চিকিৎসা – ৭,৮

dig1
[১] [২-৩] [৪]
[৫-৬]
সাত
সে বছর আর পরীক্ষার জন্য তৈরী হওয়া হলো না। ততদিনে কেয়ার সাথেও অতুলের সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে। কেয়াদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকেও বড় বেশি অন্তসাঃর শুন্য বলে মনে হতে লাগলো। ক্রমশ লাবনী আবার নিঃসঙ্গ হয়ে গেল। অথচ নিজের মনের টানাপোড়ন, অস্থিরতা কারু কাছে প্রকাশ করবার জন্য খুব করে একজন বন্ধুর অভাব বোধ করছিল। তবে অবশ্যই একজন মেয়ে বন্ধু। এই মেয়েলী দুঃখের যন্ত্রণা শুধু আরেকজন মেয়ের পক্ষেই বোঝা সম্ভব।
আর সে সময়টাতেই কামাল সাহেবের মেয়ের বিয়েতে হিয়ার সাথে লাবনীর খুব ভাব হয়ে গেলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে দুজনের মধ্যে মিলের থেকে অমিলই বেশি। একজনের সাথে লেখাপড়ার কোন সম্পর্ক নেই আরেকজন লেখাপড়া ছাড়া কিছু বুঝে না। আবার আরেকজন সাদাকালো যার সাথে সাজগোজ বা ফ্যাশনের কোন সম্পর্ক নেই তো অন্যজন রঙ্গিন জমকালো একেবারে চলন্ত ড্রেসিংটেবিল। তারপরও দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে সময় লাগলো না। এবং দেখা গেল ব্যাপন পদ্ধতির মতো এর আধিক্য আর ওর অনাধিক্যের মধ্যে আদান প্রদান হতে লাগলো। লাবনীর বাসা থেকে হিয়া ফ্যাশন ম্যাগাজিন আর হিয়ার বইয়ের সংগ্রহ থেকে লাবনী ডেল কার্নেগীর আত্ন উন্নয়ন, সমরেশের সাত কাহন কিম্বা কালবেলার মতো বই এনে পড়তে লাগলো।
এই বন্ধুত্ব লাবনীর জন্য একটা বড় রকমের উপশম হিসেবে কাজ দিল। হাসানের সাথে তার অসুখী বিবাহিত জীবন কিম্বা সুমনের পরকীয়া অধ্যায় এ রকম সে কোন বিষয় নিয়ে সে অকপটে হিয়ার সাথে কথা বলতে পারতো। হিয়া একজন ভালো শ্রোতা এবং উপদেশদাতাও। সবচেয়ে বড় কথা ডাক্তারী পড়ার এতো ব্যস্ততা থাকা সত্বেও লাবনীর কাছে কখনও সময়ের অজুহাত তুলতো না। তাই লাবনীই প্রতিদিন হিয়ার মেডিকেল কলেজ থেকে ফেরার অপেক্ষা করতো।

মেডিকেল কলেজ থেকে ফিরে হিয়া সেদিনও দেখলো লাবনী ওর ঘরে বসে আছে। বুকশেলফে গল্পের বইগুলো নাড়াচাড়া করে দেখছিলো। বুঝাই যাচ্ছে সময়ক্ষেপনের চেষ্টা। কারণ লাবনী কখনো বই পড়ে না। ঘরে ঢুকতেই হিয়াকে বলে উঠলো,
-আমার বুয়াটা আজকে কাঠালের বিচি দিয়ে খুব ভালো শুটকী ভর্তা বানিয়েছে। তোর জন্য নিয়ে আসলাম।
-কি কাকতলীয় ব্যাপার! আজকে অপারেশন থিয়েটারে মনে মনে শুটকী ভর্তার কথা ভাবছিলাম।
-তোরা ডাক্তাররা অপারেশনের সময় শুটকীর কথা ভাবিস দেখে রোগীদের দুদিন পরেই শুটকী হয়ে যেতে হয়। ভুল করে আবার রোগীর পেটে ছুড়ি কাচি রেখে দিয়ে সেলাই করে দিসনি তো?
-ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন ছুড়ি কাচির দায়িত্ব আমাদের না। ওটা নার্সদের ডিপার্টমেন্ট। এখনও আমি পুরো ডাক্তার হই নাই। ম্যাডামের সাথে ওটিতে ছিলাম। আর মনকে ডাইভার্ট করার জন্য সুস্বাদু সব খাওয়ার কথা ভাবছিলাম।
-কেন তোর রোমিও আজকেও তোর সাথে মুড মারলো?
একই ক্লাসে পড়া সুজনের কথা হিয়া কোন একদিন লাবনীকে বলেছিল বটে, তবে এই মূহুর্তে তার মাথা একেবারেই সুজনশুন্য। হিয়া বলল,
-জী না। আপনার মতো দুঃখবিলাস করা আমার সাজে না। প্রতিদিনই মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিকতা দেখতে দেখতে নিজের অনুভূতিগুলোকে ভোতা করার চেষ্ঠা করছি যাতে যখন পুরো ডাক্তার হবো তখন যাতে নিজের মধ্যে কোন মানবিক অনুভূতি অবশিষ্ট না থাকে।
-কেন আজকে আবার কি হলো?
-জানিস আজ সকাল থেকেই ওটির রোগীটা প্রসবের ব্যথা উঠাতে বড্ড বেশি চিৎকার করছিলো। ম্যাডামের কাছে জানতে চাইলাম রোগীর জন্য কি করা উচিত। ম্যাডাম আমাকে সাথে নিয়ে রোগীর কাছে এসে তার গালে ইয়া জোড়ে এক চড় কষালেন। সাথে সাথে রোগী চুপ। একেবারেই হতদরিদ্র অপুষ্টিতে ভোগা এক মহিলা। বয়স ষোল না ছত্রিশ কিছুই বোঝা যায় না। এরকম চড়ের চিকিৎসা পেয়ে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছিলো। আর আমি চোখের পানি গোপন করার জন্য অন্যদিকে তাকাচ্ছিলাম। কারণ এই ম্যাডামের কাছেই তো ভাইভা দিয়ে পাশ করতে হবে। পরে দুঘন্টা পরে এই রোগীকেই ওটিতে আনতে হলো। একেবারে সিরিয়াস অবস্থা। আরো আগে অপারেশন করা উচিত ছিল। এক্লেমশিয়া হয়ে গেছে। বাঁচে কিনা সন্দেহ। তুই একটু বস হাত মুখ ধুয়ে একটু খেয়ে নেই। বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে।
-শুধু হাত মুখ ধুবি কিরে? ওটি থেকে আসলি গোসল করবি না?
-হাসপাতালে তো মাঝে মধ্যে ওটি থেকে বের হয়ে ভালো করে হাত মুখও ধোয়ার সুযোগ পাই না। অমনি খেয়ে ফেলি।
-ওয়াক থু। আর কিছু বলিস না। তোর পাশ থেকে সরে গিয়ে আমারই এখন গোসল করতে ইচ্ছে করছে।
-খালি নিজে সাজবেন আর ঘর সাজাবেন। এই দুটোই তো আপনার কাজ। আমি তো আর আপনার মতো এতো সুখের কপাল নিয়ে জন্মগ্রহন করিনি।
হঠাৎ করে লাবনীর মুখটা ভার হয়ে গেল। গলা নামিয়ে খুব ধীরে ধীরে বলল,
-আমার সব জানার পর কপালের খোঁটা দিলি?
-সরি। কিছু মনে করে বলিনিরে। দুষ্টামীও বুঝিস না? তুই এখন ছাদে যা। আমি খাওয়া শেষ করে আসছি।

আট
দুকাপ চা হাতে নিয়ে ছাদে এসে হিয়া দোলনায় বসে পরলো। কামাল সাহেব ছাদটাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন। একদিকে টবে ফুলের গাছ। আরেকদিকে বসার জন্য বেঞ্চি। এক কোনায় স্টিলের দোলনা। লাবনী ঘুরে ঘুরে ফুল দেখছিলো। কিছুক্ষন পর সেও পাশে এসে বসলো।
আপাত দৃষ্টিতে সবার চোখে লাবনী ‘বিধাতা সব কিছুই মেয়েটাকে ঢেলে দিয়েছেন’ ধরনের একজন। বাইরের দুনিয়ার চোখে সুখি একজন মানুষ। কিন্তু হিয়া ওর ভেতরের কষ্টটা জানে বলে এখন সে আজকে ওটিতে দেখা সেই এ্যক্লেমশিয়ায় ভোগা রোগীকে এক পাল্লায় আর লাবনীকে আরেক পাল্লায় রেখে মাপছে এটা বোঝার জন্য যে দুজনের মধ্যে আসলে কার কষ্টটা বেশি। আপাত দৃষ্টিতে তুলনাটা অসম মনে হলেও, মনের কষ্ট মাপার কোন যন্ত্র যদি আবিষ্কার হতো তাহলে এর ফলাফল দেখে আর অসম তুলনা বলে মনে হতো না। কারণ লাবনীর মতো অবস্থায় পরেই তো কত মেয়ে ধুমধাম আত্মহত্যা করে ফেলছে। সেই হিসেবে দুটোই তো মৃত্যু যন্ত্রণার কাছাকছি। একটা প্রাকৃতিক আরেকটা মানুষের নিজের তৈরী করা। বিশেষ করে সুমনের ঘটনাটার পর লাবনীর মনের যন্ত্রণাটা এতো বেড়েছে যে এসময়টা হিয়াকে পাশে না পেলে সে যে কোনদিনই একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারতো। মেডিকেলের লেখাপড়া যথেষ্ট চাপের। মাঝেমধ্যে হিয়া যদি সময় দিতে না পারে তবে লাবনী খুব অভিমান করে বসে। ওর কষ্ট আরো বেড়ে যায়। তাই অনেক ব্যস্ততার মাঝেও হিয়া কিছুটা সময় লাবনীর সাথে কাটায়। মেয়েটাকে সে সত্যিই সাহায্য করতে চায়।
দুজন আস্তে আস্তে দোল খাচ্ছিল। খুব কড়া বেলী ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। লাবনীকে দেখে মনে হচ্ছে সে বিভোর হয়ে কোনকিছু নিয়ে চিন্তা করছে। হিয়া আস্তে করে বলল,
-চাটা খুব ভালো হয়েছে।
-হু।
-আজকে যে তোর রুবি ফুপির কাছে যাওয়ার কথা গিয়েছিলি।
-হু।
-কথা হয়েছে?
-হলো।
-কি বললো রুবি ফুপি?
-বললো আমি চাইলে ওনার ওখানে গিয়ে উঠতে পারি। ফুপির বাসায় অনেক পার্টির আয়োজন করতে হয় সেখানে অনেক ব্যাচেলর আর্মি অফিসার আসে। ফুপির ধারণা সেখানে আমার সাথে কারো পরিচয় হয়ে উঠতে পারে।
-প্রস্তাবটা কি তোর বাস্তব সম্মত মনে হচ্ছে?
-সেটা নিয়েই ভাবছিলাম। একদম ঠিক মনের মতো মানুষের সাথে তো চাইলেও আর সাথে সাথে পরিচয় হয়ে উঠবে না। আর সম্পর্ক তৈরী হতেও তো কিছুটা সময় লাগে। তারপর নিজের অভিজ্ঞতা থেকেও তো এতোদিনে বুঝেছি একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে সম্পর্ক করতে ছেলেদের এক সেকেন্ড দেরীও সহ্য হয় না কিন্তু কখনও সহজে কোন কমিটমেন্টে যাবে না। ফুপির বাসায় গিয়ে না হয় উঠলাম। কিন্তু কতদিন সেখানে থাকা যায়। পুরো ভবিষৎটাইতো এখানে অনিশ্চিত।
-তা একদম সত্যি কথা। তাহলে তোর রুবি ফুপির প্রজেক্টটা আপাতত বাদ। কি বলিস?
– হু। আসলে আমি ভাবছি একবার এ সংসার ছাড়লে তো আর ফিরে আসার কোন উপায় থাকবে না। তাই ঠিক অন্ধকারে ঝাপ দেওয়াটা ঠিক হবে না।
-তোর জন্য আমার আসলে খুব কষ্টই লাগে। তোর বুদ্ধি এবং সৌন্দর্য দুটোই খুব বেশী। কিন্তু বোধহয় ইমোশনটাকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারিস না তাই কি আছে সেটা ভুলে গিয়ে কি নেই সেটা নিয়ে অযথা কষ্ট পাস।
-তোর জন্য এটা বলা সহজ। আমার জীবনটা কাটাতে হলে বুঝতিস আমি কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।
লাবনীর স্বরে কিছুটা অভিমান মেশানো ঝাঁঝ ছিল। হিয়া সাবধান হয়ে গেল। আসলে এই মূহুর্তে লাবনীকে আঘাত করে এমন কিছু ওর বলা উচিত না। হিয়া নিজের বাবা মাকে মনে মনে একটা ছোট্ট ধন্যবাদ দিল যে তাকে এখন লাবনীর মতো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে না। প্রসঙ্গ পালটে হিয়া বলল,
-তবে তুই যাই বলিস না কেন হাসান ভাইকে কিন্তু আমার খুব ভালো লাগে। আম্মা তো সেদিন বলছিলো যে আমার ভাগ্যেও যেন লাবনীর বরের মতো একটা বর জুটে।
-আমারটাকেই নিয়ে নে না।
-এখন নিব কি করে? তুইই তো এখনও জুড়ে আছিস। বেচারাকে যখন একা ফেলে চলে যাবি তখন না হয় চিন্তা ভাবনা করবো। আচ্ছা তোরা তো কোন জায়গা থেকে ঘুরে আসতে পারিস?
-হাসানের সাথে কোথাও যাওয়া মানে যন্ত্রণা। কোন কথা না বলে বইয়ের মধ্যে মুখ গুজে বসে থাকবে নয়তো পাঠশালা ধরনের কোন যাদুঘরে নিয়ে যাবে। ওর সাথে কোথাও যাওয়ার কথা আর ভুলেও ভাবি না। তার থেকে বরং তোর সাথে কোথাও যেতে পারলে ভালো হতো। বুদ্ধদেবের এরকম একটা বই পড়ছিলাম। দু বান্ধবী মিলে সুন্দর একটা ফরেস্ট ভিলায় গেল।
-আইডিয়াটা মন্দ না। সামনের মাসেই তো আমার পরীক্ষা শেষ। তারপর চল কোথাও যাই। তোর বরও গেল সাথে। অসুবিধা তো নেই। যত যাই বলিস দেশে তো দুটো মেয়ে এক সাথে ঘুরলেও তো তারা একা একা। সাথে বডিগার্ড না থাকলে পুরোপুরি নিরাপদ না।
-ঠিক আছে হাসানকে বলবো।
হিয়া একটু নড়ে চড়ে বসলো। আসলে হাসানের ব্যাপারে সে এক ধরনের কৌতুহলবোধ করে। স্ত্রী তাকে ভাসবাসে না সেটা হাসান জানে। আবার স্ত্রীকে সুযোগ দিয়েছে যাতে সে তার পছন্দমতো কাউকে খুঁজে নিতে পারে। এক কথায় অদ্ভুত। ভেতরে ভেতরে মানুষটাকে জানার একটু আগ্রহও তৈরী হচ্ছে।

১,৯৪৯ বার দেখা হয়েছে

১৫ টি মন্তব্য : “চিকিৎসা – ৭,৮”

  1. প্রিয় ওয়াহিদা নূর আফজা,

    প্রথম পাতার বৈচিত্র রক্ষার্থে আপনার সহযোগিতা কাম্য। আপনার প্রতি অনুরোধ থাকলো পরবর্তী পর্বগুলো আপনি একবারে পোস্ট করুন। প্রধান পাতার বৈচিত্র রক্ষার পাশাপাশি আপনার পাঠক হারাবারও কোন সম্ভাবনা থাকবে না।

    আপনার সহযোগীতার জন্য অগ্রিম ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।

    জবাব দিন
  2. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    শান্তাপু, একবারে পুরোটা পড়বো বলে রেখে দিয়েছি। প্রতিপর্বে এসে দেখে যাই শেষ হলো কিনা!

    শেষ হলে পুরোটা পড়ে কেমন লাগলো জানাবো। আপাতত সঙ্গে আছি, লিখুন।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।