অতীত বয়ান – কেউ যদি শুনতে চায় (শেষ হইয়াও হইলো না শেষ)

অতীত বয়ান – কেউ যদি শুনতে চায় (শেষ হইয়াও হইলো না শেষ)
-ওয়াহিদা নূর আফজা

বানরের থেকে আমার পার্থক্য খুব একটা বেশি না। বানরের কোমরে দড়ি বেধে ঘুংগুর বাজিয়ে কেউ তাকে নাচতে বললে সে যেমন নাচতে শুরু করবে ঠিক তেমনি আমাকেও কেউ যদি বাহবা দিয়ে সমুদ্রে ঝাপ দিতে বলে আমিও কিছু না বুঝে অতি উৎসাহে তাই করতে যাব। এই যেমন আবার স্মতিচারণ নিয়ে বসা। এই দুরহ কাজটা আমার জন্য না তারপরও সমুদ্রে ঝাপ দেওয়া।

আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় ক্যাডেট কলেজের কোন দুটো জিনিষ আমার সবচেয়ে ভালো লাগতো তবে আমি বেছে নিব তিনতলায় সদাচার হলের বারান্দায় দাড়িয়ে দেখা গোধূলীর আকাশ আর ডাইনিং হলের ডাল।
মাথার উপর থেকে শুরু করে আকাশটা দেখা যেত একেবারে দিগন্তরেখা পর্যন্ত। বেশি নাগরিক হবার চাপে ততদিনে ঢাকা শহরের আকাশ ছোট হয়ে গেছে। ভাগ্যিস সে সময়টা ক্যাডেট কলেজে ছিলাম। তাইতো কনে দেখা আলোতে নীল আকাশের বুকের মাঝে সূর্যের শেষ আলোকরশ্মি আর মেঘেরা মিলে যে অপরূপ শিল্পকর্ম গড়ে তুলতো তা দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হইনি। আর্ট ক্লাসে মাফরুহা ম্যাডাম শিখিয়েছিলেন লাল, নীল হলুদের শাখা প্রশাখার অসংখ্য নাম। ক্যাডমিয়াম স্কার্লেট, রোজ ম্যাডার, এ্যলিযারিন ক্রিমসন, কোবালট ভায়োলেট, ইয়েলো অর্চি, ভিরিদিয়ান আরো কত কি। শেষ বিকেলের শেষ আলোটুকু মরে গিয়ে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত এই সবকটা রং হাতে হাত ধরে আকাশজুড়ে তাদের নাচ দেখাতো। সেই সাথে ছিল সারা ক্যাম্পাসজুড়ে বেড়ে উঠা আম, জাম, নারকেল, ইউক্যালিপ্টাস গাছের পাতা থেকে ভেসে আসা ঝির ঝির গানের শব্দ।

এবার চলে আসি ডাইনিং হলের ডালের কথায়। লিয়াকত ভাই ছিল হেড বাবুর্চি। বিশাল বপু। প্রতিবছর আন্তঃহাউজ বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতার সময় যখন কর্মচারীদের ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগীতা যখন হতো, লিয়াকত ভাইকে শেষ পর্যন্ত দৌড়ুতে দেখা যেত। ছয় বছরে লিয়াকত ভাই খুব ভালো খাইয়েছিলেন। তার মধ্যে ডালটার কথা ভুলার নয়। এই ডালের স্মতিকে অম্লান করে রাখার জন্য এখন পর্যন্ত আমি ডালটা ভালো রাঁধতে শিখিনি। তবে ভালো কাচ্চি বিরিয়ানি রাঁধতে পারি। এই লেখাটা যারা পড়ছেন তাদের সবার জন্য আমার বাসায় কাচ্চি বিরিয়ানির দাওয়াত রইলো। এই বিরিয়ানি নিয়েও একটা মজার স্মৃতি আছে। ফিনল্যান্ড থেকে ভূগোলে পিএইচডি করে আফরোজা ম্যাডাম তখন সদ্য কলেজে যোগ দিয়েছেন। ওনাকে দেওয়া হলো ডাইনিং হলের দায়িত্ব। একেতো পিএইচডি তার উপর ডাইনিং হল – তাই দুষ্টু আপারা ওনাকে আড়ালে পিঁয়াজ-ডিম বলে ডাকতেন। সেবারে কলেজ পিকনিকে সকাল থেকেই একটা সাজ সাজ রব। পিকনিকের বিশেষ আকর্ষণ আফরোজা ম্যাডামের রেসিপিতে লিয়াকত ভাইয়ের তদারকীতে প্রস্তুত করা কাচ্চি বিরিয়ানি। কাচ্চি বিরিয়ানী শব্দটা তখন এখনকার মতো এতো ডালভাত ছিল না। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ক্যাডেট কলেজের ইতিহাসে যা আগে কখনও হয়নি তাই সেবার হলো। লাঞ্চের সময় একটা থেকে গড়িয়ে তিনটা ঠেকলো তারপরও সেই বিশেষ মেনুর দেখা নেই। এদিকে আমরা প্রায় অর্ধমৃত। অবশেষে বেহেশতের টিকিট হাতে পাবার মতো জুনিয়র ব্যাচ হবার সুবাদে সবার আগে লাইনে দাড়িয়ে কাচ্চি বিরিয়ানি নেওয়ার ঘোষনা শুনতে পেলাম। বন্ধুরা সব গোল হয়ে এক সাথে বসলাম। কিন্তু প্লেটে কাচ্চি বিরিয়ানির চেহারা দেখে সব থ। অর্ধেক সিদ্ধ চালের মধ্যে একটা অর্ধেক সিদ্ধ মাংসের টুকরা। পেটে যতই ক্ষিদে থাকুক, বন মানুষ তো আর না। এদিকে কোন উচ্চবাচ্য করতে পারছিলাম না পাছে কাচ্চি বিরিয়ানি কি সেটা না জানার অপরাধে নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ পেয়ে যায়। পরে দেখলাম সবারই একই অবস্থা। সেদিনের সেই অভুক্ত থাকার স্মৃতির তাড়নাতেই কিনা জানি না আমেরিকা এসে আমি প্রথম রান্না করি কাচ্চি বিরিয়ানি। আফরোজা ম্যাডাম প্রথমে কিছুটা দুর্বোধ্য থাকলেও পরে দেখলাম উনি ছিলেন ওনাদের সময়ে সবচেয়ে প্রগতিশীল শিক্ষক। মেয়েরা যাতে পরিবেশনার কাজটা শেখে তাই টেবিল লিডারের দায়িত্ব ছিল টেবিলের সবাইকে খাবার পরিবেশনা করা। রান্নার ক্লাস করতে হয়েছিল। পরে এর উপযোগীতা বুঝেছিলাম। আমরা মেয়েরা যারা দিয়াশলাইয়ের দুদিকটাই জ্বালবো বলে ঠিক করেছি, অর্থাৎ কেরিয়ারও করবো সংসারও করবো, তারা ছোটবেলা থেকে একটু বিশেষ ট্রেনিংএর মধ্যে দিয়ে গেলে পরে সব সামলাতে সুবিধা হয়।

সেসময়টাতে আমাদের মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বড় রোমাঞ্চকর কাজ ছিল লুকিয়ে টিভি দেখা। ক্লাস টুয়েলভে নাইট প্রেপে এ কাজটা করার জন্য তখনকার ডিউটি মাস্টারদের সাথে কিছুটা লুকোচুরি খেলতে হয়েছে। তবে বলতে হবে আমাদের ব্যাচের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী ছিল উর্মি। ও আর ইকো দুজনে মিলে ম্যাকগাইভার দেখার জন্য ইভিনিং প্রেপ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে হলে চলে আসতো। অনেকগুলো চোখ ফাঁকি দিয়ে কাজটা করাটা খুব দুঃসাধ্য ছিল। শেষে একবার ধরা পরে গেল। শাস্তি স্বরূপ ওদের হাসপাতালের আইসোলেশন কেবিনে আটকে রাখা হলো। আর ওদের চোখের সামনে দিয়ে আমরা ক্লাস পিকনিক করতে গৌরীপুর আসলাম। ভাওয়াল আর শালবন কাছে হওয়ায় প্রায় প্রতি বছরই এখানে আসতে হতো। সে বছর হুমায়ুন আহমেদ গৌরীপুর জংশন নামে একটা বই লিখে আমাদের পিকনিক ভেন্যুর স্থান বদলে দিলেন। উর্মিদের জন্য কষ্ট লাগলেও শালবনে আসতে হচ্ছে না বলে আমরা মনে মনে সবাই খুব রোমাঞ্চিত ছিলাম। আমার ধারণা এরপরে শালবনে গেলে বনের শাল, গজার গাছগুলোও আমাদের দেখে বিরক্ত হতো।
মহাকুমা শহর গৌরীপুরে এসে দেখা গেল ওখানকার কলেজের বিশাল মাঠে বসে থাকা ছাড়া আমাদের কিছু করার ছিল না। কি মনে করে শিক্ষকরা আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে দিলেন। অনেকেই দল বেঁধে রিকসা নিয়ে গৌরীপুর রেল স্টেশন দেখতে চললো। রূপসা, তুহীন আর আমি মিলে একটা রিক্সা ঠিক করলাম। প্রথমে আমরা শহরটা ঘুরে দেখতে চাইলাম। রিক্সাওয়ালাকে দেখে স্বজ্জন মানুষ মনে হল। জানাল মান্নান নামে এই এলাকার সবাই তাকে চিনে। ছোটবেলা থেকেই আমার এক অদ্ভুত স্বভাব রয়েছে। দেখা যাচ্ছে পরিচিত অনেকের সাথেই হয়তো তেমন কথা বলছি না কিন্তু অপরিচিত একটু নতুন ডাইমেনশনের কাউকে দেখলে তার সাথে অনেক গল্প জুরে দিই। মূলত তার জীবনকাহিনী শোনার চেষ্টা করি। সেদিনও আমি মান্নান রিক্সাওয়ালাকে অনেক প্রশ্ন করছিলাম। একটা বিয়ে বাড়ি দেখে আমরা সেখানে থেমে বর-বৌ দেখে আসতে চাইলাম। ক্যাডেট কলেজে পড়ি শুনে সে বাড়িতে আমাদের খুব সাদরে গ্রহন করে বৌ দেখাতে নিয়ে গেল। যখন বৌ দেখছিলাম তখন হঠাৎ করেই আমাদের ক্লাসের আরো দশ-বারজন মেয়ে এসে উপস্থিত হলো। এতে বাড়ির লোকজন একটু ঘাবড়ে গেল। সব শেয়ালের একই বোল হুক্কা হুয়া আর সব ক্যাডেটের একই ইচ্ছা। আমরা দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে আবার রিক্সায় উঠে বসলাম। এরপর মিষ্টির দোকান দেখে মিষ্টি খেতে চাইলাম। মান্নান বিলটা দিয়ে দিল। আমরা ঠিক করলাম পরে ভাড়ার সাথে যোগ করে দিব। কিন্তু ভাড়া দিতে গিয়ে দেখি কিছুতেই ভাড়া নিবে না। আমরা নাকি তার মেহমান। বিষয়টাতে আমাকে খুবই অপরাধবোধে ভুগাচ্ছিল। তাই সে যখন আমাদের বাসার ঠিকানা চাইলো আমি সোৎসাহে লিখে দিলাম। বাকী দুজন তেমন গা করলো না। সেবার ছুটিতে বাসায় এসে মান্নান রিক্সাওয়ালার একটা চিঠি পেলাম। আমাকে তার কত মনে পরে, ভুলতে পারছে না-এই রকম কথাবার্তা। সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম প্রেমপত্র – সেইসাথে শেষও।

কলেজে উঠার পর, ছুটিতে অনেক মেয়েই ব্যাচে স্যারদের কাছে পড়তে গেল। ক্যাডেট অতিথি পাখিদের নিয়ে ঢাকার নামকরা স্যারেরা আলাদা ব্যাচ করতেন। ফৌজদারহাট, কুমিল্লা ক্যাডেটের কিছু ছেলে আর আমাদের মেয়েদের মিলে একটা ক্যাডেট ব্যাচ ছিল। কোন এক ছুটিতে এর শুরু। এদের বেশ মজার মজার কাহিনী ঘটতো। ছুটির একেবারে শেষের দিকে এরা সবাই মিলে কোন এক চাইনীজ রেস্টুরেন্টে খেতে গেল। যতোই লেফট রাইট করুক আর খাকী ড্রেস পরুক, বয়স যে ষোল পার হলো এটা তো অস্বীকার করবার উপায় নেই। বনে তো কোকিল ডাকবেই। তাই বেরসিক কিউপিডও কিছু এলোমেলো তীর ছুড়ে দিল। একে ও পছন্দ করলো তো ও তাকে পছন্দ করলো। শুধু একজোরা চোখেরই যথার্থ মিলন হলো। এরপর ছুটির বাকী কটা দিন তারা দিনরাত ফোনালাপ করতে লাগলো। ধরা যাক ছেলেটার নাম মোছলেম আর মেয়েটার নাম দুর্গা। পাঠক এখানে নিশ্চয় সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পাচ্ছেন। হ্যা ঠিকই ধরেছেন। তা মেয়ের উচ্চপদস্থ পুলিশ বাবা এতো সহজে ছেড়ে দিবেন কেন? ছেলের পরিবারে হুমকি, সেই চাইনীজ রেস্টুরেন্ট রেইড সম্ভাব্য যা করার সবই করলেন। মেয়েও বাবার হৃৎপিন্ডের সুস্থতার কথা বিবেচনা করে ফিরে আসলো। কিন্তু আমি জানি অন্ততঃ ক্যাডেট কলেজ ছাড়ার শেষদিন পর্যন্ত সে এই ব্যথা বুকে নিয়ে ছিল। কারণ সবার জন্য আমার কিছু প্রশ্ন ছিল সেটা আলাদা আলাদা ভাবে উত্তর দিতে বলেছিলাম। তার মধ্যে একটা ছিল কোন জিনিষটা খুব বেশি করে চাই? দুর্গা এতে লিখেছিল, এ জীবনে যাকে পেলাম না পরবর্তী জীবনে তাকে চাই, চাই, চাই। পরে শুনেছি দুর্গা এক পুলিশের ঘরনী হয়েছিল।
ক্যাডেট কলেজে থাকা অবস্থায় না পরে বাইরে গিয়ে ক্যাডেট ব্যাচেরই আরেকজোড়া তৈরী হলো। ধরা যাক মেয়েটা জান্নাত আর ছেলেটা কুদ্দুস। এখানে দুজনেই ছিল সবদিক থেকে পারফেক্ট ম্যাচ। কোনদিকেই কারো কোন কমতি ছিল না। কিন্তু সিনেমার কাহিনীর মতো ছেলের মা বড় বাঁধা হয়ে দাড়াল। ছেলেও সুর সুর করে পিছুটান দিন। তখন ভগ্নহৃদয়া জান্নাতকে উদ্ধারের কাজে এগিয়ে এলো পূর্বের ভগ্নহৃদয় মোছলেম। এখন তারা আদর্শজুটি, অবশ্যই বিবাহিত। শুনেছি মুখমন্ডলে দুজনের কারোই নাকি চোখ ছাড়া কিছু দেখা যায় না। একজনের কারণ নেকাব আরেকজনের দাড়ির জংগল।

আমার এক কাজিন পড়তো রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে। ওদের ব্যাচে দেখেছি একজনের প্রতি আরেকজনের কি রকম টান। কাজিনের এক বন্ধু আমারও খুব ভাল বন্ধু ছিল। অনেক আগে আমার এক খালাতো বোনের বিয়েতে ওরা এসেছিল। তখন বোধহয় আমরা ক্লাস টেনে পড়ি। সেই বন্ধু খুব ভালো ছবি আঁকতো। সে খালাতো বোনের হাতে মেহেন্দি লাগিয়ে দিয়েছিল। তখন আমি কিছুটা দুষ্টুমী করেই বলেছিলাম, আমার বিয়ের সময়ও আমার হাতে মেহেন্দী লাগিয়ে দিস। আমি হয়তো ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই বন্ধু ভুলেনি। সেই ঘটনার দশ বছর পরে যখন আমার বিয়ে হলো, সে তখন বিমানবাহিনীতে কাজ করতো। সেখান থেকে ছুটি নিয়ে এসেছিল আমার বিয়েতে। হাতে মেহেন্দী লাগিয়ে দিয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে তাকে আমার ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। সেই ঘটনারও এগারো বছর পর আজ তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অল্পবয়সে আত্মকেন্দ্রিকতা বা বয়সজনিত অহংকারের কারণে অনেক কিছুই ফর গ্রান্টেড মনে হতো। বয়স বাড়ার সাথে সাথে যখন অনেক বিনীত হতে শিখলাম, নিজে মা হলাম তখন বুঝলাম পেছনে অনেক দেনা রয়ে গেছে। যতো পেছনে যাই বন্ধুত্বগুলোকে ততই নির্ভেজাল বলে মনে হয়। এখন তো শুধুই ব্যস্ততা, খালি ছুটে চলা। ভেবে নিয়েছি এই ছুটে চলার নামই জীবন। এ নিয়ে অবশ্য কোন অভিযোগ নেই। মনে করি হয়তো এর প্রয়োজন আছে। খলিল জীব্রালের একটা কথা পড়েছিলাম। তার ভাবটা হলো পৃথিবীতে তুচ্ছ বলে কোন কাজ নেই। একজন ঝাড়ুদার তার কাজটা প্রতিনিয়ত করছে বলেই এই পৃথিবীর একটা অংশ পরিষ্কার থাকছে।

পাঠককুলের ধৈর্য্যের কথা ভেবে আবারও লেখাটার গায়ে লাগাম পরাতে হচ্ছে। ভাবছি শেষ করবো কোন ঘটনা দিয়ে?

ইন্টারমেডিয়েটের পরীক্ষার সময় শুধু আমাদের ব্যাচ অনেকটা দিন ক্যাডেট কলেজে একাকী ছিলাম। বিশাল কলেজ প্রান্তরে শুধু আমরা। সে সময়টাতে কলেজকে আরো ভালবেসেছিলাম, সেই সাথে বন্ধুদেরও। অস্বীকার করবো না সেসময় কলেজ রাস্তায় একাকী এক ছেলেকে দেখে একটু আধটু আড্যাম টিজিংও করেছিলাম। একদিন হাউজ মাস্টারের রুমের লকার ঘাটতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম একটা পরচুলা। মনে পরে গেল ক্লাস সেভেনের একটা ঘটনা। আমাদের ক্লাসে মুনমুনের ছিল সবচেয়ে সুন্দর চুল। লম্বা, কালো, সিল্কি, সোজা। পরের সেমিস্টারে দেখি মুনমুন ওর সুন্দর চুল ছোট আর কার্লি করে এসেছে। ওর থেকে মনে হয় আমরাই বেশি দুঃখ পেয়েছিলাম। একমাস পরে ইভিনিং প্রেপে একদিন মুনমুন জ্ঞান হারালো। তৌহিদা ম্যাডামসহ আরো কয়েকজন মিলে ওকে বাথরুমে নিয়ে মাথায় পানি ঢালতে লাগলেন। ম্যাডাম ওর চুলে হাত বুলিয়ে হাতটা সরিয়ে নিয়েছেন, অবাক হয়ে দেখেন যে পুরো চুলটা ম্যাডামের হাতে ঝুলছে। আসলে গত এক মাস মুনমুন মাথায় উইগ পরে ছিল। সব চুল ফেলে দিয়েছিল। ছয়বছর ধরে মুনমুনের সেই উইগ এই লকারে পরে ছিল। জটা পাকিয়ে এক ভয়ংকর অবস্থা। আমি ঠিক করলাম আচ্ছা ভূত সেজে টিভি রুমে গিয়ে সবাইকে ভয় দেখালে কেমন হয়? রুমমেট ফরিদা আর সেতু মিলে ভূত সাজাল। সেটা দেখতে এমনই ভয়ংকর হয়েছিল যে শেষে ওরাই খুব ভয় পাচ্ছিল।
টিভি রুমে যাওয়ার সাথে সাথে সবাই খুব ভয় পেয়ে এমন এক চিৎকার দিল যে আমি তখন নিজেই ঘাবড়ে গেলাম। পরবি তো পর মালির ঘাড়ে। সবার মাঝে তখন এক ত্রাস ম্যাডাম বসে ছিলেন। উনি তো আমার পিছু ধাওয়া করলেন। আমিও দে ছুট। পুরো কলেজ ফাঁকা ছিল বলে সে যাত্রায় লুকোচুরি খেলায় জিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সবার থেকে বেশি ভয়টা শেষ পর্যন্ত আমিই পেয়েছিলাম।

সেই আনন্দ বেদনা, হই হুল্লা আর সুখ দুঃখের দিনগুলো আজ কোথায়?

(বিঃ দ্রঃ এখানকার অনেক ঘটনায় বন্ধু বান্ধবরা তাদের খুঁজে পেলে আশা করি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে। কত কি ই তো প্রতিনিয়ত ঘটছে, সব কি আর মনে দাগ কাটে? কিছু দাগ কাটা ঘটনার কথা উল্লেখ করলাম। একটা সময় আমরা কেউ থাকবো না। তারপরও কোন একদিন কেউ হয়তো প্রয়াস চালিয়েছিল সেই সব টুকরো কিছু ঘটনা ধরে রাখবার জন্য।)

৫,০৮১ বার দেখা হয়েছে

৭২ টি মন্তব্য : “অতীত বয়ান – কেউ যদি শুনতে চায় (শেষ হইয়াও হইলো না শেষ)”

  1. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    ছুটিতে যাচ্ছি। হয়ত আগামী কয়েক সপ্তাহ ব্লগে আসা হবে না। কিন্তু ছোটভাইবোনদের জন্য অনেক কস্টে সময় দের করে তাড়াহুড়া করে একটা কিছু লিখলাম। সবাই ভাল থেক।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  2. রকিব (০১-০৭)
    যতো পেছনে যাই বন্ধুত্বগুলোকে ততই নির্ভেজাল বলে মনে হয়। এখন তো শুধুই ব্যস্ততা, খালি ছুটে চলা। ভেবে নিয়েছি এই ছুটে চলার নামই জীবন।

    নিদারুন সত্য এক অনুভূতি।

    পুরা লেখাই সিরাম (সেইরকম) হয়েছে আপু। কিন্তু একটা বাক্যে আমার আপত্তি আছে। এইটায়ঃ
    পাঠককুলের ধৈর্য্যের কথা ভেবে আবারও লেখাটার গায়ে লাগাম পরাতে হচ্ছে।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  3. কামরুল হাসান (৯৪-০০)
    সেই আনন্দ বেদনা, হই হুল্লা আর সুখ দুঃখের দিনগুলো আজ কোথায়?

    🙁 :((


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  4. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    সেবার ছুটিতে বাসায় এসে মান্নান রিক্সাওয়ালার একটা চিঠি পেলাম। আমাকে তার কত মনে পরে, ভুলতে পারছে না-এই রকম কথাবার্তা। সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম প্রেমপত্র - সেইসাথে শেষও 😮 😮 😮 😮 😮 😮 😮 😮 😮 😮

    হায় রে বাঙ্গালি-চান্স মারতে তেলাপোকা হয়ে গেলি x-( x-(

    জবাব দিন
  5. আপু, চরম লাগলো...
    আপনার লেখার স্টাইলটাও খুব চমৎকার। দারুণ!!

    পাঠককুলের ধৈর্য্যের কথা ভেবে আবারও লেখাটার গায়ে লাগাম পরাতে হচ্ছে। ভাবছি শেষ করবো কোন ঘটনা দিয়ে?

    তীব্র প্রতিবাদ জানাই...

    কত কি ই তো প্রতিনিয়ত ঘটছে, সব কি আর মনে দাগ কাটে? কিছু দাগ কাটা ঘটনার কথা উল্লেখ করলাম। একটা সময় আমরা কেউ থাকবো না। তারপরও কোন একদিন কেউ হয়তো প্রয়াস চালিয়েছিল সেই সব টুকরো কিছু ঘটনা ধরে রাখবার জন্য।

    :dreamy: :dreamy: :dreamy:

    কেমুন য্যান লাগতাছে বুকের ভিত্তে :(( :(( :((

    জবাব দিন
  6. জিহাদ (৯৯-০৫)

    আমি বুঝলাম না, সবাই এখানে তাড়াহুড়া করে লেখা কিভাবে বুঝলো। 😕

    আমার কাছে এই পর্বটাই সবচে বেশি ভালো লেগেছে।

    আপনি যদি এরকম ঝরঝরে লেখা সারা জীবন চালিয়ে যান
    কথা দিচ্ছি, সারাজীবন আমি একজন গুণমুগ্ধ পাঠক হয়ে থাকবো।


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  7. শোয়েব (৯৪ - ০০)

    পাঠককুলের ধৈর্য্যের কথা ভেবে আবারও লেখাটার গায়ে লাগাম পরাতে হচ্ছে

    :thumbdown: :thumbdown:

    এইরকম আরেকটা লেখার জন্য বেশিদিন ধৈর্য্য ধরে রাখা কঠিন। ছুটি-ছাটার দোহাই দিয়ে ছোট ভাইদের বঞ্চিত করা চলবে না। নতুন লেখা চাই।

    জবাব দিন
  8. স্মৃতিচারণমূলক লেখা আমার সবসময়ই প্রিয়। সেই প্রিয় লেখাগুলোর মধ্যেও আপনার সাথে ঘুরে আসা সেইদিন গুলোতে।

    খুবই সুন্দর।
    কানে কানে বলে যাই, আপনার লেখার স্টাইল চমৎকার।
    এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলছি 😀 😀 😀

    জবাব দিন
  9. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    অনেকগুলো লাইন কোট করতে হবে বলে সে চেষ্টা বাদ দিলাম।
    শুধু বলি অদ্ভুত ভালোলাগায় মনটা ছেয়ে আছে।
    আপু, আপনার লেখা অসাধারণ সুন্দর - বিশেষ করে বিভিন্ন উপমা যেভাবে টেনেছেন 🙂 :boss: :boss: ।
    আমি আপনার লেখার ফ্যান হয়ে রইলাম :hatsoff: :hatsoff: ।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  10. আব্দুল্লাহ্‌ আল ইমরান (৯৩-৯৯)
    অবশেষে বেহেশতের টিকিট হাতে পাবার মতো জুনিয়র ব্যাচ হবার সুবাদে সবার আগে লাইনে দাড়িয়ে কাচ্চি বিরিয়ানি নেওয়ার ঘোষনা শুনতে পেলাম।

    জুনিয়র হওয়ার কুবাদে কখনো আগে পাওয়ার রেকর্ড কোথাও আছে কিনা জানিনা।
    চমৎকার লেখনি আপু :boss: :boss:

    জবাব দিন
  11. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    পর-আবাস নকশা কারক - সুন্দর বাংলা।
    আমি তো এক পায়ে খাড়া। এই ব্যাপারে আমার কোন লজ্জা নাই যদিও সারা জ়ীবন লাজুক মেয়ের তকমা ছিল কপালে।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আদনান (১৯৯৪-২০০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।