ধারাবাহিক উপন্যাস – ৪

পর্বঃ চার এবং পাঁচ

চার

এরপর কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? হবে হয়তো। জেগে উঠি ধরফরিয়ে। মনে হচ্ছে বাসার সামনে দিয়ে মিলিটারির জীপ যাচ্ছে। হয়তো দুঃস্বপ্নে দেখেছিলাম। টিকটিকি টিক টিক করে উঠলো। অন্ধকার ঘরে কেয়াকে ডিঙ্গিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আসি। জানালায় কে যেন টর্চের আলো ফেললো। আবারো টিক টিক শব্দ। খুব মৃদু। শব্দটা ঘরের পেছন দিক থেকে আসছে। পাকঘরে চলে আসি। বুঝলাম টিকটিকির আওয়াজ নয়। বাইরে থেকে যে জানি পাকঘরের দরজায় অল্প শব্দ করে খুব দ্রুত সতর্ক টোকা দিচ্ছে। মাঝে মধ্যে কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, ’করিম সাহেব দরজাটা একটু খুলবেন?’
খুব খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে এই আশংকা এখন বাস্তব। ভয়টা চলে গিয়ে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে সচকিত করে তুললো। পাকঘরের দরজা ধাক্কিয়ে কেউ করুন গলায় আর্তি জানাচ্ছে ভেতরে ঢুকতে দেবার জন্য। মনে হলো শিপ্রারা এসেছে। আর এক মুহূর্তও দেরী না করে পাকঘরেরের দরজার খিড়কী খুলে দিলাম। সাথে সাথেই তিনজন মানুষ হুরমুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো।
প্রথমেই দেখলাম সেদিন আমার হাত থেকে বল ফেরত নেওয়া সেই রাজপুত্রকে। পেছনে তার মা আর খান দাদা। ছেলেটির মা খান দাদার বড় ছেলের বৌ। কিছুদিন আগে উনি একবার আমাদের বাসায় এসেছিলেন। উনার শ্বাশুরির মৃত্যু উপলক্ষ্য আয়োজিত চল্লিশায় আমাদের পরিবারের সবাইকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। আম্মার হাত ধরে চল্লিশার দিন প্রথম ও বাড়িতে ঢুকি। রাজপুত্র তার সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে ঘুরছিল। আমার দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি। অথচ সেদিন হাজার ব্যস্ততার মাঝেও রাজপুত্রের মা আমাদের খোঁজখবর নিয়েছিল। রাজপুত্রের উপর যদিও খুব অভিমান হইয়েছিল কিন্তু ওর ভাল মায়ের কারণে তাকে মনে মনে মাপ করে দিয়েছিলাম। আর এখন এ আকসিক ঘটনায় রীতিমতো হতভম্ব।
ততক্ষনে আব্বা-আম্মাও জেগে উঠে রান্নাঘরে চলে এসেছেন। প্রথমেই শুনলাম মহিলার কণ্ঠস্বর, ‘ভাবি, পাকিস্তানী মিলিটারীরা আমাদের ধরতে এসেছে। আজকের রাতের জন্য আপনাদের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা চাচ্ছি। নিজেদের জীবনের জন্য কিছুটা স্বার্থপর হয়েই আপনাদের এই ঝুঁকির মধ্যে ফেলছি। না চাইলে আমাদের বের করে দিতে পারেন।‘
’কী বলেন হোসনা আপা? বিপদে একে অপরের উপকারে না আসলে আমরা কিসের মানুষ? আমরা বাঁচলে আপনারাও বাঁচবেন।’
আম্মার দিকে আমি সকৃতজ্ঞ চোখে তাকালাম।
এরপর খুব দ্রুত খাটের নীচে, বাথরুমের পানির ড্রামে, মিটসেফের মধ্যে এরকম নানা জায়গায় আব্বা-আম্মা তত্রস্থ হয়ে উনাদের লুকানোর ব্যবস্থা করে দিলেন।
রাজপুত্রের জায়গা হয়েছিলো রান্নাঘরের তাকের উপরে। সেখানটায় সারারাত সে আড়াআড়িভাবে শুয়েছিল।

সেরাতের কথা মনে হলে এখনও দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। হাতের সব রোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়। তারপরও কেউ যদি আমাকে অতীত বদলানোর ক্ষমতা দেয় আমি আর অনেক কিছুই বদলে দিব,কিন্তু সে রাতটাকে পুংখানুপুংখভাবে একইরকম রাখবো। আমার পরবর্তী জীবনের সব ঘটনাপ্রবাহের জন্য এই রাতটার একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। একটাই অনুতাপ এই যে এরপর রাজপুত্রের জীবনও আমার সাথে জড়িয়ে যায়। একে কি কালরাত বলব? কারণ আমার সাথে তার পরিচয় হওয়াটাই ছিল একটা অশুভ লক্ষন। কিন্তু আমার জীবনে সাদারাত। রাজপুত্রের সাথে পরিচয় হওয়ার পর আমি আর আগের মতো থাকিনি। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। জীবনের স্রোত নদীর ধর্ম মানতে ভালবাসে। গতিপথে হয় নদী বড় নদীর সাথে মিশে যাবে,মরে যাবে নয়তো নিজেই সাগরে পর্যন্ত পৌছবে। এখানে কোন পৌনপুনিকতার স্থান নেই। অথচ স্বপ্ন হারিয়ে আমরা সব পৌনপুনিক জীবনের মধ্যে আবর্তিত হতে থাকি। আমাদের জীবন নদী না হয়ে বদ্ধ জলাশয় হয়ে পড়ে।

পাঁচ

খান মঞ্জিলের লোকজন এ শহরের বেশ বনেদী পরিবার। ও বাড়ির সবাই খুব গৌরবর্ণের। কারো কারো চোখের রং ধূসর সবুজাভ। জনশ্রুত আছে যে তাদের পূর্বপুরুষেরা নাকি আরব থেকে বাঘের পিঠে চেপে বাংলা মুল্লুকে এসেছিলেন। খান মঞ্জিলের লোকজনদের এসব গল্প বলার দরকার পড়ে না। তাদের দ্যুতিমান আর্য চেহারা আর চালচলনে সবকিছু খুব বেশি স্পষ্ট। দুবিঘা জায়গার উপরে এই বিশাল বাড়িটা খান দাদার বাবার হাতে তৈরী করা। ভেতরে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, গাব, জামরুল, লটকন, বেতফল, পেয়ারা,বড়ই, নারিকেল, তালসহ এমন কোন ফলের গাছ নেই যে তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। চারভাগের তিনভাগ জায়গাই গাছ-গাছালী আর খোলা মাঠ। গ্রীষ্মকালে গাছতলে প্রায়ই আম, জাম, লিচু, পেয়ারা পরে থাকে। বাড়ির লোকেরা খায়না। কাজের মানুষ সেসব নিয়ে যায়। বর্ষাকালে বেলফুল,হাস্নাহেনা, কেয়া, রজনীগন্ধা, কদমের তীব্র গন্ধ প্রাচীর ছাড়িয়ে এদিকটায় এসে আমাদেরকেও মাতাল করে তুলে। মূলবাড়িটা তিনতলা। একতলায় বিশাল এক বৈঠকখানা। ঠিক একদম রাজবাড়ির মতো করে সাজানো। দেয়ালে বাঘের চামড়া, শিংওয়ালা চিত্রল হরিণের মাথা, মোঘল আমলের খোপবন্ধ তরোয়াল ঝুলান আছে। সেগুন কাঠের উপর সূক্ষ্ম কারুকাজ করা দুসেট মোগলাই সোফাসেট নাকি বার্মা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। পুরো মেঝেটা দাবার বোর্ডের মতো মার্বেল পাথর দিয়ে বড় বড় সাদাকালো ছক কাটা। তার উপর ঘরের মধ্যখানে পারসিয়ান কার্পেট। দোতলার ঝুল বারান্দায় বড় বড় অনেক ক্যাকটাস সাজানো আছে। এই তলার পুরোটা জুরে তিনপ্রজন্ম মিলে গড়ে তোলা এক বিশাল লাইব্রেরী। শুরু হয়েছিল খানদাদার বাবার সময় থেকে। পরবর্তীতে খানদাদা আর এখন তার ছেলেমেয়েরা এর কলেবর বাড়িয়ে যাচ্ছে। দেশবিদেশের বইয়ে ঠাসা। তিনতলায় সবার থাকার ব্যবস্থা।
গ্যারেজে ছিল দুটো গাড়ি। একটা মাইক্রোবাস আর আরেকটা ভক্স ওয়াগন। শেষোক্ত গাড়িটা খানদাদা নিজে চালাতেন। সে গাড়ি চালিয়ে ওনি কখনও বাজারে যেতেন, কোর্টবাড়ি যেতেন, কুমিল্লা ক্লাবে যেতেন। কুমিল্লা শহরে তো তখন গাড়ির বেশ আকাল। রাস্তাঘাটে বেরুলে দু-একটার বেশি দেখা যেত না। অথচ ও বাসায় যারা আসতো তারাও সব গাড়ি হাকিয়ে আসতো। অধিকাংশই দূর-দূরান্ত থেকে। খান দাদার বন্ধু- বান্ধব, আত্মীয় স্বজন। সবচেয়ে বেশি আসতো ওনার বড় ছেলে আর তার পরিবার। ওনাকে আমরা সিএসপি চাচা বলে চিনতাম। ছোটবেলায় মনে করতাম এটাই ছিল ওনার নাম। যুদ্ধের সময়টাতে জেনেছিলাম সিএসপি কী জিনিষ। পেছনে পেছনে সিএসপিরাই নাকি দেশ চালায়। এরা দেশের সবচেয়ে বড় সরকারী চাকুরে। এদের আমলা বলে।
এই সিএসপি চাচার স্ত্রীই হলেন হোসনা আপা। সরকারী কলেজে ইংরেজীতে শিক্ষকতা করতেন। উনাদের ছোট ছেলে হিরণ। বড় ছেলে কিরণ।
ছোট্টবেলায় যখন আম্মার মুখে রূপকথার গল্প শুনতাম তখন আমার কল্পনা রাজ্যে রাজপ্রাসাদ হয়ে খান দাদার এই বাড়িটা ভেসে উঠতো। আর বাসার মানুষগুলো হয়ে যেতো রাজা, রানি, রাজপুত্র, পাইক পেয়াদা। শুধু কোন রাজকন্যা সেখানে থাকতো না। রূপকথার গল্পের মতোই ও বাসার মানুষগুলো ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেই কালরাতের পর তারা নেমে আসে আমার চারপাশের মর্ত্যমান পৃথিবীতে। ঊনিশশ একাত্তুর শুধু দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামই ছিল না,ছিল সবার মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়ার এক অপূর্ব মোহনা। এসময় মোল্লা হাবেলী আর খান মঞ্জিলের মধ্যেকার মরচে ধরা ছোটগেট খুলে যায়। উঁচু ইট সিমেন্টের প্রাচীল থেকে খসে পরে শ্রেনী বৈষম্যের খোলস।

সেই কালরাত কিম্বা সাদা রাতে পাকসেনারা খান দাদার বাড়ি ঘুরে বাসার কাউকে না পেয়ে একদম খালি হাতেই চলে গেল। পাশে আমাদের বাড়িতে আর হানা দিল না। পরদিন বড়দের চুপি চুপি অনেক আলোচনা চললো। খানদাদা ইতিমধ্যে আমাকে জোয়ান অব আর্ক নামে ডাকতে শুরু করেছেন। আমি চুপচাপ তাদের মধ্যে বসে রইলাম। কেউ বললো না, ‘বড়দের মধ্যে কেন, অন্যখানে যাও।‘ যাওয়ার তো আর কোন জায়গা নেই। পুরো বাসাই সরগরম। এক ঘরে ছেলেরা আর এক ঘরে মেয়েরা। মাঝে বৈঠকখানার মতো এক চিলতে জায়গায় চারখানা পেতে রাখা বেতের চেয়ারে আব্বা, খান দাদা, হোসনা আপা আর আম্মার নিচু স্বরে কথপোকথন।
‘গতবছরের শুরুতে ট্রেনিংএর কাজে বেলাল লন্ডন গেল দু বছরের জন্য। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সে বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের পক্ষে জনমত তৈরী করে যাচ্ছে। ঢাকায় থাকা নিরাপদ নয় বলে বৌমা আর হিরণকে এখানে নিয়ে আসলাম। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এখানেও ওরা নিরাপদ নয়।’ খানদাদা এক নিঃশ্বাসে কথা বলে যাচ্ছেন, ‘দুদিন আগে আগরতলা থেকে আসা দুটা ছেলেকে দিয়ে বেলাল খবর পাঠিয়েছিল আমাদের বর্ডার পার হয়ে ভারতে চলে যাবার জন্য। আমার এখন আর যাওয়ার মানে হয় না। কিন্তু বৌমা আমাকে ছেড়ে কিছুতেই যেতে চাচ্ছে না। এখন দেখলে তো বৌমা সে কথা না শুনে বড্ড বেশি ঝুঁকি নেওয়া হয়ে গেছে।’
‘গতরাতে কি মনে করেছেন ওরা আপনাকে ছেড়ে দিত?’ হোসনা আপা বললেন।
‘বৌমা এবার আর মানা করো না আমি তোমাদের বর্ডার পারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এই বুড়াকে আর ওদের ভয় কী? আর যদি ধরেও নিয়ে যায় তবে বলতে তো পারবো এক সময় মুসলিম লীগ করেছিলাম পাকিস্তান হওয়ার জন্য।’
‘আব্বা ঐ পশুগুলো কোন বাছবিচার করে না। দেখলেন তো ধীরেন কাকুকে ধরে নিয়ে গেল। গেলে সবাই একসাথে যাব।’ হোসনা আপা নাছোরবান্দা।
খান দাদা এবার নিজের অবস্থা থেকে সরে আসলেন,‘এতো বড় ফাঁড়া থেকে রক্ষা পাবার পরও যখন আমাকে ছাড়তে চাইছো না তখন আর কী করা? চল কিছুক্ষনের মধ্যেই সবাই মিলে রওনা দিই। আপাতত বর্ডারের কাছে সোনামুড়া পর্যন্ত যাই। করিম সাহেব আপনাদেরকে আমরা মহা বিপদে ফেলে গেলাম। জানতে পারলে আবার এ কারণে না আপনাদের ওরা কোন সমস্যা করে। সামনে কী হয় না হয় কিছুই তো বলা যাচ্ছে না।’
‘না কি যে বলেন…’ আব্বা এভাবে প্রশংসা পেতে অভ্যস্ত নয়।
‘দেশের এই পরিস্থিতিতে আপনাদেরও মনে হয় দেশের বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন থাকা উচিত। বিশেষ করে আপনার বড় ছেলেকে পারলে কোথাও কিছুদিনের জন্য পাঠিয়ে দিন।’খানদাদা কথাটা আব্বার দিকে তাকিয়ে বললেন। আব্বা তাকালেন আম্মার দিকে। বাসার সব সিদ্ধান্ত সাধারণত আম্মাই নেন। আব্বা সেসব শুধু অনুসরণ করে। সব মিলিয়ে আম্মার মুখটা কেমন জানি পাংশুটে হয়ে গেছে। একটু বোধহয় আতংকিত, দ্বিধান্নিত।
আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, আপনাদের বড় ছেলে কিরণ কোথায়?’
হোসনা আপা আর খান দাদা দুজন পরষ্পরের দিকে চকিতে একটু দৃষ্টি বিনিময় করে খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেলেন।
আম্মা ততক্ষনে ধাতস্ত হয়ে চোখের ইশারায় আব্বাকে চুপ থাকতে বলে নিজে যোগ করলেন ‘আগরতলার কাছেই আমার শ্বশুর বাড়ি। আপনাদের সাথে আপনও বরং যাক। একটা ছেলে তো সাথে থাকা লাগে। বর্ডার পাড় হতে না পারলে কিছুদিন আমার শ্বশুর বাড়িতে থাকতে পারেন।‘
কথাটাতে আব্বাও সায় দিলেন।
হোসনা আপা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। আস্তে করে আম্মার কাছে গিয়ে ওনার হাতটা ধরলেন তারপর খুব ধীরে ধীরে বললেন, ‘এই দুঃসময় যদি কোন একদিন শেষ হয়, যদি তখনও বেঁচে থাকি তখন আল্লাহতায়ালা ভুলিয়ে না দেন আপনাদের উপকারের কথা।’
হোসনা আপার প্রতিটি পদক্ষেপ, বাচনভঙ্গি, রুচিসম্মত সাজসজ্জা সবকিছুর মধ্যে এমন একটা সিদ্ধ আর পরিশলিত ভাব মিশে থাকে যে মনে হয় এইমাত্র উনি রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের পাতা থেকে নেমে আসলেন। তার উপর এই মুহূর্তে আম্মাকে গভীর আবেগমাখা যে কথাটি বললেন তা কেমন করে জানি সবার চোখকে ছলছল করে দিল। আমার মনে হতে লাগলো যা দেখছি তা বাস্তবের কোন দৃশ্য নয়,চলচিত্রের অংশ।
আম্মাও বোধহয় হতবিহবল হয়ে পড়েছিলেন। সম্বিত ফেরার জন্য যতোটুকু সময় লাগে ততটুকু সময় নিয়ে বললেন, ’আপা এই দেশটার জন্য আমাদের বেঁচে থাকা না থাকায় কিছু এসে যায় না। কিন্তু আপনাদের বেঁচে থাকাটা খুব জরুরী। আপনাদের সাহায্য করতে পেরে আমরাই বরং ধন্য হলাম।’
হোসনা আপা আম্মাকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে আস্তে করে কী জানি বললেন তারপর ওনার শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ’আব্বা চলেন এখনও রওনা দিই। গাড়ি করে যতোটা পারি যাই। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিব। আপা আমরা এখন বাসায় যাচ্ছি। আপনকে আসতে বলেন।’
‘আসি জোয়ান অব আর্ক।’ আমার দিকে তাকিয়ে খানদাদা মিষ্টি করে কথাটা বললেন।

এরপর সব কিছু খুব দ্রুত ঘটে গেল। সিনেমার মতো। কোন পরিচালকের নির্দেশে একটার পর একটা দৃশ্য যেন আগে থেকেই সাজানো ছিল।
ছোটগেট দিয়ে খান দাদা, হোসনা আপা আর ভাইয়া খান মঞ্জিলে চলে গেল। এরপর পরই আমাদের বাসার সামনের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ও বাসার কোন কাজের লোক মনে করে আম্মা কিছু জিজ্ঞেস না করেই দরজা খুলে দিলেন। সেখানে মূর্তমান দাঁড়িয়ে আছে বাড়িওয়ালা কাদের মোল্লা। আম্মা তো একেবারে থ। যথাসমম্ভব নিজের চমকে উঠা ভাবকে গোপন করে আগের মতোই কাদের মোল্লাকে উচ্ছ্বাসময় স্বাগত জানালেন।
কাদের মোল্লা মনে হয় কিছুটা হতাশ হলেন। ভেতরে ঢুকে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন,’তোমরা কেমন আছো না আছো তা দেখতে আইলাম।‘
‘এতোদিন পরে আসলেন? চারদিকে এতো গুলিগোলাজ, দিনে রাতে আর্মির গাড়ির বাসার সামনে দিয়ে যায়। এসব কি হচ্ছে তার কিছুই তো বুঝতেছিনা। আমি অবশ্য দেয়ার বাপরে বলি কাদের চাচা থাকতে আমাদের আর চিন্তা কী?’
’না না তোমাগো কোন চিন্তা নাই। আমি আছি না। কতোগুলা বেজন্মা হিন্দুগোর সাথে মিইল্যা শেখের ব্যাটা দেশটারে ভাঙ্গতে চায়। সাহস কতো?’
’এইটা কী সম্ভবনি? কার এমন দুর্বুদ্ধি হইছে?’কাদের মোল্লার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর আম্মা তার ভাষা বদলে ফেলে।
’আর কইয়ো না, পাশের বাড়ির ফখরুল খানের বড় পোলা লন্ডনে বসইস্যা লাফ পারতাছে। বাঙ্গালিরে বড় অফিসার বানাইতে নাই। সব নেমকহারামের বাচ্চা। হের ছোট পোলার তো মাথা খারাপ। কই আছে? মেন্টাল হসপিটালেনি? এখন আবার কি মুক্তি হওনের হুজুগ উঠছে। খানের বড় নাতি নাকি হের লাইগ্যা ভারত গেছে? দুই একটা বোম ফুটাইয়া এরা নাকি সরকারের ওগে যুদ্ধ করবো? হগলটিরে ক্যান্টনমেন্টে নিয়া পাছায় এক বাড়ি লাগাইলেই সব শখ উইড়া যাইবো। ভয়ে তো খান এখন লুঙ্গি উলটাইয়া পালাইছে। তুমি এদের দেকছো টেকছোনি?’
’না চাচা। বাড়িতে তো কয়েকদিন ধইরা রাইতে বাত্তি থাকে না। খান মঞ্জিলের বেবাকতে আগেই পালাইছে মনে হয়।’
’হাচানি? তা তোমার বড় পোলা এখন বাড়িতেনি?’কাদের মোল্লা ভাইয়ার খোঁজ করছে। আমার গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো।
‘হ বাড়িতে। তয় এখন বাজারে গ্যাছে।’
’হে বাড়িতে আইলে আমার ওখানে একটু পাঠাইয়া দিও। তাগড়া পোলা। এই দুঃসময়ে দেশের জন্য তো কিছু করা দরকার।’
’চাচা পাঠামু। আপনে বসেন একটু চা খাইয়া যান।’
’পারলে একটু পান দাও। আর একটু ল্যাট্রিন হইয়া আসি।,
’চাচা বসেন। আমি একটু দেইখ্যা আসি।’
আমি দরজার গা ঘেষে দাড়িয়েছিলাম। আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আম্মা হাত ধরে টানতে টানতে বলল,’আবার প্যাক ছাইন্যা আইছোস। আয় পা ধুবি।’ আমি মোটেই মাটি ছানিনি। আম্মার এই অদ্ভুত আচরনের কারণ বুঝলাম একটু পরে।
খান দাদাদের ও বাসায় যাওয়ার সময় হিরণ ভাই টয়লেটে ছিল। হোসনা আপা আম্মাকে বলেছে বের হলেই তাকে পাঠিয়ে দিতে। আমরা রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে টয়লেটের দিকে যাওয়ার সময় দেখি হিরণ ভাই সবে বের হয়ে এদিকে আসছে। এক হাতে আমাকে আর আরেক হাত দিয়ে হিরণ ভাইকে টেনে নিয়ে দুজনকেই বাথরুমে ঢুকিয়ে দিল। তারপর ড্রামের মধ্যে উঁকি দিয়ে বললো, ’হিরণ বাবা ভেতর থেকে দরজা আটকিয়ে তুমি এক্ষুনি এই ড্রেমের মধ্যে নেমে পড়ো। দেয়া তুই কিছুক্ষন পর পর মগে করে পানি ঢালবি।’
এরপর একদম দেরী না করে আম্মা তড়িঘরি বৈঠকখানার দিকে চলে গেল।
কিছুক্ষন পর কাদের মোল্লার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। সাথে আম্মারও। তখন আমি ইঞ্জিন চালিত যন্ত্রের মতো ড্রাম থেকে এক মগ পানি নিচ্ছি আর ঢালছি। সেই ড্রামের মধ্যে হিরণ ভাই নাক পর্যন্ত ডুবে রয়েছে। পানি নিতে গিয়ে বার বার সেই চোখদুটোর দিকে আমার চোখ চলে যাচ্ছে। একটি স্বচ্ছ সবুজ পাথরের মার্বেল। সেই মার্বেলটা আবার রং বদলাতে জানে। অনুভূতির। এখন সেখানে ভয়ের ছায়া। বেঁচে থাকার তীব্র আকুতি। পানি ঢালতে ঢালতে পানি থর থর করে কাঁপছি। মনে হচ্ছে আমি থেমে গেলেই এই সবুজ মার্বেলজোড়া তার সব অনুভূতির রং হারিয়ে ফেলবে। বয়স আন্দাজে অনেক বেশি গুরু দায়িত্ব আম্মা আমাকে দিয়ে গেছে। আমার হাতটা কেন এতো ভারী লাগছে? সব বিপদ কেন খালি আমার চারপাশ দিয়ে ঘুরপাক খায়? বাইরে কাদের মোল্লার গলার আওয়াজ পাচ্ছি।
‘ভেতরে ক্যাডা?’
‘চাচা দেয়া গোছল করত্যাছে।’
‘পোলাপানগো কি সব হিন্দুয়ানী নাম রাখছো! হেইগ্যা না কিছুক্ষণ আগে তোমার লগে ছিল?’
বাইরে দরজা ধাক্কার শব্দ …খিলকীটা বোধহয় একটু নড়ে উঠলো। সবুজ মার্বেলজোরা কেমন জানি স্থির হয়ে যাচ্ছে। বাজার থেকে কিনে আনা নিষ্প্রাণ মাছের চোখের মতো। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠলো। আমি জ্ঞান হারাবার একদম আগ মুহূর্তে দেখলাম সেই মার্বেলজোরা ড্রাম থেকে এক লাফে উঠে এসে আমার চোখের সামনে চলে আসলো। আমাকে কেউ ধরে আছে।
এরপর আর কিছু মনে নেই।

(চলবে)

২,৬৪১ বার দেখা হয়েছে

১৯ টি মন্তব্য : “ধারাবাহিক উপন্যাস – ৪”

  1. রাব্বী (৯২-৯৮)

    শান্তা আপা, সবলেখা পড়ার সময় পাই না আজকাল।

    ভাল লেগেছে। এবং আমি যতোটা পড়েছিলাম আমার বেশ ভাল লেগেছিল। এই পর্বে সময়টা উঠে এসেছে বেশ। 'সিএসপি', 'কাদের মোল্লা' জাতীয় ব্যাপারগুলো সেই সময়টিকে ধরতে পেরেছে। সাথে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার।

    উপন্যাসে উত্তম জাঁঝা!


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন
  2. সাইফ শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

    শান্তা,

    খুব সুন্দর হচ্ছে লেখা। পারলে একটা কাজ করো - প্রতি পর্বের উপরে এবং নীচে আগের ও পরের পর্বের লিংক যদি দিতে পারো তবে প্রয়োজনে এক সাথে অনেকটা পড়া যাবে।

    জবাব দিন
  3. তামিম মাহমুদ (১৯৯৯-২০০৫)

    ''ঊনিশশ একাত্তুর শুধু দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামই ছিল না,ছিল সবার মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়ার এক অপূর্ব মোহনা। এসময় মোল্লা হাবেলী আর খান মঞ্জিলের মধ্যেকার মরচে ধরা ছোটগেট খুলে যায়। উঁচু ইট সিমেন্টের প্রাচীল থেকে খসে পরে শ্রেনী বৈষম্যের খোলস।'' ::salute::
    আপু,খুব ভাল হচ্ছে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাইফ শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।