চুল বড় হতে হতে এখন নাক ছাড়িয়ে গেছে। নাপিতের কাছে যেতে ইচ্ছা করে না। এই অনিচ্ছার কারণ অবশ্য ক্যাডেট কলেজ, প্রতি দুই সপ্তাহে একবার করে নাপিতের কাঁচির নিচে মাথা পেতে দিতে হত কিনা। তখন থেকেই নাপিতের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে আমার একটা এলার্জি জন্মে গেছে যেটা এখনও যায়নি। চুল খুব ত্যক্ত-বিরক্ত না করলে নাপিতের কাছে যাওয়া হয় না। হিসাব করে দেখলাম বছরে নাপিতের কাছে যাই দুইবার। গিয়ে একেবারে কলেজীয় স্টাইলে কদম ছাঁট দিয়ে আসি। মাস দু’য়েক যায় তারপর, মাথার চুলে চিরুনীও চালানোর দরকার হয় না। এরপর চোখের উপর পড়ে, সহ্য করে যাই। কিন্তু যখন ঘুম ভাঙে কানে নিজের চুলের সুড়সুড়িতে, তখন আর সহ্য হয় না। নাপিতের কাছে যাওয়ার মতো অপছন্দের কাজটা আবারও করতে হয়।
চুল নিয়ে কলেজের স্মৃতির অভাব হবে না। আমাদের কলেজ নাপিত সুনীলদাকে দেখেছি ছয় বছর, উনিই চুল কাটতেন। সাথে করে নিয়ে আসতেন কয়েকজন শিক্ষানবিশ নাপিত। ক্যাডেটদের মাথা মনে হয় প্র্যাকটিস চালানোর ভালো জায়গা। সেই শিক্ষানবিশ নাপিতদের কবলে পড়ে কারও কারও মাথায় কালোর মাঝখানে একটুকরো চাঁদি দন্তবিকশিত হাসি দিত। কালেভদ্রে কারো কারো মাথায় সাদা তুলোর ঢেপাও দেখা যেত- শিক্ষানবিশ নাপিতদের সৌজন্যে। ক্যাডেটরা আবার জাতি হিসাবে একটু জাউরা প্রকৃতির- এই কথায় দ্বিমত করার লোক মনে হয় ক্যাডেট সমাজেও পাওয়া যাবে না। নিষিদ্ধ জিনিসপাতির উপর এই জাতির বিরাট আকর্ষণ। চুল কাটা যেহেতু একটা নিয়ম ছিল, এই নিয়ম থেকে বাং মারার কুবুদ্ধি সিনিয়ার-জুনিয়ার সবাই করত। সিনিয়াররা চেষ্টা করতো নাপিতদের ঝাড়ির উপর রেখে কিভাবে চুলটা একটু বড় রাখা যায়। জুনিয়াররা চেষ্টা করতো নাপিতদের হাতে পায়ে ধরে আয়না-চিরুনি ব্যবহার করার মতো সুযোগটুকু রাখতে। সময়ে সময়ে আবার এডু নোটিশ দিত – Defaulters will be dealt with severely. তখন সিনিয়ারদের ঝাড়ি অথবা জুনিয়ারদের কাকুতি-মিনতি কিছুতেই কোন ফায়দা হতো না। চুলের দৈর্ঘ্য এমন হয়ে যেত যে মুঠোয় তো নয়ই, আঙুলের চিপায়ও সাধের চুল আটকানো যেত না। সবার মাথাই বাদল দিনেরও প্রথমও কদম ফুল। এই অবস্থার মোকাবেলায় ক্যাডেট সমাজে কিছু মেকশিফট নাপিত জন্ম নিত। তারা সাধারণত জুলফি আর ঘাড়ের উপরের চুল ফেলে দিয়ে সামনে ও মাথার উপরের চুলগুলো রাখত, যাতে প্যারেডের সময় বেরেট ক্যাপ পরে থাকলে চুলের “প্রপার কাট” হয়েছে কিনা তা বোঝা না যায়। মাঝে মধ্যে কাজ হতো এই বুদ্ধিতে, মাঝে মাঝে না।
আমাদের ব্যাচে এই রকম একজন মেকশিফট নাপিত ছিল। ভাগ্যক্রমে আমাদের হাউসেরই। টুয়েলভে থাকাকালীন ক্যাডেটদের ডিসিপ্লিনের স্ট্যান্ডার্ড আপ করার ছুতোয় চুল কাটা নিয়ে অথরিটি আকাশ-বাতাস কাঁপানো হাউকাউ শুরু করেছিল। আমাদের হাউসে আবার নায়ক ভাবাপন্ন ক্যাডেট কম ছিল না। প্রয়োজনই আবিষ্কারের জননী, সুতরাং মাথায় একটু বড় চুল রাখার প্রয়োজনে একজন নাপিত জন্ম নিল। সেই নাপিত থাকত আবার পোর্চের সামনের রুমটাতে। একদিন শুক্রবারের অলস দুপুরে সে তার সরঞ্জাম নিয়ে পোর্চে চেয়ার পেতে বসল। সরঞ্জাম বলতে, ছোট একটা কাঁচি, স্টিলের একটা স্কেল (ঘাড় এবং জুলফির চুলে সরল রেখা দেয়ার জন্য), জিলেট শেভিং ফোম, ডেনিম আফটার শেভ। আর ছিল একটা সাদা টেবিল ক্লথ যেটা ক্লাস সেভেন এইটে থাকতে টেবিলের উপর বিছানো থাকত এবং তারপরে সিনিয়ারটির গরিমায় হাউস ইন্সপেকশান ছাড়া কখনোই লকার থেকে বের হতো না। মেকশিফট নাপিত হলেও কাস্টমারকে ছেঁটে ফেলা চুল থেকে তো বাঁচাতে হবে, তাই এই টেবিল ক্লথ। ঠিক মনে নেই, প্রথম মনে হয় প্রিন্স গিয়েছিল। আমাদের মেকশিফট নাপিত বেশ সময় নিয়ে তার চুল ছেঁটে দিল। ঘাড়ের পেছনের লাইন ঠিক করতে অবশ্য স্টিলের স্কেলটা দুয়েকবার ব্যবহার করতে হয়েছে। কিন্তু তাতে কি- জীবনের প্রথম কাজ হিসাবে কোনভাবেই খারাপ বলা যাবে না। পোলাপানের দ্বিধা ভেঙে গেল এরপর, সবাই চুল কাটাতে এসে ভিড় করল পোর্চে। নিজের এই রকম ডিমান্ড দেখে আমাদের নাপিত সাহেব তার ব্যবসা একটু বাড়ালেন। চুলের পাশাপাশি শেভও করে দেবেন, তবে এই সার্ভিস ফ্রি না। সার্ভিস চার্জ হিসাবে দিতে হবে ডাইনিং হলের কাবাবটা, বার্গারটা বা অন্য একটা কিছু। শেভিং ফোম এবং আফটার শেভ সাপ্লাই দেবেন তিনি; কাস্টমারকে শুধু রেজরটা নিয়ে আসতে হবে। পরের দিন প্রিন্সিপাল প্যারেড, সুতরাং পোলাপান লাইন দিয়ে তার সার্ভিস নেওয়া শুরু করল। রমরমা ব্যবসা যাকে বলে আরকি। পরের দিন প্যারেডে যতোদূর মনে পড়ে কেউ ধরা খায়নি। সুতরাং সে প্রফেশনাল নাপিতদের মতোই কাজ করেছিল এই রায় দিয়ে দেওয়া যায়। ছোটবেলায় বোনদের সাথে যেমন রান্নাবাটি খেলেছি, ১৫-১৬ বছর বয়েসী ছেলেগুলো তেমন সেলুন সেলুন খেলায় মেতে উঠেছিল সেইদিন। আমি অবশ্য সেই দলে ছিলাম না।
মানুষ হিসাবে আমার কিছু ক্ষুদ্রতা আছে, কেউ আমার উপর অন্যায় করেছে এটা মনে হলে আমি কোনভাবেই মন থেকে সরাতে পারি না। এ কারণে কলেজে থাকতে অনেকের সাথে বিভিন্ন মেয়াদে কথা বন্ধ ছিল। পরে ক্লাসমেটদের ঔদার্য্যে সেই বরফগুলো গলে যেত ঠিকই, কিন্তু আমি নিজে আগ বাড়িয়ে কখনোই বরফ গলাতে যেতাম না। আমাদের মেকশিফট নাপিত সাহেবের সাথেও কোন এক কারণে কথা বন্ধ ছিল। পোর্চের সেই সেলুনের সার্ভিস তাই নেয়া হয়নি, কোনদিন নেয়াও হবে না। কারণ নাপিতটা ছিল আলম, যে ২০০৭ সালের ২৪শে মে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। মানুষ মরে গেলে সব কিছু পালটে যায়। আমাকে যদি কেউ একটা টাইম মেশিন দিত, তাহলে ৭ বছর আগের সেই সোহরাওয়ার্দী হাউসের পোর্চে চলে যেতাম। স্পেশাল ডিনারের কাবাবটা দিয়ে ওর সেলুনের সার্ভিস নিতাম। আর বলতাম- কথা বন্ধ রেখে লাভ কি বল, জীবনটা তো অনেক ছোট, তাই না?
দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গেল, সময় খুব দ্রুত যায়। আমার বন্ধুটার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে সবাই দোয়া করবেন ওর জন্য।
পড়তে পড়তে আস্তে আস্তে ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠছিল মনে পড়ছিল কলেজের অনেক কথা কিন্তু শেষে এসে এইভাবে চুপ করাই দিলি। খুব মনে পড়েরে। কেন এইরকম হয়?
আল্লাহ ওকে অনেক অনেক শান্তিতে রাখুক।
খুব খারাপ। মন খারাপ করা পোস্ট।
ভাই
পইড়া যেই মনে খুশি খুশি ভাবটা এসেছিলো... অমনি তা শেষ হয়ে গেলো একরাশ দুঃখভরা অনুভূতির কাছে,
আলম ভাইয়ের জন্য মনটা কেমন করে উঠল।
আমার এইরকম কোন বন্ধুর সাথে এইরকম হইলে হয়ত প্রতিনিয়তই চোখ ভিজে উঠত-- কেন তার সাথে কথা বলতাম না এই চিন্তায়...
আল্লাহ তার আত্নার মাগফিরাত দান করুন।
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো
আলম ভাইয়ের জন্য দোয়া রইল, আল্লাহ উনাকে জান্নাতবাসী করুন।
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
অসাধারন লাগলো তৌফিক .........
লাইনগুলো ভালো লাগলো খুব।
আল্লাহ আলমকে ভালো রাখুন।
এন এস ইউ তে আমাকে দেখলেই আলম ভাই বিশাল যে একটা হাসি দিতেন তা ভুলতে পারবনা কখনো।আইসিসি এথলেটিক্স মীটে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তিনি,বিশালদেহী এই মানুষটার হৃদয়টাও দেহের মতই বিশাল ছিল।আমার এখনো বিশ্বাস হতে কষ্ট হয় যে আলম ভাই নেই আমাদের মাঝে।
আলম ভাই,আপনি যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন।
তৌফিক ভাই,অদ্ভুত সুন্দর লেখা।
মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আলমের আত্মা শান্তি পাক।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মাসরুর ভাই,আলম ভাই'র কারনেই ক্লাস ৯ এ ফুটবল কম্পিটিসনে অংশ নিয়েছিলাম।খুব ইন্সপায়ার করতে পারতেন...
পত্রিকায় খবরটা পড়ে বিশ্বাস করতে পারিনাই!
হৃদয় ছুয়ে গেল......................
তার আত্মা শান্তিতে থাকুক......
আজ সকাল থেকেই মনটা খুব খারাপ ছিল। তাই ব্লগ পড়া হয়নি। তোর লেখাটা পড়তে শুরু করে মনটা কেমন যেন ভালো হয়ে গেল.........
শেষ প্যার্যাটা পড়তে অনেক সময় লাগল। কেন এমন হয় ??
আল্লাহ উনাকে শান্তিতে রাখুন
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
🙁
এক কথায় অসাধারণ,
আল্লাহ উনাকে শান্তিতে রাখুন 🙁
"Never think that you’re not supposed to be there. Cause you wouldn’t be there if you wasn’t supposed to be there."
- A Concerto Is a Conversation
মাসরুফ ভাইয়ের লেখা কোট করি
আল্লাহ আলম ভাইকে শান্তিতে রাখুন............
আল্লাহ আলমকে শান্তিতে রাখুক ...
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
শান্তিতে থাকুক আলম, এই দোয়া করি।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
বছর দুইটা চলে গেল । মনটা খারাপ সকাল থেকেই । একটা পোস্ট লিখছিলাম । কী বলব ? জানি না কী বলতে হয় ।
মনে হচ্ছে একটা গল্প পড়ছি, শেষ ভাগে দুঃখ দিয়ে গল্পের সমাপ্তি।
ইস!!! সত্যিই যদি এটা গল্প হতো......???
আমরা আপনাদেরকে পেয়েছিলাম ২ সপতাহের মতো ।এর মাঝেও আলম ভাই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন । মনে পরে ফুটবল মাঠে তার এক অসাধারণ হেডের কথা । আললাহ্ তার রুহের মাগফিরাত দিন ।
ধন্যবাদ তৌফিক ভাই এই জটিল লেখার জন্য ।
🙁