চিকিৎসা – ৪

flower bowl
এক দুই তিন
চার
ফেরার পথে সারা পৃথিবী চষা সুমন লন্ডনে একবার তার পুলিশের হাতে পরে নাস্তানাবুদ হওয়ার গল্প বলছিল।
স্বপ্নাতুর চোখে লাবনী জিজ্ঞেস করলো,
-লন্ডন শহরটা কেমন?
-শহরটা অনেক পুরনো তো তাই একটু ঘিঞ্জি ধরনের। রাস্তাঘাট ছোট ছোট, বাড়িঘর দোকানপাট খুব লাগোয়া। ব্যস্ত মানুষজন পেভমেন্ট দিয়ে হাঁটছে। পথে ঘাটে সব সময় গাড়ি, বাস, ট্রামের ভীরভাট্টা লেগেই আছে।
-তোমার বর্ণনা শুনে তো এই ঢাকা শহরের কথা মনে হচ্ছে।
-ওহ নো। ঢাকায় যে কিভাবে তোমরা থাকছো আমি তাই বুঝতে পারছি না। পুরো শহরটাই একটা আবর্জনার স্তুপ। যেন একটা পলিউটেড গ্যাস চেম্বার। তার উপর রাস্তাঘাট না বানিয়ে খালি বড় বড় বিলডিং তোলা হচ্ছে। মাঝে মধ্যে মনে হয় একেকটা যেন কয়েদ খানার গরাদ। লন্ডনের সাথে এর কোন তুলনা হয় না। ও শহরের মানুষ অনেক। কিন্তু সব কিছুই পরিকল্পিত ভাবে করা হয়েছে। আর ওখানকার নিয়ম কানুন খুব কড়া। মানুষজনই নিয়ম কানুন মেনে চলে। অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার তুলনায় শহরটা একটু ঘিঞ্জি। আবার লন্ডনে এক ধরনের লাইফ আছে যা ঐ সব শহরে পাওয়া যায় না।
সুমনের কথায় লাবনী কল্পনার রাজ্যে লন্ডনে চলে গেল।

সুমনকে বিদায় দিয়ে যখন নিজের হাতে সাজানো সংসারের চার দেয়ালের মধ্যে আবার ফিরে আসতে হয় তখন বাস্তবকে বড় বেশী রুক্ষ লাগে। তার ধারণা সে বিবাহিত বলেই সুমন তাকে এখনও কোন কথা দিচ্ছে না। তারপরও ফিরতে বেশ দেরী হওয়াতে লাবনী কিছুটা অপরাধবোধেও ভুগছিলো। হাসান অফিস থেকে ফেরার পর ওর পাশে বসে একটু আদিখ্যেতা দেখানোর চেষ্টা করলো। সুমনের কথামতো হাত দিয়ে একটা রজনীগন্ধা ফুলের মতো করে হাসানের পাশে বসে বলল,
-দেখতো আমার আঙ্গুলগুলো কেমন লাগছে?
পেপার থেকে মুখ না ফিরিয়েই হাসানের নিরস উত্তর,
-কোন সমস্যা বোধ করছো? কালকেই তাহলে ডাক্তার দেখাও।
লাবনী হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। তার পরও শেষ চেষ্টা হিসেবে মরিয়া হয়ে বলল,
-আচ্ছা তুমি তো কখনও আমাকে মজার কোন কথা বলো না। এখন অন্তত এমন কিছু বলো যা শুনতে আমার ভাল লাগবে।
-আজকে আমাদের অফিসে স্কয়ার থেকে এক মার্কেটিং এজেন্ট এসেছিলো। ভদ্রলোক বোধহয় আগে বেক্সিমকো ফার্মায় কাজ করতেন। উনি একটা সময় দুটো কোম্পানীর সেল রিপোর্ট গুলিয়ে ফেলছিলেন। গত বছরের ফাইন্যালসিয়াল রেভেনিই যেটা বললেন তা ঠিক মিলছিলো না। আমিই ভুলটা ধরতে পারলাম। ভদ্রলোকের সাথে মিটিং করবার আগে স্কয়ারের কয়েক বছরের রেভেনিউ পড়ে গিয়েছিলাম। উনি যখন নেট প্রফিট বলা শুরু করলেন তখনি খটকা লাগলো ………
মজার কথার নামে হাসান এসব কি বলছে তা লাবনীর মাথায় কিছুতেই ঢুকছিলো না। ঘুরে ফিরে সে আশুলিয়ার স্মৃতিতে ডুবে যেতে লাগলো। সেই সাথে সুমন আর হাসানকে দু পাল্লায় বসিয়ে বার বার মনে হতে লাগলো তার মতো একটা সুন্দরী রুচিশীল মেয়ের কি হাসানের মতো একটা বুড়ো নিরস বরের গলায় মালা দেওয়ার কথা ছিল? নিজের বিয়ের সময়কার কথা ভাবলে এখনও ওর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে।

ক্লাস নাইনে মাত্র পনের বছর বয়সে ভাল ছেলে দেখে লাবনীকে ওর আম্মা বিয়ে দিল। ওর মায়ের যুক্তি ছিল এই যে এতো ভাল ছেলের প্রস্তাব পরে নাও পাওয়া যেতে পারে আর তাছাড়া পাড়ার ছেলেরা খুব বেশি তার মেয়ের পিছু লেগেছিলো। পাত্র যে পাত্রীর থেকে পনের বছরের বড় এটাও তখন ওনার কাছে বিয়ের জন্য একটা ভাল যুক্তি মনে হচ্ছিল। বিয়ের প্রথম ছয় সাত বছর লাবনী বলতে গেলে ছোট্ট একটা পাখীর বাচ্চার মতো স্বামীর সংসার করছিলো। হাসান এমনিতে খুব ভাল মানুষ। দায়িত্বশীল, পরিশ্রমী আর শান্ত স্বভাবের। কোনরকম বাজে শখ নেই। খুবই শৃংখলাবদ্ধ জীবন কাটায়। এমনিতে বয়সে অনেক বড়। তার উপর স্বভাবটাও বড্ড বেশী বুড়োটে। পারলে সব সময়ই বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকে। সবচেয়ে বেশী কষ্ট লাগে যেখানে একটু বাইরে গেলেই লাবনীকে নিয়ে চারপাশের মানুষজনদের মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় সেখানে হাসান অফিস থেকে ফিরে এসে বৌয়ের দিকে ঠিক মতো তাকিয়ে দেখে কিনা সন্দেহ। প্রতিদিনই নিত্য নৈমত্তিক বই বা পেপার আর টেলিভিষনে সি এন এন নিয়ে বসা।
বিয়ের পরেও লাবনী লেখাপড়া চালিয়ে গেছে। কিন্তু তার ছন্দটা মায়ের সংসারে যখন ছিল তার থেকে পুরো অন্যরকম। আগে লেখাপড়া ছাড়া আর কোন দায়দায়িত্ব ছিল না। কিন্তু বিয়ের পরে ছোটখাট হলেও একটা সংসার সামলে পড়াশোনা করাটা বেশ কিছুটা চাপেরই। তার উপর তখন সংসারটা চলছিল একরকম তার শ্বাশুরীর খবরদারীতে। ওনার কিছুটা বিধি নিষেধ ছিল। দুপুরে লাবনীকে লাঞ্চে বাসায় থাকতে হবে। ক্লাসের পরে সোজা বাসায় চলে আসতে হবে। বাসায় কোন ফোন রাখা যাবে না। কখনও একা বাইরে কোথাও যাওয়া যাবে না। এছাড়া সবাই যেন ভুলেই গেল যে সে তখনও পুরো মাত্রার ছাত্রী। পরীক্ষা থাকুক আর যাই থাকুক সামাজিকতা, অফিস পার্টি কোন কিছু থেকেই রেহাই ছিল না। হাসান কখনো মানা করেনি তার পরও অজানা এক ভয়ে সেই সময়টা পর্যন্ত লাবনীর কোন বাইরের বন্ধু বান্ধবও ছিল না। এতোসব কিছু মেনে মেট্টিক পরীক্ষা পর্যন্ত ভালোভাবেই চালিয়েছিল। কিন্তু তার পরে কলেজে গিয়ে লেখাপড়ায় কিছুটা অনিয়মিত হয়ে পরে। বিশেষ করে ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষায় পাশ করতে না পেরে পুরো তিন বছর ঘরে বসে ছিল। এদিকে নিজের পরিবার বিশেষ করে মায়ের উপর অভিমান করে এক রকম পরিবার থেকে দূরেই সরে ছিল। আবার ওদিকে মনে হতো তার শ্বাশুরী সময় অসময়ে ছেলেকে উপদেশ দিয়ে তার জীবনটা বেশি রকমের নিয়ন্ত্রিত করে ফেলছিল। এভাবে চলতে চলতে একটা সময় সে খুবই ডিপ্রেশনের মধ্যে দিয়ে যেতে লাগলো। যেই স্বামীর দিকে সে আগে কখনও চোখ তুলে তাকিয়ে কথা বলতে সাহস পেত না, সেই স্বামীকে তার এই স্বপ্নভঙ্গের অবরুদ্ধ জীবনের সব না পাওয়া বেদনার জন্য প্রতিনিয়ত দোষারোপ করতে লাগলো। মাঝে মাঝে যে সে খুবই অস্বাভাবিক আচরন করে ফেলে সেটা সে নিজেই বেশ বুঝতে পারতো। পরে হাসানেরই এক চাচাতো ভাই ভাবীর পরামের্শর্ ওকে এক মনোবিজ্ঞানীর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কখনও একা কখনওবা হাসানসহ সেই মনোবিজ্ঞানীর সাথে কয়েকবার বসার পর লাবনীর ডিপ্রেশন অনেকটাই কেটে যায়। অবশ্য এর জন্য হাসানকেও অনেক বদলে যেতে হয়। নিজের পরিবারের সাথে সম্পর্কটা আলগা করে ফেলতে হয়। বাসায় টেলিফোন আসে। লাবনীর নিজস্ব একটা মুঠোফোন হয়। এরপর সে চাইলেই একা একা শপিং করতে যেতে পারে। এমনকি যখন মডেলিং করতে চাইলো, হাসান সেখানেও কোন বাধা দিল না। হাসানও বুঝতে পারলো লাবনী এখন আর ছোট্ট মেয়েটি নেই। পরিনত তরুনী। সেভাবেই সে লাবনীকে মেনে নিল। সে তার ক্রমশ উর্ধধগতির ক্যারিয়ার নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকতো যে তরুনি লাবনীর একান্ত গোপন জীবনের কোন খবর রাখতো না।
চলবে …

১,৫৯৫ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “চিকিৎসা – ৪”

  1. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    বাকি পর্ব যেহেতু এখানে আর নাই, তাই একপ্রস্থ মন্তব্য করি।

    তোমার আগের গল্পটা (যেভাবে গল্পের শুরু) এখনো আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে। :hatsoff:

    বাকিটা শেষ করো, তারপর আবার জানাবো। কারণ কোনোভাবে তুমি প্রভাবিত হও সেটা চাইছি না।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      আমার এক কট্টর সমালোচক বন্ধুও যখন "যেভাবে গল্পের শুরু" সম্পর্কে কিঞ্চিৎ সার্টিফিকেট দিয়ে এটাকে উপন্যাস হিসেবে লিখতে বললো - তখন বুঝলাম লেখাটা এগুচ্ছে (হয়তবা) ভালোভাবে কারন ওটাই ছিল আমার শেষ লেখা। চিকিৎসা গল্পটা বেশ পুরোন, পড়ার পর মনে হচ্ছে আরো ভালো করা যেত। তারপরও সন্তানের মতো সব গল্পই নিজের সত্তার একাংশ।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : nidhi

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।