। বিশেষ করে এর দায়টা পোহাতে হয় তার পরিবারকে। মফিজ চাচী বেশ সুন্দরী এবং মিশুকে মহিলা। অথচ আজ কেমন এক ঘরে হয়ে গেছেন। ওনাদের এক ছেলে আর তিন মেয়ে। মেজ মেয়ে লুৎফা আমার সাথে পড়ত। এতসব ঘটনার পর লুৎফা একদিন হঠাৎ স্কুলে আসা বন্ধ করে দিল। এমনকি মেট্রিক পরীক্ষাটা পর্যন্ত দিল না। ঘর থেকে বেরুবার মুখে দাদামনুর সাথে দেখা।
‘কই যাচ্ছিস?’ দাদামনু তার খবরদারী চালাল।
‘বান্ধবীর বাসায়।’
‘কেয়াকে সাথে নিয়ে যা।’
আর ঝামেলা যাতে পাকাতে না পারে তাই আর কোন কথা না বাড়িয়ে কেয়াকে সাথে নিলাম। কেয়া লক্ষী মেয়ে। যা বলি তাই শোনে। আমার থেকে যতটা সময় যে চায় ততটা সময় আমি দিতে পারিনা। গানের জন্য আমার সব সময় বাঁধা। রিক্সা করে যেতে যেতে কেয়াকে বললাম, ‘ওদের বাসায় কিছু খেতে দিলে একটার থেকে বেশি কিছু নিবি না।’ কেয়া আস্তে করে মাথা নাড়লো।
লুৎফার এখানে এসে ওর বাবার অন্য কাহিনী শুনলাম। দেখে খারাপ লাগল যে প্রাণোচ্ছ্বল মেয়েটা কেমন জানি চুপসে গেছে। ওর ছোটবোন মিনু আমার খুব ভক্ত। কথা বলায় ওস্তাদ। কাবুলীওয়ালার মিনির অনুকরনে আমি ডাকি মিনি বলে। ও কেয়াকে সাথে নিয়ে অন্যঘরে চলে গেল।
লুৎফাকে বললাম,’পরীক্ষাটা যেমন তেমন হোক দিয়ে দিতি। একবার বিরতি দিলে কী আর আগের মতো নিয়মিত হওয়া যায়?’
’তোর কথা বল, কেমন পরীক্ষা দিলি?’
’বাংলা পরীক্ষায় শেষে যে অতিরিক্ত পৃষ্ঠাগুলো নিলাম সেগুলেতে মার্জিন টানতে পারি নাই। ভূগোলে শেষ প্রশ্নটার উত্তর শেষ করতে পারি নাই। আরো কয়েকটা মানচিত্র আঁকার জন্য ভেতরে কয়েক জায়গায় খালি রেছেছিলাম। সেসব খালিই রয়ে গেছে। এরজন্য না কম নম্বর পাই। ইংলিশটা শুধু মনের মতো দিতে পেরেছি।’
’তুই তো ক্লাসে ফৌজিয়ার থেকেও ইংলিশে বেশি নম্বর পেতি।’
’ফৌজিয়া দেখবি বোর্ডে খুব ভালো স্টান্ড করবে। ওর সব পরীক্ষা ভালো হয়েছে।’
কথাটা বলেই বুকের মধ্যে একটা চিন চিন ব্যথা করতে লাগলো। শুধু এই একটা জায়গায় আমি ফৌজিয়ার কাছে মার খেয়ে গেলাম। আমি এই মেয়েটার মতো অংক করতে পারি না বলে। ক্লাস নাইনে মানবিক বিভাগ নেওয়ার পর থেকে ক্লাসে বরাবর প্রথম হতে শুরু করেছি। কিন্তু মানবিক বিভাগের প্রথম হওয়া বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম হওয়ার কাছে কোন পাত্তাই পায় না। যদিও শিক্ষিক-শিক্ষিকারা আমাকে নিয়েও অনেক আশা করে আছে যে মানবিক বিভাগে আমিও ভালো স্টান্ড করতে পারি। লুৎফাও সে কথা জিজ্ঞেস করলো,
’অংকে ভালো করতে পারলে তো তুইও তো মানবিকে স্টান্ড করতে পারবি। কেমন হলোরে অংক?’
হ্যা অংকটাই আমার তুরুপের তাস। স্কুলের পরীক্ষায় কোনদিনই সত্তরের উপরে পায়নি। কথা প্রসঙ্গে ওর বাবার কথা আসল। লুৎফার কাছে শুনলাম এই এলাকার এমপির অনৈতিক আদেশ মেনে নেননি বলে ওদের বাবা আজ জেলে। তার পরিবারের উপরও যথেষ্ঠ চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। এমপি সাহেব তার লোক মারফৎ ওদের বুঝিয়ে দিয়েছেন মুখে কুলুপ এঁটে ভালো মানুষটি হয়ে ঘরে বসে থাক নইলে বেশী বাড়াবাড়ি করলে যা আছে তাও যাবে। বেচারা লুৎফারা না পারছে বিচার চাইতে, না পারছে ঘর থেকে বেরুতে। একাত্তরে এই দেশের এক একটা পরিবারকে কি পরিমাণ কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে!আর এখন মুষ্টিমেয় কতগুলো স্বাধীন দেশটাকে সামন্তবাদী ধারায় নিয়ে চলছে। খালেক মজুমদার এখন এই এলাকার এমপি। তার নামে বাঘে মোষে এক ঘাটে পানি খায়। শহরে এখন আইনের শাসন ব্যক্তি বিশেষের মর্জির ব্যাপার। অবশ্য সবার এতে ক্ষতি হচ্ছে না। চুপচাপ জী হুজুর মার্কা নিতান্ত আটপৌড়ে মধ্যবিত্তের নির্বিঘ্ন জীবন যদি কেউ বেছে নেয় তবে এক জীবন কোন ঝামেলা ছাড়াই সে কাটিয়ে দিতে পারবে। এই দেশের মানুষ আসলে বড় বেশি বোকা। কষ্টের সময় কষ্ট করবে। কিন্তু সময়মতো নিজের অধিকার আদায় করে নিতে জানে না।

বাসায় এসে আম্মাকে মফিজ দারোগা আর খালেক মজুমদারের দ্বন্দের কথা বললাম।
আম্মা বললেন, ‘তাইতো বলি দারোগাদের নামে এসব দোষ তো নতুন কিছু না। এতো দারোগা থাকতে মফিজ সাহেবের মতো ভাল লোক জেলে যাবে কেন?’
দাদামনু এসে যোগ দিলো। আমার পেছনে বসে মাথায় একটা চাটি মারলো।
’এই তুই কখনও একা একা ঘর থেকে বের হবি না।?’
’আমি বের হলে তোর কী হয়?’
’আম্মা দেখছেন খালি মুখে মুখে তর্ক করে?’
’আমি তো শুধু মুখ দিয়াই তর্ক করছি তোর মতো তো হাত দিয়া আরেকজানের মাথায় অকারণে চাটি মারি নাই।’
’গান গাইয়া কী একবার তুরস্ক ঘুইরা আসছে তারপর থেকে নিজেকে খালি রুনা লাইলা মনে করে। মাটিতে পা পড়ে না। এদিকে অংকে তো গোল্লা। মেট্রিকে পাবি কতো? আম্মা দেয়া ষাইটের বেশি পাইলে বাসায় বড় করে মিলাদ পড়ায়েন। আর আমি আমার নাম বদলাই ফেলব।’
’তুই আমার গান নিয়ে কোন কথা বলবি না। খুব বুঝতে পারছি আমার নাম হচ্ছে বলে তোর এতো গা জ্বলুনী হচ্ছে। অংকে ভালো না তাতে কী? শুধু অংকে ভালো হলেই তো আর কেউ প্রেসিডেন্টের হাত থেকে পদক নিতে পারে না।’
’গা জ্বলুনী নারে তবে ঘুমে খুব ব্যাঘাত হচ্ছে। লোকে যদি জানতো যে গানের জন্য বিদেশ ফেরত, প্রেসিডন্ট পদকপ্রাপ্ত গায়িকার জন্য তার পরিবারকে কতো করুন জীবনযাপন করতে হচ্ছে। প্রতিদিন সকালবেলা বিখ্যাত গায়িকার কণ্ঠানুশীলনে রাত দুটায় ঘুমাতে যাওয়া এই গরিব বান্দার ভর ছয়টায় কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যায়। দুঃখ একটাই যে দিন শেষে এই গরিবের ত্যাগটা কেউ দেখলো সবাই শুধু গায়িকার পুরস্কারের দিকে তাকিয়ে থেকেই বাহবা দিল।’
দাদামনুর এই কথায় সত্যিই খুব আঘাত পেলাম। অংক নিয়ে যা বলুক তাতে কিছু এসে যায় না। কিন্তু গান নিয়ে বললে সত্যিই খুব খারাপ লাগে। বললাম, ’আম্মা একবার এদিকে আসেন। আপনে আমারে বকা দেন প্রতিদিন ভোরে রেওয়াজ না করার জন্য। আর দাদামনু কী সব বলতেছে শুনে যান।’
আম্মা এবার আসে। কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলে,’বাসাটতো আর বাসা নাই। একদম বাজার হয়ে গেছে। দুইটা একসাথে হলেই খালি ঝগড়া করে।’
আমি বললাম,’আমারে বলেন কেন? আমি কী করলাম? দাদামনু বাইরে থেকে এসেই আমারে খালি গান নিয়ে খোঁচা মারতেছে। আপনি বলে দেন অন্য যে কোন কিছু নিয়ে কথা বলতে পারে। কিন্তু গান নিয়ে কিছু বলতে পারবে না।’
দাদামনু বলে উঠলো,’আমি কি প্রথমে তোর গান নিয়ে কথা শুরু করছিলাম? একা একা বাইরে বের হোস কেন?’
আম্মা বললেন, ’আমারে বলেই তো গেছিলো লুৎফার বাসায়। সাথে তো কেয়াও ছিল। বিপদে পড়ছে ওরা। বিপদেই তো বন্ধুরে চিনা যায়।’
দাদামনু বললো,’আমি বলাতেই না কেয়াকে সাথে নিছে। ও বাইরে গেলে আমারে বলতেন। আমি নিয়া যাইতাম। লুৎফার বাসার ঔদিকটা অতো ভালো না। সফিকের দল ওইদিকে বইসা থাকে। একলা কোন মেয়েকে চলতে দেখলে খারাপ কথা বলে। এই জন্যই বলে কারো ভাল করতে হয়না।’
আম্মা ইদানিং কোন বাছ-বিচার ছাড়াই আমার পক্ষাবলম্বন করেন। এখন দাদামনুর এই কথাকে মাটিতে পড়তে দিলেন না। বললেন,’দেয়ার মতো মেয়ে লাখে একটা হয়। সামনের বাসার হালিমার মা এসে আজকে সকালবেলাও এ কথা বলে গেলো। এলাকার সবাই আমাকে রত্নগর্ভা বলে। দেয়া কখন কি করে সেটা জানতে চাইলো।’
দাদামনু বললো,’ঐ মহিলা তো সে কথা বলবেই। দেয়ার সব নোটগুলা তো উনাকে দিয়ে দিয়েছে। অথচ আমি বাসার মানুষ হয়ে সেগুলো পেলাম না।’
আমার চোখ সটান করে চড়কগাছে উঠলো। এটাও বিশ্বাসযোগ্য যে দাদামনু আমার নোটের অপেক্ষায় ছিল! জিজ্ঞেস করলাম,’ দাদামনু তুই কার জন্য নোট নিতে চেয়েছিলি?’
’সেটা শুনে এখন আর কী হবে।’
’আমার কাছে এখনও কিছু নোট রয়ে গেছে। তোর দরকার হলে নিতে পারিস।’
’কোন বিষয়ের?’
’অংকের।’ বলেই নিজের ঘরের দিকে একটা দৌড় দিলাম। পেছন থেকে শুনতে পেলাম, ’দেখছেন আপনার লাখে একটা মেয়ের আদবকায়দা? বড়ভাই হিসেবে আমাকে একটুও সম্মান করে না। আপনারাও এই নিয়ে ওকে কিছু বলেন না। একদিন দেখবেন এই মেয়েই একদিন আপনাদের মানসম্মান ডুবাবে।’

দাদামনুর সাথে আসলে আমার নারীর সম অধিকার প্রতিষ্ঠার এক অদৃষ্ঠ প্রতিযোগিতা চলে। এর প্রধান কারণ বোধহয় আমার মানতে না পারা একসময়ের খেলার সাথী হঠাৎ করেই অভিভাবক হয়ে যাবে? একা বাইরে যেতে পারবো না,ছেলেদের সাথে কথা বলতে পারবো না,এরকম কত শত বিধিনিষেধ দিবে। দাদামনুর জন্য আমার নাচটাও ছাড়তে হলো। তারপরও প্রতিদিন আম্মার কাছে আমার নামে অভিযোগ করছে। ইদানিং আমিও দাদামনুকে পাত্তা না দেওয়ার ভাব দেখাই। হাজার হোক একটু-আধটু হলেও তো আমি এলাকার তারকা। অহংকারী হবার অধিকার তো আমার রয়েছে।
বাবা আর ভাইয়া নিপাট ভাল মানুষ। কথা কম বলেন। উনাদের সাথে দেখাও হয় কালে ভদ্রে। সেখানে সম্পর্কটা শ্রদ্ধা,ভক্তি আর ভালবাসার। আম্মাতো শাশ্বত বাংগালি মায়ের প্রতিমূর্তি। আমার যত প্রশয়ের আশ্রয়। একসময় খুব শাসন করেছেন। ইদানিং আমার উপর অতি আস্থার কারণে সেই শাসনের মাত্রা বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়। কেয়া তার কৈশোরের সময় পার করছে। বোনে বোনের আত্মিক সম্পর্কটা এখনও গড়ে উঠেনি আমাদের মধ্যে। তাই যত ভাবের আদান প্রদান,ছোট বড় খুটখাট আবার ভয় পাওয়া তার সব কিছুই পিঠাপিঠি ভাইটার জন্য তোলা।
তাই বলে আমরা সবসময়ই ঝগড়া করি ব্যাপারটা ঠিক সেরকমও নয়। মাঝে মধ্যে দাদামনুকে আমার খুব প্র্যোজন হয়। এ বাসার অলিখিত নিয়ম আছে যে সন্ধ্যার পরে কারই বাসার বাইরে থাকা চলবে না। স্বাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের জন্য আমাকে যদি কখনও বা রাতে বাইরে থাকতে হয়,তখন দাদামনুই ভরসা। তখন আমি ওর ছোট্ট লক্ষ্মী বোনটি হয়ে পরি। এ রহস্যও বেশ ভাল করে আয়ত্তে আছে যে কি করে দাদামনুকে বশ করতে হয়। সেই ক্ষমতা প্রয়োজন হলেই শুধু প্রয়োগ করি। সেই ক্ষমতাটার নমুনা হলো এরকম যে যেদিন দরকার পড়বে তার আগেরদিন ওর ঘরটা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে দিই। বিকেলবেলা চা নাস্তা বানিয়ে রুমে দিয়ে আসি। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলি। যথেষ্ট পরিমানে মন গলানোর চেষ্টা করার পর তবেই তার সার্ভিসের নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। এই পৃথিবীতে কোনকিছুই বিনা কষ্টে পাওয়া যায় না। তখন আমার আর দাদামনুর এতো মিল-মোহাব্বত দেখে আম্মা বলবেন, ’তুমি সব সময় ভালোর সাথে এমন ব্যবহার করতে পার না,তাহলে তো ও আর তোমার পিছনে লাগবে না।’
আসলে পারলেও কিছুটা ইচ্ছে করেই আমি তা করি না। আম্মাকে আর সে কথা বলি না। স্বাদ বাড়ানোর জন্য মিষ্টান্নর মধ্যেও কিছু লবন দিতে হয়। সব সময় সবার কাছ থেকে তো খালি প্রশংসা শুনছি। একটু বিপরীত স্রোতেও তো কথা শোনা দরকার। তাতে নিজেরই সংশোধন হয়। দাদামনুকে আমি আমার সমালোচক ব্যাংকে জমা রেখেছি।

(চলবে)

১,৬৫০ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “ধারাবাহিক উপন্যাস – ১১,১২, ১৩”

  1. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    শান্তা,

    আমার কেন যেন রাজনৈতিক অংশটা প্রবন্ধ প্রবন্ধ লাগে। পরের অংশ কিন্তু অনেক সাবলীল। একান্তই আমার মত। পুরোটা একসঙ্গে পড়লে হয়তো এমন নাও লাগতে পারে। এগিয়ে যাও।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      সানা ভাই প্রথমেই অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। এবার আপনাকে একটা মজার কথা বলি। মোটামুটি রাফ-কাট (কারণ এরপরও পরিবর্তন হয়েছে, হয়তো সামনে আরও হবে) এবার দেশে আমার শাশুড়ি (৬৫) এবং এক ভাগ্নী (১৭) কে পড়তে দিয়েছিলাম। প্রথমজনের কাছে রাজনৈতিক বা বিভিন্ন বাস্তব ঘটনার উল্লেখগুলো অতোটা আকর্ষনীয় লাগেনি। কিন্তু দ্বিতীয়জন আবার এইসব অংশগুলোই খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছে। এবং ধন্যবাদ জানিয়েছে যে সে প্রায় কিছুই জানত না - এইটা পড়ে সে কিছু জানতে পারছে।
      আমার মনে হয় আপনাদের মতো যারা এইসব ঘটনা দেখেছেন এবং এতোবার পড়েছেন যে তাদের কাছে বিরক্তি লাগতে পারে - আমি ধরেই নিয়েছি লাগবে। তবে নতুন তো - আশা করছি লিখতে লিখতে অভিজ্ঞতা বাড়বে। ইন ফ্যআক্ট আপনাদের সামনেই তো ঘটছে আমার লেখার বিবর্তন।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : হাসান (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।