আমাদের শিল্পসাহিত্যের গতিপ্রকৃতি (প্রথম পর্ব)


আমরা যারা বিভিন্ন ব্লগের সাথে জড়িয়ে গেছি তারা বোধহয় কমবেশি সবাই বই পড়তে ভালবাসি। নইলে তো ইউটিউব, ফেসবুক আর ভিডিও গেইমেই বাঁধা থাকতাম। দেশে এখন বই মেলা হচ্ছে। রমরম ঝমঝম। দূরে বসেও তার ঝংকার শুনতে পারছি। বেশ বুঝতে পারছি ঢাকা শহরে ফেব্রুয়ারী এখন বেশ উতসবের মাস। বাংগালিদের জন্য এই মাসটা বেশ ঘটনাবহুল। ফাগুন রাংগানো সুখ আছে। আবার একুশের কালো ব্যাচে ঢাকা দুঃখও আছে। আছে ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারীর স্বৈরতন্ত্রের প্রবর্তিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অরুণিত ছাত্র আন্দোলন, ২০০৯ সালে পিলখানায় ঘটে যাওয়া ২৫শে ফেব্রুয়ারী বিডিয়ারের রক্তরঞ্জিত অধ্যায়।
তারপরও জীবন থেমে থাকে না। আর জীবনবাদী মানুষদের জন্য তো তা একদমই নয়। আমরা শোকে ব্যথিত হই। মনের মণিকোঠায় সে শোক সযত্নে সাজিয়ে রাখি। আবার আনন্দে মেতে উঠি। আমাদের আনন্দ যারা চলে গেছে তাদেরকে ভুলে গিয়ে নয়। বরং হঠাত চলে যাওয়া জীবনগুলোর অসমাপ্ত আনন্দ ভাগাভাগি করে আমাদের নিজেদের জীবনের সাথে মিলিয়ে দিয়েছি। এতে তো বেড়ে গেছে আমাদের জীবনের আনন্দের ভার।

এই বছর বিশ্বকাপ ক্রিকেট ফেব্রুয়ারীকে আরো উজ্জ্বল করে দিয়েছে। ইউটিউবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখলাম। আবারো অনুধাবন করলাম আমাদের দেশের মানুষের সৃষ্টিশীল ক্ষমতা সম্পর্কে। খেলায় বাংলাদেশ হারলে মন খারাপ হওয়ার কথা। অথচ অনুভব করলাম ভারতের সাথে হেরে যাওয়ার পরও তেমন খারাপ লাগছিল না। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা এখন চাপ সামলাতে জানে। খেলোয়াররা মানসিকভাবে বেশ পরিপক্ক হচ্ছে। ঢাকা শহরে এতো জনসংখ্যা। তারপরও এখন পর্যন্ত সব কিছু ঠিকঠাক হচ্ছে। তারমানে সবাই সবার দায়িত্বটা ঠিক মতো পালন করছে। এখন পর্যন্ত সবই শুভ লক্ষ্মণ।

লেখা শুরু করেছিলাম বই নিয়ে। আবার বইয়ের প্রসঙ্গেই ফিরে আসি।


এই প্রবাসে বসে বেশ কিছুদিন ধরে তারাশংকর পড়তে ইচ্ছে করছিল। হাতের কাছে তা না পাওয়াতে ও হেনরির ছোট গল্প পড়েছি। বই নিয়ে লিখতে শুরু করলে তাই আমার বর্তমান বাস্তবতায় ইংরেজি সাহিত্য দিয়ে শুরু করতে হবে। ও হেনরি পড়ার আরেকটা কারণ হচ্ছে আমার বুক ক্লাবে এবারে এই বইটাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশে ইংরেজী সাহিত্যের ব্যাপারে নভিস একজনও ও হেনরিকে চিনবে তার বিখ্যাত ‘দ্য গিফট অব ম্যাজাই’ গল্পটির কারণে। জিম আর ডেলার ত্যাগের পরীক্ষায় ভালবাসা জয় করবার সেই বিখ্যাত প্রেমকাহিনী। উচ্চমাধ্যমিকের সেই সময়টাতে এই গল্প আমাদের দুলিয়েছিল এক স্বপ্নিল ভালবাসার চিত্রায়নে। এই গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য শেষের চমকটুকু।
ও হেনরির গল্পের ধরনটাই এরকম। গল্পের শেষ পর্যন্ত পাঠক ধরে রেখে একটুখানি চমকে দেয়। পাঠক মানসে ছড়িয়ে পরে সিগ্ধ ভাললাগা। লেখাটাকে ও হেনরি মনে হয় খুব উপভোগ করতেন। তাই গল্পে গল্পে পাঠকের চোখের সামনের উঠোনের ঘাসটা আরো সবুজ হয়ে উঠতো, আকাশ আরো নীল, বাতাস আরো সতেজ। এই লেখককে তার সময়ে কম সমালোচনা শুনতে হয়নি। তারপরও পাঠকের মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়াটাই যেন ছিলো তার প্রধান উদ্দেশ্য। মনে হয় ও হেনরি জীবন সম্পর্কে ভাবতেন ‘গ্লাসের অর্ধেকটা ভরে আছে’ ধরণের। অথচ তার নিজের জীবনে এসেছিলো অনেক তরঙ্গোচ্ছ্বাস। মজার ব্যাপার হচ্ছে ও হেনরির অনেকগুলো ছোটগল্প লেখা হয়েছিল জেলে বসে। বেচারা ইনসুরেন্স বিষয়ক জটিলতায় আটকে গিয়েছিল।

ও হেনরির সমসাময়িক বারর্নাড শ আর চেখভের লেখাও খুব নেশা ধরানো। পাঠক শুধু লেখা পড়তে শুরু করে আর লেখক তাকে টেনে নিয়ে যায় একদম শেষ লাইনটা পর্যন্ত। আজ থেকে একশ বছর আগের এইসব ক্ল্যাসিক লেখকদের লেখা নিজ গুনেই পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। এখনও সমান মাত্রায় আকর্ষনীয়। পাঠককে কোন সমালোচকের ট্যাবলেট গিলে বলতে হচ্ছে না – উনারা কালজয়ী লেখক।

এবার বাংলা ভাষার দিকে তাকাই। উপরে উল্লেখিত লেখকদের সমসাময়িক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বিশ্বকবি সম্পর্কে নতুন করে বলবার কিছু নেই। কিছুদিন আগে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণমূলক একটা লেখা পড়ছিলাম। অবাক হয়ে ভাবছিলাম আসলেই কি এই লেখা একশ বছর আগে রচিত হয়েছিল? কোন অকারণ অলংকরণের আতি-শয্য নেই। নেই বাক্যকে দুর্বোধ্য করে তুলবার বুদ্ধিজৈবিক প্রচেষ্টা। নদীর মতো ছান্দিক গতিময়। লেখা পড়ে বুঝতে গেলে পাঠককে অহেতুক হীনমন্যতায় ভূগতে হয় না। তারপর মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ পড়লাম। শুরু করতে বেগ পেতে হয়নি আবার শেষ না করে উঠতেও পারছিলাম না। তারাশংকর, শরতচন্দ্র, মুজতবা আলি – এরকম আরো কতো নাম উল্লেখ করা যায়।

এই যে পাঠক ধরে রাখার ক্ষমতা – এটা কি ক্ল্যাসিক লেখকদের সহজাত বৈশিষ্ট্য নাকি সচেতনভাবে তারা তা করতেন? তাদের সময় তো বইকে পাঠকের কাছে পৌছতে ফেসবুক, ইউটিউব, ভিডিও গেইম, উইই, টেলিভিশন, সিনেমার সাথে কোন প্রতিযোগিতা করতে হয়নি। বরং এ যুগেও তারা দিব্যি টিকে আছেন। টেকনোলজির সাথে পাল্লা দিয়ে চলবার মতো এখন আর কয়জন ফিকশন লেখকদের নাম উল্লেখ করা যায়?
গল্প শুনবার মানুষ প্রতিযুগেই ছিলো। মানুষের অবসর বেড়ে যাওয়াতে এ যুগে বরং আরো তা বেড়েছে। অথচ পাল্লা দিয়ে কমেছে পাঠক প্রিয় লেখকদের সংখ্যা।


এ যুগে মনে হয় লেখকরা সমালোচক পোষে। লেখা গিলতে না পারলে হয়ে যায় পাঠকের দোষ। আর আমরা পাঠকেরা অকারণ হীনমন্যতায় ভূগি। যেন সবাইকেই আইনেস্টাইনের রিলেটিভিটি বোঝার জন্য জন্মগ্রহন করতে হবে।
ও হেনরি প্রসংগ তুলেছিলাম এ কারণেই যে আমি ঠিক নিশ্চিত হতে পারছিলাম না আমার নিজের পাঠক-মাত্রা নিয়ে। ফিকশন আমার বেশ পছন্দ। তবে তাকে উপস্থাপন করতে হবে ভার্চুয়্যাল রিয়েলিটির মিশেলে। লেখক পাঠককে ভুলিয়ে দেবে যে এটা ফিকশন। আর ফিকশনের সাথে দর্শন বা ফিলসফি মিলে গেলে তো চমতকার জোরবন্ধন। ঠিক যেমন ‘দ্য আলকেমিস্ট’। আর বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে মড়মড়, কড়কড় করে লেখা ফিকশন পড়তে গিয়ে যদি মনে হয় এটা সম্পূর্ণ বানিয়ে বানিয়ে লেখা তখন আর সে লেখায় পড়তে উতসাহ পাইনা। এমনিতে নিজে কিছুটা সর্বভূক ধরনের পাঠক। এই মুহূর্তে মনস্তঃত্বের উপর বই পড়ছি। আবার চটকদার কোন গসিপ দেখলেও চোখ বুলিয়ে নিই। তালে তালে চলতে পারিনা বলে গুরু কাউকে ভালোর সনদ বিলি করলেও নিজে আবার তা পরখ করে দেখি। ঠিক বুঝতে পারি না পাঠক হিসেবে আমার অবস্থানটা কোথায়?
একটা জিনিষ বিশ্বাস করি। পাঠক হিসেবে আমার দায়িত্ব বইটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করার। আর লেখকের দায়িত্ব পাঠককে বইয়ের শেষ পৃষ্টা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার। তারপর বইটা যখন বন্ধ করবো একটা ভাল বই পড়ার অনুভূতি নিয়ে কিছুদিন ফুরফুর করে ঘুরে বেড়াবো। বন্ধু-বান্ধবকে সে বই পড়তে বলবো। বইটা উপহারের তালিকায় রাখবো। লেখকের পরের বইয়ের অপেক্ষায় থাকবো। এটা কী খুব সস্তা দরের পাঠকের নমুনা?

আমাদের এবারের বুক ক্লাবের মিটিঙ্গে একজন সদস্য গ্লোরিয়া যখন বললো, ‘এখন আর কেউ ও হেনরি ধরনের লেখা লেখে না। অথচ এখনকার বাস্তবতায় লেখা এরকম বই পড়তে ইচ্ছে করে।’, আমি অবাক হয়ে গ্লোরিয়ার দিকে তাকিয়েছিলাম। অবাক হয়ে ভাবছিলাম গ্লোরিয়া আমার মনের কথাটা জানলো কী করে? আর বাদবাকী সদস্যরাও যখন গ্লোরিয়ার কথায় সায় দিলো তখন আমার পাঠক-সত্ত্বার হীনমন্যতা এক ফুতকারে উড়ে গেলো।
আমাদের এই বুক ক্লাব বৃহত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার কসমোপলিটান সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে। এখানে আছে চাইনিজ অরিজিন, উত্তর ভারতীয়, দক্ষিন ভারতীয়, বাংলাদেশী, আমেরিকান, পর্তুগাল অরিজিন মানুষের সমাবেশ। আবার পেশার দিক দিয়ে কেউ ভূতপূর্ব হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কেউ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কেউ সাইকোলজিস্ট, মাসিক পেপারের সম্পাদক (যার সার্কুলেশন পঁচিশ হাজার), কেউবা পূনর্কালীন সংসারজীবি। পেশাগত, জাতিগত যতো ভিন্নতাই থাকুক না কেন, আমাদের মধ্যে একটা মিল হচ্ছে আমরা সবাই বইপ্রেমী এবং ফিকশন পড়তে ভালবাসি। আর হ্যা, এখানকার সদস্যরা সবাই তাদের দেহের কোষে কোষে দুটো করে এক্স ক্রোমোজম বহন করছে। বয়সের সীমানা মধ্য ত্রিশ থেকে মধ্য ষাট পর্যন্ত।


আমাদের দেশে সংস্কৃতির শিল্পসাহিত্যের প্রধান ভোক্তা হলো তরুন সমাজ আর মহিলারা। না এ সম্পর্কে আমার হাতে কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে কিছু তথ্য-উপাত্ত থেকে এ ধারণায় এসেছি। যেমন দলে দলে মহিলারা সিনেমা হলে না গেলে নাকি বাংলাদেশে কোন ছবির গায়ে হিট তকমা জোটে না। মূলত মহিলাশ্রেনীটিই বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেলগুলো টিকিয়ে রেখেছে। গৃহকর্তা অফিস ফেলে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে বসলে পরের মাসেই ডিস সরবরাহক বকেয়ার অভিযোগে লাইন কেটে দিবে। আবার অন্যদিকে বই মেলায় তারুন্যের বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাস। তাদের হাতে হাতে বই। বিক্রিবাটা ভালো হওয়াতে প্রকাশকদের মুখ হাসি হাসি।

আমি নিজে যেহেতু মহিলা শ্রেনীভূক্ত, তাই বরং মহিলাদের বয়ান গাই।

ফিকশন সাহিত্যের প্রধান পাঠক কিন্তু মহিলারা। আজকের চব্বিশ বছরের যে যুবক প্রেমিকার হাত ধরে সিনেমা হল কিম্বা বইমেলা প্রাংগনে ঘুরে বেড়াচ্ছে – দশ কিম্বা পনের বছর পর কিন্তু অবস্থা অনেকটাই বদলে যাবে। সেই যুবকটি তখন ভদ্রলোক হয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে তার অফিসের কাজে। অর্থোপার্জনের বাস্তবতার চাপে খটমটে সংবাদপত্র আর টেলিভিশনের খবর তখন তার কাছে বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। শিল্পসাহিত্য টিকে থাকে ভদ্রমহিলা বনে যাওয়া তার একদার প্রেমিকার কাছে। ভদ্রমহিলা তার ছোট্ট গৃহকোনে প্রতিদিনকার ঘরদোর, বাচ্চা সামলে কিছুটা ক্লান্ত। বিয়ের সময়টাতে মনের ভেতর যতটুকু জানালা খোলা হয়েছিলো, বাদবাকী জীবনটা জানালা ততটুকুতেই আটকে থাকে। ভদ্রলোকটির বাইরের জীবন আছে। কাজের সূত্রে প্রতিদিন কত লোকের সাথে দেখে সাক্ষতহচ্ছে। প্রতিদিনই একটু একটু করে তার পৃথিবী বড় হচ্ছে। কিন্তু ভদ্রমহিলার জীবন সংসারের চক্রে ঘুরতে থাকে একই কক্ষপথে। সেই অর্থে তার পৃথিবী তেমন আর বড় হয় না। অথচ সেও তো চায় মনের জানালা আরেকটু বড় হোক। জানালা খুলে একটু খোলা বাতাস পাবার জন্য তাই সে খুলে দেয় টেলিভিশন। কখনওবা বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন। সাংসারিক কাজে মানসিক চাপ, শারীরিক পরিশ্রম দুটোই বেশ। সেই চাপে পড়ে ভদ্রমহিলা আঁতেল হবার সুযোগ পাবে কিভাবে? তার উপর এই কাজে কেউ তাকে তাতক্ষনিক রিকগনেশন দিচ্ছে না।
চিরতার রস জানি স্বাস্থ্যকর। তারপরও পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত একজন তৃষনার্ত বুভুক্ষের মতো চিরতার রস ফেলে হাতের কাছে থাকা লেবুর শরবতই হাতে তুলে নেবে।

আকতারুজ্জামান ইলিয়াস বা হুমায়ুন আজাদের মতো লেখা খুব কম লোকের পক্ষেই লেখা সম্ভব। এই ধরনের সাহিত্য লেখা কষ্টকর বলে তাদের লেখাও কম। আবার সেই সাথে এটাও ঠিক যে খুব কম লোকই এই সাহিত্যের স্বাদ গ্রহন করতে পারে। অবসন্ন মনে তাতক্ষনিক কিছু গ্লুকোজ পাবার আশায় আমাদের ভদ্রমহিলারা হয়তো হাতে হুমায়ুন আহমেদ তুলে নেবেন নয়তো হিন্দি চ্যানেল খুলে বসবেন। ইতিমধ্যে জীবন থেকে যদি কেউ অবসর নিয়ে থাকেন তবে তিনি ঝুকবেন ধর্মীয় বইয়ের দিকে।


এদেশে বুদ্ধিজীবিরা রাজনীতিবিদদের নষ্ট করে জনগন থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দেয়। ঠিক তেমনি সাহিত্য সমালোচকরা লেখকদের মাথা খারাপ করে তাদেরকে পাঠক সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। দেশের জনগনের মতোই আমাদের দেশে ভদ্রমহিলাদেরও কোন কন্ঠস্বর নেই। ফেসবুক কিম্বা ব্লগের কল্যানে তরুন সমাজ তাদের কন্ঠস্বর খুঁজে পেলেও শিল্প-সাহিত্যের প্রধান ভোক্তা বিশ থেকে ষাট বছর বয়সী মহিলারা এখনও বাকহীন। এমনিতেই আমরা মহিলারা একটু হীনমন্যতায় ভোগি, তারপর আমাদের পছন্দের বিষয়গুলো নিয়ে সমালোচকদের তীর্যক সমালোচনা আমাদের বাক আরো রুদ্ধ করে দেয়। এ যেন আরেক ফতোয়া।

কোথায় সমালোচকরা লেখকদের তুলোধুনো করবেন বর্তমানে কেন তারা নারীমহলে শরতচন্দ্রের মতো গ্রহন গ্রহনযোগ্যতা পাচ্ছেন না – তা না করে কেউ যদি গ্রহনযোগ্যতা পায় তো তাকে শেষ করে না দেওয়া পর্যন্ত উনাদের চোখে ঘুম নেই। সমালোচনাটা ঠিক খাতে প্রবাহিত হলে ষাটোর্ধ হুমায়ুন আহমেদের কাছ থেকে আমরা অনেক ফিলসফিক্যাল উপন্যাস পেতে পারতাম। সবার তো আর রবীন্দ্রনাথের মতো সম্পন্ন পরিবারে জন্মাবার ভাগ্য হয়না যে মোহিতলাল মজুমদারের তীব্র সমালোচনা শান্তচিত্তে গ্রহন করে দিন দিন নিজেকে আরো পরিণত করতে পারবে। একপেশে, অগঠনমূলক সমালোচনা উপেক্ষা করাই ছিলো হুমায়ুন আহমেদের সারভাইভ্যাল স্ট্রাটেজি। আর নতুন লেখকরা ভড়কে গিয়ে সমালোচকদের বাহবা কুড়াতে গিয়ে কড়কড়, গড়গড় ভাষায় লিখতে শুরু করে দেয়। বিশাল মহিলা পাঠককূলের কথা কেউ মনে রাখেনা। ভাবেনা একবারও তাদের পাঠ্যশ্রেনীতে খুব জ্ঞানী শিক্ষকের থেকে ভালো পড়াতে পারে এমন শিক্ষকের খুব প্রয়োজন।
কতোটা মনের দুঃখে বাংলাদেশের মহিলাকূল যে হিন্দি সিরিয়াল বেছে নিচ্ছে, তা যদি সমালোচক মোল্লারা বুঝতেন! আর ঐদিকে প্রতিযোগিশূন্য মাঠে হুমায়ুন আহমেদ আর খেলে মজা পায় না। খেয়ালখুশি মতো যত্রতত্র এদিক ওদিক বলে কিক করেন। আমরা বঞ্চিত হই ম্যারাডোনা বা রোনালডোল মতো কোন দুর্দান্ত শট থেকে।

(পরের পর্বে সমাপ্ত)

২,১৭৩ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “আমাদের শিল্পসাহিত্যের গতিপ্রকৃতি (প্রথম পর্ব)”

  1. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    খুবই ভালো লেগেছে লেখাটা। সহজ ভাষায় পাঠকের বয়ান। আমি নিজে পাঠক হিসাবে মোটামুটি ইতর শ্রেনীতেই পরি। তারপরেও কিছু কথা শেয়ার করার চেষ্টা করলাম।
    কলেজ জীবনে ভালো লাগা ছড়িয়ে দেয়া "জিম ডেলার" গল্প টা ছাড়া ও'হেনরির ছোট গল্প পড়া হয়ে উঠেনি। ভার্সিটিতে থাকার সময় চেকভের কিছু লেখা পড়া হয়েছিলো। চেখভের লেখার সবচেয়ে ভালো লাগা দিকটা হচ্ছে লেখার মাঝে পরিমিত রসবোধ অথচ ভাঁড়ামো নেই। আর গল্প পড়তে পড়তে সেই সময়ে ঢুকে যাওয়া যায়। এই জায়গাতে মুজতবা আলীর নামও করতে হয়। লেখা পড়ে যতবার প্রেমে পড়েছি তার মধ্য শবনমের নাম নিতেই হবে। রবিবাবুর লেখা আসলে যতটুকু পড়া দরকার ছিলো তা পড়া হয়নি। খুব সম্ভবত জীবন শেষ হয়ে গেলেও এই আফসোস থাকবে। এক সময় গল্প গুচ্ছ পড়তে পড়তে এই গল্প গুলার আধুনিকায়ন করে "রিরাইট" করার ভাবনা এসেছিলো। সময়ের অভাবে হয়ে উঠেনি। আমার নিজের সবচেয়ে প্রিয় ঔপন্যাসিক মানিক। তার লেখা আমার ভালো লাগে কারণ গল্পগুলো পড়ে কল্পকথা মনে হয় না বরং আমার চারপাশে ঘটে যাওয়া সাধারণ মানুষের বয়ান দেখতে পাই। ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের মনস্তস্তে অবলীলায় ঢুকে যাবার অসাধারণ ক্ষমতা আছে মানিকের। "পুতুল নাচের ইতিকথা" উপন্যাসটির সাথে আমার ব্যাক্তিগত কিছু আবেগ জমা আছে। প্রায় এক বসায় শেষ করা এই বইটি নিয়ে কাঁটাছেড়া আড্ডা করেছিলাম আমার মায়ের সাথে। উপন্যাস পড়ার পর যখন কাঁটাছেড়া করতে যাই আমার মায়ের কথা শুনে টের পাই উপন্যাসের মূল রস আমি আস্বাদন করতে ব্যর্থ। তাই আবার পড়ি। অদ্ভুত ভালো লাগা এই উপন্যাসটির জন্য। এর নাম শুনলেই সেই তিনদিন আমার চোখের সামনে চলে আসে।

    এই মুহূর্তে মনস্তঃত্বের উপর বই পড়ছি।

    এই বিষয়ে আমার কিঞ্চিত আগ্রহ ছিলো। কিভাবে পড়তে পারি , কোন বই পড়তে পারি জানার অপেক্ষায় রইলাম।

    আকতারুজ্জামান ইলিয়াস বা হুমায়ুন আজাদের মতো লেখা খুব কম লোকের পক্ষেই লেখা সম্ভব। এই ধরনের সাহিত্য লেখা কষ্টকর বলে তাদের লেখাও কম। আবার সেই সাথে এটাও ঠিক যে খুব কম লোকই এই সাহিত্যের স্বাদ গ্রহন করতে পারে। অবসন্ন মনে তাতক্ষনিক কিছু গ্লুকোজ পাবার আশায় আমাদের ভদ্রমহিলারা হয়তো হাতে হুমায়ুন আহমেদ তুলে নেবেন নয়তো হিন্দি চ্যানেল খুলে বসবেন।

    প্রথম কথার সাথে একমত হলেও পরের কথায় একমত হতে পারলাম না। হুমায়ুনের লেখা তাৎক্ষণিক গ্লুকোজ হয়ে গেছে আমাদের রুচির অবক্ষয়ে। হুমায়ুন নিজেও তার তুমুল ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির জন্য সমালোচনার রেহাই পাবেন না। তবে তার তাৎক্ষণিক গ্লুকোজ এখন কতটা পাওয়া যায় এটা ভাববার বিষয়। কোন লেখা পড়ে বই বন্ধ করার সাথে সাথে যদি সে বইয়ের রেশ মনে না ছড়ায় তবে তা গ্লুকোজ না হাওয়াই মিঠাইয়ের মত ফাঁকিবাজিই মনে হয়। হিন্দি সিরিয়ালের ব্যাপারটায় পড়ে আলোকপাত করছি।

    সমালোচকদের বাহবা কুড়াতে গিয়ে কড়কড়, গড়গড় ভাষায় লিখতে শুরু করে দেয়। বিশাল মহিলা পাঠককূলের কথা কেউ মনে রাখেনা। ভাবেনা একবারও তাদের পাঠ্যশ্রেনীতে খুব জ্ঞানী শিক্ষকের থেকে ভালো পড়াতে পারে এমন শিক্ষকের খুব প্রয়োজন।

    পুরাপুরি একমত। লেখালেখি হওয়া উচিত নিজের মনের আনণ্দের জন্য। সমালোচকদের বাহবা কুড়াতে গিয়ে যে লেখা হয় তাকে আমি সাহিত্য বলতে নারাজ। কারণ সাহিত্য হচ্ছে মানুষের মনের ভাবের স্বতঃস্ফুর্ত বহিঃপ্রকাশ। তবে সমালোচকদের কথা ভেবেও যেমন লেখা উচিত নয় তেমনি নির্দিষ্ট পাঠককুলের কথা ভেবে লেখালেখিটাও অনুচিত। লেখকের স্বাধীনতা থাকুক। পাঠকের স্বাধীনতাও। পাঠক পছন্দমতো তার ডোমেইনের লেখক খুঁজে নিক।

    কতোটা মনের দুঃখে বাংলাদেশের মহিলাকূল যে হিন্দি সিরিয়াল বেছে নিচ্ছে, তা যদি সমালোচক মোল্লারা বুঝতেন!

    আমি সমালোচক মোল্লা না হলেও আমি এবিষয়টা বুঝতে চাই। আমার নিজের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা (যা কিনা আসল মাসের তুলনায় নগন্য) থেকে আমি অবশ্য এতটা গূঢ় কারণ উপলব্ধি করিনি। আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে সেটা হলো আমরা বাঙালিরা হলো আলসে এবং হুজুগে দুটাই। আর আলস্যের ফলেই বই পড়ার চাইতে টিভি দেখা আমাদের কাছে বেশি আরামের। কারণ বই পড়ে কল্পনার চোখে দেখতে হয়। টিভিতে সেই ঝামেলা নেই বরং টিভি ক্যামেরা দর্শকের মানস চোখের কাজটি করে দেয়। আর বই পড়া খুব ধীর প্রক্রিয়া। সময়ের অভাবে ভোগা আমাদের কাছে টিভি দেখার সময় থাকলেও তাই বই পড়ার সময় নেই। পথের পাচালী পড়ে দুইদিন নষ্ট করার চেয়ে দুঘন্টায় সিনেমা দেখে সময় বাঁচানোকে আমাদের কাছে খুবই আরামপ্রদ মনে হয়।
    হিন্দি সিরিয়াল কিন্তু শুধু গৃহিনীদের মাঝে না কর্মজীবি মহিলাদের মাঝেও জনপ্রিয়। কলিগদের আড্ডায় অমুকের ডিভোর্স তমুকের বিয়ে সমুকের ঝগড়া, সেটা না হোক নিদেন পক্ষে অমুকের সুন্দর শাড়ির প্রশংসা না করতে পারলে আধুনিক হওয়া যায় না। তাই কলিগে কলিগে বন্ধু বন্ধুতে ছড়িয়ে যায় হিন্দি সিরিয়ালের ভূত।
    বাংলাদেশের আমার আশেপাশের মেয়ে মহিলাদের বই পড়ার কথা বললে তারা কাজ পড়ালেখা ব্লা ব্লা বলে হাইকোর্ট দেখিয়ে দিত। মজার ব্যাপার হলো লোডশেডিং এর বিভ্রাট ব্যতীত তারা কখনো সময় করে সিরিয়াল দেখার টাইম কাজ বা পড়ার জন্য খুব বেশি সময় দিয়েছে বলে জানি না।
    আমাদের দৈন্দিন জীবনে খবর পাঠ নিত্তনৈমিত্তিক কাজের অংশ হলেও সাহিত্য পাঠ নিত্ত নৈমিত্তিক হয়ে উঠেনি। এবং ইলেক্ট্রনিক সাহিত্য সে সুযোগ আর করে দেবেও না কখনো। আগেই বলেছি আমার বোঝার ভুল হতে পারে। আপনার মতের প্রত্যাশায় থাকলাম।

    পরিশেষে চমৎকার একটা পোস্টের জন্য ধন্যবাদ আপু। পরের পার্টের অপেক্ষায় থাকলাম।

    জবাব দিন
  2. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    একসময় ধুপীপাঠ থেকে চন্ডিপাঠ সবই খুব মনোযোগের সংগে করতাম, এখন কোনটাই হয়ে উঠে না।

    আপনার লেখাটা একপেশে, শুধু মেয়েদের নিয়েই লেখা। 😀 একজন পুরুষের যে পরিবারের সংগে সময় কাটানোর আকুলতা থাকে, তা ফুটে উঠেনি। আমার মনে হচ্ছে আপনি হালকা হলেও ফেমিনিস্ট 😀 ।

    আপনার লেখাতে বড় কমেন্ট করতে পারিনা এর বড় কারন আপনার উপসংহার গুলো চমৎকার হয়, অনেকটা একমত হওয়ার মতই আরকি, যেটুকু বাকী থাকে তা বলতে চাইলে অনেক কিছু লিখতে হয়, এত বেশী লিখতে ইচ্ছে করে না। তবে কোন একটা সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম আহমেদ ছফা হুমায়ুন-মিলনকে চুতিয়া বলে গালি দিয়েছিলেন, ১০০ টার উপরে উপন্যাস লিখেছে, কিন্তু সবই "আজকে পড়লে কালকে উপন্যাসের নামটাই মনে থাকে না" টাইপ। এই দিক থেকে ইলিয়াস-মুজতবা অনেক বেশী মাত্রায় গ্রহনযোগ্য তো বটেই।

    আপনার মনে হচ্ছে "ৎ" লিখতে সমস্যা হচ্ছে। অভ্র ফোনোটিকে এভাবে (t ``) লিখতে পারেন।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  3. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    আপু কেমন আছেন?

    লেখাটার মূলভাব ভালো লেগেছে। কিছু কিছু বিষয় আরো জেনে তারপর অন-টপিকে মন্তব্য করবো, মানে পরের পর্বে আর কি......।

    অফটপিকঃ ফেমিনিষ্ট মানে ফয়েজ ভাই যা' বোঝাতে চাইলেন আর আপনি যা' বুঝলেন আমি তা' বুঝতে পারলাম না। হালকা খোলাসা করবেন কি.........?


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      পশ্চিম বিশ্বে সত্তর দশকে যেই ফেমিনিজমের ঢেউ উঠেছিলো কিম্বা পরবর্তীতে বাংলাদেশে নব্বই দশকে যেই ফেমিনিজমের ধাক্কা লেগেছিলো আমি তাই বুঝেছি। ফয়েজ নিশ্চিত করতে পারবে আমার বোঝাটা ঠিক কিনা।
      বাংলাদেশের নব্বই দশকের ফেমিনিজমে ্মেয়েদের অগ্রগতির বাঁধা হিসেবে ধর্ম আর পুরুষদের দোষী করা হচ্ছিল। আমি বিশ্বাস করি এখনকার দিনে পুরুষরা আর মেয়েদের সেভাবে পিছনে টেনে ধরে রাখে না। বল এখন অনেকটাই মহিলাদের কোর্টে। তবে দুই জেন্ডারের মধ্যেকার কানেকশনটা আরো অনেক পরিস্কার হওয়া দরকার। আর ধর্মটাকেও কিছুটা জুজুবুড়ি হিসেবে দেখানো হয়। একটা মেয়ে শিক্ষা এবং পড়ার সুযোগ পেলে সে আস্তে আস্তে নিজেই বুঝতে পারবে ধর্মের কোনটা অন্ধবিশ্বাস আর কোনটা জীবনকে ডিসিপ্লিন করে। এসব আমি পরের লেখায় আনছি।

      দুঃখজনক যে আমার দ্বিতীয় পর্ব উধাও হয়ে গেছে কম্পিউটারের কারনে। আবার ্লিখতে হচ্ছে।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
  4. নঈম (৮৭-৯৩)

    :boss: :hatsoff:
    আপা! সেই যুগ আর কোথায়!
    এই যুগে আমরা মনে হয় না রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, ও হেনরি, এরকম লেখকের দেখা পাব। সাহিত্য মাধ্যম এখন পরিবতর্ন হচ্ছে। সম্ভবতঃ ব্লগই হবে আগামী দিনের সাহিত্য মাধ্যম। এই দেখুন, আগের যুগ হলে, আপনি হয়তো পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লিখতেন। কোন এক সময় এটা হয়তো আরো কিছু লেখার সাথে একটি সংকলন প্রকাশিত হতো। আর আজ আপনি এটি ব্লগে লিখছেন।
    :thumbup: আপনার পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      সেই যুগে পেলে এই যুগে পাব না কেন ব্রাদার?
      ব্লগ হচ্ছে সাহিত্যের ক্ষেত্রে মঞ্ছ নাটকের মতো। কিন্তু জান তো লোকে সিনেমা দেখতে বেশি পছন্দ করে। আর ধরো এই মুহূর্তে কোন এক্টা বিষয়ে আমার কিছু পড়তে ইচ্ছে করছে। তখন ব্লগ তো আর আমার মনের কথা শুনবে না।
      পত্রিকায় চান্স পাওয়া এতো সহজ যে আমি পত্রিকায় লিখবো?


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।