বিষন্নতা নিয়ে একটু রসকথা

(লেখাটি আগে অন্য একটি ব্লগে দিয়েছিলাম।)

বিষন্নতাকে বিষন্নভাবে না দেখে একে নিয়ে একটু রসকথা বললে কেমন হয়? এই যেমন অন্ধকার না থাকলে আলোর কোন মূল্য নেই ঠিক তেমনি সুখ কিম্বা আনন্দকে আরাধ্য করে তুলবার জন্য বিষন্নতার ভূমিকা অপরিহার্য নয় কি? ছোট্টবেলায় বাবা মায়ের বকুনী, ক্লাসে ভালো করতে না পারা, সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, চাকুরীর অনিশ্চয়তা, জীবনযুদ্ধে অন্যের চোখে পিছিয়ে পরা এরকম আরো নানা অব্যক্ত মূহুর্তে কে কখনই একদম বিষন্নতায় ভোগেননি বলেন? আমার তো মনে হয় আমাদের সমাজ জীবনে অন্য আর অনেক অনুভূতির থেকে বিষন্নতার প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। তারপরও কেউ যদি হলফ করে বলেই বসে যে তার জীবন পুরোপুরি বিষন্নতামুক্ত তবে আমি তার জীবনটাকে একটা গাছের সাথে তুলনা করব। গাছও না আরো নির্জীব কিছু – এই যেমন খাম্বা ধরনের কিছু একটা।

প্রাণী মাত্রই টিকে থাকার জন্য অভিযোজনের প্রক্রিয়ার মাঝে নিজের পরিবর্তন ঘটাতে থাকে। এই যেমন শীতের দেশের মানুষেরা হয় সাদা আর মরুভূমির মানুষেরা হয় কালো। জীবনের এই অপরিহার্য অনুভূতি বিষন্নতাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার জন্য আমরা কি করছি? এখন বরং এর সুফল নিয়ে কিছুটা আলোচনা করি।

যে কোন সৃষ্টির মূলে বিষন্নতার এক ধরনের যোগাযোগ রয়েছে। বিগ ব্যাংএর ঠিক আগের মূহুর্তে (যদি তা হয়ে থাকে) স্রষ্টাও বুঝি কিছুটা বিষন্ন ছিলেন। পরে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিও সে গুনটি বহন করে চলেছে। সৃষ্টি রহস্য জানতে না পারার যন্ত্রণায় বিষন্ন নিউটন গাছ থেকে আপেল পরা দেখে মার্ধ্যাকার্ষন নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। স্কুলে ব্যক বেঞ্চার এবং সাধারণ কেরানী হিসেবে চাকুরী শুরু করা আইনেস্টাইনের মন কি সব সময়ই সময়ের রহস্যের জটিল চিন্তা নিয়ে বিষন্ন ছিল না?
অতো বড় বড় বিজ্ঞানীদের কথা বাদ দিয়ে এবার সাহিত্যে ক্ষেত্রে আসি। এখানে সার্বজনীন রবীন্দ্রনাথকে আর টানবো না। সব সুন্দর সুন্দর কবিতা আর উপন্যাসের জন্মের ইতিহাসের সাথে বিষন্নতা ওতপ্রেতভাবে জড়িত। ডিম ফাটিয়ে যেমন মজাদার মামলেটা, ওমলেট, পুডিং তৈরী করা যায়, ঠিক তেমনি বিষন্নতাও আমাদের হূদয় ফাটিয়ে ভেতরকার অনুভূতিকে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। হেলাল হাফিজের কষ্ট সওদা করে বেড়ানো `ফেরিওয়ালা` কবিতাটা পড়লেই মনটা ভালো হয়ে যায়। অথবা বিষন্নতাকে কেন্দ্র করে সোলসের গেয়ে উঠা গান `কেন এই বিষন্নতা, কেন এই মৌনতা` শুনলে মনে হয় ভাগ্যিস বিষন্নতা ছিল নইলে এতো সুন্দর গান তৈরী হতো কি করে? আনন্দ তো এক সরল রৈখিক অনুভূতি। এর রং, রসের মধ্যে কি আদৌ তেমন বেচিত্র্য আছে?

তাছাড়া অর্থনীতিতে বিষন্নতার যতো প্রভাব আর অন্য কোন অনুভূতির এতো প্রভাব আছে বলে আমার জানা নেই। একে ঘিরে মনোবিজ্ঞানীরা রোগী পাচ্ছেন, ড্রাগ কোম্পানী ঔষুধ বানাচ্ছেন , বইয়ের পরে বই লেখা হচ্ছে, এমনকি এ্যাড কোম্পানীগুলোও পিছিয়ে নেই।

তবে আমাকে আপনারা ভুল বুঝবেন না। আমি কিন্তু কাউকে শখ করে বিষন্ন হতে বলছি না। কেউ যদি পরিস্থির কারণে কখনবা বিষন্ন হয়েই পরেন তবে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ না করে বিষন্নতার উপকারীতা নিয়ে ভাবতে পারেন। প্রথমেই বলে নিয়েছি বিষন্ন মানুষ সৃষ্টিশীল। আপনি আনন্দিত, সুখী মানুষ হয়েছেন তো বিপদ – একদম খাম্বার মতো নির্জীব হয়ে পরবেন। তাই যারা বিষন্নতার অপপ্রচার চালিয়ে আপনার শিরায় আনন্দের বিষ ঢেলে দেওয়ার প্রলোভন দেখায়, তাদের বলে উঠুন `একসকিউজ মি, আমি খাম্বা হতে চাই না।`

১,৮২৫ বার দেখা হয়েছে

২৬ টি মন্তব্য : “বিষন্নতা নিয়ে একটু রসকথা”

  1. রাশেদ (৯৯-০৫)

    বিষণ্নতা নিয়ে লেখাটা ভাল লেগেছে আপু 🙂
    তবে লেখাটা পড়ে মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে, আচ্ছা জেসিসির পোলাপাইন্দের মনে কি কোন বিষণ্ণতা নাই 😀 :duel:


    মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

    জবাব দিন
  2. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    আমার ক্যান জানি বিষন্নতা ভালো লাগে না।
    মাঝে মাঝে একটু বিষন্নতা জোর করে আসতে চায়, ঝটপট বিদায় করে দেই।

    আমি ফুর্তিতে থাকতে চাই। 😛


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  3. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    বিষণ্ণতা জিনিসটা আমার ভালোও লাগে না আবার খারাপও লাগে না।
    তবে এই লেখাটা বেশ ভাল্লাগছে।
    তবে আপু, সোলসের গানটা মনে হয় বিষণ্ণতা নিয়ে না নিঃসঙ্গতা নিয়ে.....

    জবাব দিন
  4. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

    বিষণ্ণতা থাকতে হবে এবং তা জয় করার প্রচেষ্টা করতে হবে তাহলেই প্রকৃত সুখী হওয়া যাবে... - একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত।

    লেখাটা বেশ ভাল লাগলো আপু... :hatsoff: :hatsoff:

    জবাব দিন
  5. মান্নান (১৯৯৩-১৯৯৯)

    একা একা ফ্রান্সে বসে আছি আর নিজের দেশের কথা ভাবছি। চারিদিকে এতসুন্দর দেশের কিছুই আমাকে স্পর্শ করছে না। এই বিষন্নতাকে কোনমতেই মেনে নিতে পারছি না 🙁

    জবাব দিন
  6. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    এই ব্লগের মানুষজ়ণ খুব পজ়েটিভ মানসিকতার এটা দেখে খুব ভালো লাগলো। আমি শুরুতেই বলেছিলাম যে লেখাটা অন্য একটা ব্লগের উদ্দেশ্য লেখা। সেখানে হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু সবাই খুব বিষন্ন। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নিজস্ব মতামত - কোথাও আন্দনের ছটা তেমন দেখতে পেলাম না।
    বুঝলাম না এইটা কি ক্যাডেট কলেজ ইফেক্ট কিনা?
    মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি বিষন্ন থাকলে কোন কিছু করতে পারি না।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  7. আশহাব (২০০২-০৮)

    সহমত আদনান ভাই 😀
    আমারও খাম্বা হইতে ভাল লাগে 😕
    তবে এখন থেকে বিষন্নতাকেও প্রাধান্য দেব 🙂


    "Never think that you’re not supposed to be there. Cause you wouldn’t be there if you wasn’t supposed to be there."
    - A Concerto Is a Conversation

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাশেদ (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।