অতঃপর একটা চিঠি

(সিসিবিতে খুব লেখা দিতে ইচ্ছে করছিলো। অনেকদিন ধরে নতুন লেখা হয়ে উঠেনি। পুরাতন একটা গল্প দিচ্ছি। সিসিবির সাথে পরিচয় হওয়ার আগে অন্য একটা ব্লগে লেখাটা দিয়েছিলাম।)

এখন প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গার পর একটা কথাই মাথায় আসে – আজকেই কি সেই চিঠিটা আসবে। একটা একফুট বাই দেড়ফুটের বাদামী রংয়ের খামে প্রাপকের জায়গায় থাকবে আমার আর প্রেরকের জায়গায় হাসানের নাম। ভেতরে থাকবে সব কেজো কথার হিসেব নিকেষ যা আমার কাছে জল্লাদের ফাঁসির দড়ির শেষ টান কিম্বা আসামীর কাঠগড়ায় দাড়িয়ে বিচারকের মুখে নিজের মৃত্যুদন্ড শোনবার মতো। সেই চিঠিটার জন্য কি ভয়ংকর প্রতীক্ষা, একটু কলিং বেলের শব্দ শুনলেই চমকে চমকে উঠি।

অথচ দশ বছর আগে সেই একই হাসানের চিঠির জন্য কি ব্যাকুলতাই না ছিল! চিঠি হাতে আসলে পড়তে সময় নিতাম। কারণ একবার পড়া হয়ে গেলেই জীবন স্থবির হয়ে যেত আরেকটা চিঠি হাতে পাবার আগ পর্যন্ত। উহহ, প্রতীক্ষার কত ভিন্নরূপ, কী বৈপরিত্য!
কোন এক সাপ্তাহিকের প্রবাসজীবন কলামে হাসানের লেখা পড়ে আমিও ওকে প্রথম চিঠি লিখেছিলাম। উত্তর আসতে একটুও দেরী হলো না। সেই থেকে শুরু। হাসান নর্থ ডেকোটা ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিজ্ঞানে পি এইচ ডি করছিলো। রবীন্দ্র সংগীত শোনা, ভাত মাছ খাওয়া হাসানের জন্য সে ছিলো রীতিমতো নির্বাসন। আমাদের চিঠি বিনিময় হাসানকে দিল মুক্তির স্বাদ আর আমাকে দেখালো স্বপ্ন। আশ্চর্যজনকভাবে আমরা নিজেদের মধ্যে সব কিছুতেই বড্ড বেশী মিল খুঁজে পেলাম। ততোদিনে ইন্টারনেট আর ফোনালাপ সহজলভ্য হয়ে গেলেও দুজনের কাছেই চিঠির আবেদন ছিল অবিসংবাদিত। ভাবতাম ডাক্তারের প্রেসক্রিপসনে কি কেউ কখনো প্রেমপত্র লেখে নাকি ধোপার ফর্দে ভালবাসার কবিতা? তবে কেন ওসব কেজো যন্ত্রপাতি দিয়ে আমরা আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করবো? চিঠির সবচেয়ে আবেদনের বিষয়টি হলো এর প্রতীক্ষা পর্বটি। ব্যাডমিন্টনের কর্কের মতো মূহুর্তের মধ্যেই এ কোর্ট সে কোর্ট করতে পারে না। এই একটা জায়গায় দুজনেই পুরোনো হয়ে রইলাম। নাকি আসলেই আমরা দুজনে পুরোদস্তুর পুরাতন ধ্যান ধারণার মানুষ ছিলাম, না বুঝে আধুনিকতার পেছনে ছুটছিলাম -শেষে তাল সামলাতে না পেরে কক্ষ বিচ্যুত হয়ে এক সময় একজন আরেকজনের থেকে ছিটকে পরলাম?
আমাদের পত্রমিতালীর দু বছর যেতে না যেতেই হাসানের বৌ হয়ে নর্থ ডেকোটায় ওর স্টুডেন্ট এ্যপার্টমেন্টে এসে উঠলাম। শুরু হলো এক সাথে পথ চলা – ঠিক যেন আমাদের চিঠির মতোই আরেক শুভ সূচনা। আমি হাত পুড়িয়ে যাই রাঁধতাম তাই ওর কাছে অমৃত। সে সময়টা পয়সার খুব টানাটানি ছিল। কিন্তু কোন কিছুই আমাদের সুখের পথে অন্তরায় হয়ে দাড়াতে পারেনি। হাতে একটু সময় পেলেই চলে যেতাম দূর কোন পাহাড় অথবা কোন গহীন অরন্যে। আমরা দুজনেই ছিলাম জাত রোমান্টিক। কোনরকম পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই যে দিকে দুচোখ যায় সেদিকে বেড়িয়ে পরতাম। কতবার যে পথ হারিয়ে সারারাত গাড়ির মধ্যে কাটিয়ে ভোরের সূর্যোদয় দেখে বাসায় ফিরেছি তার কোন ইয়াত্তা নেই। একবার তো সন্দেহভাজন মনে হওয়ায় টহলদার পুলিশ আমাদেরকে প্রায় জেলে ধরে নিয়ে যায়। হাসানের এ্যডভাইজারের সাথে সেই মহামান্য পুলিশ কথা বলার পর সে যাত্রায় আমাদের ছেড়ে দিয়েছিলো। দিনটা ছিল এগারই সেÌেটম্বর, ২০০১। বাসায় ফিরে টেলিভিশন চালিয়ে দেখি টুইন টাওয়ার জ্বলছে। দুজন দুজনের হাত চেপে ধরে, চোখে চোখ রেখে বলেছিলাম,’বড় বাঁচা বেঁচে গেছি’। হাসান এদেশে মোহাম্মদ ইসলাম নামে পরিচিত।
এভাবে তিন বছর পার করার পর হাসানের পিএইচডি আর আমার মাস্টার্স শেষ হবার পর দুজনেই চাকরী নিয়ে স্বর্গের মতো সুন্দর জায়গা কালিফোর্নিয়াতে নতুন বসতি গড়লাম। তখন ভেবেছিলাম কষ্টের দিন শেষ। এবার অনন্ত সুখের দিন শুরু হলো। তখন নিশ্চয় স্রষ্ঠা আমাদের দিকে চেয়ে মুচকি হেসেছিলেন। যেই আমরা ইমেইলের যুগেও চিঠি বেছে নিয়েছিলাম, সেই আমরাই আমেরিকান স্বপ্নে বিভোর হয়ে অনবরত ছুটে চললাম বড় বাড়ি, দামী গাড়ি কিম্বা লোক দেখানো বিত্ত বৈভবের পেছনে। নিজেদের জন্যই কোন সময় নেই, আরেকজনকে দেব কি? তখন থেকেই কি আস্তে আস্তে আমাদের স্পর্শগুলোও অনুভূতিহীন হয়ে যাচ্ছিল? দূরত্বটা কি তখন থেকেই জট পাকাচ্ছিল নাকি টুকুন যখন জন্ম নিল সে সময়টা থেকে?
প্রথম যখন নিজের ভেতর টুকুনের অস্তিত্ব বুঝতে পেরে হাসানকে জানালাম, তার অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো আমি যেন একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছি। তখন থেকেই কি হাসানকে একটু একটু ঘৃনা করতে আরম্ভ করলাম? এই ভীনদেশে চারপাশের হাজারো অচেনা মানুষগুলোর মাঝে তখন যেন খুব বেশি করে হাসানের ভালবাসার জন্য বুভূক্ষ হয়ে ছিলাম। অথচ প্রায় এভারেস্টের চূড়া প্রায় ছুই ছুই হাসানের সে সময়টায় পিছু ফিরে দেখার সময় ছিল না। বেচারা টুকুন এই পৃথিবীতে আসার জন্য বড্ড বেশি ভুল সময় বেছে নিয়েছিল। পরে বোধহয় নিজেই সেটা ভালো বুঝতে পেরেছিল। নইলে এতো আধুনিক হাসপাতালের সব জ্ঞানী গুনী অভিজ্ঞ ডাক্তারদেরকে কি সহজে বোকা বানিয়ে মাত্র একমাসের মাথায় সবাইকে ছেড়ে চলে গেল। টুকুনের জন্মের সময় হাসান পাশে ছিল না। কিন্তু ছোট্ট ছেলেটা তার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আবার বাবাকে মায়ের কাছে এনে দিল। অনুতপ্ত হাসান তখন সব পুষিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তখন আমি তা মানবো কেন? শোকে দুঃখে আমি তো তখন উন্মাদপ্রায়। নিজের ভালোমন্দ বোঝার বোধটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম। অনেকটা আমার জেদের কাছে বশ্যতা মেনেই দুজনের আলাদা হয়ে যাওয়া।
এখন বুঝি কি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল সেটা। আলাদা হয়ে যাওয়ার পর বুঝলাম হাসান আমার কতটুকু জুড়ে ছিল। নিজের শ্বাস প্রশ্বাসে আমি ওর গন্ধ পাই। ভেতরটা খালি খালি লাগে। মনে হয় আমারই সত্বার কোন একটা অংশ যেন কোথায় রয়ে গেছে। প্রতিনিয়তই এক হতে চাওয়া কিন্তু আত্ম অহমের প্রাচীর তাতে বাঁধা হয়ে দাড়ায়। এই একটা জায়গায় এসে আটকে গেলাম। আমাদের সম্পর্ক শুরুর চিঠিটার মতো নির্দ্বিধায় সম্পর্ক শেষের চিঠিটা তাকে পাঠাতে পারলাম না। বরং প্রতিমূহুর্তেই এক ধরনের আতংকে থাকি হাসান কখন সেই অমোঘবার্তাটি পাঠায়। আমাদের ডিভোর্স লেটার।
মাঝে মধ্যে ভাবি বেহুলার মতো যদি কোন লোহার প্রাসাদে থাকতে পারতাম যেখানে কালসাপ আসার সব পথ রুদ্ধ। তারপরও তো বেহুলা পারেনি তার নিয়তিকে ঠেকাতে, আমি কি করে পারবো?

বিঃ দ্রঃ গতকাল হাসানের থেকে একটা চিঠি পেলাম সাথে আমার প্রিয় এক গুচ্ছ হলুদ লিলি। চিঠিতে লিখেছে যে সে আবার আমার সাথে এক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এখন সে আমার মনোভাব জানতে চায়। আমি এই লেখাটাই একটা খামে ভরে হাসানের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। আরেকটা চিঠি, আরেকবার নতুন করে এক সাথে পথ চলার স্বপ্ন…..

২২শে জুলাই, ২০০৯

৪,৬২৬ বার দেখা হয়েছে

৬৭ টি মন্তব্য : “অতঃপর একটা চিঠি”

    • মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

      x-( মোহনা তুই সিসিবিতে কি করিস?তোকে না বলসি আমার ওই ব্লগে কমেন্ট করা হলে ভুলেও এদিকে আসবি না? x-( x-( কখন কোন দুষ্টামি করবি সেইটা নিয়ে আমি খুবই চিন্তিত x-(

      নূরাপ্পু,আমার পিচ্চি বোনটাকে বাংলা নিয়ে খোঁটা দিতাম বলে সে নিয়মিত কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ শিখে আমার সাথে ওইগুলা ব্যবহার করত-"ভাইয়া তোমার লেখা ব্লগ পড়ে আমি আনন্দে বিগলিত হয়েছি" "তুমি আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছ কেন","বন্ধুদের সাথে তোমার কথোপকথন কেমন হন"-গাধীটাকে কিভাবে বুঝাব যে এই শব্দগুলো কথ্য ভাষায় ব্যবহার ততটা যুৎসই না!!

      জবাব দিন
  1. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    শান্তাপু,
    শেষে মিলিয়ে দিলেন দেখেই মনে হয় একটু বেশি ভালো লাগলো। এমনিতেই তো দুঃখ কষ্টের কোন শেষ নাই আমাদের জীবনে 🙁

    হাসান নামটা দেখি আপনার খুব প্রিয় 😀


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  2. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    তাড়াহুড়া করে লিখেছেন মনে হল। গল্পে ম্যাচুরিটি প্রথমটার মত নেই। নায়িকার মনের টানাপোড়নটাও মনে হল ডিজিটাল যুগের মত। হুট করে শুরু, হাট করে শেষ। 🙂

    সবমিলিয়ে মোটামুটি। দশে পাচ দেয়া যেতে পারে।

    মনে হল আপনার প্রথম দিকের লেখা।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  3. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    একটা জিনিস খেয়াল করলাম, আপনার বেশির ভাগ গল্পই উত্তম পুরুষে বলা। ইচ্ছাকৃত ? নাকি গল্পগুলোতে নিজের জীবনের কিছু উপাদান থাকে বলে?
    এই গল্পটা আপনার অন্য লেখাগুলোর চেয়ে অনেক দুর্বল।

    মোটামোটি।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      পড়ার জন্য ধন্যবাদ। উত্তমপুরুষে লেখা বোধহয় সহজ। এতে নামগুলো বার বার ্লেখার ঝামেলা থেকে বাঁচা যায়।
      কমবেশি সবাইতো সব রকম অনুভূতি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। তাই অন্যের জুতায় পা গলিয়ে তার জীবনটা অনুভব করতে চাইলে হয়তো করা যায়। পরিচালক মানুষ এটা তো তুমিই ভালো বুঝবে।
      আমার দৃষ্টিতে এ গল্পের সবচেয়ে দুর্বল অংশ সেপারেশনের কারন। বাস্তবজীবনে সেটা আরো জটিল থাকে।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
  4. শোভন (২০০২-২০০৮)

    গল্প পড়ে বিভ্রান্ত হয়েছিলাম । এটা আপনার জীবনের ঘটনাই মনে
    হচ্ছিল । পরে কমেন্টগুলো পড়ে বুঝতে পারলাম এটা সত্যি নয় ।
    আসলে এটা লেখকেরই স্বার্থকতা ।
    অসাধারণ লেখা । :boss: :boss: :boss:

    জবাব দিন
  5. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
    আমেরিকান স্বপ্নে বিভোর হয়ে অনবরত ছুটে চললাম বড় বাড়ি, দামী গাড়ি কিম্বা লোক দেখানো বিত্ত বৈভবের পেছনে। নিজেদের জন্যই কোন সময় নেই, আরেকজনকে দেব কি? তখন থেকেই কি আস্তে আস্তে আমাদের স্পর্শগুলোও অনুভূতিহীন হয়ে যাচ্ছিল?

    এইজন্যই ত দৌড়ের উপ্রে আছি :(( ~x(


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : দিহান ইসলাম

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।