চিকিৎসা – পাঁচ, ছয়

dig1
[১] [২-৩] [৪] [৫-৬]
পাঁচ
এদিকে লাবনী প্রাইভেটে ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা দিবে বলে ঠিক করলো। কোচিং ক্লাসে গিয়ে একদল বন্ধু বান্ধব পেয়ে গেল। ওদের ব্যাপারে বা তাদের সাথে মাঝে মাঝে সময় কাটানোর ব্যাপারে লাবনী আর তখন কোন ভয় নেই। এখানে সবাই ওর মতোই নানা কারণে অনিয়মত ছাত্র ছাত্রী। পড়াশোনার থেকে মুঠোফোনে কথা বলা আর ফেসবুকে নতুন বন্ধু বান্ধবের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলার কাজেই ওদের বেশী উৎসাহ।
একদিন ওরা সব লাবনীর বাসায় দাওয়াত খেতে আসলো। সবচেয়ে মুখরা বান্ধবী কেয়া হাসানের ছবি দেখে বললো,
-তোর বর এতো বুড়া! একদম তোর সাথে মানাচ্ছে না। কোন দুঃখে তুই এই বুড়ার গলায় মালা দিলি?
বান্ধবীরা আরো কিছুক্ষন হাসানকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে লাগলো।
এর আগে লাবনী কখনও হাসান সম্পর্কে এভাবে ভেবে দেখেনি। সেই রাতে আর লাবনীর ঘুম আসলো না। এবং সেইদিনই সে প্রথম খেয়াল করলো হাসান ঘুমানোর সময় খুব জোড়ে জোড়ে নাক ডাকে আর এমনভাবে হাত পা ছুড়াছুড়ি করে যে সেটা প্রায় লাবনীকে শারিরীকভাবে আঘাত করার মতো। নির্ঘুম রাত সে ফটো ফ্রেমগুলো থেকে তার আর হাসানের ছবি খুলে শুধু তার একার ছবি রাখলো।
কেয়াদের সাথে কাটানো সময় তার জীবনে অন্য এক মাত্রা এনে দিল। ওদের উত্তাল প্রেম আর হ্যান্ডসাম প্রেমিকদের নিয়ে সব রোমাঞ্চকর গল্প তার জীবনে অতৃপ্তির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল। সেদিন কেয়া বলল,
-অতুল যে আমাকে এরকম সারপ্রাইজ দিবে তা ভাবতেই পারিনি। সে আমাকে একটা সোনার চেন উপহার দিল। তারপর নিয়ে গেল হোটেল সোনারগাওয়ে।
এরপর কেয়ার গল্প আদি রসাত্মক হতে থাকলো। লাবনী সরলভাবে জিজ্ঞেস করলো,
-বিয়ে না করে তুই এতোদূর যাচ্ছিস?
মিতা পাশ থেকে বলল,
-ওরা তো লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। অতুলের মা মেনে নিচ্ছে না বলে এখনও ওরা আলাদা।
লাবনী ভাবলো হাসান তো তাকে কখনও এতোটা তৃপ্ত করেনি যেটা সে এখন কেয়ার চোখে মুখে দেখছে।
একদিন সে কেয়ার সাথে একটা ফাস্টফুডের দোকানে গেল। সেখানে আগে থেকেই অতুল তার এক বন্ধুকে নিয়ে বসে ছিল। কেয়া লাবনীর কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো, বহুৎ বড়লোকের পোলা। কিছুদিন আগেই আমেরিকা থেকে পড়াশোনা করে ফিরছে।
সেই বড়লোকের ছেলে যার নাম সুমন তার সামনেই লাবনীকে বসতে হলো। সুমনের চাহনী লাবনীর একেবারে বুকের ভিতরে বিদ্ধ করলো। নিজের অজান্েতই লাবনী শিহরিত হলো। এর আগে এই বাইশ বছরের জীবনে তার দূর থেকে অনেককে দেখে ভালো লাগলেও এতো কাছাকাছি নাগালের মধ্যে কারো জন্য এরকম অনুভুতি হয়নি। লাবনী সত্যি সত্যিই খুব নার্ভাস হয়ে পরলো পরদিন যখন কেয়া তাকে জানাল যে সুমন ওর ফোন নাম্বার চেয়েছে।
এরপর সুমনের সাথে নিয়মিত ফোনে কথা হতে লাগলো। তারপর এক সাথে বাইরে যাওয়া। হাসানের সাথে সাত বছরের বিবাহিত জীবনে যে রসায়নের অভাব সে এতোদিন ধরে বোধ করে এসেছিল সেটা সে সুমনের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় খুঁজে পেল। ওরা যখন হাতে হাত ধরে একসাথে কোথাও ঘুরতে যেত আশে পাশের সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতো। অনেকে তো মুখ ফুটে বলে উঠতো, ‘আহ কি জুড়ি’ কিম্বা ’সোনায় সোহাগা’। এ ধরনের মন্তব্যে লাবনী খুব পুলকিত বোধ করতো।
এই সময়টা লাবনীর জীবনে ছিল একদিকে সবচেয়ে সুখের আর অন্যদিকে সবচেয়ে দুঃখের। সুমনের প্রেমে পরে তার কোনরকম পার করে দেওয়া নিরাসক্ত দিনগুলো হয়ে উঠলো উত্তাল। আবার হাসানকে যখন সুমনের পাশে দাড় করাতো তখন এক অপরিসীম যন্ত্রণা তাকে বিদ্ধ করতো। সুমন যেমন তার প্রতিটি মূহুর্ত মজার কথবার্তায়,আনন্দে আবেগে রঙ্গিন করে তুলতো সেখানে হাসান বলতে গেলে একেবারেই নিরাসক্ত। অফিসের থেকে বাসায় এসে টিভিতে খবর ছেড়ে পেপার নিয়ে বসবে। বৌটা সারাদিন কি করলো না করলো তাতে কোন আগ্রহ নেই। শুধু রাতে সময়মতো বিছানায় পেলেই হয়। সম্পর্কটা একেবারেই যান্ত্রিক, শুধুমাত্র প্রয়োজনের। লাবনীর মন থেকে তখনই হাসান ক্রমশ ফিকে হতে হতে হারিয়ে গেল। অথচ সে সময়টাতেই লাবনী ধরা না পরে যাওয়ার ভয়ে হাসানের ব্যাপারে বেশি খেয়াল রাখতো। কোন কিছু চাওয়ার আগেই হাসান সবকিছু হাতের কাছে পেয়ে যেত। দিনের বেলা হাসানের যখন তখন ফোন করে বৌ এর খোঁজ নেওয়ার অভ্যাস ছিল। বাসার ফোন ব্যস্ত পেলে ঘন ঘন ফোন করে দেখতো যে সেটা কতক্ষন ব্যস্ত আছে। লাবনীর অবশ্য ধারণা এটা হাসান একটু গোয়েন্দাগিরির উদ্দেশ্যে করতো। তাই সে কখনও এক নাগাড়ে বেশিক্ষন সুমনের সাথে ফোনে কথা বলেনি। পরে তো সাহস বেড়ে যাওয়ায় সুমনকে তো বাসায়ই আসতে বলতো।
তবে প্রতিবারই সুমনের সাথে বাইরে ঘুরে আসার পর তার এই লুকোচুরিময় দ্বৈত জীবন অসহ্য মনে হয়।

ছয়
লাবনীর বিয়ের পর থেকে মায়ের সাথে বলতে গেলে কথা বলা হয়নি। তবে বাবার আদরটা সব সময়ই অনুভব করে এসেছে। এই অবস্থায় একবার তো সে বাবার কাছে গিয়ে বলেছিল যে সে আর হাসানের সংসার করতে চাচ্ছে না। তার বাবা খুব কড়া ভাবে জানিয়েছে লাবনীর এ ধরনের কাজ সে একদমই বরদাস্ত করবে না। পরে লাবনী জেনেছিল ব্যবসার কাজে বাবা হাসানের থেকে অনেক টাকা ধার নিয়েছিল। যদিও বাইরে থেকে বাবা জানিয়ে দিল শুধু ‘ভাল লাগে না‘ এই অজুহাতে কারো সংসার ভাঙ্গা উচিত না। বলতে গেলে এখন হাসানের সংসার ছেড়ে লাবনীর আর কোন যাওয়ার জায়গা নেই। শেষ ভরসা ছিল রুবি ফুপি। লাবনীর বিয়ের সময় এই ফুপিই তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল হাসানের ব্যাপারে। এবং এখন পর্যন্ত ওর মাথা খেয়ে যাচ্ছে এটা বলে যে এই বরকে ছেড়ে লাবনীর আবার নতুন করে বর খোঁজা উচিত।
কিন্তু রুবি ফুপি পর্যন্ত যাওয়ার আগেই লাবনীর জীবনে বোধহয় এই পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় দূর্যোগটা আসলো।
হঠাৎ করেই সুমন আমেরিকা চলে গেল। যাওয়ার আগে সে এই শহরের এক বিখ্যাত ব্যবসায়ীর মেয়েকে বিয়ে করে গেছে। সে মূহুর্তে সুমনের হঠাৎ এরকম আঘাত দেওয়াটা দুঃখবোধের থেকেও অপমানবোধ হয়েই বুকে বেশি যন্ত্রণা দিতে লাগলো।
ঘূর্নিঝড়, বন্যা, ভুমিকম্প বা সুনামীর মতো যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন পৃথিবীর বুকে তার ক্ষতচিহ¡ রেখে যায় ঠিক তেমনি মনন জগতে ঘটে যাওয়া হতাশা, বঞ্চনা, ক্ষোভ, অপমানের মতো নানারকমের মানসিক দুর্যোগের ক্ষতটাও সেখানে গভীরভাবে গেড়ে বসে।
সুমনের সাথে যখন লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছিলো তখন হাসানের কাছে লক্ষ্মী বৌ সাজার চেষ্ঠায় থাকতো। এখন সুমন তাকে ধোকা দেওয়াতে লাবনীর মনে হতে লাগলো তার আর হারানোর কিছু নেই। এখনকার মতো হাসানকে এতোটা অসহ্য আর কখনও লাগেনি। এমনিতে লাবনী উগ্র মেজাজের মেয়ে নয়। কিন্তু হাসান সামনে থাকলে তার সব হিসেব গড়বর হয়ে যায়। ভেতরের সব ক্রোধ তার কন্ঠনালীর কাছে জমা হয়। মাথা ঘুরতে থাকে। লাবনীর ভয় হয় আবার তাকে ডিপ্রেশনটা পেয়ে বসলো নাকি? এই জীবনের কাছে বেশিকিছু তো সে চায়নি। তার কি কোন অধিকার নেই একটা সুন্দর স্বাভাবিক জীবনযাপন করার?

একদিন অফিস থেকে এসে হাসান টেলিভিশন দেখছিলো। হঠাৎ কি হলো লাবনীর সে দুম করে সেটা বন্ধ করে দিল।
অবাক হাসান জিজ্ঞেস করলো,
-কি হয়েছে লাবনী?

আজ লাবনী সত্যি সত্যিই মরিয়া। সে ঠিক করেছে যা হয় হবে সে হাসানকে তার আসল অনুভুতি প্রকাশ করবে।
-তোমার জন্য আজ আমার এই অবস্থা।
হাসান একটু ভরকে গেল। ভাবলো লাবনীর ডিপ্রেশনটা আবার শুরু হলো কিনা। আর লাবনীও বোধহয় হাসানের মনের কথা বুঝতে পারলো। সে বলে উঠলো,
-হাসান আমি এখন সুস্থ ঠান্ডা মাথায় তোমাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই।
-বলো লাবনী।
-তুমি জান আমাদের বিয়েটা কি অবস্থায় হয়েছে। এবং তুমি এটাও জান যে কতটা কষ্ট করে আমি এতোদিন তোমার সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্ঠা করেছি। আমি আর পারছি না।
-লাবনী আজকে রাত অনেক হয়েছে। চলো আমরা ঘুমাতে যাই। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিব। কালকে সকালে উঠে তোমার কথা শুনবো।
-দয়া করে আমার সাথে বাচ্চা মেয়ের মতো ব্যবহার করা বন্ধ করো। আমাকে কথাগুলো এখনই বলতে হবে। আমি কোন ডিপ্রেশন বা আবেগের বশবর্তী হয়ে এখন কোন কিছু বলবো না। অনেকদিন থেকে চিন্তা ভাবনা করেই এখন তোমাকে কিছু কথা বলবো। ব্যাপারটা হাèা ভাবে নিও না।
-ঠিক আছে আমি সিরিয়াসলি শুনবো। তুমি বলো।
-আমার পক্ষে তোমার সাথে থাকা আর সম্ভব না। তোমার যে জিনিষগুলো বদলানো সম্ভব সেগুলো তুমি বদলেছো। কিন্তু যেসব কোন ভাবেই বদলানো সম্ভব না আমাকে সেগুলোই যন্ত্রণা দিচ্ছে। এই যেমন ধরো আমাদের বয়সের পার্থক্য, তোমার আত্মিয়স্বজনের ব্যবহার, তোমার বুড়োটে স্বভাব এগুলো এখন আমার গলায় ফাঁস হয়ে ঝুলছে। আমি এর থেকে মুক্তি চাই।
এর আগে হাসান কখনো লাবনীকে এই ভাবে এই স্বরে কথা বলতে দেখেনি। সে তার বৌ নিয়ে খুব সুখীই ছিল। বৌএর জন্য কি না করেছে? এমনকি নিজের পরিবারের সাথেও বলতে গেলে যোগাযোগ শুন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে। লাবনীর কার সাথে মিশছে, লুকোচুরি সম্পর্ক সব কিছু বুঝেও না বোঝার ভান করেছে। ভেবেছে ক্ষণিকের আবেগ। সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন মনে হচ্ছে এসব কিছুকে প্রশয় দেওয়া ঠিক হয়নি। কিন্তু এখন অনেক দেরী হয়ে গেছে।
অবাক হয়ে হাসান উপলদ্ধি করলো লাবনীর প্রতি তার রাগ বা ঘৃনা কোনটাই হচ্ছে না। বরং আশংকা হচ্ছে মেয়েটাকে নিয়ে কেউ খেলা করছে না তো? লাবনীকে যে তার পরিবারের কেউ এ ব্যাপারে সমর্থন করবে না তা সে ভাল করেই জানে। এখনও হাসান চোখ বন্ধ করলে সেই কিশোরী বয়সের বৌ সাজা লাবনীর ভীত চেহারাটা দেখতে পায়। সে ছাড়া এ মেয়েটাকে সব ধরনের বিপদ থেকে আর কেউ রক্ষা করতে পারবে না। আবার সে চায় লাবনী একটা সুখি জীবন যাপন করে।
হাসান বললো,
-তুমি যা চাও তাই হবে। তুমি যদি চলে যেতে চাও তাহলে যাবে। তার আগে যতদিন এ বাসায় থাকতে চাও থাকবে। এ নিয়ে আমার কোন আপত্তি থাকবে না।
লাবনী যে এতো সহজে যুদ্ধে জিতে যাবে তা কখনো ভাবেনি।
চলবে ……

৩,৬৩১ বার দেখা হয়েছে

৩৭ টি মন্তব্য : “চিকিৎসা – পাঁচ, ছয়”

  1. রাশেদ (৯৯-০৫)

    প্রথম 😀
    গল্প শেষ হয়ে গেল নাকি? আমাদের সমাজে আসলে এই ধরনের বাস্তবতা থেকে মুক্তি নেই। ক্লাস নাইনে পড়া একটা মেয়ে বিয়ের সময় কিবা করতে? আবার তার যখন চোখ খুলে গেল তখন সে হয়ত আর তার বাস্তবতা কে মেনে নিতে পারছে না তাই সুমনের আবির্ভাব। লাবনী চলে যেতে চাইলে হাসানের মনস্তাত্তিক অবস্থা কি হবে? সব মিলিয়ে কিন্তু দারুন একটা উপন্যাস করা যায় 🙂


    মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

    জবাব দিন
  2. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    বড় আপুর ব্লগ,তাই উল্টা পালটা কিছু বলা যাচ্ছেনা।আমার হাসানকে একটা ভেড়ারও অধম বলে মনে হচ্ছে-হি শিউরলি ডাজ নট হ্যাভ দা ম্যানহুড।এইরকম ছেলের বউ যদি পরকীয়া করে তাহলে সেইটাই তার প্রাপ্য।বউয়ের পরকীয়াকে ক্ষণিকের আবেগ বলে মেনে নিচ্ছে!আশ্চর্য!

    জবাব দিন
  3. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    মাস্ফ্যুর ম্যানহুড! 😮 না ভয় পাইছি!! :just: ঠাট্টা....... হা.....হা..।

    পরকীয়ার জন্য অনেক সময় কারণও থাকে না......... মজার জন্য, ফোনে কথা বলতে বলতেও হয়ে যায়। সুতরাং সাবধান........... (এই মন্তব্য সবার জন্য, নিজেকেও বাদ দিচ্ছি না)।

    শান্তা, অপেক্ষায় আছি। থাকবো। তোমার চমকের জন্য। আমার মন্তব্যও তাই অপেক্ষায়। ~x(


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তানভীর (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।